আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উপমা



হ্যালো বমমা! তুমি আসোনি কেন? অন্যদিনের চেয়ে আজ মোবাইলে একটু আস্তে আস্তে কথা বলছে উপমা। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা বমমা, বলো তো তোমার সাথে টেলিফোনে এত আস্তে কথা বলছি কেন? আমার একমাত্র ভাগ্নি অর্থাৎ বড়'পার মেয়ে উপমা আমাকে বমমা বলে ডাকে। পাঁচ বছরের উপমার এমন প্রশ্ন শুনে কোনো জবাব খুঁজে পাচ্ছিলামনা। এমনিতেই উপমার কথা-বার্তা, আচরণ একজন পরিণত মানুষের মতো। যখনই টেলিফোনে কথা হয় অথবা দেখা হয়, তখনই প্রশ্ন বাণে বিদ্ধ হতে হয় আমাকে।

শুধু আমি কেন, ওর মা-বাবা এবং দিদা, সবাই ওর অত্যাচারে অতিষ্ঠ, ওর অবান্তর প্রশ্নের কারণে ওর ওপর বিরক্ত। অবশ্য উপমাকে ভীষণ আদরও করেন সবাই। এই মুহূর্তে কেন সে আস্তে কথা বলছে, তাতো এপাশ থেকে আমার জানার কথা না। তবুও একটা কিছু বলতে হয় ভেবে বললাম, 'তোমার মামনি নিশ্চয় পড়তে বলেছিলো, কিন্তু তুমি তা না করে আমার সাথে কথা বলছো, রাইট?' 'উমহু.. নট রাইট বমমা'। মুনি তো এখন বাবুনি'র সাথে শপিং এ গেছে।

আমার না খুউব জ্বর। ১০৪ ডিগ্রী। বিশ্বাস না হয় কপালে হাত দিয়ে দেখইনা! ফোনে ওর কপালে হাত রাখতে না পারলেও আপাতত ঘুষ হিসেবে নতুন জামা এবং মিমি চকলেট দেয়ার কথা বলে এবং কিছুটা সান্তনা দিয়ে ফোন রেখে দিলাম। উপমার বয়স পাঁচ বছরের হলে কি হবে। ওর বুদ্ধি সুদ্ধি, কথা-বার্তা, চলন-বলন সবই বড়দের মতো।

পাশের বাসার শিমুলের আজ বিয়ে। চারিদিকে হই হুল্লোর, উৎসব মুখোর সাজ সাজ ভাব। বুঝে না বুঝে উপমা ও সবার সাথে তাল মিলিয়ে লাফালাফি, নাচা-নাচি শুরু করে দিলো। বউ সেজে শিমুল বসে আছে, বান্ধবীরা ওকে ঘিরে আছে আর টিপ্পনি কাটছে। বর আসবে আসবে অবস্থা।

স্বাভাবিক ভাবে বড়'পাও ব্যস্ত। এত ব্যস্ততার মাঝেই উপমা গিয়ে বড়'পাকে জিজ্ঞেস করলো, 'আচ্ছা মুনি, শিমুল আন্টির আজ কি হয়েছে বলো তো? আন্টি এতো সেজেছে কেন? ওকে এতো সুন্দর লাগছে কেন আজ?' এতো এতো প্রশ্নের ঝড়ে ওর মামনি খুবই বিরক্ত। 'আজ তোমার শিমুল আন্টির বিয়ে, সে জন্যই ও এতো সুন্দর করে বউ সেজেছে। ' ব্যস হয়ে গেল। ওর হাজারো বায়নার কাছে সব সময়ই পরাজিত হতে হয় সবাইকে।

মামনির কাছে এক অদ্ভূদ এবং অসম্ভব আবদার করে বসলো। 'আমাকে বিয়ে দিচ্ছনা কেন, মুনি। আমিও বউ হবো। মুনি তুমি আমাকে বউ সাজিয়ে দাও। না এক্ষুনি দাও।

আচ্ছা মুনি, শিমুল আন্টির মতো তুমি বউ সাজোনি? তোমার বিয়ে হয়নি? তোমার বিয়ের সময় আমাকে বলোনি কেন?'। ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন বাণে বিদ্ধ হয়ে অবশেষে উপমাকে বউ সাজিয়ে তবেই তাকে শান্ত করা গেলো। উপমা এমনই চঞ্চল এবং অশান্ত প্রকৃতির মেয়ে, মুহূর্তেই সব কিছু লন্ড ভন্ড করে ফেলে। ড্রয়ইং রুমের জিনিস পত্র বেডরুমে, আবার বেড রুমের জিসিসপত্র বারান্দায় অথবা কিচেনে, ইত্যাদি তার নিত্যদিনের হোম ওয়ার্ক। ওর পেছনে লেগে থাকতে হয় চার চারটি মানুষের।

ওর মামণি, বাবা, দিদা এবং কাজের মেয়ে পারুল সর্বদাই ওর উলোট পালোট করা জিনিস পত্র গোছানো কাজে ব্যস্ত। তবে বাড়িতে কোন নতুন অতিথি এলে অথবা ওকে নিয়ে অন্য কোথাও বেড়াতে গেলে; ওর মতো শান্ত মেয়ে যেন আর একটিও নেই। তখন কার সাধ্য আছে যে ওর মামণির কোল থেকে একটু আলাদা করে। ওকে নিয়ে একদিন বড়'পার বান্ধবী রূপালী'পুর বাসায় গেছে বেড়াতে। ওদের পেয়ে আনন্দে রূপালী'পু তো লম্প-জম্প দেয়ার মতো অবস্থা।

'কতোদিন পর এলি। কেমন আছিস? তোর বর কেমন আছেরে? ওকে নিয়ে এলেই তো পারতিস। ওমা তোর মেয়ে? অনেক বড় হয়ে গেছেতো বুড়ি। বাহঃ ভারী মিষ্টি হয়েছে দেখতে। তা কি নাম তোমার মা?' 'উপমা'।

খুবই অস্পষ্ট ভাবে জবাব এলো। 'ওমা, বেশ লাজুক তো তোর মেয়ে! লক্ষী মেয়ে, খু-উ-ব শান্ত। তোরা বোস, আমি তোদের জন্য নাশতার ব্যবস্থা করে আসি'। রুপালী'পু অন্য রুমে চলে গেল। পাশের রুম থেকে টুং টাং শব্দ আসছিল।

এবার উপমা ওর মামনির কোল থেকে আলাদা হয়ে বিজ্ঞ লোকের মতো সারা ড্রয়ইং রুমের জিনিস পত্র দেখছিলো। বড়'পার কাছে যেয়ে চোখ দুটো কপালে তুলে, ব্রু দুটো নাচিয়ে দুষ্টুমী ভরা হাসিতে মাকে বলল, 'মুনি, আমি নাকি লক্ষ্মী মেয়ে। আমি নাকি খু-উ-ব শান্ত। হি হি হি... ' এর পর থেকে সত্যি সত্যি উপমা শান্ত হতে লাগলো। আগের মতো আর জিনিসপত্র উলোট পালোট করেনা, এ রুমের জিনিস ও রুমে সরায়না।

বরং অন্য কেউ আগোছালো করলে নিজেই গুছিয়ে রেখে দেয়। ক্রমে ক্রমে নিজের ভেতর থেকে অন্য রকম শক্তি অনুভব করে সে। সারাক্ষণ কি যেন ভাবে গালে হাত দিয়ে। অবস্থা এমন হয় যে, উপমা যা কিছু ভাবছে, কাকতালীয়ভাবে তা-ই ঘটে যাচ্ছে। অথবা যা কিছু ঘটবে তার চারপাশে, পরিচিত জনদের ঘিরে, সবকিছু যেন সে আগে ভাগে টের পেয়ে যাচ্ছে।

একদিন ওর বাবা অফিসে যেতে প্রস্তুত। বাসার সামনে থেকে অফিসের মাইক্রো হর্ণ বাজাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে বাঁধ সাধলো উপমা। কিছুতেই বাবাকে অফিসে যেতে দিবেনা। কেন যেতে দিবেনা, তাও বলছেনা। শুধু ওর বাবার কাছে গিয়ে বললো, 'বাবুনি, কতোদিন আমাকে আদর করোনা, কোলে তুলে নাওনা।

আজ আর অফিসে যেয়ে কাজ নেই, আজ সারাদিন আমাকে কোলে নিয়ে বসে থাকবে। কোথাও যেতে পারবেনা। আমার সাথে খেলবে, খাবে আর আমাকে বাথ করিয়ে দেবে। আচ্ছা বাবুনি, তুমি আমাকে আগের মতো বেড়াতে নিয়ে যাওনা কেনো? মুনিও কোথাও নিয়ে যায়না। আমাকে তোমরা কেউ আদর করোনা।

আমাকে শুধু বমমা আদর করে'। ওর বাবা ওকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলে, 'তোমার বড়মামা তো আমার মতো অত বিজি না। অনেক সময় পায়। আর আমিতো অফিসে অনেক বিজি থাকি মা! ঠিক আছে নেক্সট ফ্রাইডেতে তোমাকে নন্দনে নিয়ে যাবোই। আজ আমাকে ছেড়ে দাও মা'।

এবার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। বাধ্য হয়ে মেয়ের ইচ্ছের কাছেই হার মানতে হলো মুস্তাফিজকে। মাইক্রো চলে গেল। ঠিক ত্রিশ মিনিট পর খবর এলো অফিস মাইক্রোটি দুর্ঘটনায় পতিত। চালকসহ ৫ জন গুরুতর আহত।

আরেক দিনের ঘটনা। সকালের নাশতার সময় বড়'পা দেখলো ডিম নেই। তাই পারুল কে দোকানে পাঠাতে হচ্ছে; কিন্তু কিছুতেই তাকে দোকানে যেতে দিচ্ছেনা উপমা। একটু বাড়াবাড়ি মনে করে সবাই ওর উপর বিরক্ত। বাসার কাছেই দোকান, যাবে আর আসবে।

তা ছাড়া পারুলকে তো মাঝে-মধ্যে দোকানে যেতেই হয়। তখন তো উপমা এভাবে বাঁধা দেয়নি। আজ কেন? তাছাড়া ওর বাবারও অফিসে যেতে দেরী হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং উপমার কথা গ্রাহ্য না করেই পারুলকে দোকানে পাঠাতে হলো। মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে পারুল অবশ্যই ফিরে আসবে।

কিন্তু দশ মিনিট, বিশ মিনিট, ত্রিশ মিনিট পার হয়ে গেল; পারুল আর ফিরে এলোনা। নাশতা না করেই দুঃশ্চিন্তা গ্রস্থ হয়ে মুস্তাফিজ অফিসে চলে গেল। এমনি করে এক ঘন্টা দুই ঘন্টা করে করে সারাদিন পার হলো, কিন্তু পারুল আর এলোনা। সন্ধ্যার পর সবাই মিলে মিটিং, সিটিং এবং শলা পরামর্শ করলো; কিন্তু কোন কাজ হলোনা। পরিচিত সব জায়গা, থানা এবং হাসপাতাল গুলোতে ফোন করা হলো।

এদিকে সবার অগোচরে উপমা ইজি চেয়ারে চোখ বন্ধ করে কি যেন ভাবছে। হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠলো উপমা, 'পারুকে মারছে, ওরা পারুকে মারছে। মুনি , বাবুনি, ওরা পারুকে ব্যথা দিচ্ছে। চোখ-মুখ বেঁধে নিয়েছে। মুনি, পারু খুব কষ্ট পাচ্ছে।

' এতোক্ষণে সবাই উপমাকে ঘিরে। সবাই যেন কোরাসে বলে উঠলো- কারা মারছে, কেন মারছে? ওরা কারা? আমি কাউকে চিনতে পারছিনা। শুধু মিমি আংকেল... বলেই অজ্ঞান হয়ে পড়লো। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে ওকে স্বাভাবিক করে তুললো। এবার সবার টার্গেট 'মিমি আংকেল'।

কে এই মিমি আংকেল? হঠাৎ মনে পড়লো বড়'পার। মোড়ের দোকানী বশির মিঞার দোকান থেকে মিমি চকলেট কেনে বলে বশির মিঞাকে উপমা মিমি আংকেল বলে ডাকে। কিন্তু বশির মিঞা তো ভালো লোক, ওর দ্বারা কি করে এই কাজ সম্ভব? এতো কিছু ভাবনার সময় নেই এখন। পারুল কে উদ্ধার করতে হবে। এরি মধ্যে পুলিশ ও চলে এসেছে।

সবাই মিলে বশির মিঞার দোকান ঘিরে ফেলেছে। দোকানে বসা একটি ছেলে। তার কাছ থেকে বশির মিঞা সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। দোকানের পিছনে লাগোয়া একটি রুমে বশির মিঞা থাকতো। সেখান থেকে গোঙানীর শব্দ আসছে।

তারপর হাতে নাতে বশির মিঞা সহ আরো ৪ সহযোগী গ্রেফতার। পারুল ততক্ষণে বড়'পার বুকে লুটিয়ে পড়ে অঝোরে কান্না। আর দুষ্টমী মাখা হাসি হাসছে উপমা। (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।