আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শখের বউ

বহুদিন ধরে আরেকটা বউয়ের শখ করে আসছিল রহমআলী। আগের বউটা নিয়ে বছর দশেক তো হলো, আর কত। এতদিনেও যে মেয়েমানুষের পেটে একটা বাচ্চা বাঁধে না, তাকে নিয়ে রহমআলী আর কতদিন সোহাগ-আদরের বান বহাতে পারে। হ্যাঁ, কোয়েলাকে তার পছন্দ হয়েছে। এ নিয়ে সে আর কোনো রাখঢাক করতে রাজি নয়।

কোয়েলার মনের খবর যদিও এখনো জানা যায়নি, তবুও রহমআলীর আশা করতে এবং উদ্যোগী হতে কোনো দ্বিধা নেই। মেয়েমানুষের মনের খবর নাকি দেবতারাই জানতে পারে না তো কোন রহমআলী। কাজেই মনের খবর মনেই থাক, রহমআলীর কর্তব্য রহমআলী করুক।

রোজ সকালে কোয়েলার ফ্যাক্টরি যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে থাকাটা রহমআলী তার কর্তব্য-কর্ম বলেই ধরে নিয়েছে। কর্তব্যের সঙ্গে তার নৈমিত্তিক কর্মের পার্থক্য এই যে, কর্তব্যকাজে মানুষ সাধারণত কোনো রস-কষ পায় না, এমনকি রসযুক্ত কর্মও কর্তব্যের শিকলে বাঁধা পড়লে হয় একঘেয়ে, নিরস, অরোমাঞ্চকর।

প্রতিদিন সকাল ৮টা নাগাদ কোয়েলাকে এই গলিপথে হেঁটে বড় রাস্তায় পা রাখতে হয়। ততক্ষণে কুচকুচে কালো রাজপথ ছুটন্ত পঙ্গপালের ভিড়ে বর্ণিল, গতিময়। সস্তা ছিটের রংজ্বলা, কোনাছেঁড়া সালোয়ার-কামিজ পরে, মাথায় ওড়নার অাঁচলটা টেনে টিফিনবাটি হাতে এরা যে গতিতে হাঁটে, তাকে মরণদৌড় বললে মোটেই অত্যুক্তি হয় না। জীবনকে বাজি রেখে মরণকে সামনে রেখেই এরা দলে-দলে কারখানা গেটের সামনে ভিড় করে।

এই যাওয়ার সময়টাকে রহমআলী কখনো মিস করে না।

গত তিনমাস ধরে এ সময় এখানটাতে খাম্বার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কোয়েলার অপেক্ষায় উৎসুক দৃষ্টিকে গলির দৃশ্যমান শেষপ্রান্তে আটকে রেখে সে অপেক্ষায় থাকে। কোয়েলাকে দেখতে পেলেই সে তাড়াতাড়ি খাম্বার আড়ালে সরে যায়। তারপর কোয়েলা যখন তার অস্তিত্ব সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন থেকেও না দেখার ভান করে খাম্বাটাকে পাশ কাটিয়ে রাজপথে ওঠে, তখন রহমআলী তড়িঘড়ি তার পাশে আত্দপ্রকাশ করে। তারপর যেন কিছুই হয়নি এমন ভান করে তার পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। মেয়েরা এ ওকে চিমটি দিয়ে রহমআলীকে ইঙ্গিত করে হেসে গড়িয়ে পড়ে।

কোয়েলার মুখ-চোখ লাল হয়ে ওঠে কিন্তু রহমআলী এসব কিছুই গায়ে মাখে না। সে বরং মেয়েগুলোর সঙ্গে ভাব জমাতে তাদের হাসিতে যোগ দেয়। মস্করার জবাবে মস্করা করে বলে, জীবনের এট্টা দিনও যারে না দ্যাহা পারি না সে যে ক্যান সেই জীবনডার কষ্ট বোঝে না।

তা মেয়েগুলো কোয়েলার মতো নির্দয় নয়_ তারা রহমআলীর কষ্ট বোঝে। তাই কোয়েলাকে তারা বোঝাতে চেষ্টা করে : 'হ্যায় কলি তোরে বহুৎ ভালা পায়, তুই এট্টু ভাইবা দ্যাক।

'

'বউ আছে তাতে কী? বউডি তো বান্জা। '

'নোকটার কিন্তুক বালো অবস্থা, নবীনগরে দুকান আছে। '

'তোরে গলার মালা অইরে রাকপো কয়। '

'ইস, ছুঁড়ির ঢং দেখি আর নবাঁচি। যেনু কুন রাজপুত্তিরির ভাবনায় বিভুর।

'

না, রাজপুত্রের ভাবনা হয়তো কোয়েলা ভাবে না। কিন্তু তাই বলে রহমআলীর মতো একজন বয়স্ক- দোজবর লোকের গলায় মালা হয়ে ঝুলবার কোনো ইচ্ছেও তার মনে জাগে না। তার শাকিলাবু'র অবস্থা তো তার সচক্ষে দেখা। বুবুটার রূপ ছিল বেশ। কোয়েলা তার পাশে কিছু না।

সেই রূপসী বুবুই ছয়মাস টিকতে পারল না, তো কোয়েলা! কিন্তু কোয়েলা যতই অনিচ্ছার ভাব দেখায়, যতই নীরব অবহেলা প্রকাশ করে, রহমআলীর জেদও ততই বাড়তে থাকে। একটা মেয়ে মানুষের উপেক্ষায় প্রত্যাখ্যাত হয়ে তার আদিম পৌরুষের একগুঁয়ে কামনা কিছুতেই প্রত্যাখ্যাত হতে পারে না। হয় এসপার, নয়তো ওসপার_ এই তার নীতি। নিয়মমাফিক ঘটক ধরে ঘটা করে পাত্রী দেখে অর্থাৎ বাজারদর যাচাই করে বিয়ে করতে চাইলে পাত্রীর অভাব রহমআলীর নেই। নবীনগর বাজারে দেড়খানা দোকানঘরের সে মালিক।

একখানায় তার লেদমেশিনের দোকান, আরেকটাতে সাইকেল পার্টসের কারবার চলে। উপার্জন যা হয় তাতে সে এই বাজারেও কমচে কম চারখানা বউ পালতে পারে। কিন্তু সুন্নত পূরণের চেয়েও তার আপাতত প্রধান লক্ষ্য কোয়েলা।

এমন কিছু আহামরি রূপসী কোয়েলা নয়_ রংটা তো তার প্রায় ময়লাই। ওর চেয়ে ঢের সুন্দরী ছিল সে সময়কার ছবিরণ।

কোয়েলার বয়সে ছবিরণকে ছবির মতোই সুন্দর দেখাত। নইলে বাপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রহমআলী কি আর তাকে বিয়ে করে। কিন্তু বাঁজা বউ রূপবতী হলেও পুরুষের মন তাতে টেকে না। এ ছাড়া এই ১০ বছরে সন্তান কামনায় নানা ঘাট-আঘাট দৌড়ে আর স্বামীকে হারাবার ভয়ে ভীতিময়, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ জীবনযাপন করে ছবিরণের রূপ থেকে রমণীয় ছবিটি হয়েছে অপসারিত, বরং সে স্থান দখল করেছে রণরঙ্গিনী মূর্তির ছায়া।

রহমআলী জানে যে ওই ছায়াটি কায়া হয়ে যে কোনো দিন তার বিরুদ্ধে রণ ঘোষণা করতে পারে।

সে জন্য রহমআলী মনে মনে প্রস্তুত। শুধু কোয়েলার একটু হ্যাঁ বলার অপেক্ষা। কোয়েলা চাইলে ছবিরণের সব ছবি জীবন থেকে, এমন কি স্মৃতি থেকেও মুছে দিতে কতক্ষণ! রহমআলীর মনে রহমের অভাব হয়তো নেই। তার প্রথম বউটাকে আগবাড়িয়ে তালাক দেওয়ার কথা হয়তো সে ভাবে না, কারণ বউটার মা-বাপ বেঁচে নেই। একটা এতিম মেয়েমানুষকে সন্তানহীনতার অপরাধে দূর করে দেওয়ার চিন্তাটা তার কাছে খানিকটা অমানবিক মনে হয় কিন্তু নিজের সুখ-শান্তির ভাবনাটাও সে না ভেবে পারে না।

আজও রহমআলী কোয়েলাকে তার অফিস গেট পর্যন্ত অনুসরণ শেষে নিজের দোকানঘরের ঝাঁপ আধখানি খুলে ভেতরে বসে টুকটাক কিছু নাট-বল্টু নাড়াচাড়া করছিল। সকাল সাড়ে ৮টায় কোয়েলাদের ফ্যাক্টরির গেট বন্ধ হয় আর ১০টায় রহমআলীর দোকান খোলে। মাঝখানে এই দেড় ঘণ্টা রহমআলী অকাজের খই ভেজে আর কোয়েলাকে নিয়ে দিবাস্বপ্নের মালা গেঁথে কোনোমতে কাটিয়ে দেয়। তার বাড়ি বাজার থেকে খুব দূরে নয় কিন্তু কোয়েলাকে দেখার আমেজ শরীরে বয়ে নিয়ে খাণ্ডারনী ছবিরণের মুখোমুখি হতে তার মন চায় না। সে বরং এ সময়টা গুনগুনিয়ে গান গেয়ে কোয়েলাকে নিয়ে ভেবে চলে।

কত আর বয়স হবে রহমআলীর? ত্রিশও তো বুঝি হয়নি। প্রথম বিয়েটা সে বড্ড কম বয়সে করেছিল। তার কত বন্ধু-বান্ধব আজও একটা বিয়েই করে উঠতে পারেনি। কাজেই নতুন বিয়ের ভাবনায়, নতুন প্রেমের নিশানায় সে যদি একটু গুনগুন করে তো সেটা মারাত্দক দোষের কিছু নয়। সুখী-সুখীভাবের অন্যমনস্কতা ছেড়ে রহমআলী হঠাৎ সচেতন হয়ে ওঠে_ তাই তো! কী হলো?

হাজারো উৎসুক জনতার সঙ্গে রহমআলীও যখন ঘটনাস্থলের ভিড় বাড়ায় তখন বেলা ১১টা।

এপ্রিলের প্রবলপ্রতাপ সূর্য তখন প্রায় মাথার পরে পূর্ণ যৌবনের দীপ্তির সঙ্গে বদমেজাজের সবটুকু উত্তাপ ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত। সেই দীপ্তিকে আড়াল করে যে ধূলির মেঘ এখন গোটা শিল্প-শহরটাকে আচ্ছন্ন করে রহমআলীদের দৃষ্টিশক্তিকে ঝাপসা করে তোলে তার অন্তরালে গগনবিদারী মরণ চিৎকার উপস্থিত মানুষগুলোর 'হায় হায়' ধ্বনির সঙ্গে যুক্ত হয়েও বুঝি আরশ ছুঁতে ব্যর্থ হয়। তাই ভবনধসের ধ্বংসস্তূপের মাঝে যে হতভাগারা চাপা পড়ে থাকে তাদের কণ্ঠ ক্রমক্ষীণ হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকলেও র্যাব, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এমনকি দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীও তাদের উদ্ধারে ব্যর্থ হতে থাকে।

অতি অল্প প্রাণই শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারে। বহুতল ভবনের প্রতি তলায় তৈরি পোশাকশিল্পের কারখানা।

কত হাজার কর্মী সেখানে কাজ করত সেই পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। ওদের একটাই পরিচয়_ ওরা শ্রমিক। ওদের একটাই চিহ্ন_ ওরা শোষিত। ওদের একটাই মূল্যায়ন_ ওরা সস্তা, বড্ড সস্তা।

কারও হাত বেরিয়ে আছে বাইরে, বাকিটা দুটো তলার সিলিংয়ের মাঝে পড়ে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা।

কারও পা-টা আটকে আছে কোনো ভারী মেশিনের তলায়_ পা-টা তার গোটাজীবন ধরে টানছে; সে মুক্তি চায়, চায় পা-টা ফেলে জীবনটাকে হাতের মুঠোয় পুরে ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে আসতে। সে চিৎকার করে বলে, 'একখান দা দেও বাহে, মুই পা-ডা কাটি বারায়া আসি। ' পৃথিবী এখন দিনের পর দিন ধরে পুঞ্জীভূত অবিচারের প্রতিশোধ নিতে ব্যস্ত। তাই সে কাউকে মুক্তি দিতে চায় না, সবাইকে তার জঠরে পুরে নিতে চায়। কয়েক হাজার প্রাণকে এক লহমায় গিলে ফেলার সহজ সুযোগটুকু ধরিত্রিমাতা হারাতে চায় না; মানুষের লোভের নিঃশ্বাস দিনে দিনে তাকেও যে আগ্রাসী করে তুলছে।

জমিন চিৎকার করে বলছে, 'তোরা আয়, তোরা আমার ভেতরে আয়। আমি তোদের পেটের ভেতরে ঢুকে তোদের ক্ষুধাকে মিটিয়ে দেব। তোদের চির-শান্তির ঘুম পাড়াব। আমার বুকের পরে তোদের সীমাহীন দর্পময় আস্ফালন আমি কত সইব বল। '

পৃথিবীর কান্নাটা যেন হঠাৎই উপলব্ধি করে রহমআলী, করে সে চমকে ওঠে।

তাই তো! অতি লোভের ফলেই তো আজ এসব ঘটছে। একটার পর একটা আকাশমুখী দালান গড়ে উঠছে তো উঠছেই। উঠতে উঠতে মাটির সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্যুত হয়ে একে অপরের পিঠে পিঠ লাগিয়ে কেবল আকাশপানে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে আকাশ ছোঁয়ার বাসনায় মেতে আছে। কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই। কেউ কারও জন্য এক তিলও জায়গা ছেড়ে রাখেনি।

এর মধ্য দিয়ে কীভাবে গলবে উদ্ধারকারীদের যন্ত্রপাতি?

মানুষের মৃত্যু মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখছে। কেউ কেউ জীবনবাজি রেখে একটা জীবিত বা মৃতদেহ উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিবেদকরা সরাসরি সম্প্রচারের নিমিত্তে চ্যানেল স্টেশনে সংযুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে অসীম ধৈর্যসহকারে ধুলোবালি গলাধকরণ করে চলছে। কেউ কেউ আবার টিভিতে মুখ দেখাবার আশায় প্রতিবেদকের আশপাশে ভিড়-ধাক্কা সামলেও টিকে আছে। অদূরে একটা ইলেকট্রনিঙ্ দোকানে ডজনখানেক টিভি একযোগে চলছে।

সব দেখে-শুনে রহমআলীর মাথা ঘুরতে থাকে, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। সেই ঝাপসা চোখেই সে দেখতে পায় একটা নূপুরপরা পা ধ্বংসস্তূপ ফুঁড়ে গোটা পৃথিবীর দিকে তাক হয়ে কালাশনিকভের মুখের মতো পরিষ্কার ফুটে রয়েছে। এই পা-টা কার? কে তার কচি পায়ে নূপুর পরে কঠিন রাজপথ ধরে হেঁটে জীবনের একেকটা কঠিন দিনকে মাড়িয়ে দিনগত পাপক্ষয় করতে এই মৃত্যুখাঁচায় গিয়ে ঢুকত? ওই পা-টা কি কোয়েলার? কোয়েলা কি পায়ে নূপুর পরত? রহমআলীর জানা নেই। কোয়েলার পা দুটোকে ভালো করে চেয়ে দেখা তার হয়নি। পা কেন_ কোয়েলার দেহের কোন অংশটাইবা রহমআলী দরদভরা চোখে চেয়ে দেখেছে? নাক, চোখ, মুখ, চিবুক কিংবা কর্মিষ্ঠ দুটো কচি হাত? না, রহমআলী ওসবের দিকে তত মনোযোগী ছিল না।

সে কেবল বিশেষ চোখে দেখেছে ওসব শুদ্ধ জড়িয়ে আর কাপড়ের আবডাল ফুঁড়ে পরিস্ফুটিত বিমূর্ত নারীত্বকে। যা কিনা তার চোখে মনে হয়েছে উর্বরতার লক্ষণযুক্তভাবে পরিপুষ্ট এবং ভোগ্যতার ক্ষেত্রে তার উপযুক্ত, কাম্য। তবু ওই পা-টাকে টিভির পর্দায় বারবার দেখে তার মনে হয় ওই পা-টা বুঝি কোয়েলার। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ার সময়টাতে বুঝি ইচ্ছে করেই সে ওটা উঁচিয়ে ধরেছে_ হয়তো রহমআলীর উদ্দেশ্যে কিংবা রাষ্ট্র, মালিক, বায়ার, সংস্থা, মুনাফা, লোভ এমনকি বিশ্ববিবেকের দিকে।

অন্ধের মতো রহমআলী ওই পা-টার অবস্থান খুঁজতে ছুটতে থাকে।

সে তো ওই পায়ের পাদদেশেই দাঁড়িয়ে আছে অথচ তাকে কিনা তা দেখতে হচ্ছে টিভির পর্দায়! কোথায়, কোন প্রান্তে আটকে আছে এই বিদ্রোহী পা? রহমআলী কেন তা খুঁজে পায় না? রাতের অাঁধার নেমে এলে হতাশ, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত রহমআলী ঘরের পথ ধরে। পেছনে রেখে যায় ধ্বংসস্তূপের গণকবরের মাঝে তার এত দিনকার অতৃপ্ত বাসনার আধার, ওই ভবনের ষষ্ঠতলায় কর্মরত পোশাককর্মী কোয়েলাকে_ জীবিত অথবা মৃত। ঘরে ফিরে রহমআলী বিধ্বস্ত ভবনটির মতোই ভেঙে-চুরে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। তার অবস্থা দেখে ছবিরণ উদ্বিগ্ন মুখে ছুটে এলে রহমআলী শুধু বলে, 'এক গেলাস পানি দে। ' ছবিরণ ছুটে গিয়ে পানি নিয়ে এলে ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে সবটা শেষ করে রহমআলী বলে, 'আমি এহন ঘুমামু।

তুই এন্নে খাওন-দাওন লয়া দিক করিস না। মশারি টাঙায়া লাইট নিভা। '

রহমআলীর ভাবগতিক ছবিরণের ঠিক পছন্দ না হলেও এ মুহূর্তে স্বামীকে সে আর ঘাঁটায় না। মশারি টাঙিয়ে আলো নিভিয়ে সেও একপাশে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়ে। কিছু পরে তার নাকডাকার ক্ষীণ শব্দ শোনা যায়।

সারা দিনের অনাহার, অবিশ্রামে শ্রান্ত রহমআলীর কেন যে আজ ঘুম আসে না! ঘুমের ভান করে এতক্ষণ পড়ে থাকলেও এখন সে উঠে পড়ে। তার টিনশেড ঘরের সামনে একচিলতে খোলা জায়গায় একটা আম্রপালির চারার গোড়া সিমেন্টের বেদিতে বাঁধান আছে। সেখানে বসে সে একটুখানি আকাশ দেখতে পায়। কিন্তু অতটুকুন আকাশে দু'চারটে বিক্ষিপ্ত তারা ছাড়া আর কিছুই তার নজরে আসে না। একটা ব্যাখ্যাতীত অস্থিরতাবোধে আক্রান্ত রহমআলী বাড়ি ছেড়ে সন্তর্পণে বেরিয়ে পড়ে।

নবীনগরের রাজপথ গভীর নিশীথেও কখনো নির্জন হয় না। ঢাকা থেকে হাজার হাজার গাড়ি এপথ ধরেই দেশের উত্তর-দক্ষিণে পাড়ি জমায়। তাই জনশূন্য রাজপথ ধরে নিশ্চিন্তে হেঁটে যাওয়ার বিলাসিতাটুকু এ পথে কখনো সম্ভব হয় না। শিল্পাঞ্চলের অধিবাসী রহমআলী স্বচক্ষে কম তো দেখেনি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যাপক প্রসারের কারণে গোটা দেশ এমনকি পৃথিবীও এখন সব দেখছে।

গণতন্ত্র জনগণকে আর কিছু না দিক, চোখে দেখার অধিকারটুকু তো দিয়েছে। অমন কত ভবনধস, পাহাড়ধস, অগি্নকাণ্ড, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাসের তোড় সয়ে এ দেশের মানুষ আবহমান কাল থেকেই আশাবাদী জীবনযাপন করে যাচ্ছে। তাদের মাথার ওপর কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া হলেও তারা মাথাটা পেতেই রাখে; একটু-আধটু নাড়া দেয় তখন যখন কাঁঠালের আঠা তাদের চোখে-মুখে এমনকি নাকে ঢুকে নিঃশ্বাসকে রুদ্ধ করে ফেলতে চায়। খানিকটা নাড়াচাড়ায় আঠা সরে গিয়ে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসটুকু চলতে পারলে আবার তারা সর্বংসহা জীব। কারণে-অকারণে যারা লম্ফ-ঝম্ফ করে জনগণ জনগণ বলে চিৎকার করে তারা সব ওই কাঁঠালখাদক।

জনগণ নামের বায়বীয় পদার্থটা ওই কাঁঠালখোরদের পাকড়াও করার মতো দুটো কঠিন-বাস্তব হাত কেন যে কোনো দিন খুঁজে পায় না!

রাজপথের প্রান্ত ধরে হাঁটতে হাঁটতে রহমআলী হঠাৎ হেসে ওঠে। ওই তো সেই ল্যাম্পপোস্ট_ যেখানে দাঁড়িয়ে রহমআলী প্রতিদিন কোয়েলার প্রতীক্ষায় থাকত। কী দেখেছিল রহমআলী কোয়েলার মাঝে_ তার অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতার প্রতিচ্ছবি? কোন আকাঙ্ক্ষা_ প্রেম, কাম, নাকি স্রেফ বংশরক্ষা? শুধু বংশরক্ষা যদি হয়তো তার জন্য সেই নারাজ কোয়েলার পিছু লাগা কেন? সম্ভাবনাময় প্রজননক্ষম নারীর কি এ দেশে অভাব? এ দেশের মানুষের বিস্ময়কর প্রজননক্ষমতা সম্পর্কে কে না জানে। এই যে আজ মুহূর্তের মধ্যে এতগুলো মরল তার ঘাটতি পূরণ হতে আজকের রাতের কতভাগ সময় লাগবে? টিভিতে ওই লোমহর্ষক খবরের সরাসরি সম্প্রচার দেখেও অগণিত দম্পতি-অদম্পতি আজ রাতে ঘুমুবার আগে-পরে মিলিত হবে, হবেই। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে শত প্রতিকূলতার মধ্যে, যে কোনো সময়ে, যেকোনো পরিবেশে, যেকোনো অবস্থানে যৌনতাকে অনুভব করে।

দুঃসহ শোক-ক্ষোভ, ব্যথা-বেদনা কিছুই তাকে এ কাজে দমিয়ে রাখতে পারে না। তাই এত হানাহানি, এত মারণাস্ত্রের ভিড়েও মানুষ আজো ডাইনোসরের ভাগ্য বরণ করেনি। মানুষের এই বিস্ময়কর ক্ষমতাচর্চার বিস্ময়কর আশীর্বাদপুষ্ট ভূমি এ বাংলাদেশে শ্রম ও শ্রমিকের দাম তাই এত মামুলি। জিরো পপুলেশন গ্রোথের দেশের মানুষের মূল্যবান অঙ্গের রক্ষণাবেক্ষণ ও শোভাবর্ধণের জন্য এই সস্তা হাতগুলো এত জরুরি অথচ এত সহজপ্রাপ্য জেনেই না এ দেশের মালিক-মহাজনরা তাদের শ্রমদানের ক্ষেত্র হিসেবে ব্রয়লার কেসের চেয়েও কম নিরাপদ কারাগার তৈরি করে।

রহমআলীর মনের চোখে হঠাৎ সেই উঁচিয়ে থাকা নূপুর পরা পা-টা ভেসে ওঠে।

সেই পা-টাকে এখন তার নিশ্চিতভাবেই কোয়েলার বলে মনে হয়। মনে হয় সে পা-টা বুঝি মূর্খ রহমআলীর প্রজননলিপ্সার প্রতি, রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যর্থতার প্রতি, উন্নত বিশ্বের ভণ্ডামির প্রতি এবং মালিক-শোষক শ্রেণীর আগ্রাসী লোভের প্রতি এক উদ্ধত সঙ্গীন হয়ে নিস্তব্ধ হুঁশিয়ারি জারি করছে।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।