আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসঃ পর্ব-১

বিচ্ছিন্নতাও একটা ভাবাবেগ যা মাকে প্রায়ই ভাবিত করে-জব্দ করে অহর্নিশ। !! তবু এটা নিয়েই বেঁচে আছি। ।
পাঠক হিসেবে আমি ছটফটে ধরনের, ছাত্র হিসেবে খামখেয়ালি টাইপের। তবু একথা মানতে একদমই দ্বিধা নাই যে লেখক হিসেবে অসম্ভব রকমভাবে আনাড়ি।

ফাঁকিবাজি করে ইংরেজি পাশ করে এসেছি বাংলা পার করেছি বেসিক থেকে। কিন্তু এই বেসিক কই থেকে আসল? প্রকৃতির পাঠশালায় মাতৃভাষার প্রতি সকল মানুষের এক ধরনের জন্মগত-স্বভাবগত-অভ্যাসগত দখল থাকে। যেখানে শুদ্ধ করার জন্য কিংবা ভুল ধরার জন্য কদাচিতই ব্যাকরণ জানতে হয়। যদিও ব্যাকরণ সৃষ্টি হয়েছে ভাষার প্রয়োগবিধির উপর লক্ষ রেখে। যাই হোক বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে আমরা খুব কম মানুষই আছি যারা বাংলা ভাষার তথা সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞাত।

অথচ বাংলা সাহিত্যেরও আছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। মোটামুটি একহাজার বছর পার হয়ে গেছে আমাদের বাংলা ভাষা সাহিত্যের। আমি বিভিন্ন ধাপে সংক্ষিপ্ত পরিসরে একটু ধারনা দিতে চেষ্টা করব। আশা করি ইহা পাঠককে বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদানে সমর্থ হবে। বাংলা সাহিত্যকে তিনটি যুগে ভাগ করা হয়েছে __ ১)প্রাচীন যুগ ২)মধ্যযুগ ৩)আধুনিক যুগ এ পর্বে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।

। প্রাচীন যুগ ব্যাপ্তিঃ প্রাচীন যুগের শুরু নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ আছে। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-র মতে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগের ব্যপ্তিকাল ছিল ৬৫০খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তবে ডক্টর সুনীতিকুমারের মতে এর সময়কাল ৯৫০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ। সাহিত্যকর্মঃ প্রাচীন যুগে বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের একমাত্র ও আদিতম নিদর্শন হল চর্যাপদ।

খ্রিষ্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত চর্যা পদাবলি ছিল সহজিয়া বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনসংগীত বা গানের সংকলন। এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল বৌদ্ধ ধর্মের সাধন প্রণালী ও দর্শন তত্ত্ব। আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিকগণ বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে চর্যার ভাষা প্রকৃতপক্ষে হাজার বছর আগের বাংলা ভাষা। সমকালীন বাংলার সামাজিক ও প্রাকৃতিক চিত্র এই পদগুলিতে প্রতিফলিত হয়েছে। সাহিত্যমূল্যের বিচারে কয়েকটি পদ কালজয়ী।

এটি আদি যুগের একমাত্র লিখিত নিদর্শন। আবিষ্কারঃ অনেক প্রাচীন সাহিত্যকর্ম হলেও এটির আবিষ্কার খুব বেশিদিন আগের কথা না। ১৯০৭ খ্রীস্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালা “রয়েল লাইব্রেরি” থেকে চর্যার একটি খণ্ডিত পুঁথি উদ্ধার করেন। মূলত ১৮৮২ সালে রাজা রাজেদ্র লাল মিত্র “Sanskrit Buddhist Literature in Nepal” গ্রন্থে চর্যাপদের অস্তিত্বের কথা বলেছিলেন। আর সেই সূত্র ধরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদ আবিষ্কারে উদ্দীপ্ত হন।

পরবর্তীতে ১৯২৩ সালে বাংলা ১৩২৩ বঙ্গাব্দ কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে এটি প্রকাশিত হয়। বর্ণনাঃ চর্যাপদের মোট পদসংখ্যা ছিল ৫১ টি। ডঃ শহীদুল্লাহ বলেছেন ৫০টি। তবে ৫১টি সর্বজন স্বীকৃত। এক একটি পদ সাধারণত সাধারণত ১০টি লাইন সহযোগে গঠিত।

শুধুমাত্র ২১নং পদে লাইনসংখ্যা ৮টি এবং ৪৩ নং পদে লাইন সংখ্যা ১২টি। চর্যাপদের ৫১টি পদের মধ্যে সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ পাওয়া গিয়েছে,বাকি সাড়ে চারটি পদ পাওয়া যায় নি। অনাবিষ্কৃত পদগুলি হল ১১,২৩,২৪,২৫,৪৮। এদের মধ্যে ২৩তম পদের প্রথম ৬টি লাইন পাওয়া গিয়েছে বাকি ৪টি পাওয়া যায় নি। সাহিত্যমানঃ চর্যাপদের প্রথম পদ __” কা আ তরুবর পঞ্চ বি ডাল” শবরপার একটি পদে দেখা যায় নরনারীর প্রেমের এক অপূর্ব চিত্রণ- উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।

মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী। । উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহৌরি। ণিঅ ঘরণী ণামে সহজ সুন্দারী। ।

ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী। একেলী সবরী এ বণ হিণ্ডই কর্ণ কুণ্ডলবজ্রধারী। । (পদ ২৮, অর্থাৎ- উঁচু পর্বতে শবরী বালিকা বাস করে। তার মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জামালিকা।

নানা তরু মুকুলিত হলো। তাদের শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত হলো। শবর-শবরীর প্রেমে পাগল হলো। কামনার রঙে তাদের হৃদয় রঙিন ও উদ্দাম। শয্যা পাতা হলো।

শবর-শবরী প্রেমাবেশে রাত্রিযাপন করলো। ) আবার সমাজ ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম দরদও আধুনিক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঢেণ্ঢণের পদে দেখা যায়– “টালত মোর ঘর নাহি পরবেষী। / হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী। ” (পদ ৩৩, অর্থাৎ- টিলার উপর আমার ঘর, কোনও প্রতিবেশী নেই।

হাঁড়িতেও ভাত নেই, তবু নিত্য অতিথি আসে। ) কোনও কোনও পদে নিছক দর্শনকথা অসামান্য চিত্ররূপের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। চাটিল লিখছেন– “ভবণই গহণগম্ভীরা বেগেঁ বাহী। দুআন্তে চিখিল মাঝেঁ ন ঠাহী। ” (পদ ৫, অর্থাৎ- ভবনদী গহন ও গম্ভীর অর্থাৎ প্রবল বেগে প্রবহমান।

তার দুইতীর কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল। ) আবার কখনও বা তত্ত্বের ব্যাখ্যায় যে প্রহেলিকার অবতারণা করা হয়েছে, সেগুলিও অসামান্য সাহিত্যগুণমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। যেমন: কুক্কুরীপাদ লিখেছেন– “দুলি দুহি পিটা ধরণ ন জাই। / রুখের তেন্তুলি কুম্ভীরে খাঅ। ।

” (পদ ২, অর্থাৎ- মাদী কাছিম দোহন করে দুধ পাত্রে রাখা যাচ্ছে না। গাছের তেঁতুল কুমিরে খাচ্ছে। ) আবার চর্যায় মোট ৬টি প্রবাদ বাক্য পাওয়া যায়। যেমন___ “ আপনা মাংসে হরিণা বৈরি” কবিঃ আবিষ্কৃত পুঁথিটিতে ৫১টি চর্যায় মোট ২৪ জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন: লুই, কুক্কুরী, বিরুআ, গুণ্ডরী, চাটিল, ভুসুকু, কাহ্ন, কাম্বলাম্বর, ডোম্বী, শান্তি, মহিত্তা, বীণা, সরহ, শবর, আজদেব, ঢেণ্ঢণ, দারিক, ভাদে, তাড়ক, কঙ্কণ, জঅনন্দি, ধাম, তান্তী পা, লাড়ীডোম্বী।

চর্যার পদকর্তাগণের নামের শেষে সন্মানসূচক পা যোগ করা হয়,যেমনঃলুইপা,শবরপা ইত্যাদি। চর্যাপদের আদি কবি বা সিদ্ধাচার্য হিসেবে ধরা হয় লুইপাকে। কিন্তু ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন শবরপা ছিলেন লুইপার গুরু তাই চর্যার প্রাচীন কবি শবরপা-ই হবেন। এই পুঁথিতে লাড়ী ডোম্বীপার কোন পদ পাওয়া যায় নি তাই তাকে চর্যাপদের নামে মাত্র কবি বলা হয়। একমাত্র অনুমিত মহিলা কবি বলা হয় কুক্কুরীপাকে।

ভাষাঃ চর্যাপদের ভাষা বাংলা কি-না সে বিষয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল পরবর্তীতে যার অবসান হয়েছে। এটি বাংলা ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। চর্যাপদের রচয়িতা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ সংস্কৃতে পারদর্শী হলেও তাঁরা তৎকালীন অপরিণত বাংলাতেই পদগুলি রচনা করেছিলেন। চর্যাপদের ভাষা বাংলা ভাষার অদ্যাবধি আবিষ্কৃত আদিতম রূপ। ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর “Origin and Development of the Bengali language” (ODBL) _ গ্রন্থে বলেছেন__ “বাংলা নিশ্চয়ই,বাংলার মূর্তি অবহটঠের সদ্যোনির্মোক মুক্ত রূপ”।

তবে ডঃ মুঃ শহীদুল্লাহ চর্যার ভাষাকে প্রাচীন বাংলা কিংবা প্রাচীন বঙ্গকামরুপী ভাষা বলাই সঙ্গত মনে করেন। ম্যাক্সমুলারের মতে “চর্যাপদের ভাষা হলো প্রচ্ছন্ন ভাষা”। নির্দিষ্ট কোন রুপ নাই বিধায় অনেকে চর্যার ভাষাকে সান্ধ্যাভাষা বা আলো আধারির ভাষা বলেছেন। তথ্যসূত্রঃ ১)চর্যাপদ-উইকিপিডিয়া ২)এমপি থ্রি- বাংলা ৩)বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কিত ক্লাশ___Saifur's,Lalmatiya.
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।