আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুরত্ব

ছায়া ছায়ায় পথ হেটে চলি--ছায়া আমার সামনে ও পিছে।

বাবাকে কখনো চিঠি লিখা হয়নি। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে মোবাইলে ফোন করা যায়, অথচ সেটিও করা হয়নি গত ছ’বছরে। তার রক্ত আমার শিরায় উপশিরায়। তার শিখিয়ে দেওয়া মানব সভ্যতার ব্যাকরণ আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

ঘূণেধরা রোদে তার মুখটা মনে পড়ে প্রায়-ই। যে দূরত্ব তার সঙ্গে আমার সেটি আসলে দূরত্ব নয়, যদি অভিমান বলা হয় তাও ভুল হবে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে খুব ভোরে ঘুম থেকে জেগে বাবাকে একটা ফোন করি। বলি--বাবা ‘আমি’। বাবা আমার ‘আমি’ কথাটা শুনেই বুঝে যাবে ‘আমি’ বলছি।

তারপর কী বলবো তা ভেবেই আর ফোন করা হয়না। বাবা হয়তো আমার ফোন পেয়ে বলতো--কেমন আছোসরে তুই। সকালে নাস্তা করছস। তোর স্বাস্থ্য ভালতো। চাকরি--বাকরির কী খবর।

মাথা গরম করিস না। নিজেরা কষ্ট করছেন এই কথাটা কোন দিন বলবে না। ১৯৯৮ এ যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম তখন তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন। ২০০৫ সালের আগস্টের ৩০। এই দিনটির কথা আমি কোনদিন ভুলবো না।

সেদিন ছিল আমার মাস্টার্স ওরাল ভাইবা। শিাজীবনের পরিসমাপ্তির দিন। আর কোনদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীার খাতায় লিখতে হবে না, বাঘা বাঘা শিকদের সামনে ইদুরের মতো চুপটি মেরে বসে থাকতে হবে না। দুপুরের দিকে দুই জন এক্সটার্নালের কাছে ভাইবাটাও দিলাম। ভাইবা বোর্ড থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের ছোট্ট টিসিতে (টিচার্স ক্যাফেটোরিয়া) আড্ডা দিচ্ছিলাম।

চার দেয়াল, উপরে খোলা আকাশ। প্রতিদিন যেমন হয়, সেদিনটাও ঠিক সেরকমই ছিল। এর ঠিক দুই দিন আগে আমার সবচেয়ে ছোট্ট বোনের বায়াপসি হয়। রিপোর্ট দেওয়ার কথা আমার ভাইবার দিন। তবে ডাক্তাররা আগেই বলেছিলেন তেমন কোন সমস্যা হয়তো হয়নি।

খারাপ রিপোর্ট না আসার সম্ভাবনাই দিয়েছিলেন তারা। তবে ডাক্তারের কথায়তো আর ঈশ্বর চলেন না। আড্ডারই মাঝেই মেঝ ভাইয়ের ফোন। --তুই তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আয়। আমি বললাম--কেন, কোন খারাপ খবর? এ্যানির কোন সমস্যা হয়েছে।

তিনি বললেন--একটু সমস্যা হয়ে গেছে। তুই বাসায় আয়, জানতে পারবি। আমার প্রচণ্ড ইচ্ছা করছিলো এ্যানির বায়াপসি রিপোর্টটা যেন ভুল হয়। আমি আবার ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম--ক্যান্সার হয়নি তো। তিনি বললেন--এমনই।

ভাইয়ার এই কথাটা শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। চারদিক অন্ধকারে ঢেকে আসছিল। চোখে সব ঝাপসা দেখছিলাম। আমার ছোট বোন এ্যানি। মাত্রই কুমিল্লা মেডিকেলে মাত্র চান্স পেয়েছে।

ওর ইচ্ছে ছিল সিলেট মেডিকেলে পড়বে। তবে অর্থের যোগান দেওয়া সম্ভব না বলে শেষপর্যন্ত কুমিল্লা মেডিকেলে মাইগ্রেশন করে চলে আসে। আমি কাউকে কিছু না বলে সোজা বাসার পথে রওয়ানা দেই। সারাটি পথ আমার চোখ বারবার ভিজে আসছিল। সিলেট থেকে বাসে করে ঢাকা হয়ে কুমিল্লা আসছি।

বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে হয়ে যায়। এসে দেখি এ্যানিকে ঘিরে সবাই বসে আছে। যেন ও চিড়িয়াখানার কোন জন্তু। হাউমাউ করছে কাঁদছে আমার মা। বাবাকে দেখলাম কি যেন কাগজপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করছেন।

আমি বাবার সামনে গিয়ে বললাম--কি দেখছেন বাবা। ‘এ্যানির চিকিৎসার খরচ কত লাগবে রে। ’ কণ্ঠটা কেমন যেন কেঁপে উঠলো বাবার। বাবাকে কখনো এভাবে কথা বলতে শুনিনি। আমি বললাম--২০/২৫ লাখতো জোগাড় রাখতেই হবে।

‘আমার কাছে তো এতো টাকা নেই রে বাবা, কোত্থেকে পাই। আমার মেয়েটাকে তোরা বাঁচা’ বাবা এই কথাটি বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। বাচ্চার মতো কাঁদছেন আমার বাবা। এই অবস্থায় আমি বাবার কান্না কি থামামো, বুক ফেটে আমারও কান্না বেরিয়ে আসলো।

তিনি বললেন--তোর আর মেঝর জন্য ১০ লাখ রেখেছিলাম। ওটার ইন্টারেস্ট দিয়েই তো চলছি। ঘুষ খেতে পারিনি। শেষ বয়সে এসে সুদ খাচ্ছি। ওটা খরচ করলে কি তোর মন খারাপ হবে? বাবার এই কথাটা শুনে তার উপর আমার প্রচণ্ড রাগ হলো।

আমার ছোট্ট বোনটার জন্য টাকা খরচ হবে আর সেজন্য তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন। কতোটা অপারগ, অসয়াস্তি ঘিরে ধরলে একজন বাবা এভাবে বলতে পারেন। মনে আছে এ্যানির চিকিৎসার জন্য যখন আরও টাকা প্রয়োজন তখন আমাদের হাতে একটি টাকাও ছিল না। তখন কাজ করতাম প্রথম আলোতে। প্রথম আলোর তৌহিদ ভাই, সাহেদ ভাই এ্যানির চিকিৎসার অর্থ চেয়ে লিখতে চাইলেন।

তারা বললেন--তুই চিন্তা করিস না দু একদিনের মধ্যেই দেখবি ৫/১০ লাখ টাকা উঠে আসবে। আমি বাবাকে বললাম সেই কথা। বাবা কি যেন চিন্তা করলেন। বললো-- গ্রামের কিছু জমি বিক্রি করে দিব ভাবছি। ওটা দিয়ে বাকিটা টেনে নিয়ে যেতে পারবো।

বাবা একটি টাকা কারও কাছ থেকে সাহায্য চাননি। শুধু বলেছিলেন--এ্যানি সুস্থ হলে মানুষের সেবা করবে। সেটা কারও সাহায্যের বিনিময়ে নয়। আমার সেই বোনটির চিকিৎসা শেষ হয়েছে। ১২টা কেমো আর দেশ--বিদেশ করে শেষ পর্যন্ত এখন অনেক সুস্থ।

এতো দুর্যোগের মধ্যেই সে দুই মাস পড়ে ফার্স্ট প্রফ উতরিয়ে গেছে। এই আমার বাবা। কারও সাহায্য নিতেও যিনি ভয় পান। লজ্জা পান। মধ্যবিত্তের লজ্জা।

কেন্দ্রমূখী আমরা কখনোই হয়তো এই লজ্জা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। তবুও আমাদের এই সম্পদ বিলিয়ে দিতেও প্রচণ্ড ভয়। আমার এই বাবাটাকে কখনো বলা হয়নি, বাবা! আমি তোমার মতো হতে চাই। তোমার মতো আত্মবিশ্বাস আমারও চাই। তোমার ঘোলা চশমাটা পরিবর্তন করো না কেন? তোমার স্বাস্থ্য অনেক খারাপ হয়ে গেছে।

ইনসুলিন রেগুলার নিচ্ছতো। ...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।