আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বয়ং জননী (২-য় ভাগ)



--হ্যালো? আপনি শুনছেন তো? বিদিশা যেন নাড়া দিল বেদান্তকে। চমকে উঠে বেদান্ত বলল-- --ও ইয়েস! আমি শুনছি। --আমার বাবার হোটেল, গেস্টহাউস, রিসর্টের ওয়ার্লডওয়াইড ব্যবসা আছে। ইয়ারলি কয়েক কোটি টাকা ট্যাক্স দেন উনি। ফেয়ারলি মিনিমাম তিনগুণ বেশি ট্যাক্স দেওয়া উচিত বলে আমার ধারণা।

কিন্তু ব্যবসা ফেয়ারলি হয় না। হলে পলিটিসিয়ানরা খাবে কি---তাই না? --ঠিক জানি না। আমি তো স্রেফ কলম চিনি-- --আপনিও ব্যবসা চিনলে আপনাকে আমি কোনোদিনই ফোন করতাম না। --কিন্তু আসল ব্যাপারটা তো এখনও-- --দেখা করার আগে মিনিমাম যেটুকু ইনফরমেশন আপনার প্রয়োজন আমি তাই দিচ্ছি। আমি বিবাহিতা।

আমার কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ। ব্যাপারটা সাক্ষাতে বুঝিয়ে বলব। --এখন, প্লিজ বলবেন, কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে চান? --দেখা হলেই বলব। দয়া করে রাজি হয়েছেন বলে আমি সত্যিই ভীষণ কৃতজ্ঞ বোধ করছি। শেষের দিকে বিদিশার গলা বিস্ময়করভাবেই কোমল খাদে নেমে এল।

--বলুন কোথায় দেখা হতে পারে? --কলকাতা থেকে ঠিক ষাট কিলোমিটার দূরে হাইওয়ে থেকে চার কিলোমিটার ভেতরে গঙ্গার ধারেই আমাদের 'ড্রিম এয়ার' গেস্ট হাউসেই দেখা হতে পারে। --কলকাতা থেকে এত দূরে! কিন্তু আমার সময় নিয়ে খুব প্রবলেম হয়-- --সময় একদিন বের করে নিন। সন্ধ্যার আগেই আপনি পৌঁছে যাবেন। রাত্রে থাকার কোনো সমস্যা হবে না। সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে কলকাতায় ফিরবেন।

--কিন্তু আমার নিজের গাড়ি নেই। অফিসের গাড়ি নিয়ে তো-- --কবে যাবেন? --কালই যাওয়া যায়। যদি অবশ্য আপনার অসুবিধে না হয়। ব্যাপারটার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দেরি করতে চাইল না বেদান্ত। --কাল ঠিক বিকেল চারটেয় আপনার আবাসনের কম্পাউণ্ডে গাড়ি পৌঁছে যাবে।

আমি অবশ্য সকালেই গেস্ট হাউসে চলে যাব। --ঠিক আছে। তাহলে বিকেল চারটে! আজই অফিসে জানিয়ে দিতে হবে। কফিতে চুমুক দিতে গিয়ে বেদান্ত দেখল কফি বরফ হয়ে গেছে প্রায়। নতুন করে আর কফি বানাতে ইচ্ছে হল না।

ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বেরিয়ে কফিহাউসে জমিয়ে এক কাপ ব্ল্যাক কফি পান করেই অফিসে ঢুকবে। বিদিশা নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বেদান্তর শিরদাঁড়া টান টান হয়ে উঠেছিল। কণ্ঠস্বরের একটা প্রভাব তো ছিলই, তার সঙ্গে নামটা মিলেমিশে বেদান্তকে প্রায় বিবশ করে তুলেছিল। 'বিদিশার নেশা' ব্যাপারটা যে নিতান্তই কবির দীর্ঘশ্বাসে উষ্ণ কাব্যমাত্র নয় সেটা যেন বিদিশাকে না দেখেই টের পেল বেদান্ত। মানুষের জীবনের ভাঁজে ভাঁজে কত যে আকস্মিক বিস্ময় লুকিয়ে থাকে কে জানে! বেদান্ত ভেবে পাচ্ছে না বিদিশা তার চেহারার ডিটেইলস্ বর্ণনা সংক্ষেপে কিন্তু স্পষ্ট করে জানালো কেন? ওর উদ্দেশ্যটা কি? কিছুতেই অনুমান করতে পারছে না বেদান্ত।

বহু মেয়েই ওর বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে এসেছে। 'ওকে না পেলে বাঁচব না' গোছের দুরন্ত প্রেমিকাও কম আসে নি। সবাই এখন দিব্যি ছেলে-পুলে নিয়ে বেঁচে-বর্তে ঘরসংসার করছে। দু-একজন এখনও অবশ্য বেদান্তর ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহী। কিন্তু এদের সঙ্গে বিদিশাকে মেলানো যাচ্ছে না।

কোথায় যেন একটা বড় রকমের পার্থক্য রয়ে গেছে। বিদিশা যে প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয়ী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্না সেটা ওর কথা বলার স্মার্ট ধরণ থেকেই বোঝা গেছে। বেদান্ত এখন নি:সন্দেহে ভেবে নিল বিদিশা সুন্দরীও বটে! মাঝ সেপ্টম্বরের বিকেল। আকাশে একটুও মেঘ নেই। সারাদিন আগুনঝরা রোদের কারণে বেশ গরম ছিল।

ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক চারটের সময় বিদিশার গাড়ি এসেছিল। বাতানুকূল কন্টেসা! পাঁচটা পনের মিনিটের মধ্যেই 'ড্রিম এয়ার' গেস্টহাউসের বিশাল লনের মধ্যে গাড়ি ঢুকে গেল। গাড়ির ভেতরের ঠাণ্ডায় একটু ঘুম ঘুম ভাব এসে গিয়েছিল। গাড়ি থেকে সবুজ ঘাসের নরম কার্পেটে পা রাখতেই একটু উষ্ণ বাতাসের ঝাপ্টায় গা শির-শির করে উঠল বেদান্তর। চশমার কাচটা ঝাপসা হয়ে গেল কয়েকবার।

গাড়ির ভেতরের ঠাণ্ডার সঙ্গে বাইরের গরম মিলেমিশে এরকমই হয়। সূর্য পশ্চিমে অনেকটাই বড় হয়ে ঢলে পড়েছে। পশ্চিমের আকাশে সোনালি-কমলা রঙ গাঢ় হচ্ছে। সামনেই গঙ্গা। বিশাল ভরাট নদীর বুকে দু-একটা মাছধরা নৌকাও দেখা যাচ্ছে।

গোটা লন জুড়ে প্রচুর দেশি-বিদেশি গাছ লাগানো হয়েছে যত্ন করে। নানান কায়দায় ছেঁটে শিল্পের চেহারা দেওয়া হয়েছে। ছোট-বড় অজস্র পাথর রঙ করে চারিদিকে শিল্পসম্মতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। গোটা দশেক সিমেন্টের ছাতার নীচে পাতা চেয়ারে বসে কয়েকজন আহ্লাদীমার্কা নারী ও নাদুসনুদুস মার্কা পুরুষ নিচু গলায় কথা বলছে। গেস্ট হাউসটাও ছবির মতোই সুন্দর একটা মন্দির-মন্দির ভাব আনা হয়েছে গঠনশৈলির মধ্যে।

বেদান্ত কি করবে ভাবতে ভাবতেই একজন বেয়ারা এসে গেস্টহাউসের ব্যালকনিতে ওকে নিয়ে যেতে চাইল। ঘাড় ঘুরিয়ে সুন্দর রেলিঙ ঘেরা দোতলার ব্যালকনির দিকে তাকাল বেদান্ত। ওখানে কেউ নেই। বেদান্ত ভাবল ওখানে বসে গঙ্গার দৃশ্য দেখতে দেখতে বিকেল থেকে সন্ধ্যায় গড়িয়ে যাওয়া সময়টুকু বেশ উপভোগ করা যাবে। বেদান্ত আপত্তি করল না।

একটা বেতের চেয়ারে গুছিয়ে বসল। এখন আর তত গরম লাগছে না। গঙ্গার দিক থেকে ভেসে আসা হাল্কা হাওয়ায় সামান্য শীতলভাব টের পাওয়া যাচ্ছে। গাঢ় সোনালি-কমলা আকাশের বুকে মাঝে মাঝেই মালার মতো এক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে। ওদের উড়ে যাওয়ার মধ্যে এক অদ্ভুত ছন্দোময় জ্যামিতি লক্ষ্য করে বেদান্ত অবাক হয়ে গেল।

সময় সমতা এবং দুরন্ত সচেতনতা ওই পাখিগুলোর ওড়ার মধ্যে এত নিঁখুতভাবে এল কি করে? বিশ-পঁচিশজন মানুষ চেষ্টা করলে কি ঠিক এইভাবে পারবে? --রাস্তায় কোনো কষ্ট হয় নি তো? চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে একেবারে পাথর হয়ে গেল বেদান্ত। নি:শব্দে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বিদিশা! মাঝখানে যন্ত্র না থাকলেও এ কণ্ঠস্বর চিনতে ভুল হয়নি বেদান্ত'র। ....কি বলবে বিদিশাকে? স্রেফ সুন্দরী? কিংবা সুন্দরের শেষমাত্রায় গিয়ে বলবে সুপার্ব! বাস্তবিকই চোখের সামনে এমন অবিশ্বাস্য রূপ বেদান্ত এর আগে সিনেমার পর্দাতেও দেখেনি। গায়ের রঙ বিদিশা বলেছিল গোল্ডেন-ইয়েলো.....মানে সোনালি-হলুদ। একেই বোধহয় যথার্থ চাঁপার বরণ বলে।

গাঢ় নীল রঙের একটা শাড়িতে বিদিশার গায়ের রঙটাই একটা অদ্ভুত বর্ণবিভার সৃষ্টি করেছে। শাড়ির পাড়ে সাদা সুতোর এমব্রয়ডারি নকশা। শাড়ির রঙের সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ। কানের রিং-এর সঙ্গে ঝুলছে দু'টি করে উজ্জ্বল নীল পাথর। নীলকান্তমণি সম্ভবত।

তুলিতে টানা দুই ভ্রূ'র মাঝখানে সূর্যোদয়ের মতো উজ্জ্বল লাল বড় টিপটাও দেখতে হয় বড় বিস্ময়ে। ছোট ছোট হীরে দিয়ে গাঁথা একটা ছোট হার মরাল গ্রীবাকে ঘিরে জ্বল জ্বল করছে। একটু নীচে জোড়া স্থলপদ্মের ঠিক মাঝখানে হারের লকেটে আঁটা চুনি পাথরের তীব্র লালের দিকে বারে বারেই দৃষ্টি আটকে যাচ্ছে বেদান্ত'র। একরাশ ঘন কালো চুল খুলেই রেখেছে পিঠের ওপর। ভেনাসের নাকের মতো টিকালো নাকে ছোট্ট একটা হীরের নাকছাবি।

ঠোঁটে ন্যাচারাল কালারের লিপস্টিকের হাল্কা প্রলেপ দিয়েছে। উগ্র প্রসাধন কিংবা চড়া মেকআপের চিহ্ন নেই কোথাও। অথচ কি ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য ওর শরীর থেকে ঠিকরে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। বেদান্ত টের পেল তৃষ্ণায় ওর বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। গলা শুকিয়ে কাঠ।

(আবার আগামীকাল)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.