আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পৃথিবীর নিকৃষ্টতম গল্প



রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান হয়েও যদি নিজের জীবনের প্রয়োজনে মায়ের কিছু আদেশ নির্দেশ কখনো আগ্রাহ্য করতে পারতাম অথবা শ্রাবন্তী আত্মহত্যা না করে আরো কিছুদিন ধৈর্য ধরতো তাহলে একটি পৃথিবীর নিকৃষ্টতম গল্প না হয়ে উৎকৃষ্টতম গল্প হতে পারতো। কিন্তু বাঙালি রক্ষণশীল পরিবারের সন্তানরা উচ্চশিক্ষা লাভ করে যতই সংস্কারমুক্ত বা প্রগতিশীল হোক চিরন্তন স্নেহের পরশে বড় হওয়ার ঋণ শোধ করতে মাতৃভক্তির প্রতি গুরুতর আসক্ত বিধায় নিজের জীবনের প্রতি তারা অন্যায় করে বসে। ফলাফল যা হবার তা-ই হয়। আমি বলতে চাইনে, মাতৃভক্তি খারাপ কোন গুণ বরং ভালোই। যা বলতে চাই তা হলো অতি মাতৃস্নেহ যেমন সন্তানের জন্য অকল্যাণকর অতি মাতৃভক্তিও তাই।

মূলত অভিধানের ‘অতি’ শব্দটির মানেই কল্যাণের বিপরীত। শৈশবকাল থেকেই মায়ের কঠোর আদেশ নির্দেশ পালন করে ধীরে ধীরে বড় হওয়ার সন্তান বিয়ের পরে হঠাৎ মায়ের আদেশ আগ্রাহ্য করতে গেলে মায়ের মাথায় বজ্রপাত ঠেকবেÑএ অস্বাভাবিক কিছু নয়, তাই মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা অক্ষুণœ রাখে বাঙালি সন্তানরা বিয়ের পরেও মায়ের কড়া আদেশ মেনে চলবে এ খারাপ কিছু নয়। মায়ের ঋণ কিছুতেই শোধ করতে পারে না সন্তান, তাই সারাজীবন মায়ের প্রতি অনুগত থাকায়ই শ্রেয়। তবে আমার রাগ অন্যস্থানে, যেমন এনজিও সমাজে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে যেসব সুশীল সমাজের প্রতিনিধি নারীর অধিকার নিয়ে লম্বা বক্তৃতা বিবৃতি দেয় তাদের ওপর। তারা সভা সেমিনারে কথায় কথায় নারী নির্যাতনের জন্য কেবল পুরুষদের দায়ী করে, পুরুষশাসিত সমাজকে দায়ী করে।

এখানে বলে রাখি, এও সুশীল সমাজের এক প্রকার পেটের ধান্দা, কোনকিছু খতিয়ে না দেখে চুম্বকের বিপরীত মেরুকে বিকর্ষণের জন্য দায়ী করে। অর্থাৎ নারী নির্যাতনের সমস্ত দায় বিপরীত লিঙ্গ বা পুরুষদের ঘাড়ে চাপিয়ে এনজিওগুলোর কাছে থেকে মোটা অংকের সম্মানী নেওয়া। তারা খতিয়ে দেখে না, সমাজে নারী নির্যাতনের জন্য কেবল পুরুষরা দায়ী নয়, নারীরাও সমানভাবে দায়ী। কেবল পুরুষশাসিত সমাজ নারীর নির্যাতনের জন্য দায়ী একথা জোরালোভাবে সুশীল সমাজের যে প্রতিনিধি সভা সেমিনারে বলে যান, তাকে যদি প্রশ্ন করা হয় পুরুষশাসিত সমাজের অবসান হলেই কি নারী নির্যাতন বন্ধ হবে ? নিরপেক্ষ বিবেচনায় তারা উত্তর দিতে পারেন না। বর্তমান সমাজের নারীনেত্রীদের সস্তা ও গতানুগতিক বক্তৃতা বিবৃতি আমাকে ক্ষুব্ধ করে, তারা কেবল পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন চায়।

যেন, কেবল পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলেই নারীদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হবে। কিন্তু তার মূল হেতুটি গভীরভাবে ভেবে দেখে না। তারা জানেই না খোদ নারীরাই নারীদের ওপর পুরুষের চেয়ে অধিক নির্যাতন চালায়। এক নারী সম্পর্কে অন্য একজন নারীর দৃষ্টিভঙ্গি কতটা খারাপ তা তারা কখনো পরখ করে না কেবল মুখস্থভাবে নারী নীতি বা আইন চায়। তাদেরকেই বলি, সমাজের প্রজন্মের পরিবর্তন বা দৃষ্টিভঙ্গি উদার ব্যতিরেকে কেবল আইন করে এ পর্যন্ত পৃথিবীর কোন বিষয়ে সফলতা আসেনি, আসবেও না।

যে পুরুষটি একজন মহিলাকে বিয়ে করে তার সমস্ত দায়ভার কাঁধে নিয়ে সংসার করছে, একসাথে বসবাস করতে গিয়ে তাদের মধ্যে কখনো কোন বিষয় নিয়ে সামান্য দ্বিমত হলে তা নিয়ে বাকবিতন্ডা বা স্ত্রীকে চড় থাপ্পড় মারলে সেটাকে আমরা নারী নির্যাতন বলছি। কিন্তু বউ-শাশুড়ি বা ভাবী-ননদের মধ্যে প্রতিদিন যে ঝগড়া-ঝাটি হয়, শাশুড়ি বউয়ের চুলের ঝুটি ধরে মারধর করে, মায়ের পক্ষে এসে ছোট মেয়েটি বা বউয়ের লক্ষ্মী ননদটি যখন ভাবীকে আঘাত করে, বাড়ি থেকে বের করে দেয়, চৌদ্দ গোষ্ঠীর জাত মারেÑতাকে নারী নির্যাতন বলব না কেন ? বউ-শাশুড়ি বা ভাবী-ননদের বৈরীতে সংসার পর্যন্ত ভাঙছে, এ রকম বহু প্রমাণ মিলে। তবুও কি বলব, নারী নির্যাতনের জন্য কেবল পুরুষরাই দায়ী। যাক সে কথা, নারী নির্যাতনের কারণ নিয়ে গবেষণা করতে বসি নাই। অথবা এ সংক্রান্ত বিতর্কে অংশ নিয়ে নিজের স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করছি না।

জেলখানায় বসে বসে শ্রাবন্তীর আত্মহত্যার কারণ খুঁজছি আর কী কারণে কোন দোষে আমার ৭ বছর কারাদণ্ড হল তা হিসাব-নিকাষ কষছিলাম। চূড়ান্ত ফলাফল পাওয়ার আগে এ বিষয়টি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। পেশাগত কারণে কত আত্মহত্যার সংবাদ লিখেছি, ফলোআপ করেছি, সাইকোলজিক্যাল স্পেশালিস্টের মন্তব্য নিয়ে রিভিউ করেছি। কখনো ভাবিনি সেই আমাকে নিজের ‘জীবনের’ আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। মানুষ নিজের ওপর বিশ্বাস হারালে কিংবা বেঁচে থাকার সমস্ত আশা ধুলিস্যাৎ হলে, জীবনের চারিদিকে নিরাশা বাসা বাঁধলে আর কোন পথ না দেখলেই মহাপাপের এ পথ বেছে নেয়।

শ্রাবন্তীর বেঁচে থাকার সমস্ত পথ যে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তা তার আত্মহত্যার অনেক আগেই টের পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার করার কিছুই ছিল না। আমি এতটা অসহায় জেনে ও চরম সিদ্ধান্তটি নিল এই ভেবে যে, যাকে নিয়ে ঘর সংসার করছি তারই কিছুই করার নেই সুতরাং এভাবে কি বেঁচে থাকা যায় ? মায়ের নির্দেশ আগ্রাহ্য করতে না পারা আর সামান্যতমও ভালোবাসা শ্রাবন্তীকে দিতে না পারাটাই আমার বড় ব্যর্থতা। তাই ওর আত্মহত্যার সমস্ত দায় আমার। আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও এই দায় স্বীকার করে বলেছি, শ্রাবন্তীর মৃত্যুর জন্য আমার ব্যর্থতাই দায়ী, আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমাকে করতে দিন।

দোষ কাঁধে নিয়ে জেলে বাস করছি। এবার আসল কথা বলা শুরু করি। আমরা দু জন দুই ধর্মের অনুসারী। শ্রাবন্তী বসাক গোড়া হিন্দু পরিবারের মেয়ে, আমি পাকা মুসলিম ঘরের সন্তান। পৃথক ধর্মীয় পরিচয়ের পরও প্রেমের বন্ধনে এক হয়েছিল দুটি হৃদয়ের কিছু আকাক্সক্ষা।

সবেমাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পা রাখা কিশোরী শ্রাবন্তীর মায়াবী নয়নে আমার নয়ন দুটো আটকে গিয়েছিল। নারীর স্বাভাবিক সৌন্দর্য একজন পুরুষকে মোহমুগ্ধ করে ঠিকই কিন্তু শ্রাবন্তীর সেদিনের রূপ-যৌবনের সমস্ত শিল্পকলা আমার ভেতরে যে ঢেউ তুলেছিল তা প্রচণ্ড আবেগে হৃদয়ের কূল খুঁজে বেড়াচ্ছিল। হৃদয় নিঃসৃত স্বপ্নের ঢেউগুলো অবশেষে একদিন কূল খুঁজে পেল, শ্রাবন্তীকে ঘিরে শুরু হলো আমার পৃথিবীর আবর্তন প্রক্রিয়া। যাহোক, আবর্তনের বয়স যতই বাড়ছিল শ্রাবন্তীর হৃদয়ের শঙ্কা ততই ঘনীভূত হতে থাকলো এই ভেবে, এই সমাজ কিংবা পরিবার আমাদের সম্পর্ককে কখনোই স্বীকৃতি দেবে না, গোপনের হৃদয় দেয়া-নেয়া হয়তো চলছে, বাস্তব পরিণতি কি হবে এখনো অজানা। কিন্তু যে হৃদয় পৃথিবীর সবকিছু বাদ দিয়ে কেবল প্রিয় একজন মানুষের মধ্যে সুখ খুঁজে পায় খী হবে তাকে ছাড়া জীবন বেঁধে ?আমার মধ্যেও শঙ্কার কমতি নেই।

একে তো বাঙালি পুরুষের প্রথম প্রেম ব্যর্থ হয় তাও আবার যাকে ভালোবেসেছি সে হিন্দু পরিবারের মেয়ে। মুসলমানের ছেলে আর অন্য জাতের মেয়ের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কে হলে সাধারণত আমাদের সমাজে মেয়েটি তার জাত ধর্ম বিসর্জন দিয়ে প্রথমে প্রেমিকের ধর্মটাই কবুল করেন, তারপর কবুল করেন প্রেমিককে। প্রেমের টানে জাত বিসর্জন দিয়ে মেয়েটি অন্য জাতের একজনকে কবুল করে আপন করে নেয় বটে কিন্তু শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে কবুল করে কদাচিৎ। সেই প্রসঙ্গ পরে বলব, বর্তমান জটিলতা হল শ্রাবন্তীর সাফ কথা, জাত ধর্ম বিসর্জন দেবে না। আমার বাবা পাকা মুসলমান, কখনো একবেলা আহার বাদ পড়বে তবুও এক ওয়াক্ত নামাজ বাদ পড়ে না।

রাতে আল্লাহ আল্লাহ জিকির করতে করতে ঘুমান। সেই বাবার সন্তান আমি যদি একটা গোড়া হিন্দু মেয়েকে বউ করে ঘরে তুলি, সমাজের কথা দূরে থাক আমার পরিবারের কী প্রতিক্রিয়া হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু সৎ পরিবারের সন্তান পরিচয়ে যার সমস্ত ভালোবাসা লুপে নিয়েছি, স্বপ্ন দেখিয়েছি, সংসার গড়ার কথা দিয়েছি তাকে কোন সততার জোরে ত্যাগ করা যায় ? আমার ধর্মেই তো আছে ‘মন ভাঙ্গা আর মসজিদ ভাঙ্গা সমান অপরাধ’ খবর নিয়ে দেখলাম, বিজাতীয় পুরুষের সাথে প্রেমের সম্পর্ক বা বিয়ে কিছুতেই মানতে নারাজ শ্রাবন্তীর বাবা-মা। তারা শ্রাবন্তীকে বুঝাতে শুরু করেছে একটা বয়সে প্রেম-ভালোবাসা সকলেই করে, এটা অপরাধের কিছু নয় কিন্তু সাথে প্রেমের সম্পর্ক তাকে বিয়ে করতেই হবে এমন কোন কথা নেই। তাছাড়া জাত-ধর্ম বিসর্জন দিয়ে কিসের প্রেম ? তারা এও বুঝাল যে, প্রেমের বিয়ের দাম্পত্য জীবন অসুখী হয়।

যে সত্যের শপথ নিয়ে শ্রাবন্তীকে ভালোবেসেছিলাম, যে বন্ধনের জন্য হৃদয়ের তরী ভিড়িয়েছিলাম ভাবলাম তা ব্যর্থ হবে। কিন্তু বাবা-মায়ের সাইকোলজিকল্যাল ট্রিটমেন্টের আজব সূত্রের মোহজালেও শ্রাবন্তী একটুও বদলায় নি। যে সত্য রক্ষায় শ্রাবন্তীর দৃঢ়তা পাথরের মতো সেই সত্যকে শ্রদ্ধা জানিয়েই তাকে নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালাম। একদিনের মধ্যেই এ খবর সারা গ্রামে চাউর হয়েগেল, অমুকের ছেলে একটা হিন্দু মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে !সাথে সাথে গ্রামের মুরব্বী শ্রেণী বাবাকে জড়িয়ে কতিপয় মন্তব্য করল, ‘বাপ কত ভালো মানুষ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী অথচ ছেলেটা কিনা এমন কাজ করল ? ছি! ছি ! এজন্যই বলে আলেমের পেটে জালিম!’ পনের দিনের মাথায় যে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। গোপনে বাবাকে খবর দিলেন।

বাবা এসে শ্রাবন্তীকে দেখে জিজ্ঞ্যেস করল, ধর্ম কবুল করেছ ? শ্রাবন্তী বলল ‘না’। ‘চলো বাড়িতে যাই কালেমা পড়ে মুসলমান হও। ’ তাতে শ্রাবন্তী রাজি হল না। তবুও বাবা আমাদের বাড়ি নিয়ে আসলেন। গ্রামে পৌঁছে দেখলাম, পাড়াসুদ্ধ লোকজন আমাদের দেখতে ভিড় করেছে, যেন আমরা চিড়িয়াখানার অদ্ভূত কোন জন্তু।

কেউ কেউ এমন ভাবে তাকাচ্ছে যেন, আমাকে এ গ্রামে কেউ কখনো দেখেছি অথবা বিশ বছর পর দেখছে। কারো কারো ভাবখানা এমন যে, ‘হিন্দু মেয়ে বিয়ে করেছিস, নরক কিনে নিয়েছিস, তোর জন্য ঘৃণা। ’ শ্রাবন্তীকে দেখেই মা রেগে গেলেন। বলতে শুরু করলেন, পোড়ামুখী, নষ্ট মেয়ে কোথাকার ‘হিন্দুয়ানী’ আমার কম বয়েসী ছেলের মাথা খেয়েছিস! বিয়ে পরানে চাইলে আমাকে বলিসনি ক্যান, একটা নয় দশ বেটা দিতাম! আমার ছেলেটা নষ্ট করলি.. ইত্যাদি ইত্যাদি। ছোটবোন তাসলিমা এসে মায়ের সাথে যোগ দিল।

শ্রাবন্তীকে উদ্দেশ্যকরে বলতে লাগল, ‘হিন্দুনি’ প্রেমের খায়েশ মিটিয়ে দেব তোকে। ওর মুখে কোন ভাষা নেই। নীরবে মাকে কদমবুছি করল। আত্মীয় স্বজন যারা নতুন বউ দেখতে এল সবার মুখে ‘তোমাদের হিন্দু বউ দেখতে এলাম’ জাতীয় ভাষা। মা কথায় কথায় শ্রাবন্তীকে বিভিন্নভাবে শাসাতে থাকলেন।

উঠতে বসতে নানারকম খোঁচা মারতে লাগলেন। আমি নামাজে দাঁড়ালে বাবা ফতোয়া জারি করলেন, ‘আর নামাজ পড়ার দরকার নেই, বিজাতীয় মেয়ের সাথে ঘর সংসার করে নামাজ পড়লে আল্লাহর দরবারে তা কবুল হবে না। ’ বাবা শ্রাবন্তীর রান্না খান না পাছে জাত নষ্ট হবে ভেবে। মা আর ছোট বোন তাসলিমা প্রতি কথায় কাজে শ্রাবন্তীকে হেনস্থ করেই চললে মাঝে মাঝে ও আমাকে নালিশ করত কিন্তু মা ও বোনকে এ ব্যাপারে কিছুই আমি বলতে পারতাম না এই ভেবে যে, মা মনে করতে পারেন বউয়ের কথায় ভুলে মাকে শাসন করছি! শ্রাবন্তীকে বলতাম ‘ধৈর্য ধরো’। এভাবে বউ শাশুড়ির সম্পর্কটা একেবারে ‘দা-কুমড়ো'তে পরিণত হলো।

মা আর তাসলিমা মিলে শ্রাবন্তীকে শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত ও প্রহার করতে শুরু করে। মাঝে মাঝে কোন মিথ্যা অজুহাতে শ্রাবন্তীকে দোষী সাব্যস্ত করে শাসাতে গেলে ও মায়েূর সাথে তর্কে লিপ্ত হতো। ও মাকে বুঝাত ঘটিত ব্যাপারে ও কিছুই জানে নাÑএ আত্মপক্ষ সমর্থন মায়ের চোখে তাহার বউয়ের মহাঅপরাধ। মা আমাকে নালিশ করে বলতো, হয় তোমার হিন্দু বউকে ত্যাগ কর, নয় আমাদের ত্যাগ কর। আমি অনেকবার তদন্ত করে দেখেছি এ ঘটনায় শ্রাবন্তীর মোটেও দোষ ছিল না।

তবুও মাকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি পাছে অবাধ্য সন্তান ভাববে বলেই। সেদিন অফিস থেকে ফিরে রুমে প্রবেশ করতেই দেখলাম, শ্রাবন্তী বালিশের ওপর মুখ চেপে নীরবে অশ্র“ বিসর্জন দিচ্ছে। আমি হাতে তার মুখখানি উপুড় করতেই বুকের মধ্যে ধক্ করে একটা ধাক্কা খেলাম, মনে হলো কলজের কিছু অংশ ছিঁড়ে পড়ে গেল! একজন নারীর কান্না দেখে পৃথিবীর আর কোন পুরুষ এমন দুর্বল হয়ে যায় বা অস্থির হয়ে পড়ে কি-না জানিনা তবে আমার ভেতরে যা অনুভব করলাম তা অতি ভয়ংকর কিছু। কী হয়েছে ? জিজ্ঞ্যেস করলাম। বলল, ‘মা ও তাসলিম প্রহার করেছে-কষ্টটা প্রহারের ব্যথার যতটুকু তারচেয়ে বেশি প্রহারের কারণ বা নিজের দোষ খুঁজে না পাওয়ার।

দেখ, তোমাকে ভালোবেসেছিলাম বলেই সবকিছু নীরবে সয়ে যাচ্ছি। তুমি এই ঘরের ছেলে, তুমি পুরুষ ! তোমার দিকে চেয়ে আমার সবকিছু বিসর্জন দিয়েছি, আমার কোন মূল্য তোমাকে দিতে হবে না অন্তত আমার ভালোবাসাকে সম্মান দিয়ে এ নরক থেকে উদ্ধার করোÑএ যন্ত্রণা অসহ্য, আর পারছিনা! আমি একই প্রবোধের পুনরাবৃত্তি করে বললাম, ‘ধৈর্য ধরো’। আমি বেরিয়ে যাওয়ার পর কী ঘটেছিল জানিনা, শুনেছি আমাকে নালিশ করার ব্যাপারে মা শ্রাবন্তীকে অনেক শাসিয়েছেন। তবুও আমার করার কিছুই ছিল না, একেতো রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে তার ওপর বিজাতীয় মেয়ে বিয়ে করা নিয়ে মায়ের সামনে পড়তে আমার মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করত। এরপর আরো কিছুদিন গেল।

শ্রাবন্তী সম্ভবত বুঝে নিয়েছে, আমাকে নালিশ করলেও ‘ধৈর্য ধরো’ বলা ছাড়া আমার করার কিছুই নেই। তাই এখন আর কোন নালিশ করে না। চুপচাপ যা বলি তাই করে, বুঝতে পারতাম একটা নীরব অভিমান জমাট বেঁধেছে কিন্তু তা যে একেবারে এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটতে তা কি কখনো কল্পনাও করেছি ? কোথা হতে এক বোতল কীটনাশক সংগ্রহ করেছিল জানি না। সেদিন সম্ভবত কৃষ্ণপক্ষের মহালয়া, ঘোর অন্ধকার রজনী। যে নরক থেকে আমি তাকে উদ্ধার করতে পারিনি সেখান থেকে নিজেই মুক্তির আশায় যেন কীটনাশক পান করল।

হাসপাতালে নেয়ার পথে যতক্ষণ চোখ দুটো খোলা ছিল ততক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়েছি। যেন বলছে, ‘তুমি একজন কাপুরুষ, বিশ্বাসঘাতক! ধিক তোমাদের, ধিক পৃথিবীকে! শ্মশান থেকেই পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করল। কারাদণ্ডের মেয়াদ হয়তো একদিন শেষ হয়ে যাবে,আমি আবারো পৃথিবীর মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেব, সকাল হবে, রাত আসবে। কিন্তু আমার প্রথম জীবনের ঘটে যাওয়া ‘পৃথিবীর নিকৃষ্টতম গল্পের’ ইতিহাস কি কখনো হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যাবে ?

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.