আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

থেমে যাওয়া সুর



মানুমিয়ার ডাকে পিছন ফিরে দেখি একটি সাত আট বছরের শ্যামলা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর হাত ধরে। মেয়েটির দিকে মনোযোগ দিলাম। ওর মুখে একটা অচেনা আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে। মায়া মায়া চেহারায় অপুষ্টির ছাপ লেগে আছে। ময়লা কুচকানো ফ্রকের সাথে তেল চিটচিটে চুলের রুক্ষ আগাগুলো লেপ্টে আছে।

মানুমিয়া আরেকটু এগিয়ে আমাকে সালাম দিয়ে বলল, ‘মাষ্টেরছার, এই মাইয়াডারে না আইনা পারলামনা। মায় মইরা গেছে জন্মের সময়। বাপ আরেকটা বিয়া করছে। নয়া মায়ে হেরে লেহাপড়া করতে দ্যায়না। ভালা কইরা খাইতে দ্যায়না।

অর বাপে মানে আমাগো হামিদ ভাই জোর কইরা হাত চাইপা ধরল। কইল, মানুরে, মাইডারে বাচাঁ। তর লগে ঢাহা লইয়া যা। পারলে লেহাপড়া করাইস। মাষ্টেরছার, আপনে ছাড়াতো কারোর ওপর আমার ভরসা নাই।

তাই আপনের কাছেই নিয়া আসলাম। আপনেই এহন অর মা-বাপ। এহন থিকা অয় আপনের কাছেই থাকব। ’ একসাথে প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল আমাদের অফিসের এমএলএস মানুমিয়া। সবাই তাকে খুবই পছন্দ করে।

আমিও। আমাকে সে ‘মাষ্টেরছার’ ডাকে। আমি বছর দুয়েক একটা কলেজে বাংলা পড়িয়েছি। এখনো দু’একজনকে পড়াই আর একটা প্রাইভেট অফিসে প্রশাসনিক কাজ দেখছি। আমার নিজেরই থাকা খাওয়ার ঠিক ঠিকানা নেই।

একটা এটাচ্ড বাথ এবং বারান্দা বিশিষ্ট রুম নিয়ে থাকছি। দু’বেলা দু’বার রান্না বান্না সহ যাবতীয় কাজ করছে রাবুরমা। এই অবস্থায় আমি একটি মেয়ের দায়িত্ব নিই কি করে। মানুমিয়াকে বারণ করেও লাভ হলোনা। অন্য কারো কাছে নিরাপদ বোধ করছেনা সে।

তাছাড়া, মানুমিয়াও নাকি সকাল সন্ধ্যায় ফরমায়েশি খেটে দেবে। মেয়েটিকে কাছে ডাকলাম। নাম কিরে তোর? আমাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি বলে উঠল, আমাকে তুই করে বললে আমি কোন কথাও বলবোনা, এমনকি এখানে থাকবোওনা। বাধ্য হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম- নাম কি তোমার? আমার নাম আফরোজা খাতুন। তোমার? আমি আমার নাম বললাম।

মেহেদি রহমান। থাকতে পারবে এখানে? পছন্দ হয়েছে তোমার? মেয়েটি মাথা দুলালো। আচ্ছা তোমাকে আমি কি বলে ডাকবো? তোমার যা ইচ্ছে। ভাইয়া চাচা মামা যা ডাকতে ইচ্ছে করে। মেয়েটি যেন একটু চিন্তায় পড়ে গেল।

ঠোঁট দুটো চেপে বলে উঠলো- দাদা, তোমাকে আমি দাদা বলে ডাকবো। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, গ্রাম থেকে আসা একটি সহজ সরল মেয়ে এত গুছিয়ে কথা বলে কি করে? যাগ্যে, তোমার নাম তো আফরোজা খাতুন চলবেনা। বুড়োবুড়ো নাম হয়ে গেছে। একটা বাচ্চা বাচ্চা নাম দরকার। আফরোজা, আফ.. রোজা, ঠিক আছে এখন থেকে রোজা, রোজা রহমান।

মেহেদি রহমানের বোন রোজা রহমান। চলবে? খুউব চলবে। রোজাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলাম। গ্রামে ক্লাশ ফোর শেষ করেছে। এখানেও ক্লাশ ফোর থেকে শুরু।

মানুমিয়া সকালে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার এবং রাবুরমা স্কুল থেকে নিয়ে আসার দায়িত্ব নিল। রাতে এসে আমি যাবতীয় খোঁজ খবর নিই। নতুন জামা কাপড়, বই, স্কুল ব্যাগ, জুতা সবকিছুতেই রোজা আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠলো। এ শহরে যে তার নতুন আগমন ঘটেছে, তার চাল চলনে বোঝার উপায় নেই। মনে হলো, আমার পরিবারেই তার জন্ম, বেড়ে ওঠা।

মাস ছয়েকের মধ্যে তার মুখে অপুষ্টির ছাপ মুছে গেল। চেহারাটা আরো মায়াবী হয়ে ওঠলো। রাতে যখন গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকে আমার পাশে, আমি তখন ওকে দেখি আর ভাবি, সৃষ্টিকর্তা মানুষকে কতো সুন্দর করে তৈরী করেছেন। কতো মমতা মেখে দিয়েছেন মানুষের চোখে মুখে। বছর দুয়েকের মধ্যে ওর মধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেল।

ও এখন আরো সুন্দর হয়েছে দেখতে। গায়ের রঙ দিনে দিনে আরো ফর্সা হচ্ছে। রোজা এখন আমাকে রীতিমতো শাসন করে চলছে। দেরীতে বাসায় ফেরা যাবেনা, রাত জেগে টিভি দেখা যাবেনা, ওমুক করা যাবেনা, তমুক করতে হবে। ছুটির দিনে ওকে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে, ইত্যাদি।

আমার আগোছালো ঘরটা এখন পরিপাটি করে রাখে সারাক্ষণ। অফিস শেষ করে এখন আর দেরী করে বাসায় ফিরিনা। মনটা ছটফট করতে থাকে ওকে দেখার জন্য। আমার সারাক্ষণের ভাবনা এখন দশ বছরের রোজা। সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকি।

কখন যেন কি ঘটে যায়! কিন্তু মানুমিয়া আর রাবুরমা যেন রোজাকে সারাক্ষণ আগলে রাখে। আমাকে অনেকটা দুঃশ্চিন্তা মুক্ত করে। রোজা যখন ক্লাশ এইটে উঠলো তখন ওর মধ্যে পরিবর্তনের ধারাটা অনেক বেশী দেখা গেল। ওর শরীরের সৌন্দর্যগুলো যেন আস্তে আস্তে ফুটে ওঠছে। শরীরের পরিবর্তনগুলো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।

কণ্ঠস্বর আরো মিষ্টি হচ্ছে। ওর সব আবদার আমার কাছেই। আমি ছাড়া কেইবা আছে ওর। এক বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে কান্নাকাটি করতে লাগলো। রাবুরমাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম প্রাকৃতিক নিয়মে সে বড় হচ্ছে।

সে কারণে কিছু অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। রোজাকে এ ব্যাপারগুলো জানানোর বা বোঝানোর কেউ নেই। সেতো এগুলোর সাথে পরিচিত ছিলনা। আমার সাথে শেয়ার করা যাবে কিনা সেই দ্বিধায় ভোগছে সে। রাবুরমা ওকে বুঝিয়ে বলল যে, এটি কোন অসুখ নয়।

সব মেয়েদেরই এরকম হয়। আবার সব ঠিক হয়ে যায়। অর্থাৎ মেয়ে! তুমি বড় হচ্ছো। হাইজেনিক থাকার জন্য যা দরকার তার ব্যবস্থা করলো রাবুর মা। কিভাবে কি করতে হয় সবই দেখিয়ে দিলো।

রাবুরমাতো রাবুর মতোই আরেকটি মেয়ে হিসেবে দেখছে রোজাকে। পাশাপাশি আমাকেও কিছু পরামর্শ দিতে ভুল করলোনা। কিছুদিন নিজেকে গুটিয়ে রেখে আবারো সরোব এবং সচল হলো রোজা। কারণে বা অকারণে রাবুরমার সাথে প্রায়ই হাসাহাসি করতে দেখা যায়। ইদানিং আমার কাছেও একটু ঘেষতে চায়।

পড়াশুনা দেখানোর জন্য পলাশ নামে অনার্স পড়–য়া একজন ছাত্রকে ঠিক করে দিয়েছি। কাজেই পড়াশোনা দেখানোর কাজে আর আমাকে ব্যস্ত থাকতে হয়না। মাঝে মাঝে একটু খোঁজ খবর নিই। আমার কাছে ওর টিউটরের খুব প্রশংসা করে। বলে যে পলাশ অনেক কিছুই জানে।

জানো দাদা, পলাশ ভাইয়ার সাথে দেখা নাহলে আমি জানতামইনা আমি অনেক কিছুই জানিনা। কি জানোনা, রোজা? এই ধরো, মানুষের মধ্যে এতো ভালো মানুষ আছে তোমার মতো, অথবা মানুষ মানুষকে এত ভালোবাসতে পারে, মানুষের মধ্যে ভালোবাসা আর মমতার এতো ক্ষমতা, এর আগে তুমিও কখনো বলোনি দাদা। তা পলাশ কি তোমার ভালোবাসার উপরই শুধু লেকচার দিচ্ছে? নাহ! ক্লাশের সব কিছুই দেখিয়ে দিচ্ছে। ফাঁকে ফাঁকে অন্যান্য প্রসঙ্গে কথা বলেছে। এতে আমি খুবই এনজয় করছি দাদা।

এটাতো খুবই ভালো কথা সোনা। তা রাবুরমাকে বলো যেন তোমার টিচারেরও একটু যতœ-আত্তি করে। ঠিক আছে দাদা, তুমি কোন চিন্তা করোনা। এ্যাই রোজা, পলাশ আর কি কি শেখায়রে। গান শেখায় আর কবিতা আবৃত্তি করে শোনায়।

কী ভালো আবৃত্তি করে দাদা। ঠিক তোমার মতো। যাহ্! আমি কি আর তেমন ভালো করি। করোনা মানে! আমি যে স্কুলে নজরুলের ‘নির্ঝরের স্বপ্ন-ভঙ্গ’ করে ফার্স্ট হলাম, কে আমাকে শিখিয়েছে শুনি। দুর বোকা! ওটা নজরুলের না, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা।

স্যরি দাদা। ইটস ওকে। তা পলাশের কাছে কি শিখেছো? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘যা চেয়েছি, যা পাবোনা’। কী চাও আমার কাছে, কবিতাটি? ওটাতো বড়দের কবিতা, ডুয়েট করতে হয়। বারে! আমিতো বড় হয়েই গেছি।

আমি আর পলাশ ভাইয়া ডুয়েট করেছি। একটু শুনবে দাদা? ঠিক আছে পলাশ আসুক, দুজনে মিলে শুনিয়ে দিয়ো। না, এক্ষনি শুনতে হবে। তুমি আর আমি করবো। তুমি হবে কবি আমি হবো নীরা।

ঠিক আছে শুরু করো। রোজা এখন ষোল। এসএসসি'তে জিপিএ-ফাইভ পেয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। কথা বার্তা চাল চলনে খুবই স্মার্ট হয়েছে। আমাকে শাসন করা তার রীতিমতো দায়িত্বের মধ্যে নিয়ে নিয়েছে।

আমি কেমন শার্ট-প্যান্ট পড়বো, পাঞ্জাবী-ফতুয়া কোথা থেকে কিনবো; সবই ওর দখলে। পলাশ এখনো ওকে দেখ-ভাল করছে। রাবুরমা আর মানুমিয়াতো আছেই। তবে কথায় কথায় পলাশের গুন-কির্তন করে। পলাশকে আমারো খুব পছন্দ।

একটু আবেগ তাড়িত। সব কিছুতেই ইমোশন্যাল। ওকে আরো প্র্যাকটিক্যাল হতে হবে। বছর দুয়েক হলো রোজা ডায়েরি ম্যানটেইন করে। তার ভালো লাগা মন্দ লাগা ডায়েরিতে লিখে রাখে।

শিরোনামহীন কবিতা লিখে রাখে। আগে আমার সাথে এগুলো শেয়ার করতো। লেখাগুলো কেমন হয়েছে, আমার কাছে জানতে চাইতো। এখন বেশী শেয়ার করে পলাশের সাথে। লেখা নিয়ে ওর সাথে কারণে অকারণে হাসাহাসি করে।

তবুও ওর লেখাগুলো আমার পড়তে ইচ্ছে করে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ি আর নিজে নিজে হাসি। এমন প্রতিভা আমার ছোট্ট সোনামনির। যদিও এখন আর সে ছোটটি নয়। চোখে ভেসে ওঠছে সেদিনের কথা।

গ্রাম থেকে মানুমিয়া যেদিন প্রথম নিয়ে এলো আমার কাছে। কতোদিন খাইয়ে দিয়েছি আমি নিজের হাতে। সারা গা মেজে গোসল করিয়ে দিয়েছি। জামা কাপড় পড়িয়ে দিয়েছি। গুটিশুটি হয়ে ঘুমাতে গিয়ে কতোদিন আমার বালিশে চলে আসতো।

ঝড়-বৃষ্টির সময় ভয় পেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতো। যেন আমিই ওর নিরাপদ আশ্রয়। সেই অসহায় ছোট্ট মেয়েটি এখন কতো বড় হয়েছে। আমাকে যেন কিছুটা এড়িয়ে চলছে। কিন্তু আমি জানি আমি ছাড়া আপন বলতে পৃথিবীতে আর কেউ নেই।

ওর জন্ম দাতা পিতা একবারো দেখতে আসেননি। মানু মিয়ার কাছে শুধু খোঁজ খবর নিতেন। শুনেছি বছর দুয়েক আগে ওর বাবা মারা গেছেন। কাজেই ওর কাছে বাবাও আমি, মাও আমি। আমিই ওর সব।

চোখ ঝাপসা ওয়ে ওঠে। ডায়েরির লেখাগুলো আর পড়তে পারিনা। কয়েক ফোঁটা পানি বেয়ে পড়েছে লেখাগুলোর উপর। চোখের পানি মুছে আবার পড়তে থাকি। এক জায়গায় লিখেছে, ‘তেতুল পাতা তেতুল পাতা, তেতুল বড় টক, তোমার সাথে প্রেম করিতে আমার বড় শখ’।

ছিঃ! কি লিখেছে এসব। কার কথা লিখেছে রোজা? বোঝার চেষ্টা করি। এক জায়গায় কার নাম যেন লিখে আবার কাটাকুটি করে রেখেছে। আরেক জায়গায় লিখেছে, ‘আবেগের তাড়নায় এই আমি কাঁপছি, তবুও সারাক্ষণ তোমাকেই ভাবছি। ’ কার কথা ভাবছে রোজা? ইদানিং কলেজের বান্ধবীরাও আমার বাসায় আসছে।

বিশেষ করে রিমি, তিথি, শিমুল, ডালিয়া এবং স্বপ্নীল এসে প্রতিদিনই আড্ডা দিচ্ছে বারান্দায়। কিসব নিয়ে যেন হাসাহাসি করে। আমি সামনে গেলে সব ষ্টপ করে দেয়। আমার সামনে ওরা ইচির মিচির করে এক অচেনা ভাষায় কথা বলে। আমি যে বুঝি, সেটা ওরা বোঝেনা।

তবু আমার খারাপ লাগেনা। রোজা আমাকে বসতে বলে। কিন্তু আমি বসিনা। ওদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করিনা। আমি ওখান থেকে চলে আসি পাশের রুমে।

আমি চলে গেছি দেখে আবার শুরু করে। কিন্তু পাশের রুম থেকে আমি সবই শুনতে পাই। স্বপ্নীলঃ কিরে রোজা, তোর হেন্ডসাম তেতুলের খবর কি? রোজাঃ এ্যাই আস্তে বল, দাদা শুনলে আমাকে জবাই করবে। শিমুলঃ তোর দাদা শুনলে কি হবে? তোর দাদা কি প্রেম করেনা? দ্যাখ গিয়ে কার সাথে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে। রোজাঃ দাদা জল খেলে ডুবে ডুবে খাবেনা।

সবাইকে দেখিয়েই খাবে। তিথিঃ বাদ দে তোর দাদার কথা। যেই না চেহারা, নাম রেখেছে পেয়ারা। তোর দাদাকে কে পছন্দ করতে যাবে বল। সবাই এক সাথে হেসে ওঠে।

শিমুলঃ সত্যিইতো। এমন বুড়ো হাবড়াকে কেইবা পছন্দ করবে? রোজাঃ সর্বনাশ! তোদের মুখেতো কিছুই আটকাচ্ছেনা দেখছি। লিস্ন, ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশান, আমার দাদার এখনো অনেক ডিমান্ড আছে। তাছাড়া, আমার জন্যই দাদার সব সেক্রিফাইস। আমি ছাড়া দাদার আর কোন ভাবনা নেই।

তোদের দাদা পাত্তা দিচ্ছেনা বলে তোদের মনে হয়েছে আঙুর ফল টক। কেন রিমিকে জিজ্ঞেস কর, দাদার সাথে প্রেম করতে আমার কতো হাতে পায়ে ধরেছে। আমি যেন দাদার সাথে ওর প্রেম করিয়ে দই। কি রিমি ধরিসনি আমার হাতে। রিমিঃ একদম ভালো হবেনা বলছি।

তোচির রচির মুচির খেচির কিচির ছুচির আচির টচির কাচির য়চির নাচির। (তোর মুখে কিছু আটকায়না)। আবার সবাই এক সাথে হেসে উঠে। শিমুলঃ তোর দাদাই এতো গম্ভীর থাকে কেন? তিথিঃ সত্যি। তোর দাদার বড় অহংকার।

শিমুলঃ অচির নেচির কচির দেচির মাচির গচির। (অনেক দেমাগ)। স্বপ্নীলঃ কিসের এতো অহংকার তার? সেদিন ফোন করলাম, কথাই বলতে চাইলোনা। বলে কিনা ব্যস্ত। আমার সাথে কথা বলতে ছেলেরা টিকেট কাউন্টারের মতো লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।

আর তুমি চান্দু কথা বলার সময় পাওনা। এমন ঘুষি মারবোনা, নানার নাম ভুলে যাবে। শালা। তিথিঃ আরে আমি সেদিন ওনার অফিসে গেলাম একটা কাজে। কাজ শেষে বললাম, চলেন এক সাথে ফিরি।

আমি একা ফিরেছি, জানলে মা খুউব রাগ করবে। তাও আমাকে সময় দিলনা। বলে কিনা আমার যেতে দেরী হবে। কত বড় বজ্জাত চিন্তা কর। আমাকে লিপ্ট দেয়ার জন্য কতো যুবকের মাথা নষ্ট হয়ে যায়, আর তুমি ঘুঘু ধান চিনোনা! হুম্ ।

রোজাঃ এতক্ষনে থলের বিড়াল বেরুচ্ছে তাহলে? সবাই একসাথে বলে ওঠে, কি আমরা বেড়াল, উম্ ! আর তোর দাদা কি? হ্যা? তোর দাদা কি? রোজাঃ আমার দাদা হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ডালিয়া এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এবার একটু নড়েচড়ে বসলো। ডালিয়াঃ থাম তো এবার। রোজা, তোর কথা বল।

তোর চান্দুর সাথে ইটিশ পিটিশ কেমন চলছে? ই¤প্র“ভমেন্ট কতটুকু? এখনো হাত ধরার মধ্যেই আছিস, নাকি ঠোঁট পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিস। আবারো সবাই একসাথে হেসে ওঠলো। তিথিঃ নাচির কিচির সচির বচির খুচির লেচির দিচির য়েচির ছিচির সচির। (নাকি সব খুলে দিয়েছিস)। আবার সাবাই একসাথে হেসে উঠলো।

স্বপ্নীলঃ দ্যাখ, দ্যাখ লজ্জায় রোজার গাল লাল হয়ে গেছে। শিমুলঃ আরে ওকে বলতে দে। বল বল রোজা। থ্রি টু ওয়ান জিরো অ্যাকশান। ওদের কথা বার্তা শুনে আমার দুই কান গরম হয়ে গেছে।

কোন টেনস্ থাকলেই আমার কান গরম হয়ে যায়। আস্তে আস্তে মাথার পেছনটা, অবশেষে পুরো মাথাটাই গরম হয়ে যায়। কি শুনলাম এসব। আমার রোজা কারো প্রেমে পড়েছে.. । কে সে? পলাশ? বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেনা।

পলাশ তা করতে পারেনা। এখন রাত সাড়ে দশটা। রোজা এখনো বাসায় ফিরেনি। ওদের কলেজে নবীন বরণ অনুষ্ঠান হবার কথা। তা সন্ধ্যে পর্যন্ত।

কিন্তু এত রাত পর্যন্ত কখনো সে বাইরে থাকেনি। মানুমিয়া সন্ধ্যে থেকেই মেইন রোড থেকে গলি পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করছে। রাবুরমাও আজ চলে যায়নি। আমার শরীরের প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে। ওর ফোন বন্ধ।

ওর কোন বান্ধবীর ফোন নাম্বার নেই আমার কাছে। ইশ্। ওরা যখন ফোন করেছিল, তখন কেন যে নাম্বারগুলো সেইভ করে রাখলামনা। মাথাটা ঘুরছে আমার। গেল কোথায়।

রাত বাড়ছে আর আমার বুকে ধুকধুকানি বাড়ছে। কত আজে বাজে চিন্তা হচ্ছে। এটা হতে পারে, ওরকম কিছু হয়নিতো? কোন দুর্ঘটনা? কোন বিপদ? এমন যেন না হয়। রোজা যেন ভালো থাকে আল্লাহ। ও যেন সুস্থ থাকে।

কোন ক্লু পাওয়া যায় কিনা এই ভরসায় ওর ডায়েরিটা খুললাম। ‘বন্ধু আমার চড়–ই পাখি, বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখি’। আবার লিখেছে, ‘ তুমি বন্ধু দুষ্টু বড়, আমায় কেবল উদলা করো’। ওহ্ মাই গড। এবার দেখি আড়াআড়ি করে কিছু লেখা।

‘চোখে তুমি, বুকে তুমি, তুমিই আমার ধ্যান। তোমার বুকে মিশে গেলে হারাই আমার জ্ঞান’। আবার পাতা উল্টাই। আরেক জায়গায় লেখা, ‘রিক্শাতে এমন অস্থির না হলেই কি চলতো না? আমিতো তোমারই। হ্যাভ পেশান’।

তার মানে আমাকে না জানিয়ে বাইরেও বেড়াতে বেরোয়। একটু নিচে আবার লিখেছে, ‘আমায় কাছে পেলে, তোমার কেবল লাফমারা, তোমার বুকে আমি গেলে, হই যেন তাই খাপছাড়া’। আরেকটু নিচে লিখেছে, বি.দ্র. লাফমারা মানে নেচে ওঠা। খাপছাড়া মানে বলতে লজ্জা পাচ্ছি। তলোয়ারতো থাকে খাপের মধ্যে।

খাপ থেকে বের করলে কেমন হয়? অর্থাৎ ন্যাংটো। হি.হি। আমার শরীরতো অবশ হয়ে পড়ছে। কি করেছে এসব। কাকে নিয়ে লিখেছে? কার কাছে গিয়ে এমন খাপছাড়া হতে হয়েছে।

মাথায় আর কিছু আসছেনা। রাবুরমাকে ডাকি। তোমার কাউকে সন্দেহ হয়। পলাশ ভাইজান আসলে তো তারা খুউবই হাসাহাসি করে। এইটাতো আপনেরে কতোবার বলছি ভাইজান।

প্রথমেই পলাশকে কল করলাম। হ্যালো পলাশ, কোথায় তুমি? আমিতো বিক্রমপুরে এসেছি ভাইয়া। কেন কি হয়েছে? হঠাৎ মার ফোন পেয়ে চলে এসেছি ভাইয়া। আপনাকেও বলা হয়নি। কোন সমস্যা? নাহ্ মানে রোজা এখনো ফিরেনি।

রোজা কি তোমার সাথে পলাশ? নাতো ভাইয়া। ওর সাথে গত দুদিন কোন কথা হয়নি। তাছাড়া, রোজাকে আনলেতো আপনাকে বলেই আনতাম। এমনকি আপনাকেও সাথে আসতে বলতাম। মা তো প্রায়ই আপনার কথা বলেন।

ঠিক আছে। তুমি কি ওর কোন বন্ধু-বান্ধবীর নাম্বার জানো? নাতো ভাইয়া। ওকে। রাখছি। রাবুরমা।

আর কেউ কি এ বাসায় আসে? কোন ছেলে বন্ধু? হ। সোহেল ভাইজান আসে। সোহেল ভাইজান আসলেতো রোজা বুজি চুপচাপ থাকে। দুজনেই আস্তে আস্তে কথা কয়। কিছুই বুঝা যায়না।

সোহেল মানে রুপোন্তির ভাই? হ। ঐযে লম্বা কইরা ফর্সা। কয়েকদিন আপনের কাছে আসতো। রুপোন্তিকে আমি পড়াতাম। ওর ভাই সোহেল মাঝে মাঝে এসে আমার কাছে আবৃত্তি শিখতো।

কিন্তু আমি না থাকলেওযে আসতো তাতো জানতামনা। রাবুরমা আবার বললো সোহেল ভাইজান আসলে অনেকক্ষণ থাকে। সেইদিন সোহেল ভাইজান চইলা যাওয়ার পর দেখলাম রোজা বুজির চোখে পানি। মনে হয় কান্নাকাটি করছে। আমাকে বলোনি কেন? আপনে যদি ভাইজান মারধর করেন, সেইজন্য।

ভাবছিলাম আমিই বুঝাইয়া রোজা বুজিকে ফিরাইতে পারবো। সোহেল যখন আসতো তুমি কোথায় থাকতে? আমিতো ভাইজান রান্না বান্না করতাম। আমি যখন সামনে যাইতাম তখন তারা ইচির মিচির কইরা কি যেন বলে। রাত এখন সাড়ে এগারোটা। রুপোন্তিকে ফোন দিলাম।

অনেকক্ষণ রিং হওয়ার পর ধরেছে। হ্যালো রুপোন্তি! জি স্যার। এতো রাতে? কোন সমস্যা? তোমার ভাই সোহেল কি ফিরেছে? নাতো। এখনো ফিরেনি। কেন স্যার, কি হয়েছে? ওর ফোন নাম্বারটা দিতে পারবে? অবশ্যই দিতে পারবো স্যার।

কিন্তু ওতো দু’তিনটা সিম ইউজ করে। কোন্টা যে চালু রেখেছে কে জানে? একটু হোল্ড করেন, প্লিজ। তুমি ওর সবকটি নাম্বারই দাও। জি স্যার লিখেন। জিরো ওয়ান...।

কিন্তু স্যার ডিজুস নাম্বারটা আমার কাছে নেই। ওকে। অন্য গুলো ট্রাই করি। কিন্তু স্যার কি হয়েছে, বললেন না তো। না এমনি।

আচ্ছা রাখছি রুপোন্তি। পরে কথা হবে। ওকে স্যার। গুড নাইট। কিন্তু কোন নম্বরেই সোহেলকে পাওয়া গেলনা।

এতোক্ষণে মানুমিয়াও ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা। চোখে অন্ধকার দেখছি। আমি পড়ে যাচ্ছি দেখে মানুমিয়া দৌড়ে এসে আমাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিলো। ছয়দিন বিছানায় পড়েছিলাম।

কেউ আর আমার সোনামনির খোঁজ দিতে পারলোনা। রোজা আমার জীবনে হঠাৎ করে এসে আবার হঠাৎ করেই শূণ্যে মিশে গেল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।