আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চাকা ঘুরছে, চলছে মায়ার খেলা (শেষ অংশ)

অনেকের মাঝেও একা থাকা যায়, নি:সঙ্গতায় কারো অনুভব ছুঁয়ে যায় ...

(ক্রমশ)... এবার আমি তৈরী সন্ধ্যার পার্টির জন্য। এতকিছু নিয়ে তো আর বাসে ওঠা যায় না, তাই মিটার থেকে বিশ টাকা বেশী দিয়ে একটা সি.এস.জি অটোরিক্সার আরোহী হলাম । ধানমন্ডি যাব। ছ'টায় যাওয়ার কথা, সাতটায় রুবেলদের বাড়ির সামনে অটোরিক্সা থেকে নামি। বেশী আগে আসতে কেমন জানি লাগছিল আসলে।

বিশাল গেটের ওপাশে থাকা গার্ড পরিচয় জিগেষ করল। আমার হাতের উপহারগুলোর দিকে তাকিয়ে আমাকে মেপে নেয়ার ভাবটা বেশ পরিলক্ষিত ছিল। নাহ্, এই গার্ড আমাকে "স্যার, স্যার" করলনা, যদিও ভেতরে প্রবেশ করা গেল বিনা বাধায় । আলিশান বাড়ি, প্রশস্ত সবুজ লন। গাছের ফাঁকে ফাঁকে আলোক সজ্জা একটা মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করেছে ।

অনেকেই চলে এসেছে দেখলাম। বাঙালি দেখি আজকাল টাইম মেইনটেইন করতে শিখে গেছে! এখানে তেমন কারো সাথে আমার বিশেষ কোন সখ্যতা নেই; শুধু কিছু মুখ চেনা, চোখাচোখি হতে একটা সামাজিক হাসি বিনিময়। এদিক ওদিক তাকিয়ে রুবেলকে খুঁজলাম। অরেঞ্জ জুস হাতে লনে পাতা চেয়ারে বসে থাকা এক অনিন্দ্য সুন্দরীকে সাহস করে জিগেষ করেই ফেললাম রুবেলের কথা। মেয়েটা বলল রুবেলকে ভেতরে পাওয়া যাবে।

বাংলা কথায় ইংরেজী টানটা অনেক বেশী স্পষ্ট; বিদেশে ছিল নিশ্চয়ই । বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল । উরি বাপস্! আসল পার্টি তো এখানে । মিউজিক চলছে। সবকিছু খুব বেশী চকচক করছে।

রুবেলকে দেখা গেল । মজার ব্যাপার হলো রুবেলকে এই প্রথম পাঞ্জাবি পরিহিত দেখলাম! মেরুন রঙের, সোনালী কারুকাজের পাঞ্জাবীটাও সবকিছুর মত অসম্ভব রকম ঝলমল করছে। রুবেলও আমাকে খেয়াল করল। নিজেই এগিয়ে এলো। একান-ওকান হাসি দিয়ে বলল, "তুমি আসবে ভাবতেই পারিনি কিন্তু! পড়াশুনার ফাঁকে সময় হলো তাহলে !" কথায় কোন খোঁচা ছিল কিনা বুঝতে পারলামনা।

ফুলের তোড়াটা বাড়িয়ে বললাম, "শুভ জন্মদিন"। ধন্যবাদ বলে তোড়াটা হাতে নিল ও। সাথে সাথেই এক ইউনিফর্ম পরিহিত লোক ছুটে এল। বোধহয় সার্ভেন্ট কিনবা কেয়ারটেকার। রুবেলের হাত থেকে তোড়াটা নিল ।

আমি আর ভনিতায় না যেয়ে হাতে রাখা অন্য বক্সটাও সেই কেয়ারটেকারের হাতে দিলাম। "ঠিক সময়ই এসেছ। এখনি কেক কাটা হবে। এনজয় কর ...", বলেই রুবেল ছুটে যায় আরেক অতিথিকে স্বাগত জানাতে । সাড়ে সাতটার দিকে একটা ঢাউস আকারের কেক কাটা হলো।

কেকটা দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে একটা ছয় চেয়ারের ডাইনিং টেবিলের সমান! শুনলাম কেকের তিন-চতুর্থাংশ কোন এক এতিমখানায় দেয়া হবে! এগুলো নাকি রুবেলের পার্ট অফ সোশ্যাল ওয়ার্ক! এখন মিউজিক আরো জোরে বাজছে। আমার মাস্টার্স ক্লাসের আরো কয়েকজনকে পেয়ে গেলাম । শুনলাম পার্টি আসলে অনেক রাত পর্যন্ত চলবে। রাতের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা নাকি লনে করা হয়েছে। কয়েকজন বন্ধুদের সাথে চললাম।

ব্যুফে সিস্টেম, অনেক আইটেম ; কোনটা রেখে কোনটা খাই ! খাবার দেখেই খিদেটা টের পেলাম পুরোপুরি। একেবারে গলা পর্যন্ত তৃপ্তি সহকারে খেলাম । ওদিকে অতিথি সমাগম আরো যেন বেড়েই চলেছে। রুবেলকে অনেকক্ষণ দেখা যায়নি। ঘাড় ঘুড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই সেই ইংরেজী টানে কথা বলা মেয়েটার সাথে রুবেলকে দেখলাম; বেশ ঘনিষ্ঠভাবে বসে কথা বলছে।

এরই মধ্যে রুবেল পোশাক পালটে ফেলেছে। এবার একটা ব্ল্যাক প্যান্ট আর ব্ল্যাক শার্ট । হাতের নড়াচড়ায় দামী ঘড়িটা শার্টের হাতার ফাঁক দিয়ে উকিঁ-ঝুঁকি দিচ্ছে। ওদের দিক থেকে চোখ ফেরাতে ফেরাতে সাথের বন্ধুদের বললাম, "দোস্ত, খাওয়াটা বেশী হয়ে গেছে আসলে। গ্যাস ফর্ম করছে বোধহয়; বুকটা কেমন চিনচিন করছে !" এরকম গল্প-গুজবে রাত সাড়ে ন'টা হয়ে গেল।

এবার ফেরা উচিৎ। রুবেল তখনও সেই মেয়ের সাথে। আমি অনেকটা উপযাচকের মত ওদের মাঝে উপস্থিত হলাম। আমাকে দেখে রুবেলের সেই একান-ওকান হাসি। একটু নড়ে-চড়ে বসে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে, "বুঝলে, আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে পড়ুয়া ছাত্র।

বই ছাড়া আর কোনদিকে খেয়াল নেই ওর। " মেয়েটি সোজা আমার দিকে তাকিয়ে সেই ইংরেজী টানে বলে, "ওহ ! রিয়েলী ! ওর সাথে তখন কথা হলো কিন্তু পরিচয় হয়নি..." । সাধারন ক'টা কথা কিন্তু তাতেই মনে হলো , মন যদি একটা গ্লাসে ভর্তি পানি হয়, তবে তা এখনই ছলকে উঠতো! রুবেল বলল, "তুমি এখনই যাবে কেন ? এরপর তো নাচ-গান হবে । আসল পার্টি তো শুরুই হয়নি। " মেয়েটাও একি কথা বলে থাকার আহ্বান করল।

আহ্বানে সাড়া দেয়ার সুতীব্র ইচ্ছা হলো কিনতু কাল আমার ওরাকল কোর্সের ক্লাস টেস্ট আছে। অনেক পড়া জমে গেছে। কোর্স টিচার বলেছে দশ-বারো দিনের মধ্যে এই মড্যিউলের অনলাইন পরীক্ষাটা দিয়ে দিতে। কিন্তু এসব কথা এখন এদের বলা যাবে না। বললাম , "আসলে আমার আরেক জায়গা হয়ে বাসায় যেতে হবে তাই চলে যাওয়াটা জরুরী।

" ওদের সাথে বিদায় পর্ব শেষ হলো । বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বললাম, "ভার্সিটি কবে খুলবে জানিয়ো পারলে। " ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁই ছুঁই করছে তখন। আমার বাসা দূরে। এবার আর অটোরিক্সায় ফেরাটা সমীচিন মনে করলামনা।

তাছাড়া এই সময় কেউ যেতেও চাইবে না। একটা রিক্সা নিয়ে মেইন রোডে গিয়ে বাস ধরতে হবে। কিন্তু রিক্সা দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য খানিকটা হেঁটে সামনে এগুতেই একটা রিকশা পেলাম। সোবহানবাগ বাস স্ট্যান্ড যেতে চাইলাম।

ভাড়া কত জিগেষ করতে রিকশাওয়ালা বলল, "স্যার, আপনের যা মনে লয় দিয়েন। " চটপট উঠে পড়লাম রিকশায়। রিকশাওয়ালা খুব বেশী বয়স্ক নয় তবে সে তত জোড়ে টানতে পারছেনা খেয়াল করলাম। যদিও রাতের বেলা রিকশায় ঘোরাঘুরির আলাদা মজা আছে। চারদিকে সেই যাক্রিক শব্দগুলো নেই, আর আজকে বাতাসটাও চমৎকার।

সোবহানবাগ পৌঁছে এবার ভাড়া দেয়া পালা । কত দেব বলাতে রিকশাওয়ালার জবার , "স্যার ভাড়া চাওয়ার মতন মন নাই। তয় আমার অনেক ট্যাকা লাগবো। " এটা কেমনতর কথা আবার! রিকশাওয়ালা বলে, "স্যার, যেই বস্তিতে থাকি, আইজক্যা সকালের পর সেইখানে আগুন লাগসে। আমার ঘরটা পুইড়া গেসে।

মা মরা অন্ধ মাইয়াটা একা ছিল ঘরে, ওর শরীর ঝলসাইয়া গেসে। বাঁচাইতে পারসি কোন রকমে খালি । অহন ঢাকা মেডিকেলে আছে। কিনতু অষুধের ট্যাকা কই পাই স্যার ! মাইয়াটা খুব ছটপট করতেসে। আমার সেইটা দেখার মতন মন নাই; আপনি যা পারেন দেন স্যার।

আইজক্যা কারো কাসে ভাড়া চাই নাই, কিনতু কিসু সাহায্য চাইসি। " আমি ঠিক বুঝতে পারছিলামনা আমার প্রতিক্রিয়াটা কেমন হওয়া উচিত। বললাম, "এরকম তো অনেকেই বলে; আসলে সব মিথ্যা! আজকে কোথাও আগুন লেগেছে তাতো শুনিনি!" রিকশাওয়ালা জামাটা একটু উপরে তুলে পেটের কাছে বাঁধা ব্যান্ডেজটা দেখালো, "আগুনে পুড়সে স্যার। " কাহিনী কতটুকু সত্য বুঝতে পারিনা আমি। পকেটে কিছু খুচরো সহ দুটো পাঁচশ টাকার নোট আছে।

রিকশাওয়ালা সত্যি বললে এই পুরো টাকা দিয়ে কি আজকে রাতের জন্য হলেও কোন ওষুধ কেনা সম্ভব ? আর মিথ্যা হলে !!! আমি বেশ সাবধানী হলাম, ভাড়া বড়জোর দশ টাকা জানি আমি, বিশ টাকার একটা নোট বের করতে গিয়ে কি ভেবে পঞ্চাশ টাকার নোটটা বের করি, ”"এটা রাখেন, এভাবে তো আর পকেটে টাকা-পয়সা থাকেনা, দেখেন আরো অনেকেই তো আছে। " টাকাটা হাতে গুঁজে দিয়েই আমি হনহন করে হাঁটা দিলাম। পেছন থেকে রিকশাওয়ালাকে বলতে শুনি, "স্যার, আমার মাইয়াটার জন্য একটু দোয়া কইরেন। বেচারী খুব কষ্ট পাইতেসে। " বাস পেতে দেরী হলনা।

আজকাল বাসে রেডিও শোনা যায়। খবর চলছে। আবার সেই রাজনীতির প্যাঁচাল। সিটে চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসলাম। কানে এলো খবরে বলছে, আজ কোথায় জানি আগুন লেগে একটা পুরো বস্তিই পুরে গেছে।

উদ্ধার কর্মীদের পৌঁছতে একটু দেরী হয়ে যাওয়ায় হতাহতের সংখ্যাটা বেশীই । আমার হাতটা কেমন অজান্তে মানিব্যাগ রাখা পকেটের উপর চলে গেল। হঠাতই কেমন জানি ক্লান্ত লাগলো নিজেকে। বাসের জানালার কাঁচটা সরিয়ে দেই; ছুটন্ত বাসের কারনে তীব্র বাতাস চোখে-মুখে ধাক্কা খাচ্ছে। খবর তখনও চলছে।

বন্যা নাকি আবার হবে। আমি মনে করার চেষ্টা করি কয়েকমাস আগের বন্যা আর তারো আগের চট্টগ্রামের সেই ভূমিধ্বসের ঘটনা। খুব নাড়া দিয়েছিল । কিন্তু যখন নানা সংগঠন সাহায্যের জন্য আসে তখন কাউকে দশ, কাউকে বিশ এভাবে কতই বা হবে, বোধহয় সর্বমোট একশ টাকা খরচ করেছি। অথচ সপ্তাহখানেক আগে একটু আলগা শখ করেই পারসোনা মেনজ সেলুনে গেলাম।

শখের দাম লাখ টাকা বলে কথা! আমি সেখানে মাত্র শ'তিনেক খরচা করলাম কেবল চুলের পেছনেই । ফিরে আসার সময় কাউন্টারে রাখা ছোট ত্রান বাক্সে একটা দশ টাকার নোট খুব আত্মতৃপ্তি নিয়ে ফেলেছিলাম! ওদিকে খবর পাঠক রোবটিক ভঙ্গিতে বলে চলেছে আজ রাতে নাকি উপকুলীয় অঞ্চলে সুনামি হওয়ার আশংকা আছে। হায় আল্লাহ! সুনামি !!! আমার জানা মতে এমনিতেই ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশ একটা কঠিন অবস্থানে আছে। বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অতি বৃষ্টি, খরা - এই সব নিয়ে ফি বছর পেরেশান থাকে সরকার-পাবলিক। কেবল মাত্র আল্লাহই জানেন কিভাবে এত কিছুর পর দেশটা টিকে আছে।

এর মধ্যে যদি সুনামি আঘাত হানে তাহলে কি আর শেষ রক্ষা হবে ! বাস ছুটছে তখনও । এটা যদি অজানার দিকে যাত্রা হত! এক মুহুর্তের জন্য আজকে সকাল থেকে শুরু করে সেই রিকশাওয়ালা পর্যন্ত পুরো ঘটনাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল। মনে হলো রুবেল, সেই ইংরেজী টানে কথা বলা মেয়েটা, সেই রিকশাওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ওদের মাঝে একটা ছোট মেয়ে আছে । একে তো আমি চিনি না ! মাথাটা দপদপ করছে।

কাল আমার পরীক্ষা, অনেক পড়া আছে; কিনতু আজ রাতে বোধহয় পড়া হবে না। বুকটা কেমন চিন চিন করছে...!!!

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।