আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাধু প্যাট্রিক

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

খ্রিস্টধর্মের যে ক’জন সাধুসন্তকে খ্রিস্টানরা অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে সাধু প্যাট্রিক তাদের মধ্যে অন্যতম। মনে করা হয় যে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের শেষের দিকে সাধু প্যাট্রিক-এর জন্ম ব্রিটেনে। একটা সূত্রেমতে সাধু প্যাট্রিক-এর জন্ম স্কটল্যান্ড।

যা হোক। ধনী খ্রিস্টান পরিবারেই জন্ম হয়েছিল প্যাট্রিকের। ছেলেবেলা সম্বন্ধে তেমন জানা যায় না। তবে প্যাট্রিকের পরিবারে খ্রিস্টধর্মের চর্চা ছিল। বালক প্যাট্রিকও সম্ভবত মন দিয়েই বাইবেলের কাহিনী শুনত, যিশুর আরাধনা করত।

বলেছি, প্যাট্রিকরা ছিল ধনাঢ্য পরিবার। ধনসম্পদ থাকলে যা হয়-আইরিশ দস্যুরা প্যাট্রিকদের জমিদারী আক্রমন করে বসল। প্যাট্রিক-এর তখন ১৬ বছর বয়েস। আইরিশ দস্যুরা কী মনে করে প্যাট্রিককে প্রাণে না মেরে বন্দি করে আয়ারল্যান্ড নিয়ে যায়। ৬ বছরের মতো আয়ারল্যান্ডে বন্দি জীবন কেটেছিল প্যাট্রিক-এর।

কিন্তু আয়ারল্যান্ডের ঠিক কোথায় বন্দি ছিলেন প্যাট্রিক? এ নিয়ে বিতর্ক আছে। কারও কারও মতে অ্যানট্রিম প্রদেশের স্লেমিশ পাহাড়ে বন্দি ছিলেন প্যাট্রিক। কারও কারও মতে মায়ো প্রদেশের কিললালা। শব্দগুলি আমাদের কাছে অপরিচিত ঠেকলেও অ্যানট্রিম প্রদেশ, স্লেমিশ পাহাড়, মায়ো প্রদেশ, কিললালা-এ সবই আয়ারল্যান্ডের জায়গার নাম। বন্দি জীবনে মেষ পালক ছিলেন প্যাট্রিক।

আর কে না জানে এ জগতে মেষপালকের হৃদয়ই সবচে পবিত্র হৃদয়। এ জগতের আলোকপ্রাপ্ত মানুষের অনেকেই ছিলেন মেষপালক; ছিলেন রাখাল। একা নিঃসঙ্গ জীবন ছিল প্যাট্রিকের। মানুষ থেকে দূরে নির্জন এক প্রান্তরের এক মেষপালক। তখন কত কিছু যে ভেবেছিলেন প্যাট্রিক।

জীবনমৃত্যুর মানে। আলেছায়ার মানে। দৃশ্যের আড়লের দৃশ্যের মানে। সময় বহিয় যায়। তারও ক্ষীন শব্দ শোনা যেত যেন।

হায়, কী এই জীবনের মানে? যদি জানা যেত। কেন এই মানবজন্ম? কেন এত দুঃখ? প্যাট্রিক-এর মনে ছিল দারুন কষ্ট । মা বাবা ভাই বোনের কি হল। এই ভাবনা তাকে তিলে তিলে দগ্ধ করছিল। হায়! কী সুন্দর জীবন ছিল।

স্বচ্ছল। স্বচ্ছল ও সুখি। এক রাতের ঝড়ে সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। ঈশ্বরের উপর তবু আস্থা হারায় নি প্যাট্রিক। ছেলেবেলায় খ্রিস্টধর্মের শিক্ষা পেয়েছিল।

দুঃখার্ত নিঃসঙ্গ জীবনে ঈশ্বর ও খ্রিস্টের আরাধনা করে কাটত। একরাতের কথা। তখন মাঝরাত। প্যাট্রিক ঘুমিয়ে। স্বপ্নে কে এসে যেন বলল, এদের আমায় পথে নিয়ে এস।

কে! মাঝরাতে মেঝেতে ঘুম ভেঙ্গে যায় প্যাট্রিক-এর। অন্ধকারে খরের গন্ধ । আর শীত। কাঠের ঘরের মেঝে দেওয়াল ভিজে আছে শিশিরে। দূরের স্লেমিশ পাহাড়ে আতংকিত নেকড়ের ডাক।

প্যাট্রিক উঠে বসে। কে এসেছিল আমার স্বপ্নে? তার প্রাণ ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তার গা ছমছম করে। সে নারীর মতো হু হু করে কাঁদে। আমাকে আলো ছড়াতে হবে।

যে আলোয় একদা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল বেথেলহেম- নারারথ। বন্দি জীবনে তো আলো ছড়ানো যায় না। তা হলে? পালানোর পথ খোঁজে প্যাট্রিক। সে পথ ঈশ্বর দেখালেন। অন্তরের ভিতর ফিসফিস করে বললেন, এখান থেকে পালানোর এখনই সময়।

মায়ো প্রদেশ থেকে উপকূলের দিকে ২০০ মাইল হাঁটল ২২ বছর বয়েসী প্যাট্রিক । উপকূলে বালিয়ারি, পাথর, সমুদ্র ও জাহাজ। জাহাজে উঠে কোনওমতে ব্রিটেনে ফিরা গেল। তারপর ব্রিটেনে থাকার সময়ই নাকি এক দেবদূত এসে বলল, তুমি আয়ারল্যান্ডে ফিরে যাও; সেখানে খ্রিস্টের বাণী প্রচার কর। প্যাট্রিক কী যেন ভাবল।

পৃথিবীতে আমার তো কেউ নেই। আমি আমৃত্যু খ্রিস্টবানীতে মগ্ন হই না কেন? এই সিদ্ধান্ত নিয়ে খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে আরম্ভ করলে। প্রায় ১৫ বছর ধরে চলল খ্রিস্টগবেষনা। তারপর যাজক-এর পদ লাভ করলেন প্যাট্রিক । যাজক-এর পদ লাভ করে আয়ারল্যান্ড যাত্রা করলেন।

এর আগেও একবার গিয়েছিলেন। তখন ছিলেন বন্দি। এখন যাজক। জীবন কি অদ্ভুত! সাধু প্যাট্রিক যখন আয়ারল্যান্ড পৌঁছলেন-তখনই নাকি আয়ারল্যান্ডে ক'ঘর খ্রিস্টান বাস করত। অবশ্য দ্বীপবাসীরা তখনও সবাই খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়নি।

দু’দলের কাছেই খ্রিস্টের বানী পৌঁছে দিতে লাগলেন সাধু প্যাট্রিক। যেহেতু আগে থেকেই আয়ারল্যান্ডে কিছু খ্রিস্টান ছিল- কাজেই তিনিই যে প্রথম আয়ারল্যান্ডে এককভাবে খিস্টধর্ম প্রচার করেছেন- এই দৃঢ়মূল বিশ্বাস সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠতেই পারে। যা হোক। সাধু প্যাট্রিক এর আগে তরুন বয়েসে বন্দি জীবনে প্রায় বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মেষপালকের জীবন কাটিয়েছেন। এবার তিনি আইরিশ রীতিনীতিতে অভ্যস্ত হতে লাগলেন।

আইরিশরা ছিল প্রকৃতিঘনিষ্ট মূর্তিপূজক ড্রুইড ধর্মের অনুসারী। তাদের ছিল অজস্র মৌখিক গাথা-উপকথা। সে সব আত্মস্থ করতে লাগলেন সাধু প্যাট্রিক। কাজেই সাধু প্যাট্রিক জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগলেন সাধারণ আইরিশদের মাঝে। যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা আইরিশ প্রথা অস্বীকার করে সাধু প্যাট্রিক সাধারণ আইরিশদের মনের ওপর বিজাতীয় মধ্যপ্রাচ্যের প্রথা চাপিয়ে দেন নি।

বরং ঈস্টার পালনের সময় বনে আগুন জ্বালালেন, যেহেতু বনে আগুন জ্বালিয়ে আইরিশরা তাদের ঈশ্বরের উপাসনা করত। সূর্য ছিল আইরিশ প্রিয় প্রতীক। ক্রশে সূর্য বসলেন সাধু প্যাট্রিক! একে বলে, "কেলটিক ক্রশ। " কাজেই আইরিশরা খ্রিস্টকে কিছুতেই দূরবর্তী অপর মনে করল না; মনে করল নিজেদের একজন-কাছের মানুষ। আর সেই কাছের মানুষের সে সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন একজন প্রিয় সাধু।

কাজেই, আমৃত্যু আইরিশ জনগনের মাঝে তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন সাধু প্যাট্রিক । সাধু প্যাট্রিক-এর মৃত্যু ১৭ মার্চ ৪৬০ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর লেখা লাতিন ভাষায় দুখানি চিঠি পাওয়া গিয়েছে। এত ক্ষণ যা বলা হল, তা ঐ চিঠির উপর ভিত্তি করেই। শেষ করার আগে আরেকটি কথা।

বলা হয় যে, সাধু প্যাট্রিক আয়ারল্যান্ড থেকে সাপ তাড়িয়ে ছিলেন। আয়ারল্যান্ডে যে কারণে সাপ নেই। কী এর ব্যাখ্যা? আমরা বাস করি বিজ্ঞানের যুগে। ব্যাখ্যা বিজ্ঞনের আলোতেই হবে। (এক) তুষার যুগের পর থেকেই সাপ আয়ারল্যন্ডে ছিল না।

যে কারণে নিউজিল্যান্ডে নেই সাপ। (দুই) আইরিশ ড্রুইডদের প্রতীক ছিল সরীসৃপ বা সাপ। কাজেই আয়ারল্যান্ড থেকে সাধু প্যাট্রিক-এর সাপ তাড়ানোর মানে হল আয়ারল্যান্ড থেকে প্রকৃতিঘনিষ্ট মূর্তিপূজক ড্রুইড ধর্মের উচ্ছেদ করে খ্রিস্টধর্মের প্রচলন। যা হোক। আয়ারল্যান্ড থেকে সাপ তাড়ানোর কৃতিত্ব সাধু প্যাট্রিককে না দিতে পারলেও তিনি যে শুদ্ধাত্মা ছিলেন তা নিয়ে সন্দেহ তো নেই।

আর এটাই সবচে বড় কথা। তিনি প্রাচ্যের মরুময় অঞ্চলের একটি দয়াশীল মতবাদ ইউরোপের একটি শীতার্ত দ্বীপে প্রোথিত করেছিলেন। এটাই বড় কথা। সাধু প্যাট্রিক আজও দ্বীপ আয়ারল্যান্ডের রক্ষাকারী সাধু বা patron saint। এটাই বড় কথা।

সাধু প্যাট্রিক-এর সাপ সংক্রান্ত উপকথাটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা -- Click This Link সূত্র:

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.