আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্কুলের ঝাল আর পিঠের ছাল (আত্মকথা)

অন্ধকার দেয়ালে তোমার আলো জন্ম দেয় মিথ্যে ছায়াকে..... আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যপ্তি সম্ভবত স্কুল লাইফটাই। আর তাই স্কুলের লিজেন্ডগুলোর কথা সারা জীবনই মনে থাকে। এমনও দেখা যায় বুড়ো নানা তার নাতিদের কাছে স্কুল জীবনে স্যরের হাতে বেধরক পিটুনি খাবার গল্প করছে রসিয়ে রসিয়ে। আমি ময়মনসিংহের একটি স্কুলের ছাত্র ছিলাম। আমাদের স্কুল থেকে যারা পাস করে বেরিয়েছে তাদের কাছে ‘শাহাবুদ্দিন স্যার’ বা ‘মোমেনা ম্যাডাম’ নাম দুটো শুনলেই অন্যরকম অনূভূতি হয় নিশ্চিত।

যেন ভয়ের এক শিহরন মেরুদন্ড বেয়ে বয়ে যায়। এর কারন হচ্ছে,ইনারা দুজনেই অত্র স্কুলের লিজেন্ডারি শাস্তিদাতা। শাস্তি দিতে নিত্য নতুন কৌশল অবলিলায় বের করে ফেলতেন। শাহাবুদ্দিন স্যার ছিলেন ছোটখাট মানুষ। স্কুলের বাইরে সাধা সিদে,৫ ফুটেরও কম উচ্চতার মানুষটি স্কুল চত্ত্বরের ভেতর সাক্ষাত যমদূত।

যেকোনো সময় উনার দ্বারা আঘাত নেমে আসতে পারে-মনে মনে সবারই সেরকম প্রিপারেশন থাকত। হয়ত পিটি করছি তীব্র রোদের মাঝে,হঠাত গালে কষে চড়ের আঘাত। কারন কি? কারন শাহাবুদ্দিন স্যারের মনে হয়েছে মনোযোগ দিয়ে পিটি করছি না! মাঝে মাঝে কারও প্রক্সি ক্লাস নিতে যখন ধাবমান হতেন,পুরা ক্লাস যেন ভয়ে নীল হয়ে যেত। সবাই দোয়া দরূদ পড়ছে, ক্লাস ক্যাপ্টেন তড়িঘড়ি করে বেঞ্ছের লাইন সোজা করছে,কেউবা কিভাবে পালানো যায় সেই ছক কষছে। সে এক হৃদয় বিদারক অবস্থা।

স্যার আসতেই ক্লাসে পিন পতন নিরবতা। নিজের হার্টবিটের শব্দও যেন থামিয়ে দিতে ইচ্ছা করত। এসেই পেছনের বেঞ্ছের কয়েকজনকে ধমাধম কিল। কাউকে কাউকে ক্লাসে বাইরে নিলডাউন। কাউকে কাউকে বেঞ্ছের উপর কানে ধরে দাড়া করানো।

এরপর চলত বেত্র চার্জ। ফটাফট বেতের বাড়ি! সে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। তাছাড়া চড় থাপ্পর তো আছেই। একটা জনপ্রিয় শাস্তি ছিল হাতের তালুতে বেতের আঘাত। তবে শর্ত,হাত নড়ানো যাবে না।

যদি হাত সামান্য নড়ে,তাহলে শাস্তি দ্বিগুন! ক্লাস শেষে সবাই যেন হাপ ছেড়ে বাচত। তবে কে কি কারনে শাস্তি পেল সেটাই শুধু বুঝত না। আমাদের ছেলেদের জন্য যে সার্ভিসটা দিতেন শাহাবুদ্দিন স্যার,ঠিক সেটাই মেয়েদের জন্য প্রভাইড করতেন মোমেনা ম্যাডাম। এই দুই লিজেন্ডকে নিয়েই অনেক গল্প প্রচলিত আছে। একদা নাকি আমাদের স্কুলের কোনার দিকে একটা ভূতুড়ে ল্যাব ছিল।

সেখানে প্রায় রাতেই কান্নার আওয়াজ শোনা যেত। শাহাবুদ্দিন স্যার শেষ পর্যন্ত সাহস করে এক অমবস্যা রাতে মাটি খুড়ে সেই ভুতের কঙ্কাল উদ্ধার করেন। এরপর থেকে আর সেই কান্না শোনা যায় নি! আসলে গল্পের মূল ভাব হচ্ছে,স্যারের ভয়ে ভূতও চুপ। আর আমরা আম ছাত্ররা আর কি?!! তবে আমার বেদম মাইর খাওয়ার ইতিহাসে এরা কেউই নেই। সেখানে আছে নুরুল ইসলাম নামের একজন(আমার উনাকে স্যার বলতে ইচ্ছা করেনা)।

ঘটনাতে একটু রাজনৈতিক গন্ধ আছে,কিন্তু সবাইকে অনুরোধ করব সেভাবে না নেয়ার জন্য। নুরুল ইসলাম ছিলেন আধা পাগলা,উনাকে নুরা পাগলা নামে সবাই চিনতাম। বছরে একবার গোছল করেন কিনা জানিনা,তবে বছরে একের বেশি পোষাক কখনও পড়তে দেখিনি। কাছে আসলে সবার আগে যা কষ্ট দিত,তা হলো উনার মোজার দুর্গন্ধ। ক্লাসে কখনও পড়া পড়াতেন না।

সবসময় সমসাময়িক রাজনীতি আর বিশ্ব নিয়ে তার ‘গভীর’ ভাবনা আর তত্ব উন্মোচন করতেন। কারও কারও মুখের কাছে পান খাওয়া মুখটা নিয়ে পিক ছিটিয়ে বলতেন, ‘আমার সাথে অমত যার,তার উতখাত না হয় মুন্ডু চাই! হা হা হা......। ’ সে লোকটা কড়া জামাত শিবির পন্থী ছিলেন আর ক্লাসে সারাক্ষন ওসব পেচালই পাড়তেন। আমরা যার যার কাজে ব্যস্ত থাকতাম,তাকে পাত্তা দিতাম না। তবে মাঝে মাঝে জোড় করে গিফট নিতেন।

যেমন উনার কলমের কালি শেষ হয়ে গেলে সামনের বেঞ্ছের ছাত্রটিকে বলতেন,’বাহ,তোমার কলমটি সুন্দর তো। আমাকে গিফট দাও। ’ ছাত্রটিও কথা না বড়িয়ে দান করে দিত। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। আমার বাবা এর কিছুদিন আগেই পরলোক গমন করেন।

নানা কারনে বেশ কষ্টের মাঝে যাচ্ছিলাম। তো এই লোকটি একদিন ক্লাসে লেকচার শুরু করলেন,শিবিররা কখনও রগ কাটে না। আমাদের ক্লাসে রাজু আর রিয়াদ নামের দুজন ছিল আমার খুব কাছের ফ্রেন্ড। তারা স্যারের সাথে এসব নিয়ে চরম ঝগড়া করছিল । আমি গোবেচারা মানুষ।

কখনও ঝামেলায় যাইনি। বসে বসে শুনছিলাম। আমার পাশে বসা রাজুর সাথে তখন তুমুল বিতন্ডা হচ্ছে নুরুল ইসলামের। চিল্লাচিল্লির এক পর্যায়ে সে রাজুকে বলল, তুমি কখনও নিজের চোখে দেখেছ যে শিবির রগ কাটছে?? এদিকে আমি কি মনে করে বলে ফেললাম,ক্যান,আমার নানু বাড়ির এক লোকেরই তো সেদিন পায়ের রগ কেটে দিল!! এরপর যা ঘটল তা বলে বোঝাতে পারব না। নুরুল ইসলাম হাতের বেত দিয়ে চটাচট ৫-৬টা বেতের আঘাত করল আমার হাতে।

পুরা হিংস্র পশু। সারা ক্লাস স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষনের মাঝেই সে বুঝতে পারল ঘটনা বেগতিক। আমি ক্লাসে বেশ ভদ্র গোছের ছিলাম,ক্লাস ক্যাপ্টেনও ছিলাম তখন। ক্লাসের ছেলেপেলেরা এই ঘটনা মানতে পারছিল না।

অবস্থা দেখে সে আমাকে সহ সবাইকে বলে দিল যেন ঘটনা ফাস না হয়। আমি তীব্র জ্বরে পড়েছিলাম আর ঘটনা ফাস হয়েছিল । পুরা স্কুলে এ নিয়ে অনেক সোরগোল হয়েছে। যদিও নুরুল ইসলামের কিছুই হয়নি। আমার বাবা তখন বেচে থাকলে হয়ত ঘটনা অন্য রকম হত।

তবে নুরুল ইসলামের মত পশুদের কখনই ক্ষমা করব না। আমার সেই ছোট্ট মনে যে আঘাত সে হেনেছে,তা সবসময়ই থাকবে। মাঝে মাঝে মনে হয় স্কুলে গিয়ে তাকে বলে আসি, আপনাদের হাতে বেত থাকতেই এর এত মহান ব্যাবহার। আর ছুরি থাকলে রগ কাটবেন না তো কি করবেন? ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.