আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চাকা ঘুরছে, চলছে মায়ার খেলা (প্রথম অংশ)

অনেকের মাঝেও একা থাকা যায়, নি:সঙ্গতায় কারো অনুভব ছুঁয়ে যায় ...

(( ভূমিকা: আমার বেশকিছু লেখা বিশেষত লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে এক বন্ধু প্রায়শই কঠিন ক্রিটিসিজম ছুঁড়ে দেয় । ক্রিটিসিজমটা সমস্যা না তবে তার ধরনটা নিয়ে প্রবল আপত্তি ছিল আমার। কিন্তু সেটা বোধহয় ঠিকমত বোঝানো যায়নি আর তাই ভুল ভাবে ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত । মনে হলো , ধুর ছাই! সময় নষ্ট করে লেখার কি দরকার এতো । এরকম মেজাজ বিগড়ে যাওয়া দিনগুলোতে, শাওন (ব্লগার শাওন নয়) বলে বসল, "তোমাকে দুটো আলাদা, খুবই সাধারন প্লট দিব, যেটা দিয়ে তুমি একই লেখায় যোগসূত্র তৈরী করবে ।

দেখি তুমি আসলে কেমন লিখতে পারো !" শাওনের আবদার, "লেখার শুরুটা এমন হবে যে এর প্রধান বক্তব্য কিনবা শেষটা আঁচ করা যাবে না । লেখাটায় গতি থাকতে হবে; দুর্বোধ্য নয় তবে সূক্ষ সেন্স অফ হিউমার থাকতে হবে। জীবনের কঠিন দ্বিমুখী বাস্তবতা উঠে আসলেও সেটা নিয়ে খুব বেশী ব্যক্তিগত উপদেশ (শাওনের উপদেশ ভাল লাগে না একেবারেই) দেয়ার দরকার নেই । ওটা পাঠককেই ভেবে নিতে হবে । " আমি শুনে গেলাম, ছোকড়া বলে কি এগুলো! তবে ও বলার পর পরই আমি প্রথম দু'টো প্যারা লিখে ফেললাম; আর তারপর মাথা খালি হয়ে গেল! একটা লাইনও লিখতে পারছিলামনা।

ভীষন অস্বস্তি হচ্ছিল! পরীক্ষা, চাকরী - দু'টোর চাপে পিষ্ট প্রায় আমি অপেক্ষা করলাম শুক্রবারের এই ছুটির দিনটার। লম্বা ঘুম দিয়ে উঠে লিখা শুরু করলাম আবার। এই লেখায় "আমি" এক বুদ্ধিদীপ্ত, আবেগী, এ যুগের তরুণ। স্বল্প পরিচয়ে আমার দেখা ও জানা শাওনকে খানিকটা ধার করে নিয়েছি এ লেখাতে । তবে আবশ্যই কাল্পনিকতা আর বাস্তবিকতার অসম মিশ্রনে এই লেখার জন্ম ।

শাওনের আবদার কতটা রক্ষা করতে পেরেছি তা জানিনা কিন্তু ওর জুড়ে দেয়া শর্ত শেষ পর্যন্ত আমার লেখাকে সীমাবদ্ধতা এনে দেয়নি একেবারেই; তবে মাঝে মাঝেই মাথা খালি হয়ে যাওয়া সেই অনুভূতিটা ফিরে ফিরে আসছিল ...। )) ========================= এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর থেকে আজকাল পত্রিকাগুলো প্রতিদিন যে হারে চমকের পর চমক দিচ্ছে তা যে কোন কাপড় কাচা সাবানের বিজ্ঞাপনের প্রতিশ্রুতিকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে । অবশ্য আজকাল আর উত্তেজিত, চমকিত হইনা । ছোটবেলায় শূন্যস্থান পূরণ শেখাটা কাজে লাগাচ্ছি । একটা লম্বা ড্যাশ যুক্ত শিরোনাম আগেই ঠিক করে রেখেছি, শুধু পত্রিকা দেখে নেতা-নেত্রীদের নামগুলো বসিয়ে ফেলি ! যদিও উনারা চৌদ্দ শিকের বাইরে থাকলেও আমি যা ছিলাম ভেতরে থাকার পরও আমি তাই আছি ।

সেই ভবঘুরেপনা আর কুছ পরোয়া নেই ভাব নিয়ে এখনো দিব্যি খাচ্ছি-দাচ্ছি, ঘুরছি-ফিরছি । বেসম্ভবরকম ব্যস্ত লোকজন যা দেখেনা আমার তা দেখার অঢেল সময় ! তবে আমার মগজে একটু-আধটু ঘিলু আছে। পড়া-লেখায় সেরা ছাত্রটি না হলেও ফেলে দেয়া যায়না আরকি। ক্যাম্পাসের, বিশেষতঃ জুনিয়র মেয়েরা মাঝে মাঝেই প্রসারিত অধরে, ক্লোজআপ হাসি দিয়ে নোট চেয়ে নেয় । আর আমি অভাগা অন্য আশায় বুক বাঁধি , এইবার বূঝি শিকে ছিঁড়ল! কিন্তু হায় ! বিধি বাম! টিউব থেকে পেস্ট বের হলে যেমন আর ভেতরে যায় না তেমনি নোটগুলো আর ফেরত আসেনা ।

উপরন্তু সেই জুনিয়র অধরাদের যখন ক্যাম্পাসের অমুক এবং তমুক সিনিয়র ভাইদের সাথে ফুচকা খেতে দেখি তখন মনে হয় মনটা যে কেন মেলামাইন দিয়ে তৈরী হলনা ! আজকে মেজাজটা কেন জানি বেশ ফুরফুরে । ক্লাস নেই বলেই হয়ত; কেবল ক্যাম্পাসের মেয়েদের চিকন চাহনি আর সুললিত কণ্ঠের অভাববোধ একটা চিনচিনে অনুভূতি তৈরী করছে মাঝে মাঝেই । আজ এক সহপাঠির জন্মদিন । ঘনিষ্ঠ নয় তারপরও দাওয়াতপত্র গ্রহণ করেছিলাম কারণ অনেকেই আসবে, দেখা-সাক্ষাৎ হবে- এটুকু মনে হতেই আবার সেই চিনচিনে অনুভূতি ! উপহার কেনাটা বাড়াবাড়ি রকমের ঝক্কি নিঃসন্দেহে । ফিজিক্যাল স্ট্রাকচার অর্থ্যাৎ উপহার সামগ্রীটির আকার-প্রকার, ওজন, একটা চকচকে মোড়ক; অপরদিকে লজিক্যাল স্ট্রাকচার অর্থ্যাৎ যার জন্য কেনা হবে তার বয়স, তার সাথে সম্পর্ক, তার ব্যক্তিত্ত্ব কিংবা অর্থনৈতিক অবস্থা, উপলক্ষ্য আর সর্বপরি দাম- এসব ব্যাপার কোন ভাবেই এড়িয়ে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবেনা ।

আমার সহপাঠিটি আবার বড়লোক গোত্রিয়। লাল রঙের চকচকে গাড়ি হাঁকিয়ে ক্যাম্পাসে আসে । অনেক হোমড়া-চোমড়া লোকের সাথে তার পরিচিতি । কিছু কিছু শিক্ষকদেরও দেখেছি তার সাথে অবনত মস্তকে কথা বলে। আর মেয়েরা তো তার গাড়ির হর্নের আওয়াজ পেলেই এত দ্রুততার সাথে আয়নায় চোখ বুলিয়ে, গালে দু'বার পাফ মেরে, চুলটা ঠিক করে নেয় যে আমি ঈর্ষা করার সময়টুকুও পাইনা! এহেন মোস্ট এ্যলিজিবল ব্যাচেলর, পাত্তিওয়ালা ছোকরার জন্য উপহার কেনা আসলেই চাট্টিখানি কথা না ! গলায় বাঁধার টাই দেব নাকি একটা ব্র্যান্ড পারফিউম দেব নাকি একটা ডাবল লেয়ার, ডেকোরেটেড বার্থডে কেক ! বাড়ির বড় ছেলে কিন্তু বাপের ঘাড়ে সিন্দাবাদের দৈত্যের মত চেপে আছি - এই অনুতাপ থেকে রেহাই পেতে টিউশনি করাই অনেক বছর ধরেই ।

ইন্টার পড়ুয়া মেয়ে স্টুডেন্টের কমতি নেই। সেদিন হঠাৎ করেই ওরাকল-ডিবিএ কোর্স টিচার বলে বসলেন পুলিশদের কম্পিউটার কোর্সের ক্লাস নিতে পারব কিনা । পুলিশদের ওরাকল ডাটাবেজ শেখাতে গিয়ে উনার পাঠানো এক টিচারের একা একা "ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা" ! অতঃপর অনেকটা সহকারী টিচার হিসেবে আমাকে যোগদানের প্রস্তাব। আমার চোখে আবার থানার ওসি নয়, বরং ওরাকল OCP সার্টিফাইড হওয়ার স্বপ্ন; কবে যে অনলাইন পরীক্ষাটা দিব ! একটা চাকরী করেছিলাম কিছুদিন, কিন্তু পড়াশুনায় যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। টাকার অংকটা কম; পরিশ্রমটা বেশী ।

তবে এই সুযোগে পড়াশোনার পরিমানটা বেড়ে যাবে, কনসেপ্ট ক্লিয়ার হবে বলেই রাজি হলাম। প্রথম দিন পল্টন থানার গার্ড আমাকে আটকে পরিচয় জানতে চাইলে, কোর্স টিচার পরিচয় দেয়ার পর তো সে "স্যার, স্যার..." করেই অস্থির । ক'দিন আগে ঘটে যাওয়া ছাত্র-পুলিশ-আর্মি গোলযোগের টেকনোলজিক্যাল প্রতিশোধ নেব কিনা ভাবছিলাম মনে মনে। কিন্তু ক্লাসে পুলিশ সুপারও যখন আমার মত ছোট-খাট ছোকড়াকে "স্যার, স্যার" বলে ডাকেন তখন নিজেকে কেউকেটা ভেবে আত্মতৃপ্তি পাই । এত দীর্ঘ কথার লুপের কারণ হলো, আমার মানিব্যাগ নামক সিস্টেমে অর্থ নামক প্রোগ্রামটিকে কম্পাইল করতে গেলে FATAL ERROR -এর সম্মুখিন হতে হয় অহরহ।

এহেন আমার জন্য বিলাসিতা বাতুলতা হলেও আজকে আমার দাতা-হাতেম-তাঈ হয়ে একটা দামী কিছু কিনে ফেলতে ইচ্ছা করছে খুবই। এটা কি কোন ধরনের ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স ! সবার মাঝে নিজের উপস্থিতিকে একটা দামী গিফট বক্সের সাহায্যে উল্লেখযোগ্য করে তোলার চেষ্টা নয় তো ! তাতে আমার পাতে হয়ত মুরগীর বড় পিস্ টা উঠবে কিনবা বার্থডে কেক এর বড় করে কাটা, এতটুকু না ভেঙ্গে যাওয়া টুকরাটা আমাকেই সাধা হবে, সাথে একটার বদলে দুইটা কোকের ক্যান আর সামনের বছরের জন্য আমার দাওয়াতপত্রটা অবধারিতভাবেই নির্ধারিত হয়ে যাবে! আমি WESTECS থেকে একটা শার্ট কিনব বলে ঠিক করলাম। ওদের শার্টের বক্সটা ভালো লাগে বেশ। ডিসকাউন্ট অফার গুলোর সময় শেষ ! তাই চার অংকের দাম লেখা ট্যাগওয়ালা একটা শার্ট শেষ পর্যন্ত কিনেই ফেললাম । হঠাৎ মনে হল রুবেল'কে (আমার সেই সহপাঠি) পাঞ্জাবিতে দেখিনি এখন পর্যন্ত ।

একটা পাঞ্জাবি কিনলেই হতো আসলে। পরক্ষণেই মনে হলো, না কিনে ভালই হয়েছে, রুবেল নিশ্চয়ই পাঞ্জাবি পছন্দ করবেনা। শার্টের বড় বক্স হাতে WESTECS থেকে বার হলাম। অথচ কেন জানি খালি খালি লাগছে তারপরও! একটা ফুলের তোড়া কিনলে কেমন হয়? নিজেকেই প্রশ্ন করি। ফুলের দোকানে গিয়ে তো মাথা ঘুড়ে যাওয়ার উপক্রম ।

কত সুন্দর সুন্দর, নাম না জানা, বিদেশী ফুলের ছড়াছড়ি। কিন্তু দাম করতে গিয়ে চুপসে যাই। ফুলের বাগানে, মানে দোকানে আর কি, নিজেকে অযাচিত কীট মনে হয় তখন। "জোটে যদি মোটে দুই'টি পয়সা, একটিতে খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি; আরেকটিতে ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী ", এরকম কিছু একটা পড়েছিলাম একসময়, ঠিকমত মনেও পড়ছেনা। কারণ সহজ কবিতাটা এখন দুর্বোধ্য লাগছে ! শেষ পর্যন্ত একটা সাজানো ফুলের ঝুড়ি কিনলাম।

বিক্রেতার চার অংকের হাঁকানো দামকে কোন মতে তিন অংকে নামিয়ে আনতে অনেক বাক্যব্যয় হয়েছিল অবশ্য। ...(চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।