আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সমুদ্রের দিনরাত্রি / চার

নিজেকে খুঁজে ফিরি আর সবার মাঝে

তিনদিন কেটে যায়। সমুদ্র তেমনি শান্ত। সকাল আটটা থেকে দুপুর বারটা পর্যন্ত ডিউটি করি। তারপর বিশ্রাম আট ঘন্টা। আবার রাত আটটা থেকে বারটা পর্যন্ত ডিউটি।

এভাবেই চলছে। চব্বিশ ঘন্টায় দু'বার নামতে হয় ইঞ্জিনরূমে। ইঞ্জিনরূম তো নয়, একটা ছোটখাট নরক। প্রচন্ড গরম। চার ঘন্টার ওয়াচে কয়েক লিটার পানি খেতে হয়।

ঘাম হয়ে বেরিয়ে যায় সব। রঙিন বয়লার স্যুট সাদা হয়ে যায় দেহ নির্গত লবনে। একটা বয়লার স্যুট একবার পরলে দ্বিতীয়বার পরা যায়না পরিস্কার না করে। ওদিকে ওয়াশিং মেশিনের অবস্থাও ভাল না । আমরা তিন বন্ধু, মোস্তফা, সৌরভ আর আমি-ই কেবল চালাতে পারি ওটা।

ওটা চালালে গোটা ওয়াশিং রূম প্লাবিত হয়, জেটও লাগে বেশি। আর খালি হাতে চালানো যায় না। লাগে তের নম্বর স্প্যানার। আমাদের জাহাজে আছে মাত্র দু'টো। সে জন্য পকেটে রাখি একটাকে; সব সময়।

অন্য জাহাজে এতটা অসুবিধা হতো না কাপড় কাচা নিয়ে। এ জাহাজে লন্ড্রীম্যান নেই। স্টুয়ার্ডের সংখ্যাও কম। স্টুয়ার্ড সংখ্যা কম হওয়ায় আমরা বঞ্চিত হচ্ছি তাদের 'সেবা' হতে। আগে যে জাহাজে ছিলাম সেখানে স্টুয়ার্ডের অভাব ছিল না।

যথাসময়ে ঘুম থেকে জাগানো. চা নাস্তা দেয়া, বিছানা গোছানো, কেবিন পরিস্কার করা- সবই করত স্টুয়ার্ড। স্যার স্যার বলে মুখে ফেনা তুলত। সহজে নিবৃত্ত করা যেত না। এখানে তার উল্টো। কোন কিছু চেয়েও পাওয়া যায় না।

স্টুয়ার্ডদের কিছু বলা যায় না। । বললে হয়তো উল্টো ধমক দেবে! মোস্তফা বলছিল, এটাই নাকি এ জাহাজের 'ট্র্যাডিশন'। ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা। তাই চুপ করে থাকি।

খাই- দাই, ঘুমাই- আকাশ দেখি, সমুদ্র দেখি। উপরে নীল, নিচেও নীল। নীলের মাঝে নীরবে বাস করি। এরই মাঝে ডিউটির সময় হয়। পনের মিনিট আগে গ্রীজার এসে দরজায় ঠকঠক করে।

'ইয়েস' বলে সাড়া দিলে যন্ত্রচালিতের মতো বলে,'স্যার, কোয়ার্টার। ' তারপর চলে যায়। এটাই নিয়ম। এ নিয়মটা জানা না থাকায় প্রথমদিন জাহাজে উঠে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে থাকি । সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার বলে দিয়েছেন রাত বারটায় আমার ডিউটি।

সেই চিন্তা ঘুর পাক খাচ্ছে মাথার ভেতর। ঘুমানোর চেষ্টা করি , কিন্তু ঘুম আসে না। একটু পরপরই ঘড়ি দেখি। তারপর এক সময় বয়লার স্যুট পরে ইঞ্জিনরূমে নামি। বন্ধু আজাদ আমাকে দেখেই বলে, 'এত তাড়াতাড়ি নামছ কেন গো?' আজাদের বাড়ি কুষ্টিয়ায়।

কথায় সেই আঞ্চলিক প্রভাবটা সবসময়ই পাওয়া যাবে। তার কথায় অবাক হয়ে ঘড়ির দিকে তাকাই। দেখি কেবল দশটা বাজে। আজাদ চা খাওয়ায়, আপেল খাওয়ায়। গ্রীজার ডেকে পরিচয় করিয়ে দেয়।

সাপার বক্স দেখিয়ে বলে, 'রাতে ইচ্ছে মতো খেতে পারবা। ডিম আছে, গ্রীজারকে বললে চা বানিয়ে দেবে। ' তারপর আমাকে নিয়ে গোটা ইঞ্জিনরূম ঘুরিয়ে দেখাল। জেনারেটর চলছে বেশ শব্দ করে। জেনারেটরের পাশে গিয়ে আজাদ আমার কানে কানে কী যেন বলে।

কিছুই বুঝতে পারি না। এত শব্দের মাঝে কানে কিছু ঢোকে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। আজাদ ব্যাপারটা বুঝতে পারে। আমাকে ডেকে নিয়ে যায় অন্যত্র, জেনারেটর থেকে বেশ দূরে, সেখানে শব্দের তীব্রতা কিছুটা কম।

আজাদ বেশ উচ্চস্বরে আমাকে বুঝিয়ে দেয় জেনারেটর সম্পর্কে। বলল, 'ইঞ্জিনরূমের ভাষা এরকমই, কথা বলতে হয় চিত্‌কার করে। ' সেই সাথে শেখাল কিছু সাংকেতিক ভাষা। যেমন, দুইহাত আড়াআড়ি করে মেলে ধরার অর্থ 'বন্ধ করো', বামহাতে ডানহাতের কনুই ধরে ডান হাত ছড়িয়ে দেয়ার অর্থ হলো 'চালু করো'। জোরে 'উফ' করে উঠলে বুঝতে হবে কাজে বিরতি দিতে বলা হচ্ছে।

আরো কিছু সংকেত আছে যেগুলো বোবারা ব্যবহার করে থাকে। কয়েকদিনের মধ্যেই সে ভাষা রপ্ত করে ফেলি। প্রথমদিকে ইঞ্জিনরূমে আরামের জায়গা ছিল টানেল। লম্বা এক টানেল ছিল, জাহাজের পেছনের দিকে। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি, গরম নেই, জেনারেটরের বিকট শব্দও নেই।

ওখানে গিয়ে বসে থাকতে বেশ ভাল লাগত। কেউ দেখতে পেত না। প্রতিদিন অন্তত একবার যেতাম টানেলে। এই জাহাজে টানেল নেই। টানেলে যাওয়ার প্রয়োজনও বোধ করি না।

কারণ এখানে কন্ট্রোলরূমেই বসে থাকতে পারি। সারা জাহাজে কেবল কন্ট্রোলরূমই এয়ারকন্ডিশনড। স্টুয়ার্ডের মতো আমাদের ইঞ্জিন ক্রুও অপর্যাপ্ত। তিন গ্রীজার আছে, ফায়ারম্যান নেই, সারেং নেই। আছে একজন ফিটার বা ডিজেল মেকানিক।

গ্রীজারের কাজ হলো বিভিন্ন যন্ত্রাংশে তেল-মবিল ও গ্রীজ দেয়া, সেই সাথে আমাদের হুকুম তামিল করা। প্রথম এসে গ্রীজার শব্দটা বিদঘুটে লাগত। তখনই একাদন এলো বন্ধু রফিক। এসেই জিজ্ঞস করল, 'তোদের অগ্নিপুরুষ কোথায়?' আমরা বুঝতে পারি না। অগ্নিপুরুষ আবার কে? অগ্নিকন্যার কথা জানি, কিন্তু 'অগ্নিপুর"ষ' তো কোনদিন শুনিনি।

আমাদের ভ্যাবাচ্যাকা খেতে দেখে রফিকই আবার বলে, তোরা কি সব বাংলা ভুলে গেলি? সবাই অনর্থক ফায়ারম্যান ফ্যায়ারম্যান করিস কেন? এতক্ষণে বুঝতে পারি ফায়ারম্যানই সেই 'অগ্নিপুরুষ'। আর গ্রীজার হলো 'তৈলপ্রদায়ক'। সেই থেকে শব্দ দু'টো চালু হয়ে গেল। আমি আর সৌরভ সেটা নিয়ে এখনও কৌতুকবোধ করি। আমাদের তৈলপ্রদায়করা তৈল প্রদানে কসুর করে না।

তাদের কাছে ঈশ্বরের পরেই আমাদের স্থান। আচরণ দেখে তাই মনে হয়। আমরা দুজন- সৌরভ আর আমি ওদের কাছে গল্প করি, 'ওই সাহেব কিন্তু বেশ রাগী। কাজে গাফিলতি দেখলে মেজাজ বিগড়ে যায়। ' কথাটা কাজ দেয়।

তারা আমাদের সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঠান্ডা পানি খাওয়ায়, গরম কফি খাওয়ায়, টোস্ট বানিয়ে মাখনসহ এগিয়ে দেয় মুখের সামনে। আর সেই সুযোগে বয়ান করে তাদের অভিজ্ঞতার কথা, সমুদ্রের কথা। বলে, ছার, আফনেরা নতুন আইছেন, এহনও ছি দ্যাহেন নাই। আল্লায় দ্যাহায় অহন দ্যাকবেন।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।