আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সমুদ্রের কাছে


কেমন আছিস বান্ধবী? ভাল আছিস নিশ্চয়ই......ভাল তোকে থাকতেই হবে......আমার জন্য....... সেই কবে গিয়েছিস বলতো, পাঁ.....চদিন হয়ে গেল। ভীষণ মিস করছি তোকে। কত কথা জমে আছে জানিস? ফিরে আয়....একটা একটা করে সব বলবো তোকে। যাকগে, এখন তোর কথা বল। আমি বলেছিলাম বারবার, 'ঘুরে আয়, ভাল লাগবে'।

মানতেই চাসনি আমার কথা। এখন? এখন তো ফিরেই আসতে চাচ্ছিস না। আমি জানতে চাই না কেমন লেগেছে সমুদ্র। ফোন ধরে যখন তুই চিতকার করেছিলি 'কি সুন্দর! কি সুন্দর!' বলে আমি বুঝতে পেরেছি। আর বাকিটুকু আমি দেখতে চাই যখন তোর সাথে দেখা হবে....তোর চোখে,মুখে, হাসিতে......।

মনে আছে যেবার আমরা গেলাম ভার্সিটি থেকে, পাঁচদিনে ঘুরেছিলাম চারটা জেলায়। কক্সবাজারে একদিন ছিলাম। তাড়াহুড়ো করে আমার সমুদ্র দেখা হয়েছিল। সকালে গেলাম লাবণী বীচে। যখন দূর থেকে সমুদ্রটা দেখতে পেলাম, জীবনে প্রথমবার, ধক করে উঠেছিল বুকের ভিতর।

পাশ থেকে হাত খামচে ধরেছিল মুন। কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না কেউ বলার মত। পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম ঢেউয়ের কাছে। পায়ের পাতায় সিরসিরে অনুভূতি তুলে ঢেউয়ের সাথে বালি সরে গেল। সারা গা শিউড়ে উঠল।

দ্বিধা-সংকোচ-ভয় কাটিয়ে নেমে গেলাম পানিতে। একটা-দুটো ঢেউ সংকোচ কাটিয়ে দিল আস্তে আস্তে। হাবুডুবু খেয়ে, কিছুটা লবন পানি গিলে বুঝে নিলাম ঢেউয়ের খেলা। ভাব হয়ে গেল। ঘন্টাদুয়েক দাপাদাপি করে উঠে এলাম পানি থেকে।

হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে ফিরে গেলাম হোটেলে। কিন্তু কেন যেন মন ভরল না। সমুদ্র কি এমন! মনে হচ্ছিল ঠকানো হল, টিভিতে তো এমন দেখায় না। ঘোলা, সাদাটে পানি.....আর ঢেউয়ের সেই গর্জনতো নেই-ই। বিকালে হিমছড়ি যাওয়ার প্ল্যান।

আগেই ঘুরে গেছে এমন একজন বলল হিমছড়িতে দেখার কিছু নাই। শুধু পাহাড়ে চড়া। তারচেয়ে বার্মিজ মার্কেটে যাই। মেয়েরা তাতেই বেশি উৎসাহী ছিলাম। কিন্তু টিচারদের কথা হল সবাই একসাথে থাকতে হবে, আলাদা হওয়া যাবে না।

যা প্ল্যান আছে তাই করতে হবে। সুতরাং গেলাম হিমছড়ি। যাওয়ার পর মানতে হল হিমছড়ি না এলে সমুদ্রই দেখা হতো না। প্রথমে উঠে গেলাম পাহাড়ে। ঘুরলাম, দেখলাম, ছবি তুললাম।

কিন্তু সাগরটা আমাকে ভীষণ টানছিল। সূর্যাস্তের আগ মূহুর্তে সবাইকে টেনে হিচড়ে নামিয়ে আনলাম সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখবো বলে। জায়গাটা কেমন ফাঁকা, ভিড়ভাট্টা নেই। কেবল আমরা ক'জন। আর সাগরের সেই গর্জন! প্রতিটা ঢেউ যেন বুকে গিয়ে ধাক্কা দিচ্ছিল।

ফাঁকা হয়ে গেল বুকের ভেতরটা। নিজেকে এত ক্ষুদ্র আর অসহায় মনে হচ্ছিল ওই বিশাল, অসীম সমুদ্রের সামনে। কতটুকু পন্ডিত তার মধ্যেই ছবি তুলছিল। সূর্য ডুবে যাচ্ছে, সেই ডুবু ডুবু সূর্যকে তালের তালুতে ধরে রাখা। উহ্, এত বিরক্ত লাগছিল! মনে হচ্ছিল কারো সাথে শেয়ার করতে হবে।

তোকে ফোন করলাম। কিন্তু কি নিয়ে যেন বিজি ছিলি তুই। কথা হল না। আশপাশে তাকালাম। প্রায় সবাই কেমন নিরব, স্থির হয়ে গেছে।

মুন কথা বলছিল ওর হবু বরের সাথে, দেখলাম চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সোহেল একা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাগরের দিকে মুখ করে। বাকিরাও যে যার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিন্তু বিষন্ন। সবার মধ্যেই যেন একটা হাহাকার। কি যে হয়ে গেল! মনে হল সব ছেড়ে পালাতে হবে।

আচ্ছন্নের মত ঢেউয়ের পার ধরে হাঁটতে লাগলাম সামনের দিকে। যেতেই থাকলাম........যেতেই থাকলাম। জানি না কতক্ষণ হেঁটেছি..........কতদূর গিয়েছি। অনেকক্ষণ পর পিছনে শুনলাম সোহেল ডাকছে। ফিরতে হবে।

অনেকক্ষণ ধরে ডাকছিল, না শোনায় হেঁটে এসেছিল নিয়ে যাওয়ার জন্য। তারপর আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, 'তোর কি মন খারাপ?' আমি কথা বলতে পারছিলাম না। নিজের ভেতরের শূন্যতা আমাকে গ্রাস করে নিয়েছিল। কোনরকমে মাথা নেড়ে না বললাম। ও হাসানোর চেষ্টা করল, 'তোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে এখনি কেঁদে ফেলবি'।

চোখ তুলে তাকালাম ওর দিকে। আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে এল চোখ। গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা পানি। আর তারপর পড়তেই থাকল। আমি কাঁদতে থাকলাম।

সোহেল আমাকে থামাতে চাইল, কিন্তু কিছু বলতে পারল না। আমরা বাসে উঠলাম। কিছুতেই কান্না থামাতে পারছিলাম না। তুই তো জানিস সোহেল ভাল গান গায়। ও একটার পর একটা গান গেয়ে গেল পুরো রাস্তা।

আর আমি অঝোরে কেঁদে গেলাম। মুন এক হাতে জড়িয়ে ছিল আমাকে। আমার ভেতরটাকে ধুয়ে মুছে নিয়ে যেন বেরিয়ে আসছিল নোনা জল। বুক ভেঙে যাচ্ছিল। এত নি:স্ব এত অসহায় কখনো মনে হয়নি নিজেকে।

কিন্তু যখন ফিরে এলাম আমি ছিলাম নতুন এক মানুষ। একদম অন্যরকম। এ যেন পুনর্জন্ম! নিজেকে হারিয়ে ফেলার....আবার একটু একটু করে ফিরে পাবার.....মনের সব কষ্ট-গ্লানি ধুয়ে ফেলার........শুদ্ধ-পবিত্র-নতুন এক মানুষের জন্ম দেয়ার নাম হল সমুদ্র। তোর মাঝে নতুন এক মানুষকে দেখতে চাই আমি। ভাল থাকিস................. আমার জন্য নিয়ে আসিস সমুদ্রের এক ঝলক নোনতা বাতাস আর বুক কাঁপানো ঢেউয়ের গর্জন................................. ***তিন বছর আগে আমরা বন্ধুরা গিয়েছিলাম কক্সবাজার।

সমুদ্র আজও আমাকে ভীষণভাবে ডাকে। রোজ নয়, কিন্তু কোন কোন একলা, নিস্তব্ধ রাতে কিংবা বিষন্ন সোনালী বিকেলে................. প্রিয় বান্ধবী যখন সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে উচ্ছসিত হয়ে অনুভূতির কথা জানাচ্ছিল মনে হচ্ছিল আমি বুঝি ফিরে গেছি সেই তিন বছর আগে। আরেকবার যেতে হবে সাগরের কাছে........খুব শীগগিরই......সাগর যে আমাকে ভীষণ ডাকে!***
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।