আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রিয় সাজি, কেমন দেখে গেলেন- প্রিয় স্বদেশ?

কেবল সমুদ্র পারে শুষে নিতে সব, যা কিছু বিপ্রতীপ, ভেসে আসে নিদারুণ কষ্টের নীলজলে..

প্রিয় সাজি, ঠিক জানিনা, কতোটা ভালো আছেন। তবে এটা জানি, আর মাত্র একটি দিন। .... আর একটি দিন পরেই আপনি ফিরে যাবেন আবার প্রবাসে। আবার কানাডার কোন শীতের সকালের মনোমুগ্ধকর তুষারপাত অথবা বহুদূরের কোন পাহাড় ঘেষা শহরের রাস্তা দিয়ে একাকী গাড়ীতে চলার অপরূপ আনন্দ হয়তো এক একটি বিস্ময়কর গোলাপ অথবা এক একটি বিনিদ্র জ্যোছনার অপরূপ রাত্রি হয়ে ফুটে উঠতে থাকবে আপনার কবিতায়...। কানাডার নীরব নির্জন ছিমছাম সুন্দর কোন পাহাড়ীপথে, আপনার কবিতায় বহুবার বলা সেই স্বপ্নের মতো কোন ওভারকোট আর স্কার্ফ পড়ে আনমনে একাকী হাঁটতে গিয়ে-আপনার কি হঠাৎ মনে পড়ে যাবে, ফেব্রুয়ারি ২০০৯ মাসটা আপনি কাটিয়েছিলেন এই প্রিয় স্বদেশেই? আপনার কি মনে পড়ে যাবে-এই স্বদেশের কিছু রক্তিম কৃষ্ণচূড়া দেখার প্রত্যাশায় এসে আপনি শেষমেষ দেখে গেছেন ভয়ানক রক্তাক্ত এক কৃষ্ণপক্ষ, ভয়ংকর বেদনাময় এক নদী সমান রক্তের অবিশ্বাস্য এক হোলি খেলা? আপনার কি মনে পড়বে আবার- স্বদেশের যে পবিত্র মাটিতে খালি পায়ে একটু হেঁটে আপনি স্বাদ নিতে চেয়েছিলেন বাঙালীর চিরন্তণ মমতার, সেখানেই মমতাহীণ হিংস্র কদর্যতায় গেঁথে ফেলা কিছু মানুষের লাশ-আপনাকে ঠেলে দিয়েছিলো নির্বাক, অবিশ্বাস্য, কবিতাবিহীণ এক জ্যোছনাশূন্য স্তব্ধতায়? আর কি কোন একুশের বইমেলায়, কোন স্বদেশের স্মরণ অনুষ্ঠানে, আপনি শোনাতে পারবেন-সেই অনিন্দ্য উচ্চারণ-‘এক জ্যোছনায় তুমি আর আমি?’ এরপর আবার কোন বিষণ্ণ রাত্রিতে, আবার কোন বৃষ্টির রাতে যখন হু হু কান্নার মতো এই দেশের কথা আপনার মনে পড়তে থাকবে, তখন কি আপনিও সেই আরেকজন মানুষের মতো বলে উঠবেন, “ আমি ভালো নেই , আমি ভালো নেই, শুধু তুমি ভালো থেকো দেশ! ” ২৬ শে জানুয়ারীর যে সকালটিতে আপনি পা রেখেছিলেন দেশের মাটিতে, সেই দিনটাও হয়তো আপনাকে স্তব্ধই করে দিয়েছিলো।

তবে সেই অনুভবের সাথে আজকের অনুভবের নিশ্চয়ই অনেক তফাৎ। আপনার সেদিনের সেই স্তব্ধতা ছিলো অপার মুগ্ধতার! সেই স্তব্ধতা ছিল বিস্ময়ের, আনন্দের! আপনার সেই স্তব্ধতা ছিল বহুদিন পর ফিরে পাওয়া-চিরচেনা ঢাকার রাজপথে আবার হাঁটতে পারার তীব্র আনন্দের অপরিসীম এক নির্বাক স্তব্ধতা! যতোদূর মনে পড়ে, সেদিন আকাশে কোন বৃষ্টি ছিলোনা। মেঘের চিহ্ণ তো নয়ই। বরং অদ্ভুত এক উজ্জল রোদের আলোয় ভেসে যাচ্ছিলো নগরী। ঠিক ক’টায় আপনার প্লেন ঢাকার আকাশ স্পর্শ করেছিলো তা জানা নেই, তবে জানি, আমাদের কয়েকজন ব্লগার সেদিন আপনাকে হৃদয়ের শুভ্র শুভেচ্ছায় স্বাগত জানাতে গিয়েছিলো।

বিশ্বজুড়ে ব্লগাররা অন্তর্জালের এক ভার্চুয়াল চরিত্র। সাধারণভাবে প্রকাশ্য আলোয় ব্লগারদের আসার কথা নয়। কিন্তু বাঙালী ব্লগার বলে কথা! বাঙালীর আবেগ, বাঙালীর সামাজিকতা, বাঙালীর দায়িত্ববোধ ও আপ্যায়ণমুখী স্বভাব খুব সহজেই তাকে টেনে বের করে আনে মুখোশের আড়াল থেকে বাইরের সুস্পষ্ট আলোয়। সেই যে ‘প্রাপ্তি’ নামের ছোট্ট মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্য কিছু ব্লগার বেরিয়ে এসেছিলো লুকানো নিক-এর আড়াল থেকে বাইরে, তারা আর ফিরতে পারেনি ভার্চুয়াল মুখোশের অজানা অন্তরালে। প্রাপ্তি থেকে শাশ্বত, শাশ্বত থেকে উপমা -এক এর পর এক বিপন্ন মানবতাকে বাঁচানোর দায়িত্ববোধ বাঙালী ব্লগারদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সীমাহীন শুদ্ধতার অপরূপ এক সুস্পষ্ট বারান্দায়।

কিন্তু সেই সুস্পষ্ট বারান্দা, সেই সুন্দর আঙিনার অন্য আরেক চিত্রও হয়তো আপনি দেখে গেলেন সাজি। আপনি দেখলেন, বাঙালীর অন্তহীন ঐক্যের এই অপরূপ মোহনা থেকেই কিভাবে সৃস্টি হয়ে যায় অনাকাংখিত সব বিভেদ। কিভাবে এলোমেলো সব ভুল অনুভব, কিভাবে অষ্পষ্ট সব ভ্রান্ত উপলব্ধি থেকে অযথা দীর্ঘ দূরত্বে চলে যায়, প্রিয় সব ব্লগার আমাদের ! আমাদের প্রিয় সামহয়্যারকে আমি বরাবরই তুলনা করেছি-প্রতিদিন চোখ রাখা এক মুগ্ধ জানালার সাথে। সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী ব্লগাররা প্রতিদিন এই জানালায় চোখ রেখে যেন নতুন সঞ্জীবনী শক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে লেখালেখির তাড়নায় নতুন করে পরিশুদ্ধ হয়ে ওঠে ! অথচ সেই ব্লগ যখন আক্রান্ত হয় কদর্য কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে, সেই ব্লগ যখন ভাসতে থাকে আক্রমণাত্বক গালাগালির বন্যায়, তখন খুব কি ইচ্ছে করে না, জানালাটা খুব দ্রুত বন্ধ করে দেই? খুব কি ইচ্ছে করে না, চীৎকার করে পৃথিবীর সব বাংলা ভাষাভাষীদের বলি, আমাদের ব্যর্থতার এই অংশটুকু তোমরা দেখতে এসোনা। .... আমাদের গালাগালির এই অংশটুকু তোমাদের অনাবিস্কৃত থাকুক।

তোমরা চোখ বন্ধ করে রাখো। ....যতোক্ষণ না আমরা ফিরে যেতে পারি, অনাকাংখিত বিভেদ থেকে ঐক্যের অপরূপ, শুদ্ধ মোহনায়। আমি জানি, ঢাকায় আসার পর প্রথম কয়েকটি দিন খুব চমৎকার কেটেছিলো আপনার। ফেব্রুয়ারী আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের মাস। এই মাসে আমাদের নানা আয়োজন।

আপনি এসেই সম্ভবতঃ দুদিনব্যাপী জাতীয় কবিতা উৎসব পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন প্রতিদিনের বইমেলায় নতুন নতুন বইয়ের প্রকাশনা উৎসব। পেয়েছিলেন অতিথিপ্রিয় বাঙালীর প্রাণের উষ্ণতা। দেখেছেন সাহিত্যের আড্ডা, দেখেছেন লেখক-কবি-গল্পকারদের প্রাণোচ্ছল ব্যস্ততা। দেখেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবীতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য নিবেদিত প্রাণ মানুষদের ঐকান্তিক প্রয়াস।

ব্লগারদের মিলনমেলায় উপমা নামের একটি ছোট্ট শিশুকে বাঁচানোর ঐকান্তিক মহতী প্রয়াসও আপনি প্রত্যক্ষ করেছেন। যখন উপমার জন্য মানবতাকামী ডেডিকেটেড ব্লগাররা ফাল্গুণের শিশিরসিক্ত স্নিগ্ধতায় সারিবদ্ধ হয় এক মোহনায়, যখন এই ছোট্টমেয়েটির জন্য আকুলতা আর সমবেদনা জানিয়ে সামহয়্যারের আকাশ জুড়ে একের পর এক ফুটে উঠতে থাকে -অপূর্ব চন্দ্রিমার মতো হৃদয়স্পর্শী সব মমতাময় পোষ্ট, যখন ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দের ভেতর এক থোকা বিবর্ণ বিষণ্ণ গোলাপের মতো উপমা’র বিপন্ন দৃষ্টির সাথে মিলে মিশে যায় দায়িত্ববোধে সমুজ্জ্বল আমাদের ব্লগারদের সমব্যাথী চোখ, তখনও কি আপনার একবারও মনে হয়েছিলো-এই এতোসব উজ্জলতার পরেও, ব্লগারদের ত্যাগ-আত্মোৎসর্গের এতোসব বিকীর্ণ শুভ্র আলোকছটার পরেও আবার আমাদের ব্লগ ‘উত্তপ্ত হয়ে ধূসর-ম্লান’ হয়ে যেতে পারে কিছু অসহিষ্ণু বিভেদ জটিলতায়? আবার এখানে আসতে পারে ব্যান অথবা আনব্যান এর মত ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ সব আলোচনা-প্রসঙ্গ? আমি লক্ষ্য করেছি দেশে কাটানো সময়টাতে আপনার তেমন কোন নতুন পোষ্ট আসেনি সামহয়্যারের পাতায়। কী আশ্চর্য্য! দেশে এসে দেশের অবাক সান্নিধ্যে যেন থমকে গেলেন কবি। খুব কি নিবিড় কোন জ্যোছনায় ডুবে থাকলেন কবি? নাকি প্রিয় মানুষের ভিড়ে হারানো কাউকে অন্তহীণ খুঁজে বেড়ানো? লালমনিরহাটের লাল নীল সূতোয় বাঁধা কিশোরী বয়সের হারানো কবিতার খাতায় কী কী খুঁজে পেলেন-স্মৃতিমগ্ন কবি? অবশ্য সাজি, আমার খুব মনে পড়ে, কয়েকদিন আগের এক রাত্রিতে টেলিফোনে কথা বলার সময়-আপনি যেন অনেকটা আনমনেই বলে উঠলেন-‘ছোট ছেলেটার জন্য মন খুব খারাপ লাগছে....’। মুহুর্তে আমি বুঝলাম-এই দেশের সমুদ্র সৈকতে আছড়ে পড়া সব ঢেউ, লালমনিরহাটের লাল নীল সোনালি স্মৃতি- যতোই হাতছানি দিয়ে ডাকুক আপনাকে-আকাশ অরণ্য আর পাহাড় পর্বতের সকল সীমানা ছাড়িয়ে-অনেক দূরের সেই কানাডা শহরেই পড়ে আছে আপনার আসল শেকড়- আপনার আজন্ম আদরের রাইয়ান আর রাশীক।

আপনি কবি, আপনি আবেগপ্রবণ, আপনি দেশপ্রমিক। কিন্তু চিরন্তণ এক বাঙালী মায়ের মমতার ঔদার্য্য যেন মুহুর্তে হাজারো উজ্জ্বল শিখায় সমুন্নত হয়ে অবাক বিস্ময়ে ঢেকে ফেলে আর সব পরিচয়ের প্রজ্জ্বল পথরেখা। সব পরিচয়ের সীমানা ছাড়িয়ে কোথায় যেন বাজতে শুরু করে গান..... “ কতোদূর.... আর কতোদূর..... বলো মা....” । দেশে কাটানো এই একমাসের ভেতরেই একুশের ভোর এসে শোকার্ত পায়ে দাঁড়িয়েছে আপনার দরোজায়....। আমার মনে পড়ে, আমার এক প্রবাসী বন্ধু প্রায়ই অনুযোগ আর হাহাকার করতো-একুশের প্রভাতফেরীর গাম্ভীর্য্যময় থমথমে বেদনার্ত মিছিলে আর সে শামিল হতে পারে না বলে।

সেদিক থেকে আপনি ভাগ্যবান..। আপনি দেশে এসেছেন একুশের মাসে। এমন একটি মাস- যে মাসে এ দেশের আকাশ-অরণ্য- নিলীমায়, জলে-স্থলে--অন্তরীক্ষে, আমাদের হৃদয় অভ্যন্তরের স্পর্শের অতীত কোন অন্তিম গহীনে, অণুক্ষণ অজান্তেই ভেসে বেড়াতে থাকে পৃথিবীর শোকাবহতম সেই অনন্ত জিজ্ঞাসার কান্নাবিধুর সঙ্গীত-“আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি?” একুশ স্মরণে বাঙালীর এই চিরন্তণ মিলনমেলা, বাঙালীর এইসব প্রাত্যহিক প্রাণের উৎসবে ভেসে যেতে যেতে আপনার কি কখনো মনে হয়েছিলো, বাঙালীর এই ইতিহাস ঐতিহ্য সমুন্নত রাখার প্রয়াস বাধাগস্ত করতেই নীরবে ধেয়ে আসছে কোন অশুভ দিন? আপনার কি কখনো মনে হয়েছিলো, আবার এই দেশের বুক রক্তাক্ত হবে, আবার এই ফাল্গুনেই এই মাটির বুকে লুটিয়ে পড়বে রাশি রাশি রক্তে বিলীন সব অমূল্য কৃষ্ণচূড়া! না, আমি জানি, আপনি তেমনটি ভাবতে পারেননি। আর শুধু আপনি কেন? এই শহরের বুকে কলংক হয়ে লেপ্টে থাকা সব কালের, সব যুগের, সব অনাকাংখিত রক্তপাতের ঘটনাগুলোই কোন বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন লোক ভেতরে ভেতরে মেনে নিতে পারেনি। ... আর কবিরা? কবিরাতো নয়ই।

এসব বিষয়ে কবিদের অনুভব আরো সুস্পষ্ট, আরো গভীর, আরো তীক্ষ্ণ....। একারণেই শব্দের সীমাহীণ আশ্চর্য্য সুন্দর ব্যবহার প্রয়োগ করে ‘হন্তারকদের প্রতি’ শিরোণামে কবি শহীদ কাদরী লিখে ফেলেন বেদনা বিধুর আরেক কৃষ্ণ সকালের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে হৃদয় চমকে দেওয়া এক স্তব্ধতার কবিতা- “বাঘ কিংবা ভালুকের মতো নয়, বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা হাঙরের দল নয়, না, কোনো উপমায় তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে না। তাদের পরনে ছিল ইউনিফর্ম, বুট, সৈনিকদের টুপি, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের কথাও হয়েছিল, তারা ব্যবহার করেছিল এক্কেবারে খাঁটি বাঙালির মতো, বাঙলা ভাষা। অস্বীকার করার উপায় নেই ওরা মানুষের মতো দেখতে, এবং ওরা মানুষই, ওরা বাঙলার মানুষ এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা আমি আর শুনব না কোনোদিন”। প্রিয় সাজি, যারা ২৫ শে ফেব্রুয়ারীর সকালটিকেও ঢেকে দিয়েছিল নিষ্ঠুর রক্তের এক অবিশ্বাস্য আল্পনায়-তারাও মানুষ ছিল এদেশেরই- তারাও ছিল এই বাঙলারই মানুষ।

..... হয়তো এর চেয়ে ভয়াবহ কোনো কথা-আমরাও আর শুনব না কোনদিন ! .................................. ভালো থাকুন সাজি। ভালো থাকুক আপনার সব শুভ উচ্চারণ। ভালো থাকুক আপনার সব শুভ কবিতা। ..... অনুমান করি, এইবার প্রবাসে ফিরেই আপনার সব লেখায়, সব কবিতায়, সব গানের সুরে হয়তো বারবার বলতে চাইবেন- ‘আমি ভালো থাকবো, আমি অবশ্যই ভালো থাকবো- যদি শুধু তুমি ভালো থাকো দেশ...! যদি শুধু তুমি স্বাভাবিক থাকো দেশ...!’ শুভেচ্ছান্তে, সুনীল সমুদ্র


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.