আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমেরিকানদের পশুপ্রেম ও তৃতীয় বিশ্বের মানুষের ভাগ্য



আমেরিকানদের পশুপ্রেম ও তৃতীয় বিশ্বের মানুষের ভাগ্য ফকির ইলিয়াস ========================================= নিউইয়র্কের পাতাল রেল দিয়ে চলাচলের সময় ট্রেনের কামরায় একটি উদার আহ্বান প্রায়ই চোখে পড়ে। নিউইয়র্ক মহানগরীর মেয়র মাইক ব্লুমবার্গ নাগরিকদের প্রতি একটি অনুরোধ করছেন। তিনি বলছেন, যাদের গৃহপালিত কুকুর আছে, তারা যেন কুকুরগুলো সিটির সুনির্দিষ্ট দফতর থেকে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেন। এ জন্য একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের ফি-ও পরিশোধ করতে হয়। দিনে দিনে কুকুরের রেজিস্ট্রেশন বিষয়টির গুরুত্ব বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রে।

যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ধনিকেরই পালিত কুকুরের উচ্চ অঙ্কের ইন্স্যুরেন্স করা থাকে। কয়েক বছর আগের ঘটনা। নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলেন এক ধনকুরের। সঙ্গে ছিল তার প্রিয় কুকুর। কুকুরটি মানসিকভাবে ছিল অসুস্থ।

ফলে কুকুরটি কামড়ে দিয়েছিল একজন পথচারীকে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে গিয়েছিল ওই পথচারীর। তিনি শিগগিরই ফোন করেছিলেন পুলিশে। পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতালÑ সব কটি পর্ব সেরে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন ওই পথচারী। ক্ষতি পূরণের মামলা করেছিলেন ওই ধনকুবেরের বিরুদ্ধে।

আদালতের রায়ে দেড় মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন তিনি। না, দেড় মিলিয়ন ডলার ওই ধনকুবেরের নিজ পকেট থেকে পরিশোধ করেননি। পরিশোধ করেছিল কুকুরের ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। তারপরও ধনকুবের কুকুরটি নিয়ে ছিলেন মহাআনন্দিত। সংবাদটি ওই সময়ে নিউইয়র্কে সাড়া জাগিয়েছিল।

মার্কিনীরা কুকুরপ্রিয় জাতি হিসেবে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেছে বিশ্বব্যাপী। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নগরীতে কুকুর-বিড়ালের অভিজাত দোকানগুলো দেখলে চমকে উঠতে হয়। কুকুর-বিড়ালের খাবারের দোকান, পরিচর্যা কেন্দ্র, হাসপাতাল অত্যন্ত ব্যস্ততার সঙ্গে চলে যুক্তরাষ্ট্রে। অনেকের কাছে কুকুর-বিড়াল তাদের সন্তানতুল্য। অনেক মার্কিনী প্রকৃত পিতৃত্ব কিংবা মাতৃত্বের স্বাদ নিতে ভয় পান।

ধনাঢ্য ব্যক্তিরা দত্তক হিসেবে সন্তান গ্রহণ করে সে ইচ্ছা পূরণ করে থাকেন। আর যারা তাও পারেন না, তারা প্রিয় কুকুর-বিড়ালটিকে বুকে আঁকড়ে ধরে কাটিয়ে দেন জীবনের বাকিটা সময়। অতিসম্প্রতি আবারো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের কুকুর-বিড়াল। জাতিসংঘের একটি সমীক্ষা জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকানরা কুকুর-বিড়াল পোষার খাতে যে অর্থ ব্যয় করে তার অর্ধেক দিয়ে বিশ্বের ছয় বিলিয়ন মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জল এবং স্যানিটেশনের সুব্যবস্থা করা সম্ভব। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ পরিচালিত এই জরিপে আরো দেখা গেছে, ইউরোপিয়ানরা প্রতিবছর মদ্যপান বাবদ যে অর্থ ব্যয় করে এর দশ ভাগের এক ভাগ দিয়ে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব।

অথবা ইউরোপিয়ানরা এক বছর আইসক্রিম খাওয়া থেকে বিরত থাকলে ওই অর্থ বিশুদ্ধ পানীয়জলের সংকট মোকাবিলায় যথেষ্ট হতে পারে। জাতিসংঘের ভাষ্য অনুযায়ী, বিশুদ্ধ পানীয়জলের অভাবে প্রতিবছর বাইশ লাখ মানুষ ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায়। জাতিসংঘ আরো জানিয়েছে, এশিয়া মহাদেশের ১.৭৭ বিলিয়ন লোক বিশুদ্ধ পানীয়জলের সরবরাহ কোনো কালেই পায়নি। বিশ্বে এই মহাদেশের অবস্থা ভয়াবহ। এখানকার পঁয়ত্রিশ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে দূষিত পানি ব্যবহার করে চলেছে।

মানবাধিকার এবং গণহিতৈষীপূর্ণ যত বড় বড় বুলি আওড়ানোই হোক না কেন, বিশ্বের নিতান্ত গরিব মানুষগুলোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কতটা উদার? একুশ শতকে এসেও এর সঠিক জবাব খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনো। যায়নি কারণ যুক্তরাষ্ট্র কিছু কিছু ব্যাপারে এখনো তাদের অবস্থান স্পষ্ট করছে না। একথা আমরা সবাই কমবেশি জানি খাদ্যে অতিরিক্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ যুক্তরাষ্ট্র তাদের উদ্বৃত্ত খাদ্য বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দেয় না। অর্থনৈতিক বাজার সমতার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সব সময়ই বিবেচ্য হিসেবে ছিল এবং আছে। এর কোনো পরিবর্তন হয়নি।

উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য জাহাজ বোঝাই করে সমুদ্রে গিয়ে ফেলা দেয়া কিংবা ফলন্ত শস্যের মাঠের মালিক কৃষককে তার ফসলের মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করে ফসল মাঠেই জ্বালিয়ে ফেলার মাঝে কি কৃতিত্ব থাকতে পারে? না কোনো কৃতিত্ব নেই। আছে বিশ্বে ধনী এবং দরিদ্রের বৈষম্যকে জিইয়ে রাখার অদম্য স্পৃহা। আছে অর্থনৈতিক বাজারদর চাঙ্গা রাখার নামে একটি শ্রেণীকে নিষ্পেষণ করা। একজন মানুষের কতটুকু স্বাধীনতা থাকলে তাকে ব্যক্তি স্বাধীনতার সংজ্ঞায় ফেলা যাবে তা দিয়ে বিতর্ক চলছে বিশ্বের অনেক দেশে। অতিসম্প্রতি এক মা তার এক সপ্তাহের জীবন্ত সন্তানকে আবর্জনার ব্যাগে পুরে ফেলে দিয়েছে রাস্তায়।

নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের ঘটনা। পুলিশ নবজাতককে উদ্ধার করে ওই মাকে গ্রেফতার করেছে। মা পুলিশের কাছে বলেছে, ওই সন্তানটিকে পালনের সঙ্গতি ও সামর্থ্য তার ছিল না। আইনানুযায়ী ওই মায়ের সাজা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় সংস্থা, অনাথ আশ্রম, হাসপাতালগুলো বলছে যুক্তরাষ্ট্রে ভূমিষ্ট হওয়া কোনো সন্তানকেই রাস্তায় ফেলে দিতে পারবে না তার মা-বাবা।

প্রয়োজনে সরকারের হাতে তুলে দিতে পারে। সরকার ওই নবজাতকের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবে। কারণ কারো ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে- সদ্য জন্ম নেয়া একজন নাগরিকের ওপর এমন আচরণ কাম্য হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ মনোবিজ্ঞানীদের মতে, অতিরিক্ত স্বাধীনতা একজন মানুষকে বেপরোয়া করে তুলতে পারে এবং তা সমাজের জন্যও হতে পারে শঙ্কার কারণ। সেজন্য পরিমিত এবং পরিশীলিত আচার-আচরণের জন্য এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষভাবে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হয়েছে।

অপচয়কেও এক ধরনের স্বাধীনতা, প্রাচুর্যের বড়াই বলে গণ্য করা হয় আমেরিকায়। অনেকে না বুঝেই অপচয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। ভাবতে কষ্ট হয়, এসব মানুষ যদি তাদের এই অপচয়কৃত অর্থটি বিশ্বের দরিদ্র মানুষের জন্য দান করে দিত! অনেক বাংলাদেশী আমেরিকানকে জানি, যারা হৃদয় দিয়ে এই বিষয়টিকে অনুধাবন করেন। বাংলাদেশী আমেরিকানদের নিজ মাতৃভূমির জন্য অনেক কিছু করার ইচ্ছাও আছে। কিন্তু সে সুযোগ কোথায়? শুধু নিউইয়র্ক নগরীতেই প্রায় দেড় শতাধিক সামাজিক, সাংস্কৃতি, আঞ্চলিক সংগঠন রয়েছে বাঙালিদের।

শীত মৌসুমে এসব সংগঠন স্বল্প ব্যবহৃত শীতের কাপড় সংগ্রহ করে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পাঠাতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পাঠাবেন কিভাবে? বাংলাদেশ বিমান যদি বিনা মূল্যে এসব কাপড় বাংলাদেশে বহন করে নিয়ে গিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বণ্টনের ব্যবস্থা করত তবে অনেক প্রবাসীই এমন মহতী কাজে এগিয়ে আসতেন। কিন্তু বিমান চলছে না এই রুটে। বাংলাদেশী আমেরিকান ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের জানি-তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে বিভিন্ন দরকারি যন্ত্রপাতি দিয়ে সাহায্য করছেন। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে আরো সহযোগিতা করতে চান।

কিন্তু তাদের অভিযোগ দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ ব্যাপারে আগ্রহ নেই। বলছিলাম আমেরিকানদের পশু প্রেমের কথা। পশু প্রেম থেকে হয়ত আমেরিকানদের দমানো যাবে না। কিন্তু মানবপ্রেমের প্রতি তাদের আরো ঘনিষ্ঠ করা যাবে। যদি তাদের হৃদয়ের মানবিক সমুদ্রকে আরো জাগানো যায়।

আর সে উদ্যোগ নিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত তৃতীয় বিশ্বের মানুষদেরই। যারা পিছনে ফেলে এসেছেন, প্রিয় শৈশব, প্রিয় কৈশোর, প্রিয় যৌবনের স্মৃতি। তাদের প্রিয় স্বদেশ-স্বজন, শিকড়। তাদেরকেই হতে হবে ‘দ্য রুটস’ খ্যাত একেকজন অ্যালেক্স হ্যালী। -------------------------------------------------------------------- দৈনিক ডেসটিনি।

ঢাকা। ১৮ এপ্রিল ২০০৯ শনিবার প্রকাশিত ছবি- ভিকি প্রিটসিনি

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.