আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নামের কীর্তন



সম্প্রতি নাম নিয়ে ব্লগে কিছু কথাবার্তা চলতেছে। বেশ। নামহীন মনুষ্যপ্রানী মেলা দায়। নামভারেই কেটে যায় মানবজন্ম। যাক এসব, আমি তুষার হাসান মাহমুদ সম্পাদিত "নাম" পত্রিকার সম্পাদকীয়টি আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম প্রাসঙ্গিক বিবেচনায়।

পত্রিকাটি এবছর বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে। নামের কীর্তন বদনাম করবেন না জনাব, সাচ্চা কথা হলো ইতিমধ্যে আমরা, মানে মহান মানব জাতি ওরফে আশরাফুল মাখলুকাত, আমাদের গুঢ় রহস্যময় চলার পথে তামাম জাহানের যা কিছু চিহ্নিত করে ফেলেছি, করে যাচ্ছি, এবং যাবো বিভিন্ন জীবিত, মৃত অথবা অনাগত নতুন কোন ভাষার সহায়তা নিয়ে সেইসব ‘তামাম জাহানের যা কিছু’, এবং তাদের প্রত্যেকের নাম এই দুইটা জিনিসই আলাদা। আমাদের এই নামকরণের সার্থকতা ক্ষেত্রবিশেষ এমন যে, জগতে ‘ঘোড়ার ডিম’ না পাওয়া গেলেও ভাষার মধ্যে এর একটা নাম আছে, আর এই নামে জিনিসটার চরিত্রও ফুটে ওঠে। ফলে যেকোন কিছুর নামকরণ শুধু সাধারণভাবে নয়, অসাধারণভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, সা¤প্রতিক অতীতে মার্কিন সাম্রাজ্য যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তার নাম দিয়েছে তারা ‘সন্ত্রাসবাদ’।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে একদল নতুন ধারার চিত্রকলাকারদের সমালোচকেরা ‘ইম্প্রেশনিস্ট’ বলে গালি দিতেন, পরে দেখা গেলো সেই নবীন ধরনটাকে মানুষ ‘ই¤েপ্রশনিজম’ বলে আদুরে মধুর স্বরে ডাকতে আরম্ভ করেছেÑ যদিও ভবিষ্যতে এটা অধিক মধুর না-কি আবার অম্ল হয়ে যাবে সেটা ভবিষ্যৎ-ই জানেন। কিন্তু কথা হচ্ছে, নামকরণের এই বিপুল সার্থকতার ফাঁকে ফোকরে একটা বড়সর গোলমাল থেকেই যায়। ভাষার রাজনীতি নিয়ে পৃথিবীর দার্শনিকেরা এসব কথা বহু আগে পেড়ে ফেলেছেন; এবং এখানে আমরা, সম্পাদকীয় ভাষ্যে কোন নতুন কথা বলছিও না, শুধু পুনরায় সচেতনতা অনুভব করছি, কেননা লেখকের আশ্রয় তো সে-ই ভাষাÑ যা একই সাথে অমৃত, এবং গরল। ‘নামে কি বা আসে যায়’, কথাটা সম্ভবত এটা ভেবে যে, কোন মানুষ, প্রাণী, গাছ, বস্তু, বা অবস্তু কেউই নিজ নামকরণ নিজে করেন না। গুটিকয় লেখক, বিপ্লবী, চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, পতিতা, বিভিন্ন অপরাধচক্রের লোকজন, গুপ্তচরেরা অবশ্য ছদ্মনাম নিয়ে থাকেন।

প্রথমত তারা সংখ্যালঘু; দ্বিতীয়ত, নিজ উদ্যোগে নেয়া ছদ্মনামে নিজেদের কাছেই তারা পরিচিত নন। আবার ‘ছদ্মনাম’ শব্দটার মধ্যে নাম কথাটার আগেই রয়েছে ছদ্ম; অর্থাৎ যা হলো কপট, ছল প্রভৃতি। এসব ছাড়াও ধর্মান্তরিত হবার কারণে বহুলোকের পুনরায় নামকরণের ঘটনাটি ঘটে। তবে সেক্ষেত্রে পূর্বের নামটির সাথে নতুন নামটি হয়ে থাকে অধিকাংশে সমিল সম্পূর্ণ। খুব কদাচিৎ আরও একটা জিনিস দেখা যায়, লেখক-কবি-শিল্পী ইত্যাদি সৃষ্টিশীল লোকেরা সাবেক কোন মহৎ মানুষের নামের সাথে নিজ নামটির হুবহু মিল পেলে, অথবা বাড়তি কাব্যময়তার জন্য নিজ নামটি স্ব-উদ্যোগে ঈষৎ পরিবর্তিত, অথবা পুরোপুরি পাল্টে ফেলেন।

তবে এর কোনটাই জগতে নামকরণের আদৌ মূলধারা নয়। ফলে একটা বিষয় খুব পরিস্কার, নিজ নামকরণের জন্য আমাদের পরনির্ভরশীলতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু ‘নাম’ বিষয়টা পরিচয় জ্ঞাপক; সেজন্য নামকরণের ছুতায় অপরের মাধ্যমে নিজের সাথে নিজের আর একবার পরিচয় ঘটে কিনা, সে বিষয়ে হয়তো প্রশ্নের রেলগাড়ি বারবার শিস্ দিয়ে যেতে পারে। জগতে নারীবাদী না হয়েও এটা অন্তত স্বীকার্য যে, নামকরণের যাবতীয় কেচ্ছাকাহিনী পৃথিবীর সর্বাধিক প্রচারিত ভাষাগুলোতে প্রায়শ একতরফা পুরুষায়নে ভরপুর। তবে এখানে উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যতিক্রম আছে।

যেমন, বাংলাতে বেশ্যা, পতিতা ইত্যাদি শব্দগুলো নারীবাচক। কিন্তু ঈশ্বর, সম্রাট, পুরোহিতÑ এ সমস্ত শব্দগুলো পুরুষবাচক হওয়াতে, ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে কোন নারীর বেশ্যা হয়ে ওঠায় তাঁর নিজের কতটা স্বাধীন কর্মফল, আর কতটা সাজানো দুভার্গ্য জড়িত সেটা নিয়ে যেকোন সময়ে একটা বিতর্ক তো থেকেই যায়। ফলে নামকরণের সাথে ক্ষমতার এই এত বেশি মাখামাখি, ক্ষেত্রবিশেষ মাত্রাজ্ঞান লুপ্ত হয়ে প্রণয়ের অতিরিক্ত ব্যভিচারের পর্যায়ে উথলে ওঠে। এজন্য সন্দেহ হয়, শোষকের হাত সত্যি কালো কিনা; কিংবা কালো আসলে এতটা কালো কি, এবং সাদা কি প্রকৃতই এমনতর সাদা। কালো বা অন্ধকার কোন কোন সময়ে গভীরতার চিহ্ন ধারণ করে, আর কোন কিছু যখন শুধু সাধারণ, বাংলাতে তো তাকে ‘সাদামাটা’ বলেও জাহির করা যায়।

আবার আর্থ-সামাজিক মর্যাদায় যারা সমাজে দুর্বল বলে চিহ্নিত সেই চণ্ডাল, ফকির-মিসকিন, পামর, মেথর প্রভৃতির নামসমূহ রীতিমতো গালিগালাজ হিসেবে ভাষার রাজ্যে অধিকতর পরিচিত। সুতরাং নামে কিছুটা তো আসে যায়। এখন যেটা ঘোর সংশয়, নামের এই দুনিয়াবি প্রভাবÑ শোষকের বিপরীতে দাঁড়ানো শোষিতের আর্ত বা প্রতিবাদী স্বরকে কতখানি প্রভাবিত করে, কিংবা এই প্রভাবের মধ্যে শোষকের রক্ষাকবচ শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে কিনা। সরিষার ভেতরে লুকানো এই ভূত আবিস্কারের পরে হয়তো আরও একবার চোখে সরিষা ফুল দেখার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। কারণ শ্রেণীহীন, শোষণমুক্ত, বৈষম্যরহিত ইত্যাদি মহত্তর বিশেষণে বিশেষায়িত সাম্যবাদী আদম-সমাজ গঠনের জন্যÑ আশরাফুল মাখলুকাতেরা তাদের বাসনার রাজ্যে ঠিক কতখানি উচ্চতা লাভ করেছে সে বিষয়েও কিছু পরিষ্কার ধারণা পাবার অবকাশ আছে।

তবে এতদপ্রসঙ্গে আশাবাদের বিকল্প কোথায়- কারণ, অন্যথায় সাধারণ জীবকুল থেকে উন্নত ও বুদ্ধিমান বলে আত্ম-স্বীকৃত মানুষের আত্ম-মর্যাদা বোধ বলে যে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। যেকোন মানুষকে মানুষ বলে সম্মান, এবং তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারাটাÑ সমগ্র মানব জাতির যে আত্ম-প্রচারণা সেখান থেকেই চূড়ান্ত নৈতিক পরাজয়ের বিবরণমাত্র। লেখকেরা সহজাত কারণে শব্দ সচেতন হয়ে থাকেন। এ সমস্ত যুক্তি তর্ক মেনেই পত্রিকাটির এমনতর নামকরণ। তবে এতে করে, এর নাম ‘নাম’ হওয়াতে, ঠিক কতটা সুনাম অর্জন করা গেছে সেসব ব্যাপারে আরও অনেক রকম তর্ক-যুদ্ধের ডালপালা মেলে দেয়া থাকলো, কারণ নামকরণ বলে কথা।

পত্রিকাটি আরও তিনবছর আগে প্রকাশিত হবার কথা ছিল, কিন্তু কিছু অনাবশ্যক অসুবিধার কোপানলে পড়ে এই বিস্তর বিলম্ব। আশা করা যায়, লেখকেরা এই সহস্রাধিক দিনে-রাত্রিতে ধৈর্যের যে বিপুল পরাক্রম দেখিয়েছেন, তা অন্তত বেনামে সৌরভ ছড়াবে না। সকল দুর্নাম সম্পাদকের সহায় হোক। আমেন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।