আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিক্ষাব্যবস্থা, ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতি, যুদ্ধাপরাধী ইস্যু, জাফর ইকবাল ও আমাদের বুদ্ধিজীবি সমাজ- আপাত বিক্ষিপ্ত প্রাসঙ্গিক ভাবনা

কৃষ্ণশুভ্রারা বেঁচে থাকুক দূরে সুদূর স্বপ্নসীমান্তে

১. আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বরাবরই আমি চিন্তা করি। প্রমথ চৌধুরী বোধ করি বলেছিলেন, " আমাদের ধারণা শিক্ষা আমাদের গায়ের জ্বালা চোখের জল দুই ই দূর কর করবে। এ আশা সম্ভবত দুরাশা। তবুও আমরা সম্মুখে কোন সদুপায় খুঁজে পাইনা। " আমরা এমন হতভাগার দেশ যে শতাব্দী আগে বলে যাওয়া এই কথাগুলো আজো আমাদের জন্য সত্যি।

কোনরূপ উত্তরণ আমরা ঘটাতে পারিনি নিজেদের অবস্থার। প্রথম চোধুরী যা বলে যেতে পারেননি তা তিনি দেখেননি। তিনি বেঁচে থাকলে অবশ্যই আমাদের শিক্ষার সুকেন্দ্রীকরণ নিয়ে কথা বলতেন। সুকৌশলে শিক্ষা বসার ঘরের দামি সোফার মতই বড়লোকদের বিলাস সামগ্রী হচ্ছে ধীরে ধীরে। এই কথাগুলো মনে এলো অনেকদিন পর হঠাৎ টিভি দেখতে বসে।

খুব কটুভাবে কিছু শব্দ কানে বাঁধল। সৃজনশীল পদ্ধতির সেরা গাইড কথাটা শুনলাম। পরেরবার দেখার জন্য অপেক্ষা করলাম ঠিক শুনেছি তো। আবার শুনে নিশ্চিত হলাম ,না কোন ভুল নাই। নানা ভাবনার মাঝেও আমার মাথায় সব সময় বিদ্ধ করে গেলো সেই কথা গুলো।

২. ছোট ভাইকে পড়ানোর সুবাদে আমাদের আধা মফস্বল এলাকার পড়ালেখার একটা বাস্তব চিত্র আমার কাছে খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। লেখাপড়ার উদ্দেশ্য জ্ঞান সাধনা এই আইডিয়া লোপ পেতে শুরু করেছে বোধ করি অনেক আগে থেকেই। ইদানিং শিক্ষা অর্জনের নূন্যতম বোধটাও নেই। পরীক্ষায় পাশ করার সহজ পদ্ধতি শেখার চর্চাই চলছে সবদিকে। এই সাথে কোচিং সেন্টার আর নোট নামক বিষয়গুলোর মিথস্ক্রিয়ায় আমাদের ছোট ভাইরা টাদের সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ দূরে থাক , সৃজনশীলতা কী জিনিস তা বুঝতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে।

আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার সুযোগ পায় না বলেই দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলিতে মফস্বলগুলোর প্রতিনিধিত্ব কমে যাচ্ছে। শিক্ষা ক্রমশই উচ্চবিত্তদের ভূষণে পরিণত হচ্ছে। শিক্ষা অবকাঠামোর পার্থক্য শহুরে স্কুল কলেজের সাথে মফস্বল কিংবা গ্রামের স্কুল কলেজ গুলোর সাথে মেলাতে গেলেই নগ্ন ভাবে ফুটে উঠে। শিক্ষার অবকাঠামোগত কথা বলার সাথে সাথে আরেকটি আপাত প্রাসঙ্গিক ব্যাপার এসে যায়। সেটা হচ্ছে শিক্ষা থেকে কী বেরিয়ে আসছে আমাদের জন্য।

শিক্ষার হার বাড়ার সাথে সাথে মানুষের মাঝে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হবে- আগেকার পুস্তকের মত এমন দুরাশা করাটা আমাদের জন্য কঠিন। জরা জীর্ণতা আর হাজার প্রতিকূলতা আমাদের মানবতা বোধ জীবনবোধ জাতীয় জিনিসগুলোকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া কিছু চিত্র আমাকে প্রশ্নের সামনে ফেলে দেয়। আমি হতবাক হয়ে লক্ষ্য করি টিকেট কেটে দশটাকায় যাবার পরিবর্তে কলেজ পড়ুয়া ছোট ছোট ছেলেরা কন্ডাকটরকে পাঁচ টাকা দিয়ে অবলীলায় পার হয়ে যাচ্ছে। এমনি নানা ঘটনা ঘটে প্রতিনিয়ত যা মনে হয় শুধু অভাবজাত ব্যাপার নয় বরং আামদের মাঝেকার মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে।

এর পিছনে রয়েছে মূলত মধ্যবিত্ত উচ্চ বিত্ত দ্বারা গ্রাস হওয়ার ক্রমাগত প্রক্রিয়ার মাঝে। উচ্চবিত্তের অর্থ আর মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি নিয়ে যে দ্বন্দ্ব তাতে আপাত উচ্চবিত্ত বিজয়ী। তারা এমনভাবেই বিজয়ী যাতে মধ্যবিত্ত কালচার হারিয়ে সেখানে উচ্চবিতত মধ্যবিত্ত মিশ্রিত কালচারের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে মধ্যবিত্ত সমাজের অস্ত্র যে কালচার তাকে ভুলিয়ে দিতে বসেছে। ৩. আমরা এক হতভাগা জাতি যার জন্মেই কিছু বেজন্মাদের হাতে তার কিছু সূর্য সন্তানদের বলি দিতে হয়েছে। মুনীর চৌধুরী শহীদুল্লাহ কায়সার সহ আরো অনেক প্রগতিশীল লোকদের আমরা হারিয়েছি বেজন্মাদের জন্য।

যারা থাকলে আজকের বাংলাদেশ অন্যরকম হতে পারত। যারা থাকলে মৌলবাদ জঙ্গিবাদ ডানা মেলতে পারতো আজ। সেদিন হঠাৎ ই একটি কথা শুনে ধাক্কা লাগলো। মুরুব্বি শ্রেণীয় একজন ফস করে বলে বসলেন, শহীদুল্লাহ কায়সার- ও তো ভারতের দালাল। আমি চমকে উঠলাম।

একজন শিক্ষিত মানুষের মুখে এমন ভয়ানক কথা। তার ঘরের একটি ছেলে কী বিকৃত জ্ঞান নিয়ে বড় হবে ভেবে শিউরে উঠি। আরো শিউরে উঠি শিক্ষিত মানুষদের ধারণা এমন হলে অশিক্ষিত গ্রামের লোকদের ভাবনার কাছ দিয়ে গিয়ে। আমরা বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধাপরাধী যে প্রচারণা চালাই তা সকল আম জনতার কাছে গ্রহনযোগ্য করে তোলার কথা আমরা কতটুকু চিন্তা করি? কিংবা মৌলবাদ ধর্মান্ধ এই দেশে তা কতটা ফলপ্রসূ? ৪. উপরের দুইটি ব্যাপার আপাত দৃষ্টিতে অসংলগ্ন। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত মিল খোঁজার আগে আরেকজন মানুষের কথা না বললেই নয়- তিনি মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

আমার তোলা দুইটা ইস্যু নিয়েই তিনি প্রতিনিয়ত বলে গেছেন। তার কলামগুলো আমাকে মনে করাতো এই দেশ এখনো শেষ হয়ে যায়নি জাফর ইকবালের মত লোকেরা হাল ধরবে। জাফর স্যারের বিজ্ঞানী পরিচয়টা আমার অনেক পরে জানা। ছোট বেলায় তার সায়েন্স ফিকশন পড়ে মজা পাই। সেই মজা থেকেই টার লেখা পত্রিকায় দেখে ভাবলাম দেখি তিনি মজার কিছু লিখেছেন কিনা।

কিন্তু সেখানে কোন গল্প কথা নয় সব সিরিয়াস কথা। এক নিঃশ্বাসে পড়ে গেলাম। সত্য কথার সাহসী উচ্চারণে মুগ্ধ হলাম। এই পর্যন্ত থাকলে ভালো হতো। কিন্তু আস্তে আস্তেই তার সীমাবদ্ধতা বুঝতে শুরু করলাম।

তিনি ভালো মানুষ কিন্তু দেবতা নন। তিনি এক হাতে বদলে দিতে অপারগ। এই ধারণা প্রথম আসলো যখন তিনি টিভিতে এক টক শো তে বললেন, " এখন রচনা আসে বিজ্ঞানের অবদান। আমি হলে দিতাম- আইনস্টাইন কম্পিউটার থাকলে কী করতেন?" এটা এই শতকের গোড়া কিংবা গত শতকের শেষ দিককার কথা। তখনকার দিনে বাংলাদেশের আম ছাত্র কয়জন কম্পিউটারের চেহারা দেখেছে তা বোধ করি স্যার জানতেন না।

আরো এরকম কিছু ঘটনা থেকে আমার ধারণা হয় স্যার খুব আগ্রহ নিয়ে কিছু করতে চান কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট ভালো বুঝেন না। জাফর স্যার বরং আমাদের সব সমস্যার সমাধান খুঁজে পেলেন গণিত অলিম্পিয়াড করার মাঝে। এর মাধ্যমে তিনি গণিতভীতি দূর করার উদ্যোগ নেন। উদ্যোগটা অবশ্যই উনার একার না তবে জিনিসটাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার পিছনে লেখক জাফর ইকবালের বিপুল জনপ্রিয়তা নিঃসন্দেহে কাজে লেগেছিলো। ভালো মানুষ হলেও জাফর সয়ার প্রচারবিমুখী নন।

স্বভাবতই তার ইনফ্লুয়েন্স প্রচণ্ড হয়ে যায়। এর আরেকটি ফল আমরা দেখতে পাই একমুখী শিক্ষা একরকম একক উদ্যোগে থামিয়ে দেন। শুধু জাফর স্যারের ভালো দিক সেগুলোই আনলাম পোস্টের খাতিরে। তার একগুয়েমি আর আরো কিছু কারণে জাফর স্যারের প্রতি আমার আগের ভালো লাগা শ্রদ্ধা নেই, সাধারণ দশটা শিক্ষকের মতই তাকে সম্মান করি। সেটা পোস্ট বহির্ভূত বলে এখানে বরং ক্ষেমা দেই।

৫. শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধের চেষ্টা, মূল্যবোধের অবক্ষয় বোধ আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীকে গণমানুষের প্রাণের দাবীতে পরিণত করার জন্য আমাদের সামনে এক এবং অভিন্ন এক পথ দেখতে পাই আমি। আর সেটা হচ্ছে আমাদের নিজস্বতা বোধ আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের শিক্ষা এগুলোকে ছড়িয়ে ডিতে হবে সাধারণ মানুষের জন্য। মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্তের স্নায়ু যুদ্ধে নিম্নবিত্তদের প্রবেশাদিকার দিতে হবে। আমাদের মগজে আজ যে পচন ধরেছে আমাদের বিন্তা চেতনায় যে দৈন্য ভর করেছে তার থেকে মুক্তির একমাত্র পথ আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিমুখীতা। আমাদের নিজেদের জাতিসত্তার বোধ ছড়িয়ে দেয়া দরকার সারাদেশের মানুষের মাঝে।

আমাদের সহজ সরল যে সব মানুষ আজ ধর্ম ব্যবসায়ীদের কবলে পড়ে হয়ে যাচ্ছে মৌলবাদী কিংবা জঙ্গি তাকে চেনাতে হবে বাঙালি ঐতিহ্য বাঙালি সংস্কৃতি। আমাদের সংস্কৃতি যাতে ফেব্রুয়ারির বইমেলা, মার্চ ডিসেম্বরের দুই দিনের আড়ম্বর কিংবা ১লা বৈশাখের একদিবসীয় বাঙালি হওয়ার মাঝে আটকে না থাকে। কিংবা শুধু গায়ক কবি কিংবা চিত্রকরের তুলিতে নয় বরং সংস্কৃতির ছোঁয়া লাগুক প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয়ের কোমলতম জায়গায়। জাফর স্যার আমার লেখা হয়তো কখনোই পড়বেন না বা পড়লেও গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন মনে করবেন না কিন্তু সস্তা জনপ্রিয়তায় বুদ হয়ে না থেকে এই আন্দোলনের সূচনা ঘটানো তাঁর কাছে অথবা তাঁর মতো সকল বুদ্ধিজীবীদের কাছে সময়ের দাবি। গণিত অলিম্পিয়াডের গুরুত্ব অস্বীকার করছি না কিন্তু তার থেকে অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব।

যেভাবে জাফর ইকবাল তাঁর যাদুতে গণিতকে ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশের আনাচে কানাচে তেমনিভাবে মানবিকতা জীবনবোধের বাণী নিয়ে তিনি কিংবা তার ন্মত কেউ পৌছে যেতে পারবেন দেশের সহজ সরল মানুষ গুলোর কাছে। আর শুধু জাফর সয়ার কিংবা তার মত কারো কাঁধে দায়িত্ব চাপিয়ে আমাদের বসে থাকলে চলবে না আমরাও তাদের পিছু পিছু এগিয়ে যাব বাঙালি সত্তা দুয়ারে দুয়ারে পৌছে দেয়ার অভিপ্রায়ে। আর সাংস্কৃতিক বিপ্লব না ঘটিয়ে উদ্যোগ নিলে আমরা শুধু বৃথা আস্ফালন করে যাব শিক্ষা ব্যবস্থার অসাড়তা নিয়ে কিংবা মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে অথবা দেশের সাধারণ মানুষের কাছে শুনব মুনীর চৌধুরীদের নামে কটু কথা কিংবা দেখব রাজাকাররা আবার ক্ষমতায়। আমাদের নিজস্ব শক্তি বাঙালি বোধ নিয়ে একে প্রতিহত না করতে পারলে কপাল চাপড়ে দুর্ভাগ্যের বোঝা বয়েই কেবল বেড়াতে হবে আমাদের। জাফর স্যার কিংবা বাংলাদেশের সংস্কৃতিবান বুদ্ধিজীবীদের কেউ কী আমার তথা আমার মত নিরীহ আম জনতাদের নিজেদের সত্তা টিকিয়ে রাখার আকুতি মেশানো গোঙানি শুনতে পান ??


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.