আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডায়ানা বদলে দিয়েছিলেন ব্রিটেনকে



ডায়ানা রাজবধূ ছিলেন। তবে মনের দিক থেকে রণশীল ব্রিটিশ রাজপরিবারের একজন হয়ে উঠতে পারেননি প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে প্রায় ১২ বছর ঘর করার পরও। রাজবধূ থাকাকালে তিনি এমন কিছু কাজ করেছেন, যা ছিল রাজপরিবারের জন্য বিব্রতকর, তবে জনগণের একজন হয়ে ওঠার জন্য বেশ সহায়ক। এসব ‘বিব্রতকর কাজ’ তাঁকে যেমন বিতর্কিত করেছে, তেমনি বাড়িয়েছে কাছের মানুষদের সংখ্যা। ৩৬ বছরের ছোট্ট জীবনে ডায়ানা কেবল বাড়িয়েই গেছেন কাছের মানুষ।

মৃত্যুর ষষ্ঠ দিনের মাথায় ১৯৯৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর শেষকৃত্যের দিনে পুরো লন্ডন শহর ভেঙে পড়েছিল ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে। অন্তত ১০ লাখ মানুষ ধীর পায়ে হেঁটে তাঁর কফিনে ফুল দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিলেন ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথসহ রাজপরিবারের রণশীল মানুষেরাও; যাঁরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে সচরাচর কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন না। আর টেলিভিশনে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানটি দেখেছিলেন বিশ্বের প্রায় ২০০ কোটি ভক্ত-অনুরাগী। একজনমাত্র মানুষের মৃত্যুতে কোটি কোটি মানুষের অশ্র“।

ডায়ানা এভাবেই যেন জাদুমন্ত্র দিয়ে ভালোবাসার সুতোয় মানুষকে বেঁধে রাখতেন। একে একে চলে গেল ১০টি বছর। এখনো কত জীবন্ত তাঁর স্মৃতি! এখনো তিনি বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান ব্রিটিশ। জীবদ্দশায় তিনি দামি পোশাক যদি নাও পরতেন, না থাকতেন ট্যাবলয়েডের পাতায়, তবু তিনি বেঁচে থাকতেন, আজও যেমন আছেন। রণশীল ব্রিটিশ রাজতন্ত্রকে আধুনিকতার প্রলেপ তিনিই দিয়েছেন।

দরিদ্র, যন্ত্রণাকিষ্ট শিশুটির পাশে দাঁড়ানোর জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন তিনিই। বসনিয়া, এঙ্গোলাসহ বিভিন্ন দেশে ভূমি মাইনের বিরুদ্ধে প্রচারে তিনিই নেমেছেন, ইন্দোনেশিয়ায় কুষ্ঠ রোগীর শয্যাপাশে বসে রোগীকেই বিব্রত করে ছেড়েছেন। রণশীল এমপিরা নাখোশ হওয়া সত্ত্বেও তিনিই প্লাকার্ড ধরে দাঁড়িয়েছেন পরিবেশ রার আন্দোলনে। ডায়ানার মতো একজন বেশ কম লেখাপড়া করা নারীর জন্য এ অনেক বড় অর্জন। সম্ভবত এ কারণেই মৃত্যুর এক দশক পরও সব ব্রিটিশের মনে তাঁর বিরামহীন উপস্থিতি।

সব না হলেও অধিকাংশ তো বটেই। ব্রিটিশদের জীবনে-অস্তিত্বে ডায়ানা যেভাবে যেখানে লুকিয়ে আছেন, এখন সময় সেগুলো খুঁজে দেখার। ২. ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ কখনো সাাৎকার দেন না। সমালোচকেরা বলেন, নিজের দুর্বলতাগুলো যাতে বেরিয়ে না যায়, আবার ঠাট বজায় থাকে, তার জন্য এ এক দারুণ কৌশল। রানি হওয়ার পর গত ৫৪ বছরে একবারও গণমাধ্যমের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি রানিকে।

রাজপরিবারের সমালোচনা করা যাবে না, ব্রিটেনে এ এক অলিখিত নিয়ম। সব গণমাধ্যমকে তা কঠোরভাবে মেনে চলতে হয়। রাজপরিবারের সদস্যরাও একই রকম। আভিজাত্য তাঁদের অলংকার। রাজপরিবারের সদস্যরা বাইরে বের হলে সবাইকে তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

১৯৮১ সালের ২৯ জুলাই প্রিন্স চার্লসের বধূ হয়ে আসার পর ডায়ানা স্পেনসারের তা ভালো লাগেনি। তিনি রাজবধূ থাকা অবস্থায় বিভিন্ন কনসার্টে যেতেন, কখনো চার্লসকে সঙ্গে নিয়ে, কখনো একাকী, কনসার্টের মঞ্চে উঠতেন, আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতো হাত তালি দিতেন, প্রকাশ্যে কিছুটা হই-হুল্লোড় করতেন, নাচতেনও। স্যার এলটন জনের বন্ধু হন এভাবে। তিনি সাধারণের মধ্যে গেলে তাঁদেরই একজন হয়ে যেতেন। ঘনিষ্ঠদের জড়িয়ে ধরতেন, চুমু খেতেন।

১৯৮৫ সালে প্রিন্স চার্লসের ৩৭তম জš§দিনে ডায়ানাই উঠে গিয়েছিলেন মঞ্চে। তাঁর আবেগের প্রকাশ ছিল এ রকম, এভাবে। বলার অপো রাখে না, রাজপরিবারের সদস্যরা, স্বামী চার্লস, বা পাথর-হƒদয়ের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথÑকেউই এসব পছন্দ করেননি। একটা সময় রানি বুঝতে পারেন কোথায় যেন একটা ভাঙনের শব্দ। রাজপরিবার নিয়ে মানুষের ােভ।

শুরুটা করেছিল এমওআরআই নামে একটি সংগঠন। সেটা ১৯৬৯ সালে একটা জরিপ করে। তাতে ১৮ শতাংশ ব্রিটিশ অভিমত দেন, তাঁরা রাজতন্ত্রের বিলোপ চান। এরপর রাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তা নিয়ে হাজারও জরিপ হয়েছে। এখন অবশ্য রাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তা ৮৫ শতাংশ।

এই জনপ্রিয়তার জন্য কেউ যদি অবদান রেখে গিয়ে থাকেন, তিনি ডায়ানাই। রাজপরিবারের সদস্যরা এখন আর ততটা অনুদার নন। যে রানি ডায়ানাকে পছন্দ করতেন না, তিনি এখন প্রয়াত প্রিন্সেসের কবরে শ্রদ্ধা জানাতে যান দু-হাতভর্তি ফুল নিয়ে। এমনকি সিংহাসনের উত্তরাধিকারে রাজপরিবারের নারী সদস্যরাও সমান অংশীদার। দীর্ঘ বিতর্কের পর সেটাও মেনে নিয়েছেন তিনি।

এমওআরআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট ওরচেস্টারের ভাষায়, অবশেষে রাজতন্ত্র বুঝতে পেরেছে যে জনগণের সমর্থনের ওপরই তারা দাঁড়িয়ে আছে, আর তাদের পতনও জনগণের কাছে। আর এই আধুনিকতা ও বদলে যাওয়ার ধারণা তৈরিতে সহায়তা করেছেন ডায়ানা। প্রিন্সেসের মৃত্যুই এই ‘বোঝা’টা আরও দ্রুত করেছে। ক্যামিলা পার্কারের রানি হওয়া উচিত কি না, ডায়ানার মৃত্যুর পর মাত্র ১৫ শতাংশ ব্রিটিশ এ ধারণা সমর্থন করেছিলেন। আজ এই সমর্থন পৌঁছেছে ৩৮ শতাংশে।

ওরচেস্টারের মতে, রাজতন্ত্রের পরিবর্তনের সঙ্গে বদলেছে জনগণের ধারণাও। রাজতন্ত্রের প্রতি তাঁদের ধারণা অনেকটা স্বাভাবিক। এই ধারণা বদলের জায়গায় পুরোপুরি নেতৃত্ব দিয়েছেন ডায়ানা। সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার মনে করেন, ডায়ানা আমাদের শিখিয়ে গেছেন নতুনভাবে ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ার উপায়। ১৭ বছর পাদপ্রদীপের আলোয় থাকাকালে তিনি অভিজ্ঞ হয়েছেন, অভিজ্ঞ হয়েছে ব্রিটেনও; তিনি বদলেছেন, বদলেছে ব্রিটেনও।

৩. প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ডায়ানা তাঁর ছেলেবন্ধু ব্রিটিশ হার্ট সার্জন হাসনাত খানের স্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কল্পনা ও হতাশা তাঁর মনোজগৎকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল ওই সময়। তাঁর এই স্বপ্ন ছিল এরই বহিঃপ্রকাশ। এরপর তাঁর জীবনে এল চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী দোদি আল ফায়েদ। দুজন মুসলিমকে বন্ধু ও প্রেমিক হিসেবে বেছে নিয়ে তিনি ব্রিটিশ সমাজকে সহিষ্ণুতা আর ধৈর্যের পরীায়ও ফেলেন।

কৃষ্ণাঙ্গ এমপি, বর্তমানে ব্রিটেনের সমতা ও মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনের চেয়ারম্যান ট্রেভর ফিলিপস মনে করেন, গায়ের রং, ধর্ম নিয়ে ব্রিটিশদের যে উদ্বেগ, তা ডায়ানাকে কখনো ছুঁয়ে যায়নি। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, ব্রিটেন একটি বহু সংস্কৃতির দেশ, নানা বর্ণের মানুষের দেশ। গোড়া, শেতাঙ্গ ব্রিটিশরা কখনো তা মেনে নিতে পারেননি। তাঁর রহস্যজনক মৃত্যুর জন্য কি এই মেনে না নেওয়াটাই দায়ী! ৪. নারীবাদীরা কিন্তু ডায়ানার সমালোচনা করতে ছাড়েন না। ব্রিটিশ নারীবাদী লেখিকা নওমি উলফের দাবি, ডায়ানা লিঙ্গসমতায় আগ্রহী ছিলেন না।

তিনি ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের সমালোচনা করতেন, এটা পুরোনো ধাঁচের ও রণশীলÑসে কারণে; পুরুষদের আদর্শ ও বিশ্বাসকে সেখানে বেশি মূল্য দেওয়া হয়, সে কারণে নয়। অনেক কমিউনিস্টের কাছে ডায়ানা কেবলই একজন বহুগামী। অনেকে স্মরণ করিয়ে দেন, রাজবধূ না হলে কে ডায়ানার খোঁজ রাখত। আসলে এসব আলোচনা-সমালোচনাই তীব্রভাবে বাঁচিয়ে রাখছে ডায়ানার স্মৃতি। কল্পনা করুন তো, ডায়ানা এখনো বেঁচে আছেন।

৪৬ বছর বয়সে নতুন একজন ছেলেবন্ধু নিয়ে ম্যানহাটনের একটি অ্যাপার্টমেন্টে দিন কাটাচ্ছেন। এ অবস্থায় তিনি কি জনপ্রিয়? সম্ভবত। কিন্তু কিংবদন্তি? সম্ভবত না। তরুণ বয়সে মারা গিয়ে নিজের অমরত্ব নিশ্চিত করেছেন ডায়ানা। চামড়ায় ভাঁজ পড়ার আগে মৃত্যুই শ্রেয়।

(আজকের প্রথম আলোয় প্রকাশিত)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.