আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নাহার মনিকা'র গল্প হলুদ আক্রান্ত



২য় কিস্তি ফেল করা মার্কশীট অংক বইয়ের মধ্যে ভরে, শীতের দুপুরে স্কুলের মাঠ পার হয়ে লেবার কলোনী আর সুগার মিলের অফিসার্স কোয়ার্টার্সের সামনে বয়ে যাওয়া ছোট্ট নদীর সঙ্গে জোড়া দেওয়া হাতে কাটা খাল যা কিনা চিনিকলের জলীয় বর্জ্য নিষ্কাশনের উদ্দেশ্যে বানানো, ফলে তার পানির রং লালচে, দুর্গন্ধযুক্ত আর সবসময়ই কুসুমের চেয়ে গরম, - রীনা সেখানে স্কুল ড্রেস উঁচু করে হাটু পানিতে দাঁড়িয়ে, আম্মা রেজাল্ট দেখলে কি রকম মাইর দিবে- এই চিন্তার পাশাপাশি উষ্ণ পানির পরশ নিতে থাকে। একটু পরে অবশ্য তার ভাবনা নদীর ওপারে খাল কাটার মাটি দিয়ে বানানো প্রায় টিলাটার দিকে তাকিয়ে উধাও হয়ে যায়, কারণ সেখানে পিকনিক পার্টির হৈচৈ, নদীর পানি উপচিয়ে ধোয়ায় ভাসা পোলাওয়ের সুঘ্রাণ আর পরিষ্কার দেখা যায় ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজা চলতি হিন্দি গানের সঙ্গে চাম্পা, তারু বা মর্জিনা এরা বা এদের মত কেউ কোমর দুলিয়ে নাচছে। শির শির শীতবোধ নিয়ে রীনা তখন গরম পানি থেকে পা উঠিয়ে মাটির কাঁচা রাস্তায় দৌড় শুরু করে। পাশে আখ ক্ষেতের আইল ধরে সে যখন তাদের গলির মধ্যে ঢোকে তখন ছুটুর বাড়ি আর খোকার বাড়ির কেউ না কেউ কোন না কোন কারণে অথবা কারণ ছাড়াই তুমুল ঝগড়া শুরু করেছে। এই দুই বাড়ির কারণে- পাড়ার মুরুব্বীরা বলাবলি করে – পাড়াটার ইজ্জত থাকে না।

এই দুই বাড়ির মালিক দুই ভাই এলাকায় থাকেও না, থাকে তাদের পীর হুজুরে মুরিদানদের জন্য যে ইসলাম নগর বানায়া দিছে সেইখানে। আর নিজেদের এই বাড়িতে অনেকগুলি ছোট ছোট ছাপড়া উঠায়া, কোনটায় টিনের চাল- বাঁশের বেড়া, কোনটায় ছনের চাল-চাটাই দিয়া ঘেরা দিয়া, পানির টিউব অয়েল আর পায়খানা ছাড়াই- পান বিড়ি অলা, গুড়ের ব্যাপারী বা ধুনকর – এই জাতীয় লোকজনকে ভাড়া দিয়া, ভাড়াটিয়ার সুবিধা অসুবিধা বিবেচনা না করেই মাস গেলে ঘরপ্রতি দুই আড়াইশ টাকা নিয়া নিজেদের শিমুল তুলার তোষকের তলে টাকার পাহাড় বানায়া ফেলতাছে। রীনাদের বাড়িতে নাইলে পাশের বাড়ির সালামতের বাড়িতে এদের বৌ ঝিরা ঠিল্লায় করে পানি নিতে আসে। চাপকলের পানি নেওয়ার সময় রীনার আম্মা কিংবা সালামতের বৌ কপাল কুচকে থাকে। ছোট মেয়ে টেয়ে হলে ধমকে কলসী সমেত ফেরত পাঠিয়ে দেয় আর নিজের ছেলেমেয়েদেরকে সাবধান করে, “খবরদার এইগুলি আইলে গেট খুলবি না, সব চোর ছ্যাচ্চর – সেইদিন উঠানের তারে মেলা আমার গোলাপী বেলাউসটা নাই হইয়া গেল”।

মেয়েটিকে তখন মোয়াজ্জেমের তুত বাগান ছাড়িয়ে রাইস মিলের চাতালের কোনায় টিউব অয়েল থেকে পানি আনতে যেতে হয়। এমনও অবশ্য হয়, যেদিন রীনার আম্মার পেটব্যথাটা বেশী কিংবা ছুটা কামের বেটি আসতে পারে না, আর তখন যদি ছুটু – খোকার বাড়ি থেকে কেউ, কোন মাতারী বা মেয়ে কাঁখে মাটির কলসী আর হাতে ছোট বালতি নিয়ে রীনাদের টিনের গেটে ঠুন ঠুন আওয়াজ করে-“ একটু খাওনের পানি নিতাম”। রীনার আম্মা তখন তাদের ভাইবোনদের একজনকে অথবা নিজেই তল পেট চেপে, ব্যথাক্লান্ত লাল চোখে এলোমেলো শাড়ী গোছাতে গোছাতে গিয়ে গেট খুলে দেয়। মেয়েটি ঘরে ঢুকলে ক্লান্ত গলায় নির্দেশ করে- “পাকের ঘরে রুটি আর আলুভাজি আছে- আয় খাইয়া যা, আর আমার থাল বাটি কয়ডা ধুইয়া তারপর পানি নিছ”। “খাড়ান তাইলে মায়েরে এট্টু কইয়া আহি” র পর চাম্পা বা তারু নির্গত হয়ে পূনরায় প্রবেশ করে।

তারপর উঠান পার হয়ে স্যানিটারী ল্যাট্রিনের কাছাকাছি চারদিক পাকা করা চৌকোনা কল পাড়ের টিউব অয়েল ইচ্ছামত চেপে মনের আনন্দে ছাই দিয়ে ঘষে ঘষে পাতিলের তলা ঝকমকা করে, আর শেষ হলে দুই পা হাঁটু পর্যন্ত ধুয়ে নিজের কলসী ভরে ফেরার প্রস্তুতি নিলে রীনার আম্মা বা সালামতের বৌ হয়তো বলে, “ এখনি যাবি ক্যান, বয়, মশলাডা একটু বাইটা দে। তারু বা চাম্পা অথবা মর্জিনা বিরক্ত হলেও খাওয়ার পানি পাওয়ার এই মধুর সম্পর্কটিকে অন্যখাতে বইতে দিতে চায় না। সে তার ঠিল্লা পাকা বারান্দার একপাশে নামায়া, তার দিকে বাড়িয়ে দেয়া গোটা হলুদ, লাল শুকনা মরিচ, গোল গোল গোটা ধনিয়া আর ধুসর জিরাগুলোকে তাকিয়ে দেখে- রান্না ঘরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা শিল পাটা একটু শব্দ করেই নামায়। সালামতের বৌ হয়তো তখনো সতর্ক করে- অই ছেমড়ি ভাইঙ্গা ফালাইছ না আমার পাটাপুতা, সেই ফরিদপুর থন আনছি”। নাক বোচাঁ কালো শুটকা মেয়েটি তখন কেঁপে উঠে সন্তর্পণ হয় আর গভীর মনযোগের সঙ্গে হাতের কব্জিতে শক্তি জমিয়ে শাদা মশলাদানিটিকে বর্ণিল করে তোলে।

বাটা মশলার ঝাঁঝালো ঘ্রাণের মধ্যে তারু তার বোচা নাকের ফুটোয় আসন্ন দুপুরের রিঠা মাছ ভুনার গন্ধটা কল্পনায় দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখতে রাখতে সালামতের বৌয়ের স্বগত সংলাপ শোনে-“ মাছগুলিতে কেমুন কুইয়া কুইয়া গন্ধ। কতদিন কইছি বাসি মাছ আনবা না, বিক্রমপুর থাকতে এমুন মাছ আমরা জীবনেও খাই নাই, অখন এই মাছের গন্ধ কেমনে ছাড়াই?- অই ছেমড়ি, মশলাবাটা হইলে যাতো বইন- ম্যানেজারের উঠানথন কয়ডা লেবুপাতা আইনা দে, তরে মাছ ভুনা দিমুনে এক টুকরা”। আট, দশ কিংবা তের বছরের কিশোরীটি তখন মোলায়েম কন্ঠস্বরেও খুশী হয়ে ওঠে না, শরীর মোচড়ায়। ধূসর কালো সূতির ওড়নাটা ডান বগলের নীচ দিয়ে টেনে বাঁ কাঁধের ওপর উঠিয়ে রাইস মিলের চাতালের কোনায় পাকা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা নারকেল গাছে ছায়া সুনিবিড় ম্যানেজারের বাড়ির উঠানে গিয়ে দাঁড়ায়। ম্যানেজারের বৌ, বিয়ের পর পাবনা শহর থেকে এখানে আসার কতদিন হয়ে গেল, দশ পনর বছরতো হইবই, এতদিনেও একটা মন লাগানো কামের ছেড়ি তার কপালে জুটলো না, ঘন ঘন পলায়, যার ফলে নিজেকেই ছেলেমেয়েদের সাফসুতরো করার পরে ঘর দুয়ার, পায়খানা-কল পাড় ধুয়ে ফকফকা করার পর খাটা ঝাড়ু আর বালতি ভর্তি ফিনাইল মিশানো পানি দিয়ে বাড়ির পিছন পর্যন্ত পরিস্কার করতে হয়।

চাম্পা বা তারু যখন লেবুপাতার সন্ধানে ঢোকে, ম্যানেজারের চার ছেলেমেয়ে তখন গোসল করে গায়ে সরষের তেল মেখে ঘরের খাটালের নীচে রাখা বড় বড় তক্তায় বসে কচ্ছপের মত রোদ পোহায়, কেন না তাদের মা ঘর মুছছে এবং তা না শুকানো পর্যন্ত কারো ঘরে ঢোকা নিষেধ। কামের মাতারি না থাকায় এমনিতেই তাদের মায়ের মাথার ঠিক নাই, তার ওপর এই খোকা বা ছুটুর বাড়ি টাইপ মেয়েগুলির একটাকে দেখে তার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। “এই এইখানে কি চাস”- এর পাশাপাশি হাতের কাছে চিকন তক্তা খুঁজে পেয়ে ধুপধাপ পিটিয়ে যখন চাম্পার হাতের বাজু দিয়ে রক্ত বের হয় তখনি কেবল তার শোনার ফুরসত হয় যে মেয়েটা আসলে সালামতের বৌয়ের জন্য লেবুপাতা চাইতে এসেছে। কিন্তু লেবু পাতা কি সস্তা যে চাইলেই পাবি? “আইচ্ছা যা, নিবি, কিন্তু তার আগে উঠানের পিছনডা ভালো কইরা ঝাড়ু দিয়া, পানি দিয়া ধুইয়া দিয়া যা”। এই ঘটনার সাক্ষী রীনা তখন তার বড়বোনের সঙ্গে, অথবা বলা যায়, বড়বোন তাকে সঙ্গে নিয়ে ম্যানেজারের মেয়ে রেবেকার কাছে পরামর্শের জন্য আসে যে কি উপায়ে রীনা ইয়ার লস না দিয়ে অন্য কোন স্কুলে গিয়ে ক্লাশ ফাইভে ভর্তি হতে পারে? তার আগে অবশ্য ভুমিকাতে- কি ভাবে মোলবী স্যার ইচ্ছা কইরা রীনারে ফেল করায়া দিছে- সেই নাতিদীর্ঘ বিবরণের সময় জানায় যে তার বোনটি গেল বছর জ্বরজারীতে ভুগেছে- এবং আর মথুরাপুর হাইস্কুলে যেতে ইচ্ছুক নয়।

রেবেকার আব্বা যেহেতু স্থানীয় দুই একটা স্কুল কমিটির সদস্য, তার পক্ষেই হয় তো এই জটিল সমস্যাটির সমাধান সম্ভব। বারান্দার চৌকিতে বাড়া ভাতের গামলা বাঁশের সরা দিয়ে ঢেকে রাখা শেষ হলে রেবেকার মায়ের একটু ম্যানেজার সুলভ বক্তব্য দেওয়ার ইচ্ছা হয়- যে এটা একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে যদি রীনা অন্য স্কুলে ক্লাশ সিক্সে ভর্তি হয়। কেন না সেতো আর ছেলে না, তার বিয়াশাদী হওয়ার ব্যাপার আছে, ম্যাট্রিকে উঠতে না উঠতে যদি বুড়ির মতন দেখতে হইয়া যায়, তাইলে তো বিপদের কথা, কারণ তার বাচ্চা কাচ্চা হওয়ারও ব্যাপার আছে- বলার দরকার নাই কিন্তু কথা তো সত্যি যে বংশ বৃদ্ধির মহান কাজটা নারী জাতিকেই করতে হয়- ইত্যাদি ইত্যাদি। ....... ক্রমশ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.