আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নর্থ হলিউড শুটআউট: বাস্তব থ্রিলার



ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলটা আমার বেশ পছন্দের। টিভি দেখতে বসলেই চক্রের মত রিমোট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে যে যে কয়েকটা চ্যানেলে একটু বিশ্রাম নিই তার মাঝে এটা একটা (বাকি চ্যানেলগুলার মাঝে কার্টুনের আর ডিজনি চ্যানেলটা বড় সময় দখল করে রাখে)। বাস্তব ফুটেজের সাথে নিজেদের বানানো কিছু ফুটেজ মিলিয়ে অসাধারণ কিছু ডকুমেন্টারি বানায় এরা,দেখার মতই। সেদিন অলসভাবে ঘুরছিলাম,হঠাৎ গোলাগুলি টাইপ কিছু একটা দেখাচ্ছে দেখে আটকে গেলাম,দেশে অনেকদিন পুলিশি হইহল্লা কাঁদানে গ্যাস পিকেটারের হইচই নেই,টিভিটাই পানসে মেরে গেছে,যাহ ন্যাট জিওতেই দেখি। আর দেখতে গিয়েই আটকে গেলাম, ঝাড়া একঘণ্টার জন্য,তাই মনে হল,ব্লগারদের জন্যও শেয়ার করি ডকুমেন্টারিটার সারসংক্ষেপ।

ঘটনার সূত্রপাত অনেক আগে,১৯৮৯ সালে,যখন ল্যারি ফিলিপ জুনিয়র আর এমিল ম্যাটসেরেনু'র দেখা হল প্রথম একটা জিম এ। দেখা হবার কিছুদিনের মাঝেই দু'জনের বেশ খাতির জমে গেল,আর দেখা গেল দু'জনেরই আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আর অপরাধের দিকে সমান আগ্রহ। ছোটখাট নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়লো এই মানিকজোড়,আর পুলিশের হাতে ধরাও পড়ে গেল একবার ১৯৯৩ সালের দিকে। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, দু'টো সেমি-অটোমেটিক রাইফেল,দু'টো হ্যান্ডগান,১৬০০ রাউন্ড রাইফেল বুলেট,১২০০ রাউন্ড হ্যান্ডগান বুলেট,বডি আরমার,পুলিশ রেডিও স্ক্যানার আর ৩টা ভুয়া লাইসেন্স প্লেট সহ ধরা পড়েও আমেরিকার অদ্ভুত আইনের মারপ্যাঁচে কিভাবে যেন মাত্র ১০০ দিনের জেল আর ৩ বছরের প্রোবেশনে ছাড়া পেয়ে গেল দু'জনই। ছাড়া পেয়ে সেটা কাজেও লাগাল,সিদ্ধান্তটায় যে গলদ ছিল সেটা প্রমাণ করে দিল দুই বছরের মাঝে ৩টা ব্যাংক ডাকাতি করে,লুট করল প্রায় ২ মিলিয়ন ডলারের মত।

কিন্তু এগুলো ছিল প্রস্তুতি মাত্র। আসল কাজে হাত দেয়ার আগে দু'জনের প্রস্তুতি যেকোন হলিউড থ্রিলারকেও হার মানায়। মূল লক্ষ্য হিসেবে তারা স্থির করল লস এন্ঞ্জেলসের লরেল ক্যানিয়ন বুলভার্ডে ব্যাংক অভ আমেরিকার শাখাটিকে। মাসের পর মাস চলল রেকি,একি সাথে চলল অস্ত্রসজ্জা। ল্যারির ছিল এ ব্যাপারে নেশা,নিজের অস্ত্র কিনে নিজেই সেটাকে কাটছাঁট করে পছন্দসই রূপ দেয়া।

চাইনিজ একে-৪৭ এর সাথে যুক্ত করা হল বিশেষ ধরণের ড্রাম ম্যাগজিন,বেশি বুলেট ধরার জন্য। সাথে নিল আরো দু'টো ফুল অটোমেটিক রাইফেল,একটা ছিল হেকলার অ্যান্ড কচ ৪১,আরেকটা এআর-১৫। ছিল দু'টো বেরেটা অটোমেটিক আর ১টা পয়েন্ট ৩৮ রিভলবার,আর ৩৩০০ রাউন্ড বুলেট। কিন্তু বড় চমকটা ছিল তাদের বডি আর্মার,'আরামিড' নামের বিশেষ সিনথেটিক ফাইবার দিয়ে বানানো,তার সাথে ছিল বিশেষ ধরণের সিরামিকের 'ট্রমা প্লেট',ভাইটাল অরগানগুলোকে বাঁচানোর জন্য। ফেব্রুয়ারি ২৮,১৯৯৭,আমেরিকার অপরাধ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গানফাইটের সূত্রপাত হল।

দুই ডাকাত তাদের গাড়ি থেকে ব্যাংকের সামনে নামলো ৯ টা ১৭ মিনিটে,ঘড়িতে ৮ মিনিট সময় ঠিক করে,কারণ মাসাবধি পর্যবেক্ষণে জানা গিয়েছিল ব্যাংকে ডাকাতি শুরু করার পর পুলিশ পৌঁছাতে অন্তত এটুকু সময় লাগবেই। কিন্তু বিধি বাম,অনেকটা নিয়মের ব্যতিক্রম করেই ঠিক তখনি একটা পুলিশ পেট্রল কার অলসভাবে ব্যাংকের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল,আর কালো পোশাকে হাতে অটোমেটিক রাইফেলওয়ালা ২ ডাকাতকে দেখামাত্র তারা পুলিশ স্টেশনে সংকেত পাঠালো সম্ভাব্য ডাকাতির আশংকা জানিয়ে,আর নিজেরা তৎক্ষণাৎ পজিশন নিল ব্যাংকের বাইরে। ল্যারি আর এমিলের মাথায় অত কিছু নেই,তারা মোটামুটি নিশ্চিন্তেই ব্যাংকে ঢুকে গোলাগুলি করে ম্যানেজারের কাছ থেকে ভল্টের চাবি বাগিয়ে নিল,কিন্তু ভল্টে ঢুকে তাদের মেজাজ চরম খাপ্পা,মাত্র ৩ লাখ ডলার আছে। ঘটনা কি? ঘটনা হল,সেদিনকার ডেলিভারি ট্রাক আসতে দেরি হয়েছে,সেজন্য ভল্ট মোটামুটি খালি। যাহোক,যা পাওয়া গেল তা নিয়েই বের হল ২ ডাকাত,একজন দক্ষিনের দরজা দিয়ে,আরেকজন উত্তরের,কিন্তু বের হয়ে দেখল,অন্তত ডজনখানেক পুলিশের গাড়ি তাদের ঘিরে রেখেছে,পেট্রল কারের চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার ফল।

পুলিশের আত্মসমর্পণের আহ্বানে সাড়া দেবার প্রশ্নই আসেনা,এমন পরিস্থিতির জন্য তারা তৈরিই ছিল,অটোমেটিক রাইফেল থেকে গুলি করা শুরু করলো, এবং পুলিশ অফিসাররা,আতংকের সাথে আবিষ্কার করলেন,রাইফেলের বিশেষভাবে মডিফাই করা মেটাল জ্যাকেট বুলেটগুলো তাদের আড়াল করা পেট্রল কারের দরজা ভেদ করে তাদের দু'জনকে শুইয়ে দিয়েছে। অপারেশনে অংশ নেয়া একজন পুলিশ অফিসার,পরে বলেছেন,ডাকাতরা যদি চাইত,তখন ইচ্ছে করলেই পালিয়ে যেতে পারত,কারণ তাদের ভারি বুলেটের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে ছিল হালকা বেরেটা হ্যান্ডগান। কিন্তু পালিয়ে না গিয়ে,কোন এক রহস্যজনক কারণে,ল্যারি জুনিয়র প্রবল আক্রোশে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়েই পুলিশের দিকে গুলিবর্ষণ করে চলল। একজন দুঃসাহসী অফিসার এক ফোন বুদের আড়াল থেকে পাম্প অ্যাকশন শটগান দিয়ে গুলি চালালেন,যে কারো গায়ে লাগলেই তার টুকরো হয়ে যাবার কথা,কিন্তু ভয়াবহ আতংকের সাথে এবার পুলিশ আবিষ্কার করলো,ল্যারির বডি আর্মার খুব সহজেই শটগানের বুলেট আটকে দিল। এরি মাঝে মারাত্মক আহত হয়ে পড়ে গেলেন আরো দু'জন পুলিশ অফিসার,যাদের একজনের গায়ে বিঁধেছিল ৪টি গুলি,তাঁর বাড়িতে রাখা পুলিশ ওয়াকিটকিতে তাঁর স্ত্রী শুনতে পাচ্ছিলেন তাঁর স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়ে সাহায্য চাইছেন,কিন্তু দুই ডাকাতের প্রবল গোলাগুলিতে বাকি অফিসাররাও তখন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত,আহত সঙ্গীদের ধারেকাছেও যেতে পারছেন না,সব মিলিয়ে নারকীয় অবস্থা।

অবস্থা পাল্টালো অনেকটা দৈববলে। গোলাগুলি শুরু হবার ১৮ মিনিটের মাঝে সোয়াট (SWAT) সদস্যরা চলে এসেছে,বিপজ্জনক পরিস্থিতির জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত বাহিনী,কিন্তু ২ ডাকাতের সামনে তারাও মোটামুটি কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় পড়ে গেছে,বিশেষ করে আহতদের উদ্ধারের ব্যাপারে,যারা তখন রেডিওতে সাড়া দেয়াও বন্ধ করে দিয়েছিলেন,বোঝাই যাচ্ছিল,অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছে আহতরা। হঠাৎই দেখা গেল,সেদিনের ব্যাংকের আর্মার্ড ডেলিভারি ভ্যান আসছে,যেটা অন্যদিনের চেয়ে দেরি করে আসছিল। সোয়াট ক্যাপ্টেন হালে পানি পেলেন,ঝটপট সোয়াট অফিসারদের উঠিয়ে দেয়া হল ভ্যানে, আর্মার্ড ভ্যানের আড়াল নিয়েই তারা পৌঁছে গেল আহতদের কাছে,প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে তাদের ভ্যানে তুলে ফেলা হল,সেখান থেকে সরিয়ে আনা হল নিরাপদ দূরত্বে। ল্যারি আর এমিল কিন্তু তখনো তাদের তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে,বিশেষ করে ল্যারি।

মাথার উপর টিভি চ্যানেলের হেলিকপ্টার ঘুরছে,সরাসরিই দেখা যাচ্ছে তাদের কর্মকাণ্ড কিন্তু সেটা নিয়ে তাদের ভ্রক্ষেপ আছে বলে মনে হয়না। সোয়াটের এবার লড়াইয়ের দিকে নজর দেবার পালা,পূর্ণোদ্যমে আক্রমণ শুরু হল। তবে এবারও ভাগ্য সাহায্য করলো তাদের,হঠাৎই একটা বুলেট গিয়ে লাগলো ল্যারি জুনিয়রের বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলে,আর ঠিক একি সময়ে তার একে-৪৭ টা জ্যাম হয়ে গেল,খুব বেশি গুলি চালালে অনেকসময় একে-৪৭ এর বুলেটের খোলটা রিলিজ হতে গিয়ে আটকে যেতে পারে,যেটাকে স্টোভপাইপ ম্যালফাংশান বলে,ম্যানুয়ালি একটা লিভার টেনে সেটা রিলিজ করে দেয়া যায়,কিন্তু একটা হাত জখম থাকায় ল্যারি সেটা করতে পারল না। একে-৪৭ রেখে হাতে নিল বেরেটা হ্যান্ডগান,কিন্তু শিগগিরি বুঝে গেল,তার খেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে,ঘেরাও হয়ে গেছে সে। পুলিশকে কিছু করার সুযোগ না দিয়েই,গলার নিচে বেরেটা ঠেকিয়ে নিজেই ট্রিগার টেনে দিল,তখন বাজে ৯টা ৫১।

ওদিকে এমিলকে সোয়াট ধাওয়া করেছে,কপাল খারাপ তার,গাড়ির চাকা ফেঁসে যাওয়ায় ঠিক পাশাপাশি তার গাড়ি আর পুলিশের গাড়ি চলে এল,গাড়ি থেকে নেমে একদম মুখোমুখি দু'টো গাড়ির আড়াল নিল এমিল আর সোয়াট অফিসাররা। টুকটাক গুলি চলল,এর মাঝেই এক সোয়াট অফিসার তার এম-১৬ রিলোড করার সময় খেয়াল করলেন,গাড়ির নিচ দিয়ে এমিলের অরক্ষিত পা জোড়া দেখা যাচ্ছে। গুলি চালালেন তিনি,পড়ে গেল এমিল,আরো কয়েকটা গুলি বিঁধলো তার গায়ে,ঘেরাও করে ফেলা হল তাকে,তখন ঘড়িতে ৯টা ৫৬। তবে অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে পৌঁছাবার আগেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় তার,পরে দেখা গেছে ২৯টা বুলেট বিঁধেছিল তার গায়ে। বন্দুকযুদ্ধ এখানেই শেষ,তবে এর জের গিয়েছিল অনেকদূর।

মোটামুটি ৪৪ মিনিটের এই যুদ্ধে ল্যারি আর এমিল প্রায় ১৩০০ রাউন্ড গুলি ছুঁড়েছিল,পুলিশ আর সাধারণ পথচারী মিলে আহত হয়েছিল ১৭ জন। এমিলের পরিবার অবশ্য অভিযোগ করেছিল পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবেই তাকে রক্তক্ষরণে মারা যেতে দিয়েছে,তবে পুলিশের বক্তব্য হল অ্যাম্বুলেন্স 'প্রসিডিউর' অনুসরণ করেছে এবং সেখানে অন্যান্য আহতরা অগ্রাধিকার পেয়েছে। ল্যারির বাড়ি থেকে যেসব জিনিস উদ্ধার করা হয় তার মাঝে ছিল একটা মুভি,'হিট',রবার্ট ডি নিরো অভিনীত,সেটার কাহিনীও মোটামুটি একি রকম,ব্যাংক ডাকাতি করতে যেয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষে মৃত্যু,ফাইট টিল ডেথ। এরকম ধারণা করাও হয়েছিল যে এই মুভি দেখেই ডাকাতদের মাথায় এমনভাবে পুলিশের উপর হামলা করার চিন্তাটা আসতে পারে,যদিও সেটার জবাব যারা দিতে পারত তারা আর নেই। এ ঘটনার পরই লস এন্ঞ্জেলেস পুলিশকে পেট্রল কারে বহন করার জন্য এম-১৬ এবং এআর-১৫ এর মত অত্যাধুনিক অস্ত্র দেয়া হয়,আর পেট্রল কারগুলোতে লাগানো হয় বিশেষ রকমের আরামিড প্লেটিং।

এ ঘটনায় অংশ নেয়া ১৯ জন পুলিশ অফিসারকে সাহসিকতার জন্য দেয়া হয় "মেডাল অভ ভেলোর" পুরস্কার,এ ঘটনা নিয়ে বানানো হয় একাধিক তথ্যচিত্র ও মুভি। আর হ্যাঁ,লস এন্ঞ্জেলেস পুলিশ ডিপার্টমেন্টের অপরাধবিষয়ক মিউজিয়ামে ল্যারি জুনিয়র আর এমিল ম্যাটসেরেনুর প্রমাণ সাইজের মূর্তি গড়া হয়েছে,তাদের সাথে রাখা হয়েছে সেদিনের সেই অস্ত্র আর বডি আর্মার,কুখ্যাত হলেও মাঝে মাঝে মিউজিয়ামে জায়গা পাওয়া যায় বৈকি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.