আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নাহার মনিকা' র গল্প - হলুদ আক্রান্ত



গল্প হবো হবো সন্ধ্যায় বাতি টাতি জ্বলতে শুরু করলে, বাড়ি যাওয়ার আগে রীনা শাড়ি কিনতে যায়। রাপা প্লাজা অথবা আড়ং এর নীচের কোন দোকানে এসির মধ্যে, টুলে বসে দুই তিন রকম লাল টাঙ্গাইল জরীপাড় শাড়ীর সামনে কোনটা নিবে যখন ঠিক করতে পারছিল না, দোকানের আয়নায় হঠাৎ চোখ গেলে সে দেখে তার চুলগুলি আধাকাঁচা, আধাপাকা আর সে যার পর নাই চমকে ওঠে। তার কি চুল পাকার বয়স? এমন সময় তার মোবাইল বেজে উঠলে তার ক্ষণকালের মনোসংযোগ মাথার চুল থেকে হাতব্যাগের সাইড পকেটে ঘোরাঘুরি করে। আম্মার ফোন। আম্মা তাকে এইকথা, সেইকথা, পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলেও রেওয়াজমত বাড়ি ফিরতে কেন গড়িমসি, কবে আসতাছোস ইত্যাদি শেষে আম্মা তাকে আসল খবরটা দেয় যে, তার সবকিছু প্রায় ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়ের পাত্রপক্ষ পিছিয়ে গেছে, তখন তার মনে হয় যে দোকানটাতে এসির মৃদু গুঞ্জন না হয়ে বাজারের হট্টগোল হলে ভালো হতো, তারপর অবশ্য- এই দোকানের সেলসম্যানরা তাদের অনুচ্চ কন্ঠের ফোনালাপ শুনে তাকে চিনে রাখলেই বা কি, এদের সঙ্গে তো তার সম্বন্ধ হইতে যাইতেছে না- এই রকমের ভাবনা তাকে স্বস্তি দিলে সে এসির আরাম ছেড়ে বাইরে গিয়ে কথপোকথনের চিন্তা বাদ দিয়ে এক কোনায় দাঁড়ায়।

সংবাদটা রীনাকে কড়া কিসিমের শরীর অবশ করা হতাশা বোধ দিলে সে তার আম্মার ওপর খুব বিরক্ত হয়, এই খবরটা ফোনে না দিলে কি চলতো না? মেয়ের বিয়ের দুশ্চিন্তা তাকে এমন বেদিশা করে ফেলেছে যে কোন হুশটুশ নাই। তারপরও সে কৌতূহল নিবৃত্ত করতে ফোন কানে চেপে প্রশ্ন কওে, “ক্যান পিছায়া গ্যালো, কারণ কয় নাই কিছু?” কারণ শুনে তার খুশি হওয়ার কিছু থাকে না। বাড়ী যাওয়ার তাড়াটাও গরমের সন্ধ্যার মত দম ধরে থাকে। দোকানের আয়নাতে আবারো চোখ ফিরায় রীনা, নাহ চেহারা পোশাক সব ঠিকই আছে! আর মাথার চুলও কালো- কিন্তু ভুল দেখার অস্বস্তিটা কেমন কুট কুট করতে থাকে। পরীক্ষা শেষ হলে শরীর আর মাথার গ্রন্থি শিথিল হবে, নিজেকে অরুণ বরুণ কিরণ মালার নায়িকা মনে হলেও হতে পারে বলে মোটামুটি ধরে নিয়েছিল।

সিনেমাটা রীনা দেখে নাই, নানীর আমলের জিনিষ। রীনাকে একটু ফুর্তিতে আছে দেখলেই- “কি কিরণ মালা হইতে চাও”?- বলে নানী যে রূপকথার সুতা হাতে নিতো তাতে রীনার আগ্রহ থাকতো কি? কিরণমালার কথা মনে উঠলে সে জানে যে সেই রাজকন্যার চাকরী খোঁজার ঝামেলা ছিল না কিন্ত মা বাপকে খোঁজার মিশন অবশ্য ছিল, তবে বয়স তার কোনকালেই ষোল অতিক্রম করে নাই। রাজকন্যাদের তা হয় না। এইসব ভাবতে গিয়ে রীনা দেখে তার নিজের বয়সতো বাইশ তেইশ না, প্রায় তিরিশ পার হয়ে গেছে! তিরিশ পার হওয়া নিয়ে তার মাথাব্যথা অত নাই, সেইটাতো কত জনের হয়। সে নিশ্চিত তার বান্ধবী আর ক্লাশমেটদের মধ্যে অনেকের হইছে।

মেয়েদের বয়স লুকানো কি আজকের থেকে শুরু হওয়া ব্যাপার? ভালোমত ভেবে রেজিয়া পারভীন রীনার মনে হয়, এই কথাগুলা কি সবাইকে খুইলা বলার যে সে যখন ক্লাশ ফাইভে পড়ে তখন একবার ফেল করেছিলো আর ঊনিশ শো আটাশির ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে তার পড়ালেখা বন্ধ ছিলো বছর চারেক এবং তারো পরে থার্ড ডিভিশনে বি এ পাশ করলেও এম এ প্রিলিমিনারি দর্শন বিভাগে ভর্তি হতেও তার দুই তিন বছর লেগে যায়। ক্লাশ ফাইভে, রীনার মনে হয় তার নিজের কোন হাত ছিল না। অবশ্য শুধু ক্লাশ ফাইভ কেন, অন্যান্য সময়ে ও নিজেকে এত দোষী ভাবার কি আছে- এমন কথাবার্তায় তার আম্মা অবশ্য বলে-“ বুজলাম ক্লাস ফাইভে বড় আছিলি না, পরের গ্যাপগুলির সময় খামোখা অবুজ না হইলেও পারতি”। ক্লাশ ফাইভে রীনা কিন্তু অবুঝ ছিল না, কেন না সে তখন তাদের হাই স্কুল সংলগ্ন প্রাইমারী সেকশনের টিনের চালাঘরে ওয়ান, টু, থ্রি আর ফোর পাশ করে ফাইভে উঠে গেছে আর ক্লাশ টিচার হিসেবে পেয়েছে তাদের মোলবী স্যার, যাকে অত্র এলাকার বাসিন্দারা আড়ালে নোয়াখাইল্যা হুজুর বলেও সম্বোধন করে থাকে। মসজিদের ইমাম বছরে একবার দেশের বাড়ি গেলে আজান দেয়া আর নামাজ পড়ানোর কাজটা তার জন্য বরাদ্দ হয়।

এই মাসাধিক কাল মোলবী স্যারের মন মেজাজ ফুর্তিতে থাকে, হেডমাষ্টার বা অন্য কেউ তার কাছে সময়ের ফিরিস্তি চায় না। মোলবী স্যার নতুন ক্লাশের শুরুর দিন সবার নাম, বাপের নাম ধাম, কয় ভাইবোন ইত্যাদি প্রসঙ্গে রীনাকে শনাক্ত করে ফেলে যে সে এই মথুরাপুর স্কুলে ভর্তির আগেও একবার স্কুলে এসেছিলো, তার বড়বোনের সঙ্গে- যখন সে প্রায় গেদা বাচ্চাই ছিলো বলা যায়। এমন না যে - আমি স্কুলে যামু বলে কান্দাকাটি জুড়ে দিয়ে সে স্কুলে এসেছিলো, রীনার আম্মাই সম্ভবত, কোলের বাচ্চার ডায়রিয়ার সময় অথবা নিজের প্রবল কোন পেট ব্যথার সময় কিংবা রীনার অযথা দৌরাত্ম্য এড়াতে তাকে বড়বোনের সঙ্গে, যে নাকি সবে টু নয় তো থ্রিতে উঠেছে, তাকে কোন রকম সাজিয়ে গুজিয়ে, কপালের কোনায়, নাহয় মাঝখানে কাজলের টিপ দিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এই ঘটনার কথা রীনার আবছা মনে ছিল, বাসায় দুই একবার গল্প হয়ে টয়ে থাকতে পারে। কিন্ত মোলবী স্যার নোয়াখালীর আঞ্চলিক কথার টানে যখন সারা ক্লাশকে জানান যে রীনা সেই মেয়ে যে কিনা তার বড়বোনের সঙ্গে স্কুলে এসে পেশাব করে পায়জামা ভিজিয়ে দিয়েছিল, নীল ছিট কাপড়ের রং হয় তো পাকা ছিল না, পেশাব গড়িয়ে যখন বেঞ্চের তলা দিয়ে সামনে আসছিলো তখন মোলবী স্যার মুহূর্তের জন্য সে জলীয় ধারাকে একটি নীল সাপ ভেবে ভয় পেয়েছিলেন।

প্রাইমারী সেকশনের টিনের চালাঘরের সামনে পিছে জানলাগুলায় পাল্লা না থাকায় কিছু দুরন্ত বালকের বিস্তারিত যে সুবিধা ছিল তা হলো, টিকাদান কর্মসূচী উপলক্ষে যখন এই ক্লাশগুলি ব্যবহার হয়, তখন টিকার ব্যথাজনিত আতংক বা তৎপরবর্তী জ্বরের আশংকায় বেশ কিছু ছেলেকে এইসব জানলা দিয়া ব্যাঙের মত লাফ দিয়ে বের হয়ে যেতে তো রীনা ক্লাশ ওয়ানে থাকতেই দেখেছে। তো রীনার তখন সেই রকম একটা ইচ্ছা হয়। মোলবী স্যারের হাটে হাড়ি ভাঙ্গা কথা শুনে, দরজা- জানালা আর টিনের বেড়ার ফুটাফাটা দিয়া সরসর করা বাতাস আর সব ছেলেমেয়েদের হা হা হিহি শুনতে শুনতে সদ্য সেলোয়ার পরতে শুরু করা রীনার আর বুঝতে বাকি থাকে না যে এই নোয়াখাইল্যা হুজুর তার বারোটা বাজায়া দিছে। ঘটনাটা, যা থেকে রীনা তার নীল ছিট কাপড়ের পায়জামাটা স্মৃতিতে উজ্জ্বল দেখতে পায়, তারপর গল্প হয়ে গজিয়ে ডালপালা ছড়ায়। ক্লাসে, খেলার মাঠে ছেলেরা, ঝগড়াঝাটি লাগলে মেয়েরা, “তুই তো স্কুলে আইসা সাপ বিয়াইছিলি”- শুনতে শুনতে রীনার কান্দা আসে।

বিয়ানোর মত একটি প্রাপ্তবয়স্ক বিষয় সে তার বোঝার অতিন্দ্রীয় মেয়েলী ক্ষমতা দিয়ে বুঝতে বুঝতে অতঃপর ঘাড় গুজে বসে থাকলে আম্মা গালে ঠোনা মেরে মেরে বকুনি দিলেও তার মাথা থেকে সবার ইয়ার্কিগুলি দূর হয় না। কোন কোন সময় তার নিজের ও মনে হয় নীল পেশাবের ধারাটা বুঝি সত্যি একটা সাপই ছিল। পরিণতিতে তাকে মথুরাপুর হাই স্কুলের পাকা ভবনটির ক্লাশ ফাইভের আশা ছাড়তে হয়। ..............ক্রমশ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.