আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খিস্তি ঠাটে ত্রিতাল ভৈরবের জঙ্গনামা: সামহোয়ার নিয়ে আরো কিছু ভণিতা

গেরিলা কথাবার্তা

ব্লগের লিখিয়েরা: পুরনো নোট থেকে সামহোয়ার নিয়ে এটি আমার তৃতীয় লেখা। প্রথম ফাহমিদুল হকের একটি লেখার আলোচনা করতে গিয়ে এই লেখাগুলোর শুরু। ''খিস্তি ঠাটে ত্রিতাল ভৈরবের জঙ্গনামা'' আমার এই শিরোনামটি সামহোয়ারের সেই উত্থাল মুহূর্তটির কথা মনে করিয়ে দেয়। সেটিতে যা বলেছিলাম তার সারসংক্ষেপ হল: বাংলাদেশের উত্থান মুহূর্তে ভূমিকা পালনকারী দৃশ্যমান দুটি শ্রেণী, বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত্বশ্রেণী-উদ্ভূত পলিটিক্যাল এলিট এবং পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাকারী ইন্টালেকচুয়াল এলিট; উভয়ের পাকিস্তানী হেজিমনির বিরুদ্ধে যে দৃশ্যত অবস্থান (দৃশ্যত বলা হচ্ছে, কারণ তার ভিতরে একটি সুবিধাবাদী অবস্থানও ছিল), তা বাংলাদেশ-বিপ্লব পরবর্তী সময়ে তার চরিত্রের মৌলিক কোন ট্রান্সফরমেশন ঘটাতে পারে নি। ফলে এই উভয়বিধ শ্রেণী বাংলাদেশ-বিপ্লবের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ- হাজার বছরের লড়াই, সংগ্রাম ইত্যাদির ভিতরকার নানা বাঁক, টানাপোড়ন ও শক্তির জায়গাগুলো- ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।

দ্বিতীয়ত মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তর আবহ নিয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের (সংবেদনশীল তরুণদের কথা ব্যতিরেকে) যে জনপ্রিয় আগ্রহ বর্তমানে জারি আছে তাতে উল্লেখিত দুটি শ্রেণীরই ইমেজ বীরসুলভ, পর্যালোচনামূলক নয়। তাই পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পুনর্গঠনে উভয়ের যে মৌলিক ভূমিকা পালন করার দরকার ছিল, সেটি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ অভিজ্ঞতায় প্রবলভাবে অনুপস্থিত। এই ইতিহাসঅভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে সামইনে ব্লগারদের লেখালেখি বিষয়ক আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়নটা ছিল, ব্লগের গড়পড়তা লিখিয়েরা সকলে ধ্রুপদি গ্রেকো-রোমান এবং সেই সাথে রেনেসাঁস ও এনলাইটেনম্যান্ট আনিত আধুনিকতার মূল মটো ফ্রি উইল, যার ভৌত প্রকাশ মত প্রকাশের স্বাধীনতা বা ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন, এটাকেই ইমিটেশন অর্থে ধারণ করেন। আমি ইমিটেশন বলেছি; ফাহমিদুল হক, যার লেখাকে কেন্দ্র করে সেদিনের সেই আলোচনার অবতারণা, এবং যারা পোস্টটিতে তার পক্ষে বিপক্ষে তখন অবস্থান নিয়েছিলেন, তারাও এই ছদ্ম অবস্থানের কুশিলব। এই ছদ্ম অবস্থানের কারণেই, ব্লগে বিভিন্ন সময়ে জামাত এবং জামাত বিরোধী অর্থে স্বাধীনতার 'স্বপক্ষ' এবং 'বিপক্ষ' এবং 'নাস্তিক'- 'আস্তিক' ইত্যকার বিতর্কের বিভিন্ন পক্ষসমূহ পরস্পরের মতামত রুদ্ধ করে দেয়ার জন্য যে ধরণের আক্রমণাত্মক ভঙ্গি (ক্ষেত্র-বিশেষে একঘরে করা, বর্জন, ব্যান এবং গালি-গালাজ দিয়ে হেনস্থা) ইত্যাদি অবলম্বন করেছেন, তাতে আমাদের দেশের হালনাগাদ ইন্টেলেকচুয়াল এলিটদের মধ্যে পাকিস্তানি আমলের উল্লেখিত দুই শ্রেণীর ভিতরকার বিরাজমান সার্বিক অপরিপক্কতার বিষয়টিই নতুনভাবে দৃষ্ট হয়।

প্রগতিশীলতার বৈশিষ্ট্য হিশেবে 'মত প্রকাশের স্বাধীনতা' নামক যে প্রপঞ্চটি আমরা বহুবার আওড়িয়েছি, সেটির অন্তর্নিহিত অনুপ্রেরণার সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ আমরা প্রদর্শন করেছি এইসব ক্ষেত্রে। সামহোয়ারইন ব্লগ: কর্তৃপক্ষীয় রাজনীতি এতো গেল ব্লগের লিখিয়েরা। কিন্তু সামহোয়ারইন ব্লগ আর ব্লগের লিখিয়েরা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। সামহোয়ার ইন ব্লগের কর্তৃপক্ষীয় রাজনীতির দিক থেকে যে কোন ব্লগীয় তৎপরতা প্রতিষ্ঠান হিশেবে তার অবস্থান এবং টিকে থাকার প্রশ্নের সাথে জড়িত। এই দিকটা বিবেচনা করলে এর মধ্যেই ব্লগে বহু নতুন ঘটনা ঘটেছে যেগুলি তাৎপর্যময় গুরুত্ব বহন করে।

অনেকেই বলছেন, সামহোয়ার এই প্রথম প্রতিষ্ঠান হিশেবে নিজের অবস্থান ঘোষণা করেছে। একাত্তরের বাংলাদেশ বিপ্লবের পর একটি ভূখণ্ডের রাষ্ট্র হয়ে ওঠার সাধনা এবং ভাঙচুরের ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ, সেই সাথে রাষ্ট্রের ভিতরে ছোট রাষ্ট্রীয় ফেনোমেনা 'প্রতিষ্ঠান' এর নিজের সত্ত্বা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠার চেষ্টা এবং তার চোখা বাঁকগুলোও এই ইতিহাসেরই অংশ হিশেবে গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যাপারটিকে ধর্তব্যে রেখেই আরো একটি প্রাগ-সতর্কতা। একটি রাজনৈতিক জনগোষ্ঠির জন্য রাষ্ট্রের সাধনা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই রাষ্ট্র যখন পোপ হওনের আকাঙ্ক্ষা তথা ধর্মাকাঙ্ক্ষা পোষণ করে তখন এর পেছনে রাষ্ট্রের যে বাসনা ও আগ্রাসী চরিত্র দাঁড়ায় নাগরিকের জায়গা থেকে তার পর্যালোচনা এবং মোকাবেলাও জরুরী হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের যখন ধর্মাকাংক্ষা জাগে, রাষ্ট্রের ভিতরে প্রতিষ্ঠান আর রাষ্ট্রের সম্পর্ক তখন এক জায়গায় এসে সেই ধর্মাকাংক্ষাকে বাঁচানোর জন্য কাজ করে।

ফলত প্রতিষ্ঠান নিজের 'প্রতিষ্ঠান' সত্ত্বা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠার পর, তার ভিতরে রাষ্ট্রের মতই দানা বাধে ধর্মাকাঙ্ক্ষা। সামহোয়ারেরও এই পর্বটি বেশ কিছুদিন আগে থেকেই শুরু হয়েছে। প্রথম তার এ চরিত্রটি ধরা পড়ে 'নিরাপদ' 'অনিরাপদ' শ্রেণী বিভাজনের মাধ্যমে। সামহোয়ারইন ব্লগ এর মডারেটরগণ ব্লগারদেরকে 'নিরাপদ' মানে বিশ্বাসী হতে বলছেন এবং তার জন্য তাদের ফোন নাম্বার চেয়েছেন। বিশ্বাসী না হতে পারলে, তাদের পোস্ট সংকলিত পোস্টে সরাসরি স্থান পাবে না।

আর ডিফল্ট অনুসারে, সংকলিত পোস্টই আসল পেইজ হিশেবে ভিজিটরদের কাছে উপস্থিত হবে। মানুষ অবিশ্বাসীদের লেখা দেখবে না। অবিশ্বাসীদেরকে, পোস্ট দিয়ে বিনীতভাবে অপেক্ষা করতে হবে, এবং মডারেটরদের যথাযথ সময় হবে যখন, তারপর যথার্থ মডারেশনের পর, যদি দেখেন, সেই অবিশ্বাসী লোকটা ঈমানদারের মতন কাজ করেছেন, রাষ্ট্র, এবং অথরিটির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না, তাহলে অবিশ্বাসীর পোস্ট জেল থেকে ছাড়া পাওয়া যেতে পারে। বেশ সিগনিফিকেন্ট এই ঘটনার নিকটবর্তী আগে এবং পরে আরো বহু ঘটনা ঘটেছে, যা সামহোয়ার এর এই পর্বটিকে পর্যালোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সর্বসাম্প্রতিক পিলখানার ঘটনায় রাষ্ট্রের ঘোষিত চতুর শোকে ব্লগের কালো কাপড় পরিধান, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে কর্তৃপক্ষীয় তত্ত্বাবধানে পিটিশন লেখালেখি, এমনকি নির্বাচনের আগে বিশেষ ব্যানার টাঙিয়ে ক্ষমতা হেজিমনি তৈরী করা, শ্রেষ্ঠ লেখা নির্বাচন, ষ্টিকি পোষ্টগিরি এবং কিছুদিন আগের বহুল আলোচিত ব্লগের চুড়ান্ত নিয়মাবলীর কঠোর প্রয়োগ, যার মাধ্যমে কারো কারো ভাষায়, বাংলা ব্লগের মাস্তান ''বারো ভুইয়াঁ''র পতন হলো।

এমনকি কখনো কখনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভুল-প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগ, যার গুপ্ত হত্যার শিকারও হয়েছেন অনেকেই। তার মধ্যে আমিও আছি (অন্যান্যদের মধ্যে এই মুহূর্তে রাইসু এবং মাহবুব মোর্শেদেরটা আপাতত মনে পড়ছে, তারা এর প্রতিবাদে নিজেরাই স্ব-উদ্যোগী হয়ে ব্লগে তাদের সব পোষ্ট পর্যন্ত মুছে দিয়েছেন)। কর্তৃপক্ষের এইসব কর্মকাণ্ডের একটাই উদ্দেশ্য: ব্লগে কর্তৃপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। মজার ব্যাপার হলো, শুরুতে কর্তৃপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণের টুলস ছিল সেই ''বারো ভুইয়াঁ'', সেটি ঘটানো হয়েছিল তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি সীমাহীন উদাসীনতায়, তাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার হাতে মডারেশন এবং ব্লগের ঘোষিত নীতিমালাকে বাক্সবন্দী করে, বিপরীতে আবার এখন এসে তাদের পতন ঘটানোতেই সেই পোপগিরির পথ খোঁজা হল, নীতিমালার চুড়ান্ত এবং চরম প্রয়োগ ঘটানোর মাধ্যমে। এই উভয়বিধ চরমপন্থাই বিপদজনক বলে মনে করি আমি।

এবং মোকাবেলা জরুরী হয়ে ওঠে সামহোয়ার তথা প্রতিষ্ঠানের ধর্মবাসনা। মনে রাখতে হবে, সামহোয়ার প্রতিষ্ঠান হিশেবে নিজের সত্ত্বা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠার কালে প্রথমে তার এই বোধটা আসা জরুরী যে, দেশকালের আকাঙ্খা এবং সমাজের রাজনৈতিক সত্ত্বার মাত্রাটাই একটি নির্দিষ্ট স্থানের গণমাধ্যমের সংস্কৃতি ও প্রাকটিসের মূল নির্ধারক। ফলে বাইরের কোন স্বার্থ-উদ্যোগ এবং ক্ষমতা সম্পর্ক বরং এটির প্রাতিষ্ঠানিক স্পিরিটকেও ক্ষতিগ্রস্হ করবে। প্রসঙ্গ বার ভুইয়াঁ এই ক্ষেত্রে 'বার ভুইয়াঁ' শব্দবন্ধটি প্রথম ব্যবহার করেছিল মনে হয় বন্ধু ফিউশন ফাইভ। যাই হোক, আপাতত এই শব্দটি ধার করি।

আমরা উপরে দুটি দিক আলোচনা করেছি, একটি হল ব্লগের গড়পড়তা লিখিয়েদের বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান এবং দ্বিতীয়টি প্রতিষ্ঠান হিশেবে সামহোয়ারের কর্তৃপক্ষীয় রাজনীতি। দেখা গেছে ব্লগের বিভিন্ন মুহূর্তের বাঁক এবং ঢেউগুলোর আলোচনাকালে বা রেসপন্স করার সময়ে এই দুটি দিকই মোটামোটি অনালোচিত থেকে যায়, যেটি ছাড়া সঠিক এবং উপযুক্ত অবস্থান ঠিক করা অসম্ভবই মনে করি। ফলত দেখা যায়, আমাদের বন্ধুরা যখন ব্লগে বার ভুইয়াঁর পতনকে পর্যালোচনা করতে আসেন, তারা এটিকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানান এবং ব্লগে এইসব গোষ্ঠীবদ্ধতার কুফল সম্পর্কে লেখালেখি করেন। উভয় পক্ষের মধ্যেই এমনও অনেকে আছেন ব্লগে যাদের ভাষা, প্যাশন এবং অন্যান্য কিছু বিষয়ের আমি গুণমুগ্ধ। যেমন কৌশিক।

আর কথিত বার ভুইয়াঁর পালের নেতা হাসিবের প্যাশনেরতো তুলনাই হয় না। যদিও এই প্যাশন সবসময় ব্লগ খবরদারীতে ব্যস্ত থাকত। আমি একদিক থেকে তার এই প্যাশনেরও গুণমুগ্ধ। কিন্তু সেই কারণে নয়, তার বিবিধ ভিলেজ পলিটিক্স এবং ব্যান আন ব্যানের সালিশদারীর বিরোধীতা এবং এইসবের বিরুদ্ধে আমার নীতিগত এবং নৈতিক অবস্থান সত্বেও একজন হাসিবের এই ব্যান এবং যে কারো ক্ষেত্রেই নীতিমালার 'চরম' প্রয়োগ বা অপপ্রয়োগকে অসমর্থন করতে পারি। এই অসমর্থন কোনভাবেই সিনিয়র ব্লগার বা সেলিব্রেটি ব্লগার ইত্যকার ফাজলামোপূর্ণ ফ্যানোমেনায় বুদ হয়ে থাকার সুবিধাবাদিতা নয়।

কারণ আমার কাছে ব্লগের লিখিয়েদের সমস্যা কোনভাবেই এই যুথবদ্ধতায় বা গোষ্ঠিবদ্ধতায় বা স্রেফ যুথবদ্ধ খবরদারীর প্রশ্নে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বোঝার জন্য আমরা নজর দিতে পারি যারা ব্লগে বারো ভুইয়াঁর পতনে উল্লসিত তারা আবার নিজেরাই অবচেতন যুথবদ্ধতায় অথবা ব্যক্তি চেতনার জায়গায় 'জামাত-শিবির'কে পাশবিকভাবে তাড়ানো এমনকি নিধনের পক্ষে অবস্থান প্রকাশ করেছে গত কয়েকদিন আগেও। তাই, সমস্যাটা যদিও যুথবদ্ধতা বা খবরদারীতে প্রকাশিত হয় কিন্তু তার মৌল চরিত্রটা ধরতে গেলে এই লেখার প্রথম পর্বে আলোচিত বাংলাদেশ বিপ্লবের পর দেশের হালনাগাদ ইন্টেলেকচুয়াল এলিটদের মধ্যে পাকিস্তানি আমলের দুই শ্রেণীর ভিতরকার বিরাজিত সার্বিক অপরিপক্কতা এবং সেই হেতু তৈরী হওয়া ছদ্ম অবস্থানটিরেই ধর্তব্যের মধ্যে আনতে হবে । যেই ছদ্ম অবস্থান এবং চেতনা থেকে প্রতিনিয়ত বার ভুইয়াঁর জন্ম হয়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.