আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুরত্ব আর কতটুকু বাকী জীবনের গতি পথে ?

অনেকের মাঝেও একা থাকা যায়, নি:সঙ্গতায় কারো অনুভব ছুঁয়ে যায় ...

চারদিকে অন্ধকার ভীষণ প্রকট। নূন্যতম আলোক উৎসও নেই যে ফাঁক-ফোঁকড় গলে কোন রশ্মি রেটিনাতে প্রতিফলিত হয়ে ক্ষানিকটা আবছা আলোছায়ার রহস্যময়তায় মত্ত হবে। এখানে শুধুই চাপ চাপ, জমাট বাঁধা অন্ধকার। নিজের অবয়বও যেন হারিয়ে গেছে রালফ এলিসনের অনবদ্য সৃষ্টি ইনভিজিবল ম্যান -এর মত। নিজের মুখাবয়ব, হাত স্পর্শ করি পাগলের মত; মাংসের প্রলেপনে অস্থির চড়াই-উতরাইয়ে আমার তটস্ত হাত দুটো পরিভ্রমণ করে।

ইনভিজিবল ম্যানের নিজস্ব অনুভূতি কি ছিল ? বাইরের জগতের কাছেই তার শরীরটুকু অদৃশ্য ছিল নাকি নিজের এক হাত অন্য হাতকে স্পর্শ করলে সেখানে একরাশ শূণ্যতা ছাড়া কিছুই মিলত না! কোন মন্ত্রপাঠে কি এই মুহুর্তে নিজের শারীরিক অবকাঠামোকে প্রকাশিত করা সম্ভব ? এখানে নিঃশ্বাস ততটুকুই নেয়া যাচ্ছে যতটুকু দরকার। নিজেকে মৃত মনে হচ্ছে না আবার জীবিত কিনা সেটাও বুঝতে পারছিনা । অনুভুতি কেমন জড়তায় আচ্ছন্ন । আমি ঠিক কি এই মুহুর্তে ? কোমায় পরে থাকা কোন অর্ধ মৃত লাশ নাকি আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স সম্পন্ন রোবটের আলফা ভার্সন! আমি পেছনে ফিরে যেতে পারছিনা ! একপা এগুলেই পেছনের অদৃশ্য দেয়ালটাও বর্ধিত হয়ে যায়। এখানে ডানে যাওয়া যায়না; বামেও না।

কেউ বলে দিচ্ছে না; ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছাতেও নয়; দু'পাশের আর পেছনের রাস্তা যখন রুদ্ধ তখন সামনের গাঢ় থেকে প্রগাঢ় অন্ধকারের দিকেই পা বাড়াতে হচ্ছে। এ জায়গাটা চোরাকাদার মত। আমি সেই চোরাকাদার অতল থেকে অতলান্তে একটু একটু করে মজ্জমান । মনে হচ্ছে এক ঝাঁক মৌমাছি যেন গুঞ্জন করছে কাছাকাছি। শব্দটা জোড়ালো হলো।

মৌমাছি নয়; অনেক মানুষ কথা বলছে যেন। কেউ কি আমাকে ডাকছে ? সাহায্যের আশ্বাস কি ওগুলো ? আমার ভোতা অনুভুতি শিরশির করে ওঠে পলকে। কথাগুলো অস্পষ্ট তখনও, প্রতিধ্বনি শব্দের তীব্রতা বাড়াচ্ছে কিন্তু অস্পষ্টতা জোড়ালো করছে। আমার কান সজাগ হয়; অস্থির মনের লাগাম টেনে ধরি শক্ত হাতে; বুঝতে চাই কে ওরা, কি বলছে, কি চাইছে ? কোন দিক নির্দেশনা আছে কি আমার জন্য ? আমার মনোযোগ কাজে দিচ্ছে। কথা তখনও অস্পষ্ট হলেও একটু একটু করে আমি যেন আলাদা করতে পারছি প্রতিটা কণ্ঠস্বরকে।

এরা আমার চেনা, অতি জানা-শোনা মানুষ। হয়ত কারো কারো সাথে আমার অস্তিত্তের দাবী জড়িয়ে আছে। আমি পুলকিত হই; এরাই আমাকে নিয়ে যাবে এই কালকুঠুরি থেকে কিনবা নিতে আসছে খুব তাড়াতাড়ি শত শত মাইল আলোকবর্ষের পথ পাড়ি দিয়ে। আমার মনোযোগী মন এক পলকেই আমাকে ভ্রম থেকে বার করে আনে; যা ভাবছি তা নয়। ওপাশের বলয়ের কেউ আমার হাঁশফাঁশ করা মুহুর্ত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়।

শব্দ তরঙ্গ থেকে যেটুকু এখনও অনুভব করছি তাতে সংগত কারনেই আমাকে ফিরিয়ে নেয়ার কোন আহ্ববান নেই। মাথার উপর আশ্বাস নামক বলয়টা আমাকে নিরাশায় নিষিক্ত করে। অনুভবে আসে আমার এই গহ্বরের মধ্যে দিয়ে নিঃসঙ্গতাকে সাথী করে শুধুই সামনে এগিয়ে চলার কারণই যেন ওই মুর্তিমান বলয়- রাশি রাশি চাহিদা আমাকে ঠেলতে থাকে শুধু সামনে, আরো সামনে; একটু একটু করে নিজের মানব শরীরের রোবটিক হয়ে যাওয়ার কারণও এই ঘূর্ণায়মান বলয়। আমি কি স্বার্থপর নাকি একটু? নিজের অবয়ব স্পর্শের ভোতা অনুভূতি জাগ্রত করার আকাঙ্খা নিশ্চয়ই স্বার্থপরতা নয়! একটু আলোর অন্বেষণ নিশ্চয়ই কারো জন্য বিশেষ ক্ষতি বয়ে আনবে না! নিজের সাথে নিজের এই বাকবিতন্ডায় ভারাক্রান্ত লাগে। একটানা কতক্ষণ চলেছি কে জানে ! কতক্ষণ শুদ্ধ অক্সিজেন বুক ভরে নেয়া হয়নি কে জানে ! টলে উঠি আমি; কালো, শক্ত জমিনে ধপ করে বসে পরি।

কতক্ষণ এভাবে ছিলাম কে জানে ! কান্ত চোখে পিট্ পিট্ করে তাকানোর চেষ্টা করি। কোথাও কি এক চিলতে আলো দেখা গেল ? নিজের সম্পূর্ন অনুভূতি একত্রিত করে চোখ খুলি। এটা অন্য কোন জায়গা মনে হলো, কোথা থেকে যেন চিকন রেখার মত আলো এসে পড়ছে সরাসরি চোখের উপর। আমি আবার অস্থির হয়ে উঠি, দেখতে চাই বহু আকাংখিত এই উৎসকে। প্রাণপনে শক্তি সঞ্চয় করে উঠে বসি।

নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি হালকা আলোয় নিজেকে দেখা যায়। অদ্ভুত অনুভুতি; আবারও হাতদুটো হাতড়ে বেড়ায় নিজের শরীর; আমি ঘামে জবজবে ভেজা। পরোয়া করিনা। মাথা তুলে এদিক ওদিক তাকাই। আলোক উৎস চোখে পরে।

নিজেকে আবিস্কার করি আমার নিজের চিরচেনা ঘরে; জানালার পর্দার ফাঁক গলে আলো এসে পড়ছিল চোখে এতক্ষন। মাথা নীচু করে থাকি আমি। বুঝি প্রতিদিনের মত আজকেও বিছানায় নিজের শরীর এলিয়ে দেয়ার পর আমার আত্মা এই রোবটিক শরীরকে আবারও ছেড়ে গিয়েছিল কোন প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা শরীরের খোঁজে। কিন্তু বরাবরের মতই অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে কান্ত হয়ে আবার ফিরে আসে। জেগে উঠার পর আবার শুরু হয় সেই একঘেয়ে জীবন, বেঁচে থাকার প্রতিযোগীতা, সাংসারিক জটিলতা কিনবা চাহিদা।

আজোও কি সেরকম কিছুই হবে ? উত্তরহীন আমি উঠে দাঁড়াই। ধীর পায়ে রান্নাঘরে যেয়ে নিজের জন্য কফি বানাই। মগ ভর্তি কফি হাতে জানালার সামনে এসে দাঁড়াই। একহাতে জানালার ভারী পর্দাটা একটানে সরিয়ে দিই। আলোর বন্যা বয়ে গেল যেন।

নিকষ আঁধারে অভ্যস্ত চোখ ঝট করে বন্ধ হয়ে আসে। ধীরে ধীরে চোখ খুলি। ঝকঝকে গ্লাসের ভিতর দিয়ে দৃষ্টি যায় কচি সবুজ ঘাসে ভরা বিশাল মাঠে। বৃষ্টি হয়ে গেছে এক পশলা; রোদের হালকা হলদেটে রং তা বলে দেয়। মনে হয় জীবন ডাকছে যেন ওপাশে।

ওখানে যেদিকে খুশি ছুটে চলা যায়, কোন বাধ্যবাধকতা নেই। বুক ভরে তাজা বাতাস নেয়া যায়। আমি ভাবি আজ কেননা বার হয়ে আসি প্রতিদিনের সেই মৃত্যুর গোলকধাঁধা থেকে! ছুটে যাই; হেঁটে আসি। কাউকে ছুঁয়ে দেখি কিনবা কাউকে বলি, আমাকে ছুঁয়ে দেখ। অনুভ’তিহীন শরীরে জাগুক আজ শিহরন , ছুটুক তা বল্গা হরিণের মত- প্রতিটি শিরায়, ধমনীতে, রক্ত কনিকায়।

আজ একবার শুধু নিজের জন্য কারো সঙ্গ চাইব। শুধু নিজের জন্য বাঁচব। সবুজ ভেলভেটের মত ঘাসে ঢাকা মাঠ আমাকে পাগল করে ফেলে; মুক্তির আস্বাদে আপ্লুত হই আমি। ঘামে ভেজা শার্ট বদলানো দরকার। একটা চমতকার গোসল দরকার ।

সিডি প্লেয়ারটা ছেড়ে বাথরুমে যেয়ে ঝরনাটা ছেড়ে দেই । পানির শব্দ ছাপিয়ে গানের কথাগুলো খেলে যায় কানে- "বরষার প্রথম দিনে ঘনকালো মেঘ দেখে, আনন্দে যদি কাঁপে তোমার হৃদয়, সেদিন তাহার সাথে করো পরিচয়, কাছে কাছে থেকেও যে কভূ কাছে নয়..." পুনশ্চ : এটা অনেক দিন আগের লেখা। একদিন বন্ধু কিছু আইডিয়া দিল ; আমি লেখাটা শুরু করে মাঝে একটা লম্বা বিরতি দিয়ে এক সময় শেষ করলাম । প্রতিক্রিয়া ছিল , আমি এই কাহিনীকে আশাতীত মোড়ে দাঁড় করাতে পারিনি; কথা সত্যি ; হয়ত সেটা আমার লেখনী কিনবা অনুভব সীমাবদ্ধতা ছিল, নয়তো ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত- লেখক চাইলেই কাহিনীকে পথ থেকে তুলে এনে রাজবাড়ীতে স্থান দিতে পারে । ব্লগে প্রকাশ করব কি করবনা এই ভেবে ভেবে আজকে হঠাত লেখাটা দিয়েই ফেললাম ...


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।