আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দানব বনাম একজন পোকামানব

ভুলে যাওয়ার মধ্যে যে শান্তি আছে, সেই শান্তি নিহত সন্তানের মায়ের নয়। তাঁর বসার ভঙ্গিতে, মৃদু কণ্ঠের ভাষায়, কথা বলতে বলতে সোফায় বুলানো হাতে, তাঁর চুড়িতে, তাঁর আঁচলে ‘দুঃখ তার লেখে নাম। ’ কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘আমাদের বারান্দার ঘরের চৌকাঠে/কড়িকাঠে চেয়ারে টেবিলে আর খাটে/দুঃখ তার লেখে নাম। ’ সাত মাস আগে যেদিন শীতলক্ষ্যার কাদাপানিতে ত্বকীর ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া গেল, বাড়িটায় সেদিনই দুঃখের মিহি প্রলেপ পড়ে গিয়েছিল। আজও তা অটুট।

ত্বকীর বাড়িতে শান্তি নেই। নারায়ণগঞ্জ শহরে শান্তি নেই। এর জন্য দায়ী ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি। তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে নারায়ণগঞ্জের শিশু; কাউকেই ভুলতে দেননি যে একটি ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, মাসুমের প্রাণ হরণ করা হয়েছিল; আর সেই নিষ্পাপের নাম ছিল ত্বকী।
বেঁচে থাকলে গত শনিবারই আঠারোতে পা রাখত ত্বকী।

এ রকম করে সেদিনও বাড়িতে অনেক লোক আসত। কিন্তু আজকে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, শিল্পী অশোক কর্মকার, জাহিদ মোস্তফা ও আমার যাওয়ায় শান্তি নেই; কষ্ট আছে। বসে আছি। হঠাৎ পর্দা সরিয়ে ট্রে হাতে একটি কিশোর ঘরে আসে। চমকে উঠি।

মনে হলো, ত্বকী বুঝি এল ফিরে! তেমনই মায়াবী মুখ, তেমনই নিষ্পাপ শান্ত চাহনি। ছেলেটি ত্বকীর ছোট ভাই সাকী। নারায়ণগঞ্জ শহীদ মিনারে সেদিন ত্বকী স্মরণে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা শিশুদের। ‘তুমিও চল সাকীকে নিয়ে’, স্ত্রীকে বলছিলেন ত্বকীর বাবা। ত্বকীর মা—যিনি রওনক রেহানা, তিনি মেঝের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায়—অনেক কান্নার পর যে রকম শান্ত শুদ্ধ হয় মানুষের স্বর—বললেন, ‘না, আমি যাব না।

গেলেই মনে হয় যেন ত্বকী আমার পাশে দাঁড়িয়ে। ’ তারপর আনমনেই বললেন, ‘সাথে সাথে সব জায়গায় যেত...। ’ কথাটা শেষ হলো না। ডান হাতটা তখনো বুলাচ্ছেন সোফার কাপড়ে, যেন ওখানটায় ছেলে পিঠ পেতে শুয়ে আছে। সাকী পাশে বসে...কেউ কথা বলতে পারছি না।

ঘরের চৌকাঠে, কড়িকাঠে, চেয়ারে, টেবিলে আর খাটে দুঃখের শ্বাস পড়ছে। পাশেই ত্বকীর কম্পিউটার বোবা ও বধির। ত্বকীর বন্ধুরা সকালে যে একগুচ্ছ ফুল রেখে গেছে; সেগুলোই কেবল কথা বলে চলছিল ত্বকীর স্থির ছবিটার সঙ্গে।
চেক উপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরা লিখেছিলেন, ‘ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম। ’ স্মৃতি যেন এক মোমের প্রদীপ, আলো নিভে গেলেও তলায় জমাট মোম পড়ে থাকে।

স্মৃতির হুতাশন তেমনই। ত্বকীর বাবা ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে স্মৃতি ধরে রাখার সংগ্রামটাই করে যাচ্ছেন। চাইছেন ত্বকী হত্যার বিবরণ, হত্যাকারীদের নাম-ধাম-পরিচয় এবং তাদের কৃতকর্মের দায় রাষ্ট্রের স্মৃতিভান্ডারে লেখা থাকুক। অর্থাৎ উচিত বিচার হোক। এ জন্য তাঁকে দাঁড়াতে হচ্ছে বিপুল ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে; এমনকি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির বিরুদ্ধেও।

কঠিন বেদনা বা পরাজয়ের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে চায় মানুষ। মানুষ বিশ্বাস করে, সময়ই সব ক্ষত সারিয়ে দেয়। সব ভুল। কোনো কোনো ক্ষত সারবার নয়, কোনো কোনো স্মৃতি ভুলবার নয়। রফিউর রাব্বি ও রওনক রেহানা তাই বিস্মৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন এ আশায় যে একদিন সরকারের টনক নড়বে, একদিন মানুষের গুঞ্জন-ফিসফাস চিৎকার হয়ে ফেটে পড়বে।

নারায়ণগঞ্জের গডফাদারদের দুর্গ একদিন ধসে পড়বে।
হলিউডি ছবি দেসপ্যারাদোর নায়ক প্রেমিকা হত্যার প্রতিশোধ নিতে খুনি গডফাদারের দর্প চূর্ণ করে। আর নারায়ণগঞ্জের রফিউর রাব্বি পুত্রহন্তারক গডফাদারের বিচার চান। সব বাধা-হুমকি অগ্রাহ্য করা ‘ডেসপারেট’ মানুষ তিনি। তাঁর প্রতিপক্ষের অগাধ বিত্ত, মাস্তান বাহিনী, প্রশাসনিক যোগসাজশ এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের আশীর্বাদ।

এটা পরাশক্তির বিরুদ্ধে সামান্য মানুষের অসামান্য লড়াই। রাব্বির অপরাধ, তিনি শহরের সন্ত্রাস-দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন; তিনি একই সঙ্গে সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটি ও নারায়ণগঞ্জের গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের নেতা। তাঁর তৎপরতায় হুমকি বোধ করেছিল শহরের ‘স্বনামধন্য’ ওসমান পরিবার। রাব্বির অভিযোগ, পুত্রকে হত্যা করে পিতাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল ওরা। কিন্তু তিনি দমেননি।

যুদ্ধের ময়দানে যে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে, সে-ই বিজয়ী। দেখা যাক, দিনের শেষে ময়দানে কে দাঁড়িয়ে থাকে।
স্প্যানিশ ভাষায় দেসপ্যারাদোর একটা অর্থ আশাহীন বা বেপরোয়া। রফিউর রাব্বির আশার প্রদীপ নিভে গেছে; তাই তিনি বেপরোয়া। ১৭ বছরের সোনার টুকরা ছেলেটির ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে ছিল শীতলক্ষ্যার পানি আর কাদায়।

মাতৃমুখী ত্বকী সেই থেকে নারায়ণগঞ্জের সব মায়ের শোক, সব বাবার ক্রোধের হুতাশন, প্রতিবাদের প্রেরণা অনেক ভাইয়ের। রাব্বির সংগ্রামেই পারিবারিক ট্র্যাজেডি পরিণত হয়েছে জাতীয় ট্র্যাজেডিতে। এই কথাটাই বলছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। ত্বকীর মাকে নিরুপায় সান্ত্বনায় বলছিলেন, ‘ত্বকীর শোক কেবল আপনারই নয়, আমাদের সবারও। ’ নারায়ণগঞ্জের এক তরুণ শিক্ষক বললেন, ‘আমার স্কুলের সব শিশুই জানে কে খুন করেছে ত্বকীকে।

’ রাব্বি বললেন, ‘খুনি হিসেবে অভিযুক্ত শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমানের নির্যাতনকেন্দ্র তো শহরের ছেলেরাই ভেঙেচুরে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা বিচার চাই, প্রতিশোধ চাই না। ’
এদিকে শামীম ওসমানের ভাই সাংসদ নাসিম ওসমান রাব্বিদের পোকামাকড়ের মতো পিষে ফেলতে চান। গত রোববার প্রকাশ্য সভায় তিনি হুংকার ছেড়েছেন, ‘অতীতে অনেকেই আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করে টিকতে পারেনি। সামনে আমাদের ক্ষমতা আরও বাড়বে।

যেসব পোকামাকড়, পিঁপড়া, তেলাপোকা এখন দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে, তাদের পা দিয়ে চাপ দিলেই পিষে মরে যাবে। এরা কেউ আমাদের সঙ্গে টিকতে পারবে না। ’ (প্রথম আলো, ৭ অক্টোবর) বারভুঁইয়ার বাংলাদেশে এ রকম অনেক ভুঁইয়া ইদানীং গজিয়েছেন, যাঁরা মনে করেন তাঁরাই রাষ্ট্র, তাঁরাই ক্ষমতা, তাঁরাই রাজা। এখনই এঁদের থামানো না গেলে দেশটা মগের মুলুক হওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না।
ওসমানদের মতো পিষেমারার হস্তীসুলভ বাসনা অনেক গডফাদারেরই আছে।

জনগণকে তাঁরা পোকামাকড়ের বেশি কিছু ভাবেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কী ভাবেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। দলীয় সভায় নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অভিযোগের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শুনিয়ে দেন, ‘দলে শামীমেরও ভূমিকা আছে’ (প্রথম আলো, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩)। কী এমন ভূমিকা শামীম ওসমানদের যে তাঁদের জন্য সাতখুন মাফ? কী সেই ভূমিকা, যা কেবল প্রধানমন্ত্রী জানেন! কী সেই ক্ষমতা, যা দিয়ে ওসমানরা ফরিয়াদকারীদের পোকামাকড়ের মতো পিষে মারতে চান?
ত্বকী হত্যার বিচারের আন্দোলন কেবল ন্যায়বিচারের আন্দোলন নয়, এটা বাংলাদেশকে খুনি গডফাদারদের থাবা থেকে মুক্ত করার আন্দোলন। এই দেশ দুর্বৃত্ত শক্তির চাপে হাঁসফাঁস করছে।

নিরাপত্তাহীনতা আর ভয়ের সংস্কৃতি সবার মনে জেঁকে বসেছে। বুকের ওপর সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসেছে মাফিয়াতন্ত্র। তারা মাদক, অস্ত্র, সন্ত্রাসের চোষণযন্ত্র দিয়ে যুবশক্তিকে শুষে নিচ্ছে। ত্বকী, যে ভাবুক, যে শিল্পী, যে কবি, যে ভেবেছিল ‘আমি হব তাই, যা কখনো কেউ ভাবেনি চিন্তায়’; সেই ত্বকীর প্রাণ এরা ভয়ংকর কষ্ট দিয়ে কবচ করেছে। ত্বকী যতটাই নিষ্পাপতার প্রতীক, ত্বকীর খুনিরা ততটাই পৈশাচিকতার প্রতীক।

মানব ও দানবের এ লড়াই-ই এই মুহূর্তে সামাজিক সমতলের প্রধান লড়াই। অথচ গদি রাখা ও গদি পাওয়ার অশ্লীল হট্টগোলে এত প্রাণের লড়াইটা চাপা পড়ে থাকছে। বড় দলগুলো যখন যাবতীয় দানবের আখড়া, তখন জনগণের কেবল জনগণই আছে বলে ধরে নিতে হবে। দাঁড়াতে হবে নিজেরাই। ১৯৫৫ সালে আমেরিকায় সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে এক কৃষ্ণাঙ্গ মা একাই তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন।

লাখো মানুষের সমর্থনে বিচার নিশ্চিত তো হয়ই, সংবিধান পর্যন্ত বদলে যায়। রফিউর রাব্বির পাশে দেশের সজ্জন মানুষেরা আছেন, আছেন নারায়ণগঞ্জসহ দেশ-বিদেশের বাংলাদেশিরা। নাসিম ওসমানের চোখে এরা সবাই পোকামাকড়। বিচার না হলে এরা সত্যিই পরিবারটি শেষ করে দেবে। আরও অনেক পরিবারের ওপর নেমে আসবে করালছায়া।


দুই পরিবারের এই লড়াই দানবের সঙ্গে মানবের। মানবের হার কেবল আমাদের সময়ের এক দেসপ্যারাদোর হার নয়, বাংলাদেশেরই হার। পৈশাচিকতার কাছে নিষ্পাপতার হার। এ রকম হেরে যাওয়া বাংলাদেশকে তখন আশার গোরস্থান বলা কি ভুল হবে?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com



সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।