আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বুড়িগঙ্গার পানি আর পানি নেই। বিষ হয়ে গেছে।



বুড়িগঙ্গা নদী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত একটি নদী। পলিথিন, ট্যানারিসহ শিল্প-কারখানার বর্জ্য, হাসপাতাল-ক্লিনিকের পরিত্যক্ত কেমিক্যাল, লঞ্চ-জাহাজের পোড়া তেল-মবিল, টনকে টন বিষ্ঠা বুড়িগঙ্গাকে বিষে জর্জরিত করে তুলছে। বুড়িগঙ্গার তলদেশে প্রায় ১০ ফুট পলিথিনের স্তর জমে গেছে। ঢাকা রক্ষাবাঁধ থেকে পাগলা পর্যন্ত এখনও অসংখ্য স্থাপনা বুড়িগঙ্গাকে দখল করে রেখেছে। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে যে ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল ৯ হাজার, কালের সাক্ষী বুড়িগঙ্গা নদীর তীরের সেই ঢাকার লোকসংখ্যা এখন প্রায় দেড় কোটির মতো।

বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজ করেছিলেন বাংলার সুবাদার মুকাররম খাঁ। তার শাষণামলে শহরের যেসকল অংশ নদীর তীরে অবস্থিত ছিল, সেখানে প্রতি রাতে আলোক সজ্জা করা হতো। এছাড়া নদীর বুকে অংসখ্য নৌকাতে জ্বলতো ফানুস বাতি। ঢাকা সিটি করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহরের গৃহস্থালি ও অন্যান্য শিল্প থেকে প্রতিদিন ৭ হাজার টনের বেশি বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। এরমধ্যে ৬৩ শতাংশ অপরিশোধিত সলিড বর্জ্য বিভিন্ন সংযোগ খালের মধ্য দিয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়ছে।

বুড়িগঙ্গা নদী রক্ষায় বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্টবিজয়ী মুসা ইব্রাহিম চারটি সুপারিশ পেশ করেছেন। ১৮০০ সালে টেইলর বুড়িগঙ্গা নদী দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন- বর্ষাকালে যখন বুড়িগঙ্গা পানিতে ভরপুর থাকে তখন দুর থেকে ঢাকাকে দেখায় ভেনিসের মতো। সদরঘাটসহ নদীর আশপাশে কেউ প্রবেশ করলে নাকে রুমাল গোঁজা ছাড়া উপায় নেই। পরিবেশ অধিদফতর ১০ বছর আগেই বুড়িগঙ্গার পানি যে কোনো কাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ করে তা ভয়াবহ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বুড়িগঙ্গা নদীর এই করুণ পরিণতির জন্য দায়ী মূলত অবৈধ দখলদারদের অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসন আর দূষণকারী একশ্রেণীর অবিবেচক নাগরিক।

অবৈধভাবে নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠা অসংখ্য শিল্প-কারখানা, বহুতল মার্কেট, ইট-পাথর-সিমেন্টের মহাল, কাঁচামালের আড়ত, ছিন্নমূল মানুষের শত শত বস্তি, নদী ভরাট করে মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরির কারণে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে নদীর প্রস্থ। সেই সঙ্গে একশ্রেণীর বিবেকহীন মানুষের যথেচ্ছ অপব্যবহারে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে দূষণ অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করে গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। ঢাকার মিরপুর ব্রিজ থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা পর্যন্ত প্রায় ২৭ কিলোমিটার জুড়ে নদীর পানি বিবর্ণ ও দুর্গন্ধময় হয়ে পড়েছে। নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জ থেকে ২৫-৩০টি খালের মধ্য দিয়ে বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি বুড়িগঙ্গায় পড়ছে।

এ নদীর পানি এত কালো এবং কুশ্রী হয়ে গেছে স্বাভাবিকভাবে পানির দিকে তাকানো যায় না। পানি গায়ে লাগলে চুলকানি শুরু হয়ে যায়। বুড়িগঙ্গা নদীর পানিপ্রবাহের মূল উৎস যমুনা। যমুনা থেকে তিনটি শাখা ধলেশ্বরী, তুরাগ ও বংশী নদীর মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা পানিপ্রবাহ পেয়ে থাকে। আরও কয়েকটি উৎস থেকে বুড়িগঙ্গায় পানি আসে।

এর একটি হচ্ছে কালিগঞ্জ নদী, অপরটি হচ্ছে নাগরপুরের সলিমাবাদ-বিনানুই থেকে ছোট নদীর পানি বুড়িগঙ্গায় পতিত হয়। তবে মূল প্রবাহ তুরাগ নদী থেকে শতকরা ৭০ ভাগ পানি আসে বুড়িগঙ্গায়। ৫০ বছর আগেও বিকেল-সন্ধ্যায় আশপাশের এলাকার মানুষ ছুটে যেত বুড়িগঙ্গার নির্মল বায়ু সেবনের জন্য। অনেকে নৌকা ভাড়া করে বুড়িগঙ্গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে বেড়াত। সেই সদরঘাট, সোয়ারীঘাট কিংবা বাকল্যান্ডের বাঁধের ধারে ভ্রমণ আর নির্মল বায়ু সেবন এখন অকল্পনীয়।

পানি দূষণ ছাড়াও নদী দখলের কারণে বুড়িগঙ্গার দু’পাশ দিনদিন ছোট হয়ে যাচ্ছে। বুড়িগঙ্গা দখলের সঙ্গে সাবেক মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে অনেক প্রভাবশালী জড়িত। বুড়িগঙ্গার পানিতে এখন লেড ও ক্যাডমিয়ামসহ ৬ ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ আছে৷ তা শুধু বুড়িগঙ্গা নয়, আশেপাশের ৫৬ কিলোমিটার নদীকে দূষিত করছে৷বুড়িগঙ্গার এই দূষিত পানিতে ৪০ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন৷ নদীর দুই পাড়ের মানুষ এ পানি ব্যবহার করার কারণে প্রায় সবাই এখন নানা ধরনের চর্মরোগে ভুগছেন। অনেকের হাতে-পায়ে ঘা হয়ে গেছে। আগে নদীতে অনেক মাছ পাওয়া যেত।

বুড়িগঙ্গা এখন মাছশূন্য। সোয়ারীঘাটের মাছের আড়ত বাদামতলী ও শ্যামবাজারের ছোট-বড় অনেক ফলের আড়ত এবং নদীর তীরবর্তী অসংখ্য হাটবাজারের আবর্জনা সরাসরি ফেলা হচ্ছে পানিতে। পাগলার কাছে বুড়িগঙ্গার উভয় পাড়ে গড়ে উঠেছে দু’শতাধিক ইটের ভাটা। সদরঘাট টার্মিনালসহ ঢাকা নদী বন্দরের বিভিন্ন ঘাট থেকে প্রতিদিন ৪৯টি নৌর"টের শতাধিক যাত্রীবাহী লঞ্চসহ স্টিমার এবং বিভিন্ন ধরনের পণ্যবাহী নৌযান নানা গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। অনুরূপভাবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও সমসংখ্যক নৌযান প্রতিদিন এখানে আসে।

চোখের সামনে অত্যাচারে অনাচার, লোভের-লাভের চাপে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে দেখেও আমরা ঢাকার নাগরিকসমাজ প্রতিবাদে সচল হচ্ছি না, আশ্চর্য মনে হচ্ছে। এক দশকে বুড়িগঙ্গা দখল উচ্ছেদের জন্য কয়েক দফা অভিযান চালানো হয়েছে। তারপরও প্রভাবশালীরা নানা কৌশলে তাদের দখল অব্যাহত রেখেছে। স্থানীয়রা বলেছেন, একদিক থেকে উচ্ছেদ শুর" হলে শেষ না হওয়ার আগেই আবার দখল শুর" হয়ে যায়। ২০১১ সালের ১ জুন হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়েছিল, বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এ পানিকে আর পানি বলা যাবে না।

ওই সময় বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে সমস্ত সংযুক্ত পয়ঃপ্রণালি এবং শিল্প কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশন লাইন বন্ধ করতে ওয়াসার চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু নির্দেশ ওই পর্যন্তই। প্রতিরোধ তো দূরের কথা নদী দূষণ দিন দিন আরো ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। যমুনা নদী থেকে পরিষ্কার পানি এনে বুড়িগঙ্গাকে ধৌত করা হবে মর্মে একটি পরিকল্পনার কথা শোনা গিয়েছিল। নদী বাঁচতে হবে।

মানুষ বাঁচাতে হবে। ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামীলীগ কেন বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি- তার জন্য তাদের বিচার করা হোক। তাদের সময় তো শেষ- গত বছরে তারা কেন বুড়িগঙ্গাকে গুরুত্ব দিলো না !

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.