আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আধ্যাত্মিক ইসলামের পথে মুসলিম বিশ্ব



সাধারণ মানুষ যুদ্ধ আর সহিংসতাবিরোধী, এই উপলব্ধি অবশেষে ইসলামী আলেমদের হয়েছে। সাম্প্রতিক ইসলামী আলেমদের শান্তিপূর্ণ নীতিকে কাপুরষতা বলে জঙ্গীবাদী ইসলামী সংগঠনগুলো ধিক্কার জানালেও পরিবর্তনের হাওয়া বইছে চারপাশে। বরং এই প্রেক্ষিতে অন্তত ধর্মীয় সংঘাত উস্কে দেওয়ার ধারাবাহিক প্ররোচনাকে চমৎকার ভাবে সামাল দিয়েছেন ইসলামী আলেমগণ। এটা খ্রীষ্টানদের কিছুটা হলেও নিজেদের আচরণের গলদ সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে, এখন সেখানেও এই প্রশ্নটা উত্থাপিত হচ্ছে, ইসলামের জঙ্গী পরিচয় তুলে ধরবার পেছনে ইসলামের ভেতরের অন্তর্নিহিত উগ্রতা এবং একই সাথে মিডিয়া প্ররোচনা কোনটা বেশি ভুমিকা রেখেছে। বিভিন্ন মুসলিম প্রধান দেশগুলোর প্রধান সমস্যা এখানকার বাসিন্দাদের অশিক্ষিত মনোভাব।

তারা সহজেই প্রভাবিত হয়, প্ররোচিত হয়। এবং হঠকারিতায় লিপ্ত হয়। মূলত এই উপলব্ধি জাগানোর দায়িত্ব স্থানীয় পর্যায়ের ধর্মবিশেষজ্ঞদের। এতদিন তারা এই দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছিলো কিংবা তারা উস্কানির জবাবে পাল্টা উস্কানি দিয়েছে কিংবা তারা এই বিষয়ে কোনো অবস্থান গ্রহন করেন নি, তাই ক্ষুদে কিন্তু উচ্চকিত অনগ্রসর মানুষেরা ইসলামের ধুঁয়া তুলে সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছে। সামগ্রীক ভাবে মুসলিমদের জঙ্গী মনোভাবসম্পন্ন একটি জনগোষ্ঠি হিসেবে চিহ্নিত করা সহজ হয়েছে পশ্চিমা ভাবধারা পরিচালিত সংবাদমাধ্যমগুলোতে।

মূলত নতুন পোপ বেনেডিক্ট ২০০৬ সালের এক অভিভাষণে যখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট জঙ্গীবাদিতার অভিযোগ তুললেন এরপরের প্রতিক্রিয়ায় অনেক বেশী সহিংস আচরণ ঘটেছে আপাত খ্রীষ্টান মুসলিম ঐক্যবদ্ধ দেশগুলোতে। লেবানন, যেখানে একটা সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের ভেতরে আনুপাতিক হিসেবে সবচেয়ে বেশী খ্রীষ্টানের বসবাস ছিলো এবং যারা বিভিন্ন ইস্যুতে এমনকি উগ্রপন্থী হেজবুল্লাহকে সমর্থন করেছিলো, পোপের উন্মাদ অনেতসুলভ বক্তৃতার প্রভাবে তাদের উপরে সহিংসতা বৃদ্ধি পায় এবং মধ্যপ্রাচ্যে খ্রীষ্টানের আনুপাতিক হার কমতে থাকে। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের খ্রীষ্টানরা দেশত্যাগ করছেন পোপের বক্তৃতার প্রতিক্রিয়ায় শুরু হওয়া উন্মাদনায়। প্যালেস্টাইন, পোপের বক্তৃতার পরে সহিংস হয়ে উঠে,সেখানে আগে যা ঘটে নি তেমন ঘটনাও ঘটে যায়, উন্মত্ত মুসলিমেরা চার্চে অগ্নি সংযোগ করে। অবশ্য এরপরে বেনেডিক্ট এই মতবিভেদ এবং এই বিরুপতা সামাল দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহন করেন, তাই খ্রীষ্টান- মুসলিমদের ভেতরে মতবিনিময় শুরু হয়।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে সৈদি আরবের বাদশাহ মক্কা বিজয়ের পরে সম্ভবত প্রথম একটি চার্চ স্থাপনের অনুমতি প্রদান করলেন প্রকাশ্যে। একই ভাবে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয়গুলো আয়েতুল্লাহ ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। উভয় ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর ভেতরে সভ্যতার প্রয়োজনেই সহনশীলতা প্রয়োজন এই উপলব্ধি ধারণ করে তিনি ইসলামী আলেম, মিডিয়া কর্মী এবং অন্যান্যদের এই সম্পর্কের টানাপোড়েন কমিয়ে আনবার উদ্যোগ গ্রহন করতে বলেছেন। প্ররোচনা অনেকগুলোই ছিলো, মুহাম্মদকে ব্যঙ্গ করে আঁকা কার্টুন প্রকাশ, জনৈক আফগানিস্তানের মুসলিমের খ্রীষ্টান হয়ে যাওয়ার খবরে উগ্রবাদী আলেমদের প্রদত্ত মৃত্যুদন্ডের ধিক্কার এবং এরই প্রতিক্রিয়ায় আরও বেশী বিশ্লেষনাত্মক ইসলামের অন্তর্নিহীত জঙ্গীবাদ উন্মোচনের প্রয়াস। এর প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম বিশ্বে চরম প্রতিক্রিয়া ঘটেছে।

ডেনিশ সংবাদপত্রের কার্টুন প্রকাশ করবার বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিক্রিয়ায় ডেনিশ দুতাবাসে অগ্নিসংযোগের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। মানুষ মৃত্যু বরণ করেছে। একই সাথে মধ্যপ্রাচ্যে খ্রীষ্টানদের সংখ্যা কমেছে । ইরাক যেখানে অন্তত ২০০৩ সালের আগে কোনো দিন ধর্মীয় পরিচয় মূখ্য হয়ে উঠেনি সেখানেও ইদানিং মানুষ ধর্মীয় বিবেচনায় চিহ্নিত হচ্ছে। সেখান থেকে পালিয়ে আসা এক যাজক বলেছেন সাদ্দামের সময়ে ইরাকের কোথাও ধর্মপালনে কোনো বাধা ছিলো না, বর্তমানে সেখানে এই বাধা সৃষ্টি হয়েছে।

মানুষ ধর্মীয় কারণে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হচ্ছে। ধর্মীয় বিভেদের কারণে মানুষকে খুন করা হচ্ছে। একই ঘটনা ঘটছে মিশরে, ঘটছে লেবাননে, ঘটছে প্যালেস্টাইনে। মূলত ইরাক, লেবানন, প্যালেস্টাইনের নির্বাসিত মানুষেরা অনেক বেশী ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের অধিকারী ছিলো, সেখানেও পোপ বেনেডিক্টের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ধর্মীয় সহিংসতা বেড়ে গিয়েছে। তবে ভুল এবং ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে মুসলিম আলেমেরা।

গত ২২শে মার্চ ঘটা করে মাগদী আল্লাম ধর্মান্তরিত হলেন ইতালীতে। তিনি প্রাক্তন মিশরীয় নাগরিক অনেক দিন ধরেই ইতালীতে বসবাস করছেন এবং সেখানের একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক, তিনি ব্যক্তিজীবনে ইসলামকে একটি পশ্চাতপদ সহিংস ধর্ম মনে করেন। তিনি ধর্মান্তরিত হওয়ার পরে বলেছেন তিনি শান্তির পথ খুঁজে পেয়েছেন। খ্রীষ্টান ধর্মের অন্তর্নিহীত সৌমতা তাকে আকৃষ্ট করেছে। অবশ্য মানুষের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা রয়েছে।

পোপ বেনেডিক্ট এই ব্যাপ্টিজমকে শুধুমাত্র ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রকাশ হিসেবে দেখতে চাইলেও, চুপিচুপি পুনরায় ধর্মে প্রবেশ করা টনি ব্লেয়ারের তুলনায় এই মাগদি আলমের ধর্মান্তরিত হওয়ার দৃশ্য প্রচারণার ব্যপক উদ্যোগ অন্য একটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আচরণ বিবেচিত হতেই পারে। ধর্মভিত্তিক উস্কানি প্রদানের লক্ষে যদি এমনটা করা হয়ে থাকে তবে এই উস্কানি খুব সফল ভাবেই মোকাবেলা করেছে ইসলামী আলেমগণ। তারা শুধুমাত্র এই আচরণকরে দুঃখজনক এবং যৌথসংলাপের ক্ষেত্রে সামান্য বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন এতটা সমারোহে এটা না করে সাধারণ পরিবেশে ঘটালে সেটা আরও সুন্দর আচরণ হতো। মাগদী আল্লাম নিজে ইসলামকে সহিংস মনে করেন, তবে তিনি খ্রীষ্টানদের সহনশীলতার প্রশংসা করে বলেন ইতালীতে যেখানে অনেক খ্রীষ্টানই ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হচ্ছেন, তাদের প্রতি কোনো উগ্রতা প্রকাশ করে নি খ্রীষ্টানেরা কিন্তু বিপরীতটাও সত্য- এখানে অনেক মুসলিম ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রীষ্টান হলেও তাদের উগ্র মুসলিমদের আক্রমনের আশংকায় প্রকাশ্যে ধর্ম পলানের সুযোগ নেই।

ইতালীর মুসলিম আলেমরা এই বক্তব্যের কঠোন জবাব দেন নি। সেটাই তাদের প্রাজ্ঞতার পরিচায়ক। একই ভাবে একজন হল্যান্ডের এমপি গ্রীট ওয়াইল্ডার যখন দাবি জানান কোরানকে নিষিদ্ধ ঘোষিত করা উচিত তখনও মুসলিম বিশ্বে তেমন উন্মাদন শুরু হয় নি। এ বিষয়ে তার জনসচেতনতামূলক ভিডিওটি কোনো প্রেক্ষাগৃহই প্রচারিত করতে চায় নি, অবশেষে ধর্মীয় বিভেদ উস্কে দেওয়া এই ছবিটি ইন্টারনেটে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়, সেখানে প্রথম ৩ ঘন্টায় প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ গেলেও হল্যান্ডের স্থানীয় মুসলিম আলেমরা এ বিষয়ে তেমন উগ্রতা প্রকাশ করেন নি। আমরা আয়েতুল্লাহ মোহাম্মদ হোসেইনের বক্তব্য বলতে পারি- পশ্চিমা বিশ্বের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিশ্বাসীদের সচেতন হতে হবে।

তাদের মুসলীম বিশ্বাসের অপরিহার্য এবং সম্মানিত বিষয়গুলোতে আঘাত হানা মুসলিম এবং পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি অনাস্থা উস্কে দেওয়ার একটি চক্রান্ত। পশ্চিমা বিশ্বে যেসব মুসলিম নিজস্ব ধর্ম পালন করছেন তাদের মুসলিম প্রধান বিশ্বের মুসলিমদের অবিবেচক আচরণ আরও বেশী জনবিচ্ছিন্ন করে দিতে পারে। আয়েতুল্লাহ মোহাম্মদ হোসেইনের এই অনুভব অনেকটাই সত্যের কাছাকাছি। তাই সত্যিকারের ধর্মীয় নেতার মতো তার ভেতরেও শোনা যায় ঐক্যের সুর, তিনি ঐক্যবদ্ধ মানবিক খ্রীষ্টান মুসলিম সংঘ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি চৎটকার করেই বলেন যদি ইসলামের শত্রুরা এইভাবে মুসলীম এবং পশ্চিমা বিশ্বের ভেতরে বিভেদ বাড়াতে চায়, তাদের উস্কানিতে উন্মত্ততা প্রকাশ না করে চুপচাপ ইসলামের শত্রুদের খেলা দেখে যাও।

বর্তমানের এই মুসলিম শান্তিপ্রিয়তা চমৎকার একটি অনুভুতি জাগালো। হয়তো সহিংস ইসলামের পথ অতিক্রম করে মুসলিম বিশ্ব শান্তিপূর্ণ আধ্যাত্মিক ইসলামের পথে ধাবিত হচ্ছে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.