আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মেইড ইন বাংলাদেশ : একটি চলচ্চিত্র (????) রিভিউ



মূলগল্প: আনিসুল হক। চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী। 29 ডিসেম্বর, 2006। মুক্তি পেল মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী'র দ্বিতীয় ছবি মেইড ইন বাংলাদেশ। ফারুকী একজন গুণী নির্মাতা।

জীবনের সহজ সব কথাকে তিনি সহজভাবেই বলেন। অহেতুক ভারিক্কি আনার চেষ্টা করেন না। তার চরিত্র গুলোও খুব সাদামাটা ধরণের হয়। সংলাপে নীতি ও উপদেশের, সর্বোপরি কঠিন কঠিন শব্দের বাহুল্য নেই। একজন দর্শক খুব সহজেই গল্প ও চরিত্রের সাথে একাত্মতা বোধ করে।

'মেইড ইন বাংলাদেশ' ছবিটির গল্প মোটা দাগে দুইভাগে বিভক্ত: প্রথমভাগেঃ এক বেকার যুবক মফস্বল থেকে (জাহিদ হাসান) চাকরি খুঁজতে ঢাকায় আসে। ঢাকায় এসে মামার বাড়িতে ওঠে এবং অবধারিতভাবে চাকরি বাকরির কোনো হদিস পায় না। মামার সাথে তার খিটিমিটি, পাশের বাড়ির বিবাহিত রমণী যার হ্যাসবেণ্ড বিদেশে, তার সাথে আধো প্রণয় - সূক্ষ্ম ফারুকীয় রসবোধ - সব কিছুর মধ্যেই মৌলিকত্বের ছোঁয়া। দ্বিতীয়ভাগে : এরপর হুট করেই আমরা জাহিদ হাসানকে আবিষ্কার করি - ফেলে আসা মফস্বলের ডিসি অফিসে, যেখানে সে একটি পিস্তল এবং এক ব্যাগ বোমা নিয়ে হাজির হয়। এবং জিম্মি করে সেই শহরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি ও পুরো প্রশাসনকে।

তার কিছু দাবী সংসদে পাস না করা পর্যন্ত সে তাদের বন্দী রাখার হুমকি দেয়। এবং বিভিন্ন হাস্যরসাত্মক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গল্প কাইমেক্সের দিকে যেতে থাকে। গল্প যত সামনে যেতে থাকে হিউমারগুলোও সূক্ষ্ম থেকে ক্রমশ: স্থূল হতে থাকে এবং পরিমিতি বোধের অভাব দেখা যায়। এক ধরণের উইশফুল থিংকিং স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শেষে দেখা যায়, জাহিদ হাসানের বোমা এবং পিস্তল দুটোই নকল।

সে একধরণের শিক্ষা দেয়ার জন্য কাজটা করেছে। গল্পের প্রথমভাগ এবং দ্বিতীয় ভাগ পৃথক পৃথকভাবে দুটো গল্প। এবং একটি আরেকটির সাথে কোনোক্রমেই সম্পৃক্ত নয়। প্রথমভাগের বেকার যুবকটিকে আমরা কোথাও ডেসপারেটলি ফ্রাস্টেটেড অবস্থায় দে খতে পাই নি যাতে আমরা দ্বিতীয়ভাগের ডেসপারেট ছেলেটির জন্য প্রস্তুত হতে পারব। বরং প্রথমভাগের জাহিদ হাসান ছিল অনেকটাই গা ছেড়ে দিয়ে ফুরফুরে মেজাজের - যে কি না পরকীয়া প্রেমের নিষিদ্ধ আনন্দের প্রায় কাছাকাছি।

তাই এই ছেলেটিই যখন প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় মানুষগুলোকে জিম্মি করে- দর্শক এক ধরণের ধাক্কা খায়। চলচ্চিত্র পরিভাষায়, জাম্প কাট বলে এক ধরণের শব্দ আছে। তাত্তি্বক বিশ্লেষণে না যেয়েও বলা যায় - সেই জাম্প কাট প্রয়োগ করতে গেলেও ন্যারেটিভ বা গল্পের স্বার্থে দর্শককে প্রস্তুত করে নিতে হয়। গল্পের প্রথম এবং দ্বিতীয়ভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতার তীব্র অভাব বুকে ব্যথার মত বেজেছে । কারণ আমরা যারা চলচ্চিত্র মাধ্যমটিতে কাজ করতে চাই - অন্তত তাদের কাছে ফারুকী ভাই একটি দর্শন গ্রন্থের মত।

গল্পের সমন্বয়হীনতার অভাবে এটি পূর্ণাঙ্গ ছবি হয়ে ওঠে নি, বরং দুটি আলাদা আলাদা গল্পের সমন্বয়ে 'এক টিকিটে দুই ছবি' হয়ে উঠেছে। আমি বিশ্বাস করি - একটি মূল গল্প থাকে সিনেমায়। সেই মূল গল্পকে সমর্থন দেবার জন্য যতগুলো সাবপ্ললট প্রয়োজন কাহিনীকার তা তৈরী করেন। কোনো সাবপ্ললটই মূল গল্পের জন্য বাহুল্য বোধ হলে তা অবশ্যই সমন্বয়হীনতা। রোজী সিদ্দিকী'র সাথে জাহিদ হাসানের আধো পরকীয়ার ব্যাপারটি মূল গল্পের স্বার্থে কতটা জরুরী ছিল প্রশ্নসাপেক্ষ।

গল্পের কাইমেক্স যখন চলে আসে, তখন অনেক পরিচালক পরপর কয়েকটি এ্যান্টি কাইমেক্স দৃশ্য চলচ্চিত্রে জুড়ে দেন। ফোর্ড এই ধারায় অন্যতম সার্থক প্রবক্তা। ফারুকীর প্রথম ছবি ব্যাচেলারে এ্যান্টিকাইমেক্স এর কয়েকটি স্বার্থক প্রয়োগ আমরা দেখেছি। এবং বিষয়টা উপভোগ্য হয়েছে। এবং এ্যান্টিকাইমেক্সগুলোকে গল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে হয়েছে।

মনে হয়েছে এগুলো না থাকলে গল্পটি পূর্ণতা পেত না। মেড ইন বাংলাদেশে অপ্রয়োজনীয় কিছু এ্যান্টিকাইমেক্স এসে বিরক্তি উদ্রেক করেছে। মূল গল্পটির সাথে মারজুক রাসেল ও তিন্নী কতটা সম্পৃক্ত এবং গল্পের শেষভাগে তাদের বর্তমান অবস্থা দেখানো আনিসুল হকের 'জিম্মী' উপন্যাসকে সিনেমায় রূপ দেবার ব্যাপারে কতটুকু সাহায্য করেছে প্রশ্নসাপেক্ষ (স্ক্রীণে ভাগশেষ শব্দটা বড় আকারে লিখে দেবার পরেও প্রশ্নটা মনে রয়েই যায়। ) ব্যক্তিগতভাবে আমি ফারুকীর চলচ্চিত্র ভাষার একজন ভক্ত। লংগ শট এবং লংগ টেক দুটোই আমার খুব পছন্দের।

আর্টিস্টের ক্লোজ শট দেখানো আমি অবধারিত মনে করি না, যতক্ষণ পর্যন্ত না গল্প ডিমান্ড করে। এবং শট পরিবর্তন অবধারিত মনে করি না, যতণ পর্যন্ত না মনে করি দর্শক একঘেঁয়ে বোধ করবে। চলচ্চিত্র ভাষার দিক থেকে ছবিটি আমার ভাল লেগেছে। শুধু একটা কথা বলব, জিম্মিরা সবাই যখন একই ফ্রেমে বন্দী - তখন বার বার একই ফ্রেমের রিপিটেশন হচ্ছিল। যেহেতু বড় একটা সময় আমরা জিম্মীদের দেখেছি, সেহেতু ফ্রেম এবং চিত্রভাষায় আরও কিছূ বৈচিত্র্য আসলে দৃশ্যগুলো আরও উপভোগ্য হত।

সবকিছুর পরেও এটি উপভোগ্য ছবি। তারচেয়েও বড় কথা এখানে প্রতিফলিত হয়েছে - মানুষের অবদমিত ক্ষোভ - প্রশাসন, রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সমাজের শীর্ষস্থানীয় ভণ্ডদের প্রতি। নি:সন্দেহে এইধরণের উইশফুল থিংকিং মানুষ পছন্দ করে। আসুন ছবিঘরে গিয়ে একবার যাচাই করে দেখি।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.