আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্কুলের প্রথম দিন......



‘সেই দিনটা অন্য সব দিনের মত শুরু হয়নি। ভোর হতে না হতেই মা ঘুম থেকে উঠিয়ে দিলো। আমাকে সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে দিলো। আমি ভাবছিলাম হয়তো বেড়াতে যাচ্ছি কোথাও। মা বের হবার সময় আমার কাধে সুন্দর একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে দিলো।

কোথায় যাচ্ছি মা’কে জিজ্ঞেস করলাম। মা বললো, ‘স্কুলে’। স্কুল ! এটা আবার কেমন জায়গা ভাবতে ভাবতে স্কুল গেটে পৌঁছালাম। দুরুদুরু বুকে মা-বাবা’র হাত ধরে ঢুকলাম ভেতরে। আমার মতোই আরো কত বাচ্চা সেখানে!...বাবা-মা আমাকে একটা ঘরে নিয়ে গেলেন।

সেখানে টেবিল-চেয়ারে একজন গুরুগম্ভীর চেহারার বয়স্ক লোক বসে আছেন। তিনি স্কুলের হেড মাস্টার। তাকে দেখে আমার মনে হলো, উনি অনেক রাগী একজন লোক। কিন্তু উনি হাসিমুখে আমাদের স্বাগত জানালেন। হাসিমুখে আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন।

আদরভরা কণ্ঠে বললেন, ‘এখানে তোমার অনেক বন্ধু পাবে। কোনো ভয় নাই’...। আমারো ভয় কেটে গেলো। গম্ভীর চেহারার হাসিখুশি লোকটি আমাকে হাত ধরে একটা ক্লাসে নিয়ে গেলেন এবং সবচেয়ে সামনের সিটে বসিয়ে দিলেন। আমার মত আরো অনেক ছেলে-মেয়ে দেখলাম...ক্লাস টিচার এলেন...এভাবেই আমার স্কুল জীবনের প্রথম দিন শুরু হলো...’ যে কোনো রচনা বইতে ‘স্কুল জীবনের প্রথম দিন’ টাইপের প্রবন্ধ রচনাগুলোতে গতানুগতিক বক্তব্য এমনটাই থাকে।

কিন্তু বাস্তবে আসলেই তাই হয় কি?...মোটেই না!...আমার নিজের প্রথম দিনটাও কেটেছে অনেক ভিন্ন ভাবে। সেটা ১৯৯২ এর একটা শীতের সকালের গল্প। আমার জীবনের সবচেয়ে মজার স্মৃতিগুলোর একটার গল্প। সে সময় আমার থাকা হতো ব্রাহ্মণবাড়িয়া’তে। মা’র সেখানে ‘মহিলা কলেজ’ এ পোস্টিং।

তাই মা ওখানেই থাকতো। ওখানেই আবার আমার নানু বাড়ি। তাই থাকার সমস্যা নেই। আমি আর আমার ভাইও থাকি মা’র সাথে। আব্বু’র তখন পোস্টিং ঢাকা কলেজে।

তাই ঢাকাতেই থাকে। ফলে, আমার স্কুল এর প্রথম দিনটা যাওয়া হয়েছে মা’র সাথেই। ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া মিশন প্রাইমারি স্কুল’-এ। স্কুলে গিয়েই দেখলাম লম্বা লাইন ধরে আমারই মতো আরো অনেক ছেলে-মেয়ে দাঁড়িয়ে। সাথে তাদের বাবা/মা কিংবা দু’জনেই।

ছেলে-মেয়েরা কেউ বাবা-মা’র হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ ছটফট করছে, কেউ আঙ্গুল চুষছে। আমি ঘুরে ঘুরে সবাইকে দেখতে শুরু করলাম। আমি ছোটবেলায় খুব দুরন্ত ছিলাম। ‘বিশ্ব দুরন্তপনা চ্যাম্পিয়নশিপ’ হলে তখন দুই-একটা পুরস্কার জিতেও নিতে পারতাম!...আমি কোথায় এসেছি, কেন এসেছি তা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত হলাম না...দুরন্তপনা এবং চঞ্চলতা চলতে লাগলো। এর মধ্যে আমাদের ডাক পড়লো।

দুই লাইনে ভাগ করা হলো সবাইকে। এক লাইন ‘ক’ শাখা, আরেক লাইন ‘খ’ শাখা। আমার জায়গা হলো ‘ক’ শাখায়। ক্লাস টিচাররা যার যার শাখার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন। তবে ক্লাসে কেবল শিক্ষার্থীরা না, পারলে অনেকের বাবা-মা’ও ঢুকে পড়ছিলেন।

কোনো একটা ছেলে হয়তো ডাক দিয়ে ঊঠলো, ‘মা’...তার মা ভীড়ের মধ্য থেকে বলে উঠলেন, ‘এই তো আছি’। কোনো একজন হয়তো ভয়ঙ্কর শব্দ করে কাঁদছে। কেউ এসেই দুষ্টামি শুরু করে দিয়েছে। আবার কেউ চুপচাপ বসে আছে, যেন কিছুই হয়নি। এতসব ঘটনা দেখে আমি চঞ্চলতা ভুলে এদিক-ওদিক তাকাতে শুরু করলাম।

আমার মা’কে খুঁজলাম। কিন্তু তাকে দেখলাম না কোথাও। আমি ভাবছি, ‘এইটা কোথায় আসলাম!’ এর মধ্যেই ক্লাস টিচার বুঝে গেলেন এভাবে তিনি পরিস্থিতি সামলাতে পারবেন না। তাই তিনি দরজা বন্ধ করে দিতে গেলেন। হতভম্ব আমি এবার আকাশ থেকে পড়লাম! ‘হচ্ছেটা কি?’ ‘দরজা বন্ধ করছে কেন?’ আমি মুহুর্তের মধ্যে ধরে নিলাম এটা একটা জেলখানা জাতীয় কিছু।

যেখানে আমাদের আটকে ফেলা হচ্ছে। কিংবা এখন জাদু দিয়ে আমাদের ভ্যানিশ করে দেয়া হবে। আর কোনোদিন আমি ফিরে আসবো না। মা কে দেখবো না। নানু কে দেখবো না।

নানী কে দেখবো না...কাউকে দেখবো না...আমি পুরোপুরি ভেবেও শেষ করতে পারলাম না, উনিও তখনো দরজা পুরোপুরি লাগাতে পারেন নি। আমি প্রায় ছিটকে বের হয়ে গেলাম ক্লাস রুম থেকে। বের হতে হতেই আশে পাশের অভিভাবকরা নিশ্চয় মা’কে ডাক দিয়েছিলেন। মা’ও চলে এলো ক্লাসের সামনে। আমি মা’কে জড়িয়ে ধরে শুরু করলাম, ‘ভ্যাঁ.........’ তারপর টিচার আসলেন।

উনি আমাকে সেদিন ক্লাসে নিতেই পারলেন না। পাশের ক্লাসের টিচার [ সুষমা দিদি ] এসে আমার হাত ধরে বললেন, ‘আমার ক্লাসে আসবে?’...উনাকে আমার কেন যেন পছন্দ হলো, আমার নানীর মতো দেখতে মনে হলো। তাকে বললাম, ‘হ্যা’। উনি বললেন, ‘তাইলে কাল থেকে আমার ক্লাসে এসো...’ এভাবেই আমার স্কুল জীবনের শুরু.........আমার ছাত্রজীবন [নাকি ছাত্রীজীবন!!] শুরু!......

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.