আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভৌতিক গল্পঃ ~~ঢাকা মেট্রো-ভ-৬৬-৬৬-৬৬~~(১)

আমি আমাকে নিয়েই তো এখনও বেচে আছি । একদিনআমাকে নিয়েই চলে যাব । সেদিন খুঁজলেও আর পাবি না..........আমার ভার্চুয়াল ফ্যাক্টরিতে স্বাগতম । আমার মন খারাপের সময়টা এখানে আর ফেসবুকে কাটে । মাঝে মাঝে দু একটা লেখা তৈরি করতে ইচ্ছা হলে চলে আসি এখানে ।

https://www.facebo (১) প্রচন্ড শীতে জমে যাওয়ার মতো অবস্থা । এবার বাংলাদেশে প্রচন্ড শীত পড়েছে । এই তো কিছুদিন আগেই তো নীলফামারিতে রেকর্ড ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল । ১৯৬৮ সালে সিলেটের শ্রীমঙ্গলে ২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল । অনেকের আশংকা যে পৌষ মাসেই এ অবস্থা ! তাহলে মাঘের সময় তো রিতিমতো বরফ পড়বে ।

বাংলাদেশের জলবায়ু ভয়াবহ আকার ধারন করেছে । আসলে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলসরূপ এই ছোট্ট দেশটাকেও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে । শৈত্য প্রবাহের দরুন রোদ উঠার পরও প্রচন্ড ঠান্ডা থেকে যাচ্ছে । ফলাফল সরূপ মৃত্যু হচ্ছে বস্ত্রহীন গরিব মানুষগুলোর । গলায় পেচানো মাফলারটার প্যাচ খুলে নিয়ে কান নাক ভাল করে ঢাকলো রুদ্র ।

ভয়াবহ বাতাস চারিদিকে । প্রচন্ড বাতাসে গায়ে জড়ানো চাদরটার একাংশ পতাকার মতো উড়ছে । কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ গেইটের বিপরিত পাশে একটা টং দোকানের পাশে দাড়িয়ে আছে সে । ঘাড় ফিরিয়ে একটু পিছনে একটা মাকের্টের ভিতর করিডোরে দাড়ানো নীলাকে দেখে নিলো রুন্দ্র । মেয়েটা সেলোয়ার কামিজের উপর একটা উলের সোয়েটার পড়ে তার উপর জড়িয়েছে কাশ্মিরি শাল ।

শালের উপরের অংশ ঘোমটার মতো মাথার উপর দিয়ে রেখেছে যাতে কানে ঠান্ডা না লাগে । ঘাড় ফিরিয়ে মূল সড়কের দিকে এগিয়ে গেলো রুদ্র । বাসটা এখান দিয়েই আসার কথা । কিন্তু খুব বেশি দেরি করছে , বাস এখানে আসার কথা সেই রাত দশটায় । অথচ এখন সোয়া এগারোটা বাজে , তবুও বাসের দেখা নেই ।

রাগ লাগছে রুদ্রর , এতো ঠান্ডার মাঝে এভাবে দাড়িয়ে থাকার কোন মানে হয় ? রাগ ঝাড়তেই যেন রাস্তায় পরে থাকা ছোট একটা পাথরে সজোরে লাথি মারলো সে , পাথরটা গড়িয়ে গিয়ে রাস্তার পাশে ড্রেইনে গিয়ে পড়লো । পাথর পরার শব্দটাও বাতাসের শো শো শব্দ গ্রাস করে নিলো । মাঝে মাঝে দূরে রাস্তা দিয়ে আসা ছোট ছোট গাড়ি অথবা ট্রাকের আলো দেখতে পাওয়া যায় । টং দোকানটাও এখনি বন্ধ করে দিবে । বিরক্ত হয়ে ফোন বের করে ডঃ আসিফকে ফোন করলো রুদ্র ।

"হ্যালো । আসিফ ভাই ? কি মিয়া ? বাস কই ? আরে ভাই তাড়াতাড়ি করেন না । দাড়ায়ে থাকতে থাকতে তো কুলফি আইসক্রিম হয়ে যাব । " অপর প্রান্তের কথা শুনে ফোন কেটে দিল রুন্দ্র । তারপর নীলার দিকে এগিয়ে গেল সে ।

তাদের বিয়ে হয়েছে মাত্র ছয়মাস আগে , ব্যাস্ততার কারনে নীলাকে নিয়ে বের হওয়া যায় নি । কিছুদিন আগে অর্থপেডিক্স ডিপার্টমেন্টের ডঃ রাশেদই প্রথম এই ট্যুরটার কথা প্রথম তোলে । ট্যুরটা হবে কুমিল্লা টু বান্দরবান । প্রস্তাবটা সবাই মিলে লুফে নেয় , আসলে ডাক্তারদের জীবনে অবসর জিনিসটার খুব অভাব । সামান্য অবসর যাপনটা তাই লুফে নিতে দেরি হয় না কারো ।

তাছাড়া স্পন্সর করছে স্কয়ার আর ইনসেপ্টা নামক ঔষধ কম্পানি । খরচের ব্যাপারটা নিয়েও তাই ভাবতে হচ্ছে না । নীলাকে নিয়ে তাই যেতে কোন অসুবিধাই দেখতে পায়নি রুদ্র । প্রচন্ড শীতে সামান্য কাঁপছে নীলা , চোখ কুচকে রেখেছে সে । টং দোকানে জ্বলতে থাকা ৬০ ওয়াটের নগ্ন বাল্বের আবছা আলোয় রুদ্র দেখতে পেলো নীলার চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে আছে ।

হটাত্‍ করেই খুব বেশি মায়াবি লাগলো মেয়েটাকে । নীলাকে অবাক করে দিয়ে ওর চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিলো রুদ্র , তারপর চাদরের এক কোন দিয়ে মুছে দিলো চশমার কাঁচ । নীলার অবাক হওয়া চোখজোড়া তখনও তাকিয়ে আছে রুদ্রের দিকে । কাঁচ মোছা শেষ করে নীলার দিকে তাকাতেই রুদ্র দেখলো মেয়েটা মুচকি হাসছে । রুদ্রর ভাল লাগলো খুব ।

প্রিয় মানুষের হাসি যে কতো বড় ভ্যাকসিন হতে পারে তার কিছুটা রুদ্র বোঝে , মাঝে মাঝে সে নীলাকে বলে "বুঝছো টমেটো বেগাম তুমি হইলা গিয়া আমার পেইনকিলার । আমার প্যারাসিটামল । " নীলা হেসে ফেলে এসব কথা শুনে । হাসতে গিয়ে মাঝে মাঝে চোখে পানি চলে আসে তার । রুদ্র আলতো করে মুছে দেয় সে পানি ।

চশমাটা আবার নীলার চোখে পরিয়ে দেয় রুদ্র । বাসের হর্ণ শোনা যায় রাস্তা থেকে । এক হাতে নীলার হাত অন্য হাতে সুটকেসটা ধরে বাসের দিকে এগিয়ে যায় রুদ্র । ডঃ আসিফ আর বাসের হেল্পার দাড়িয়ে আছে সামনে । হেল্পারের হাতে সুটকেসটা ধরিয়ে দেয় রুদ্র ।

হেল্পার সেটা নিয়ে লাগেজ বক্সে ঢোকাতে ব্যাস্ত হয়ে যায় । "কি ব্যাপার ভাই ? এতো দেরি যে ?" জিজ্ঞেস করে রুদ্র । "আরে বলিস না , সবাই আসতে এতো দেরি করছে যে বাস ঠিক টাইমে ছাড়তেই পারি নাই । চল্ চল্ আর দেরি করে লাভ নাই । ডঃ আসিফের পিছন পিছন বাসের সামনের দিক ঘুড়ে দরজার সামনের দিকে এগোলো রুদ্র ।

বাসের হেডলাইটের আলো তাদের তিনজনের লম্বা ছায়া ফেলল রাজপথে , অধিভৌতিক করে তুললো দৃশ্যপট । হটাত্‍ কেন যেন বাসের সামনের নাম্বারপ্লেটের দিকে চোখ গেলো রুদ্রর । সেখানে লেখা "ঢাকা মেট্রো -ভ-৬৬-৬৬-৬৬" । ঠিক এসময় এক ঝলক বাতাস বয়ে গেলো , রাস্তার ধুলো , গাছের পাতা কাঁপিয়ে দিলো । ঘাড়ের কাছে ঠান্ডা অনুভূতি হলো রুদ্রর ।

হাতের বাহুর কাছে লোমগুলো দাড়িয়ে গেলো , ব্যাথা লাগলো রুদ্রর । নীলার হাত ধরে টান দিলো সে , বাসে উঠলো । বাসের মাঝামাঝিতে তাদের সিট । আশেপাশের সিটে বসা মুখগুলো রুদ্রের পরিচিত । তাদের অর্থপেডিক্স ডিপার্টমেন্টেরই সবাই ।

সর্বমোট ৩৫ জন যাত্রী । একটু পর হেল্পার এসে উঠলো বাসে । বাসের ভিতরে লাইটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো । চলতে শুরু করলো বাস । মেডিকেল রোডের অবস্থা বড়ই খারাপ ।

জায়গায় জায়গায় প্রমান সাইজের গর্ত হয়ে আছে , বাস ভীষনভাবে দুলছে । ভিতরে যাত্রীরা মোটামুটি আলুভর্তা হয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ । একটু পর বাস চিটাগাং রোডে উঠে আসলো , ঝাকুনি থেমে গিয়েছে ততক্ষনে । ডান দিকের সারিতে সিট পেয়েছে রুদ্র আর নীলা । জানালার পাশে নীলা বসেছে , মেয়েটা বরাবরই জানালার পাশে বসতে ভালবাসে ।

তাছাড়া অলিখিত সিস্টেম হিসেবে জানালার পাশের সিটে স্ত্রীদের বসিয়ে পাশের সিটে স্বামীরা বসে থাকেন । সুতরাং যেভাবেই চিন্তা করা হোক না কেন নীলাকে জানালার পাশেই বসতে হবে । রাত এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিট , বাসের সবাই ঘুমাচ্ছে , নীলাও ঘুমিয়ে আছে । জেগে আছে শুধু বাস ড্রাইভার , হেল্পার আর রুদ্র । অস্বস্থি লাগছে রুদ্রর , এমনটা কখনো আগে হয়নি তার সাথে ।

কেন যেন তার মনে হচ্ছে কোথাও বড় ধরনের গড়মিল রয়ে গেছে , কিন্তু কেন মনে হচ্ছে সেটা সে জানে না । মানুষের পাঁচটা ইন্দ্রিয়দের পর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নামে একটা আলাদা ইন্দ্রিয় আছে । যাকে ইংরেজিতে সিক্সথ্ সেন্স বলে । মূলত এটি মানুষের অবচেতন মনের একটি অবাস্তব ভাবনা মাত্র । অনেকটা স্বপ্নের মতো ।

তবে প্রাচীন কালে মানুষরা বিশ্বাস করতো মানুষের স্বপ্নের সাথে বাস্তবের সংযোগ রয়েছে । অতি অদ্ভুত হলেও সত্য সিক্সথ্ সেন্স ব্যাপারটা অনেকের ক্ষেত্রে সত্য হয় । বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের এ সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া হয় । যাতে শক্রুর পদক্ষেপ সম্পর্কে তারা আগেই সতর্ক হয়ে যেতে পারে । (২) অস্বস্থি নিয়েই ঘুমানোর চেষ্টা করলো রুদ্র ।

কিন্তু ভালো ঘুম হলো না , দুঃস্বপ্ন দেখলো সে । দেখলো বাসটা এক্সিডেন্ট করেছে , খাদে পড়ে গেছে সেটা , একটা গাছের ডালের সাথে অস্থায়ী ঠেস দিয়ে দুলছে বিপদজনক ভঙ্গিতে । সে খাদের কাছে দাড়িয়ে আছে , নীলা এখনো রয়ে গেছে বাসের ভিতরে । হাত বাড়িয়ে রুদ্রকে কাতর গলায় ডাকছে নীলা , রুদ্র নীলার হাত ধরতে চাইছে কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছে না । বহু কষ্টে নীলার হাত চেপে ধরলো সে , ঠিক সে মুহূর্তেই গাছটা উপরে আসলো মাটি থেকে ।

বাস সহ রুদ্র অসীম শূন্যতায় রওনা হলো , আর্তচিত্‍কার বের হয়ে এলো গলা দিয়ে , ঐ অসীম পরার মাঝে কোন বিরতি নেই । হটাত্‍ ঝাকি মতো খেয়ে জেগে উঠলো রুদ্র , ঘামে জ্যাকেটের ভিতরে তার টিশার্টের পিছনের অংশ ভিজে গিয়েছে । অস্বস্থি লাগলো ভীষন , জ্যাকেটের চেন একটু আলগা করে দিলো সে । পাশ ফিরে নীলার দিকে তাকালো রুদ্র , মেয়েটা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে একপাশে কাত হয়ে । গায়ের শালটা একপাশে ঝুলে আছে , ঠিক করে দিলো রুদ্র ।

আবছা আলোয় নীলার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সে , ঘুমালে নীলাকে একদম ছোট বাচ্চাদের মতো নিষ্পাপ লাগে । নীলার পাশ দিয়ে বাহিরে তাকালো রুদ্র , বাসের জানালায় কুয়াশা জমে সাদা হয়ে আছে , কুয়াশা ঘনিভূত হয়ে পানি হয়ে নেমে যাচ্ছে কাঁচ বেয়ে । সে পানির ধারা আকাঁবাকা কয়েকটা রেখা তৈরি করেছে জানালায় গায়ে ,বাহিরে কালিগোলা অন্ধকার । মাঝে মাঝে দু একটা ট্রাক অথবা বাস প্রচন্ড গতিতে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে , বাতাসের শব্দের ফলে বুঝতে পারছে রুদ্র । হটাত্‍ বিকট শব্দ হলো , বাস নিয়ন্ত্রনহীনের মতো আচরন শুরু করলো ।

বাসের সব যাত্রী জেগে গিয়েছে ততক্ষনে , আতংকিতো চিত্‍কার করছে মেয়েরা । ভয়ার্ত চোখে সামনে তাকিয়ে আছে রুদ্র , খেয়াল নেই কখন যেনো নীলা তার বাহু শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে । নীলার হাতের বড় বড় নখগুলো একটু একটু করে তার মাংসপেশীতে বসে যাচ্ছে , উত্তেজনায় ব্যাথা টের পাচ্ছে না রুদ্র । বাস ড্রাইভার অবশেষে বাস নিয়ন্ত্রনে আনলো অনেক কায়দা কসরত্‍ এর পর , জানানো হলো যে বাসের বাম দিকের পিছনের চাকা পামচার হয়েছে । যাত্রীরা মোটামুটি শান্ত হয়ে আবার ঘুমাতে চেষ্টা করলো , দু একজন বাহিরে নেমে গেলো প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে ।

রুদ্রর অস্বস্থি ভাবটা আরেকটু প্রকট হলো , অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে তার । নীলা তার বাহু তখনো জড়িয়ে ধরে আছে , তবে এখন আস্তে করে ধরেছে । আলতো করে নীলার হাত ছাড়িয়ে উঠে দাড়ালো রুদ্র , নীলা কিছু বললো না , জানে যে রুদ্র এখন সিগারেট খাবে । বাসের বাহিরে নেমে সামনের দিকে এগোলো রুদ্র , একটা মেহগনি গাছে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে সিগারেট ধরালো একটা । বাসের হেডলাইট নেভানো হয়নি , হেডলাইট দুটোর মাঝামাঝি নিচের দিকে নাম্বার প্লেট লাগানো ।

নাম্বারপ্লেটের নাম্বারগুলোর মাঝে কোথায় যেন একটা ঘাপলা আছে , কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছে না সে । রাস্তার পাশেই ঘন বন বোধহয় , বনের ভিতর থেকে শেয়াল অথবা কুকুরের কান্নার মতো আয়োয়াজ শোনা যাচ্ছে , গায়ে কাঁটা দিলো রুদ্রর । নিজের কাছেই অবাক লাগলো ব্যাপারটা , কুকুরের ডাক শুনে এভাবে কখনো ভয় পেয়েছে কিনা মনে করতে পারলো না । চাকা মেরামত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে , বাসে এসে উঠলো সে । বাসের ভিতরে লাইট জ্বালানো , নীলা জেগে রয়েছে , কিন্তু তার চোখজোড়া এখনো লাল ।

রুদ্রকে আসতে দেখে শুকনো হাসি হাসলো , রুদ্রও হাসতে চেষ্টা করলো কিন্তু অস্বস্থি মাখানো হাসিতে কোন প্রাণ ছিল না । একটু পর বাস আবার চলতে শুরু করলো , নিভে গেলো বাসের ভিতরে লাইট । সারাটা সকাল হাসপাতালে ডিউটি করেছে , স্নায়ুগুলো সব ক্লান্ত হয়ে আছে রুদ্রর , বেশিক্ষন জেগে থাকতে পারলো না সে , একটু পরই ঘুমিয়ে পরলো । ঘুম যখন ভাঙ্গলো তখন দেখলো বাস থেমে আছে একটা হোটেল এর সামনে । নীলা তাকে ডেকে তুলেছে , বাসের যাত্রীরা সব নামছে এক এক করে ।

বাহিরে তখনো ঘুটঘুটে অন্ধকার , নীলাকে নিয়ে বাস থেকে নামলো রুদ্র । ডাঃ আসিফ আর ডাঃ রাফিদকে এক জায়গায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে গেলো সেখানে । "আসিফ ভাই বাস থামলো কেন ? কোন সমস্যা ?" জিজ্ঞেস করলো রুদ্র । "আরে মিয়া কইয়ো না । বাসের ড্রাইভার রাস্তা ভুল করছে ।

হেয় তো কক্সবাজারের রাস্তায় চইলা আইছে । এখন বান্দরবানের রাস্তা অনেক পিছনে । সামনে নাকি একটা শর্টকাট রাস্তা আছে । জাভেদ আর রাসেল কথা বলতেছে হোটেল ম্যানেজারের সাথে । " বলল আসিফ ।

ডাঃ আসিফ আবারও ডাঃ রাফিদের সাথে কথা বলায় ব্যাস্ত হয়ে গেলো । নীলাকে নিয়ে হোটেলে ঢুকলো রুদ্র , দু কাপ চায়ের অর্ডার দিলো । "ড্রাইভার রাস্তা ভুল করলো কেন ?" নীলা জিজ্ঞেস করলো । "বুঝলাম না । চিনে না বোধহয় ।

এসব ভাড়া করা বাসগুলো এ রুটে চলাফেরা করে না , রাস্তাঘাটও ঠিকমতো চিনে না । টাকা দেখতেই লুফে নিছে আরকি । " জবাব দিলো রুদ্র । দুজনের মাঝে আর কথা হলো না , চুপচাপ চা খেলো । একটু পর বাসের হেল্পার সবাইকে বাসে উঠতে বললো , সবাই উঠার পর বাস চলতে শুরু করলো আবার ।

সুবেহ সাদিক হয়ে গেছে ততক্ষনে , বাহিরে কালিগোলা অন্ধকারের গাঢ়ত্ব কমে গেছে , তবুও আবছা আলোয় খুব সামান্যই দৃষ্টি চলে । একটু পর বাস বাম দিকে মোড় নিলো , রাস্তা ক্রমশ উপরের দিকে উঠে গিয়েছে , রাস্তার অবস্থাও তেমন ভালো নয় । ঝাকি খাচ্ছে বাস , বিপদজনক ভঙ্গিতে কাত হয়ে যাচ্ছে এপাশ ওপাশ । একটু পর রাস্তার দুপাশে পাহাড়ের অবয়ব দেখতে পেলো সবাই , বান্দরবান জেলায় যে তারা এসে গিয়েছে তার পূর্বলক্ষন । পাহাড়ের পেট কেটে তৈরি করা হয়েছে এই রাস্তা , পাহাড়ের উপরে ঘন বনের ছায়া এসে পড়েছে রাস্তার উপর ।

যেন বিশাল কোন দানব গ্রাস করে নিচ্ছে আগুন্তুকদের । ঘাড়ের কাছে আবারো সেই শিরশিরে অনুভূতি হলো রুদ্রর , ভয় পেলো বোধহয় , নিজেকে ধমক দিলো সে । অল্পতেই ভয় পেয়ে যাওয়ায় নিজের উপরই বিরক্ত হলো রুদ্র , এদিকে নীলা আবারও আগের মতো রুদ্রর বাহু চেপে ধরেছে । নীলা হাতের নখ চেপে বসেছে রুদ্রর মাংশপেশিতে , ব্যাথা পেয়েও কিছু বলল না সে । অবশেষে বাস মোটেলের সামনে এসে পৌছালো ।

সবাই একে একে নামলো বাস থেকে । মোটেলটা দেখতে পুরোনো , মনে হচ্ছে অনেক আগে তৈরি করা হয়েছে , অবাক হলো সবাই । ডাঃ রাশেদ আর ডাঃ আসিফ ভিতরে ঢুকলো , রিসিপশনিস্ট লোকটা নাক মুখে চাদর মুড়ি দিয়ে আছে । তার শরীরের নিচের অংশ কাউন্টার ডেস্কের নিচে আর উপরের অংশটা কালো চাদরে ঢাকা । "ভাই এখানে বোধহয় আমরা ১৭ টা রুম বুকিং দিয়েছি , এটাই পর্যটন মোটেল না ?" জিজ্ঞেস করলো ডাঃ রাশেদ ।

লোকটা মাথা ঝাকালো কেবল , কোন কথা বললো না । "আসলে কোন সাইনবোর্ড দেখিনি তো , তাই আরকি শিওর হলাম । রুমের চাবিগুলো দিবেন কাইন্ডলি ?" হেসে বলল রাশেদ । এবারও লোকটা কোন কথা না বলে একসাথে কতোগুলো চাবি রাখলো ডেস্কের উপর । আসিফ সেগুলো গুনে দেখলো , ঠিক ১৭ টাই আছে ।

আসিফ খুশি হলো এই ভেবে যে লোকটা তাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলো , লোকটাকে ধন্যবাদ দিয়ে বাহিরে বের হয়ে এলো দুজনে । বাহিরে এসে নাটকিয় ভঙ্গিতে ডাঃ আসিফ বললো "সুতরাং ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাগন বান্দরবানে আপনাদের স্বাগতম । যারা জুটি হিসেবে এসেছেন তারা উপরতলায় রুম পাবেন , আর যারা ব্যাচেলর তাদেরকে নিচতলাতে রুম নিয়েই সন্তুস্ট থাকতে হবে আমার মতো । " তার বলার ভঙ্গিমায় সবাই হেসে উঠলো , একে একে তার হাত থেকে চাবি নিয়ে যে যার রুমে যেতে লাগলো । রুদ্র চাবি নিয়ে দেখলো তার রুম নাম্বার ২২২ , উপরতলায় উঠে বাম দিকে রুমটা ।

নীলাকে সাথে নিয়ে উপরে উঠে এলো সে , রুমটার সামনে এসে দরজায় চাবি ঢুকালো । বান্দরবানে বেশ শীত , এলোমেলো বাতাস বইছে সারাক্ষন । নীলা তার গায়ের শালটা আরো ভালমতো জড়িয়ে নিলো । রুমের দরজা খোলার সময় দরজাটা ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে প্রতিবাদ জানালো , ভিতর থেকে ভ্যাপসা একটা গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারলো । মনে হলো রুমটাতে অনেকদিন কেউ ঢুকে না , অস্বস্থি ভাবটা আবারও চেপে বসলো রুদ্রর মনে ।

নিজেকে শাষন করলো সে , রুমে ঢুকে রুমের সুইচ বক্স খুঁজলো , সুইচ বক্সে হাত লাগার পর লাইট জ্বালালো । মিট মিট করে জ্বলে উঠলো রুমের দুটো টিউব লাইট , রুমে একটা ডাবল বেড , একটা আলমারি আর একটা টি টেবিল আছে । আর আছে একটা এটাস্টড্ বাথরুম । নীলার দিকে ফিরে মুচকি হাসলো রুদ্র তারপর নাটকিয় ভঙ্গিতে বলল "ম্যাডাম আপনি কি দয়া করে এই গরীবখানায় পদধূলি দিবেন ?" । মিষ্টি করে হাসলো নীলা তারপর বলল "এই অবস্থায় ফাইজলামো করো কিভাবে তুমি ? ৭.৩০ বের হতে হবে ভুলে গিয়েছো ?" ।

"না ম্যাডাম ভুলি নি , আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন তারপর একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে । " বলল রুদ্র । নীলা আর কথা না বলে বাথরুমে ঢুকলো , সে বের হবার পর রুদ্র ঢুকলো বাথরুমে । বের হয়ে দেখলো নীলা ঘুমিয়ে পরেছে , রুমের লাইট অফ করে বিছানায় গিয়ে নীলার পাশে শুয়ে পরলো রুদ্র । ঘুমে চোখ প্রায় জড়িয়ে এসেছে , হটাত্‍ জানালার দিকে চোখ পরতেই মনে হলো কেউ একজন রক্তলাল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে , চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলছে ।

ঝট করে উঠে বসলো রুদ্র , চোখ কচলে ভাল করে তাকালো সে । কিন্তু কাওকে দেখতে পেলো না । ব্যাপারটাকে চোখের ভুল মনে হলো , কিন্তু মনের অস্বস্থির মাত্রাটা বাড়লো আরেকটু । আবার শুয়ে পরলো রুদ্র , সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখে ঘুম নেমে আসতে দেরি হলো না । (চলবে) কিছু কথাঃ ১৪ই জানুয়ারি তারিখটা আর ২০০২ সালটা আমার জন্য এবং আমার পরিবারের জন্য স্মরনীয় একটা মূহুর্ত ।

সালটাকে তো আর ফিরে পাবো না , তাই তারিখটাকেই প্রতিবছর স্মরন করি । আমার এখনো মনে পরে গভীর রাতে আমি , আমার ছোট বোন নিধি আর আমার ছোট ফুফু জেগে ছিলাম । আব্বা রাত ৩ টায় বাসায় এসে আমাদের দুই ভাইবোনকে বলল "তোমাদের ছোট একটা বোন হয়েছে । " আব্বা ছোট বোনটার জন্য কাপড় নিয়ে গেলেন । ভোর হতেই হসপিটালে চলে গেলাম আমরা ।

গিয়ে দেখলাম আধবোজা চোখে একটা ছোটখাট পুতুল মিটমিট করে তাকাচ্ছে সবার দিকে । সেই ছোট্ট পুতুলটার নাম রাখা হয় "নাফিসা সালসাবিল নিঝু" । আমার কলিজার টুকরো বোনটা চোখের সামনেই কিভাবে যেন এতো বড় হয়ে গেলো । নিঝু হাসলে তার দুগালে টোল পরে । আম্মা হাসলে তার দু গালেও টোল পরে , আম্মার এই দুর্লভ গুনটা সয়ংসম্পূর্নভাবে পেয়েছে নিঝু ।

নিঝুর ছোটবেলার আধো আধো কথা বলা , প্রথম হাটতে শেখা , প্রথম আবদার করা অথবা প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিনগুলো এখনো চোখের সামনে ভাসে । গত নয়টা বছর কখনো তার জন্মদিন মিস হয়নি , কষ্টকর ব্যাপার হলো এবার মিস হচ্ছে । আমি আমার ফুলপরিটার কাছ থেকে প্রায় ১০০ কিঃমিঃ দূরে । কুমিল্লা থেকে চলে আসার সময় জন্মদিন উপলক্ষে তার একটাই আবদার ছিল , ফোন করে যেন তাকে উইশ করি । সে অতটুকুতেই খুশি ।

"হ্যাপি বার্থডে ফুলপরি বেগাম । তোমাকে অনেক ভালবাসি । :-*" গল্পের এ পর্বটা তাকে উত্‍সর্গ করলাম । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।