আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মন্তব্যের সঙ্গে একমত, দ্বিমত এবং অন্যমত

হয়তো আমি কোন কিছু সম্পর্কে নিশ্চিত নই

ভয়েস অব আমেরিকার (ভোয়া) ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিচারপতি হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে নাতি জন্মগ্রহণ করলে তিনি মুখে মধু ও কপালে কাজলের টিপ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চিকিৎসকেরা তা দিতে দেননি। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি মন্তব্য করেন, ‘নিজেদের চিন্তার বাইরে কোনো বিষয়কে তারা গ্রহণ করতে পারেন না’। আমি অসম্ভব রকমের একমত বিচারপতি হাবিবুর রহমানের পর্যবেক্ষণের সাথে। অরিয়েন্টালিজম গ্রন্থে এডওয়ার্ড সাঈদ খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন, বস্তুগত জ্ঞানবিজ্ঞানে এগিয়ে থাকার সুবাদে ওয়েস্টার্ন মানুষ অরিয়েন্টালদের পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি আস্থা রাখতে চায় না।

যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসকদের এ মনোভাবের প্রকাশ সাঈদের এ বিশ্লেষণকেই প্রমাণিত করে আরেকবার। তাই শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মন্তব্য ওয়েস্টার্ন সংস্কৃতির যে কোনো দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মুখে মধু ও কপালে কাজলের টিপ দেওয়া আমাদের সংস্কৃতির অন্তর্গত হলেও যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতিতে এর কোনো আবেগিক স্থান নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের পর্যবেক্ষণ বা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে তারা কেন মেনে নিতে পারে না। পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা খুব কঠোরভাবে পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল।

আর পরীক্ষালব্ধ ফলাফল আসলে সবসময়ই অনানুষ্ঠানিক বা জীবনভর পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দিতে চায় না, কারণ এর কোনো সিস্টেমেটিক মেথডলজি নেই, নেই কোনো হাইপোথিসিস বা অনুমিত সিদ্ধান্ত। যদিও পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের যে কয়টি পর্যায় রয়েছে, তাতে এই পর্যবেক্ষণ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কোনো ধরনের সিস্টেমেটিক অ্যাপ্রোচের মধ্যদিয়ে না গেলেই সেটিকে খারিজ করে দিতে পাশ্চাত্য দুনিয়া একপায়ে খাড়া। আর সিস্টেমেটিক অ্যাপ্রোচের মূল বক্তব্যই হচ্ছে, প্রথম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করে তার পর নির্দিষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমে সুশৃঙ্খলভাবে একের পর এক কাজ সম্পাদন করা। অথচ পৃথিবীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারই কিন্তু কোনো ধরনের সিস্টেমেটিক অ্যাপ্রোচের দ্বারা হয়নি।

অন্যদিকে পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার অনেক ফসল পরবর্তী সময়ে ছলচাতুরির মাধ্যমে পশ্চিমাবিশ্ব প্যাটেন্ট করে নিয়েছে। আমাদের নিম গাছের ঔষধি গুণের কথাই ধরা যাক। এই উপমহাদেশের মানুষ শত শত বছর ধরে নিম গাছের ঔষধি গুণের কথা জানে এবং সে অনুযায়ী এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত প্রাচ্যের এই জ্ঞানটি পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা পাত্তাই দেয়নি। পরে যখন তারা নিজেরা এর রাসায়নিক গঠন বিশ্লেষণ করে এর উপযোগিতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হলো, তখন কিন্তু তারা ঠিকই কৌশলে এটিকে তাদের প্যাটেন্ট বানিয়ে নিলো।

অবশ্য পশ্চিমা চিকিৎসকেরা স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলে যার কারণে হয়তো অজানা বা পরীক্ষালব্ধভাবে প্রমাণিত নয় এমন কিছু গ্রহণ করতে তাদের অনীহা। * বিচারপতি হাবিবুর রহমান অন্য প্রসঙ্গে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী মনোনয়নের লড়াইয়ে ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের সিনেটর ওবামা জিতলে তা হবে বর্ণের বিজয়, আর নিউ ইয়র্কের সিনেটর হিলারি ক্লিনটন জিতলে তা হবে জেন্ডারের বিজয়। একদিক দিয়ে কথাটি ঠিক। কারণ এর আগে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট পায়নি যুক্তরাষ্ট্র, তেমনি কোনো নারী প্রেসিডেন্টও নেই সে দেশে। কিন্তু বিচারপতি হাবিবুর রহমান সে সেন্সে কথাটি বলেছেন, সেটি নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে এই দুই প্রার্থীর প্রতি আমার ব্যক্তিগত কৌতুহল ছিলো প্রথম থেকেই- প্রথমজনের প্রতি বর্ণের কারণে, দ্বিতীয়জনের প্রতি জেন্ডারের কারণে। ফলে অনেক আগে থেকেই এ দুটো বিষয়ে তারা কী বলেন, তাদের মনোভাব কী- তা জানার চেষ্টা করেছি, এখনো করছি। কিন্তু বারাক ওবামা যেমন বর্ণ ইসু্যতে তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করতে পারেন নি, তেমনি নারী ও জেন্ডার ইসু্যতে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন হিলারি ক্লিনটনের ভূমিকা। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাসহ অনেক জায়গাতেই দেখা গেছে, বারাক ওবামাকে বর্ণবাদবিরোধী ভূমিকায় নামাতে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতা প্রচারে নামার পর বারাক ওবামা এমন কোনো বক্তব্য রাখেন নি, যার দ্বারা বুঝা যায় তিনি বর্ণবাদবিরোধী কাজ করছেন।

শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের বর্ণবৈষম্য ঘুচানোর মতো কোনো এজেন্ডাও তার প্রচারণায় দেখা যায় নি। বরং অনেক বিষয়ে তার বক্তব্য শ্বেতাঙ্গদের পক্ষেই যায়। শুধু গায়ের রং সাদা বা কালো হওয়ার জন্য কাউকে মানসিকভাবে শ্বেতাঙ্গ বা মানসিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গ বলাটা ঠিক হবে না। তাছাড়া বর্ণের বিজয় কথাটিও স্পষ্ট নয়। এর মানে কি এই- শ্বেতাঙ্গ কেউ প্রার্থী হলে সেটি বর্ণের বিজয় হতো না? শ্বেতাঙ্গ কোনো প্রার্থী বর্ণবাদবিরোধী অবস্থান নিলে সেটি কি বর্ণের বিজয় হতো না? বর্ণের বিজয় বিষয়টি কোনো ব্যক্তিবিশেষের গায়ের রঙের ওপর নির্ভর করে না।

অবশ্য পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কেউ নেতৃত্ব বা ক্ষমতায় আসলে সেই জনগোষ্ঠীর অনেক উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেদিক দিয়ে বারাক ওবামার নেতৃত্ব আসা কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য ইতিবাচক। কিন্তু ওই যে, তার বক্তব্য থেকে এরকম কোনো ইঙ্গিত যে পাওয়া যায় নি! হিলারি ক্লিনটনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাঁর বক্তব্য কখনোই জেন্ডার সাম্য প্রতিষ্ঠার দিকে যায় নি, তেমনি নারীবাদ ইস্যুতেও তাঁর বক্তব্য পরিষ্কার নয়। বস্তুত তাঁর এজেন্ডা শুনে মনে হয়েছে, পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা ও দর্শন একজন নারীর মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে।

আমাদের দেশে তো বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা অনেকদিন ক্ষমতায় ছিলেন। নারী ইস্যুতে তারা কি তাৎপর্যপূর্ণ কোনো কাজ করেছেন? নাকি তারা নারী হয়ে পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন? সুতরাং হিলারি ক্লিনটন জয়ী হলে তা যে জেন্ডারের বিজয় হবেই, সেটি বোধহয় ঠিক নয়। * রিপাবলিকান পার্টির গত দুপর্বের শাসন দেখে এবং ছোট বুশের ভাঁড়ামি দেখে একটি পরিবর্তনের আশা করছিলাম মার্কিন রাজনীতিতে। যে কারণে ডেমোক্র‌্যাটদের প্রতি অসচেতন সমর্থন গড়ে উঠছিলো। কিন্তু প্রার্থী প্রচারণায় ডেমোক্র‌্যাটদের যে এজেন্ডা ও নীতি দেখা গেলো, তাতে এটা পরিষ্কার যে তাদের কাছ থেকে বিশ্ববাসী কোনো পরিবর্তনের আশা করতে পারে না।

নিজ স্বার্থের জন্য তারা যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে; শুধু কৌশলের দিক দিয়ে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র‌্যাটরা হয়তো আলাদা। বিশ্ব বাণিজ্য উদারীকরণ, পরিবেশ ইসু্য, ইরাক যুদ্ধ, ইরানের প্রতি মনোভাব, লাতিন আমেরিকার প্রতি হুমকি, কিউবার প্রতি অবরোধ, তৃতীয় বিশ্বের ওপর ছড়ি ঘোরানো, তেল-গ্যাস-কয়লা লুট, উপমহাদেশগুলোতে ঘাঁটি তৈরি- সব ইসু্যতেই রিপাবলিকান ও ডেমোক্র‌্যাটদের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে সরকার পরিচালনায় দল পরিবর্তন হোক, হিলারি বা ওবামা আসুক- তাতে বাকি পৃথিবীর আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই। কারণটাতো বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেই দিয়েছেন- ‘নিজেদের চিন্তার বাইরে কোনো বিষয়কে তারা গ্রহণ করতে পারেন না’। লেখাটি একই সাথে প্রকাশিত হয়েছে স্রোতের বিরুদ্ধে... গ্রুপে


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.