আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভৌতিক গল্প: ধূপ

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ আজ বিকেলে ব্যাঙ্ক থেকে বেরুতেই দারোয়ান রশিদ মিঞা সালাম দিয়ে বলল, ছার, আপনারে একখান কথা কই। আপনে পরিবার পরিজন লইয়া যেই বাড়িত উঠছেন, সেই বাড়িটা ভালো না ছার, বাড়িতে জিনের আছর আছে। এট্টু দেইখা শুইনা থাইকেন সার।

কথাটা শুনে শওকতের ভ্রুঁ কুঁচকে যায়। কুসংস্কার বেশ মজার ব্যাপার। আর কুসংস্কার জিনিসটা মানসিকভাবে লালন করারও একটা ব্যাপার আছে। দারোয়ান, কাজের ঝি-এই শ্রেণির লোকজন কুসংস্কার জিনিসটা লালন করে। সযত্নে।

নতুন কাজের মেয়েটিও নাকি তানজিনাকে বলেছে বাড়িটা নাকি ভালো না। শওকত খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। তারপর হাঁটতে থাকে। তখনও ঝরঝরে রোদ ছিল। দূর্গাপাড়ার বাড়িটা কাছেই।

এখানকার লোকে বলে পুরানবাড়ি । রেললাইন পেরিয়ে, বাসষ্ট্যান্ড, তারপর আসফ আলী মিলনায়তন, চাঁদপিরের গলি। সেই গলির শেষ মাথায় বেশ নিরিবিলি গাছপালায় ঘেরা পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি। একতলায় গ্রিন হোমিও হল। মোছলেম উদ্দীন নামে একজন বৃদ্ধ ডাক্তার সকাল-সন্ধ্যা বসেন।

বৃদ্ধ কানে কম শোনেন বলেই হয়তো পসার তেমন ভালো না। শওকতরা থাকে দোতলায় । পুরনো আমলের বাড়ি বলেই ছাদে কড়িবর্গা, বেশ বড় বড় রুম, বড় বড় বাথরুম আর বড় বড় জানালা। পানির সমস্যা নেই। সোলাইমান মিঞা নামে একজন দারোয়ান আছে ।

মুসল্লী টাইপের লোকটাকে মধ্যবয়েসিই বলা চলে। সোলাইমান মিঞা থাকে একতলায় । মাঝেমধ্যে বাজার- টাজার করে দেয়। চাঁদপিরের মাজার থেকে সিন্নী এনে দেয়। বাড়িওলা আশীষ খোন্দকার সুলতানগঞ্জের বড় ব্যবসায়ী।

নবীগঞ্জ থাকেন। ভাড়ার টাকা সোলাইমান মিঞাই নবীগঞ্জে পৌঁছে দেয়। সুলতানগঞ্জ ব্রাঞ্চে সদ্য বদলী হয়ে এসেছে শওকত। নির্জন ছিমছাম শহর সুলতানগঞ্জ । এই শীত আসি-আসি সময়ে ভালো লাগছে।

অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যাবেলায় বেডরুম-লাগোয়া দোতলার বড় বারান্দায় বসে শওকত । তখন রাইসাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখে; গল্প বলে, যে গল্প মায়ের মুখে ছেলেবেলায় শুনেছিল, সেই গল্প। তখন নীচের বাগানের গাছপালা, দূরের আবছা গাছপালা, শিবমন্দির, সীতার দিঘী কেমন স্তব্দ হয়ে থাকে । দূর থেকে ভেসে আসে শেয়ায়ের ডাক । দূরে কুয়াশা ঢাকা নিঝঝুম গ্রাম।

খুব ভোরে উঠে যে গ্রামের মেঠেপথে তানজিনার সঙ্গে চলে যায় শওকত। শিশির-ঝরা নির্জন গ্রাম্য পথে হাঁটে। কুয়াশার ভিতরে তখন একটি-দুটি কাকা উড়ে যায়। তানজিনার সঙ্গে শওকতের স্কুল জীবন থেকে প্রেম ( সর্ম্পকে তানজিনা শওকতের খালাতো বোন)। সে প্রেম এত বছর পর এখনও অটটু।

... কখনও ওরা হাতে হাত রেখে বসে প্রাচীন শিব মন্দিরের সিতার দিঘীর ঘাটে । শিব মন্দিরের পুরোহিত নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তার সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে। সৌম্য বৃদ্ধটি বেশ অমায়িক আর স্বশিক্ষিত। চমৎকার জলদ গম্ভীর কন্ঠস্বরে কথা বলেন।

তানজিনার আবার পুত্রসন্তানের ভীষণ শখ। বৃদ্ধ পুরোহিত তানজিনার হাত দেখে গর্ভধারণের দিনক্ষণ বলে দিয়েছেন। পুত্র সন্তান নাকি কুম্ভ রাশির জাতক হবে। ভারতীয় জ্যোতিষ শাস্ত্রমতে কুম্ভ রাশির জাতক অত্যন্ত মেধাবী হয়। ... রোদ উঠি-উঠি ওরা সময়ে ফিরে আসে।

রাইসা তখনও ঘুমে কাদা। “স্কুলে যেতে হবে মা। ” বলে মেয়ে কে ডেকে তুলে রান্নাঘরে যায় তানজিনা । শওকতের বদলীর চাকরি। মেয়ের স্কুল নিয়ে সমস্যা হয়।

তবে এবার ভাগ্য প্রসন্ন বলতেই হয়। রাইসার স্কুল পুরানবাড়ির একেবারে কাছেই, আসফ আলী মিলনায়তনের পাশে। তানজিনাই মেয়েকে নিয়ে যায়, নিয়ে আসে। রাইসা এবার ক্লাস ফাইভে উঠল। রাইসার জন্য কী যেন কিনতে হবে।

ঠিক এই মুহূর্তে মনে পড়ল না। তানজিনাকে ফোন করবে কিনা ভাবল। মোবাইলটা প্যান্টের পকেটে ছিল। ভাইব্রেশন মোডে ছিল। ওটা বিজবিজ করে উঠল।

ফোন বের করে দেখল-ওশন আপা। তানজিনার বড় বোন। মাগুরা থাকেন। তানজিনা সর্ম্পকে শওকতের খালাতো বোন বলেই বিয়েতে সাংঘাতিক ঝামেলা হয়েছিল। তখন রওশন আপাই নানা ঝক্কি সামলিয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন।

হ্যালো । স্লামালাইকুম আপা। অলায়কুমআস সালাম। ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল রওশন আপার কন্ঠস্ব। কেমন আছেন আপা? ভালো থাকি কি করে বল? রায়পুরায় আমাদের দাদারবাড়ির জমিজমা সব ভাগভাঁটোয়ারা হচ্ছে।

ছোটন বিদেশ থেকে এসেছে। ভাইরা আমাদের ঠাকাচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না। এখন আমরা চুপ করে থাকলে ঠকে যাব না? তুই কি বলিস? শওকত বলল, এসব আপনাদের ব্যাপার আপা। আমার কিছু বলা কি ঠিক হবে? তোরা বাপেরবাড়ির সম্পত্তি থেকে পরীকে ভাগ দিলি না? শওকতদের দেশের বাড়ি যশোর। পৈত্রিক জমিজমা বিক্রি করে গত মাসে মোটা অঙ্কের টাকা পেয়েছে।

শওকতরা এক বোন, দুই ভাই। ছোট বোন পরীকে কিছু টাকা দিয়েছে। সে বলল, একটাই বোন। আদরের ... আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি? আমরা নেকস্ট উইকে রায়পুরা যাচ্ছি। তুই তানজিনা কে ছাড়বি তো? ওর ইচ্ছে হলে যাবে।

শওকত বলল। তারও ইচ্ছে তানজিনা ওর ভাগের টাকা পাক। তুই যাবি রায়পুরা? আমি বরং না যাই। ঠিক আছে। কাল শুক্রবার।

আমি আর তোর দুলাভাই কাল সুলতানগঞ্জ আসছি। ঠিক আছে। আসুন। এখন রাখছি তাহলে। ঠিক আছে।

চাঁদপিরের গলির মুখে মধু ঘোষের মিষ্টির দোকান। রাইসার জন্য আধ কে জি বুন্দিয়া কিনল শওকত। মেয়েটা বুন্দিয়া খেতে ভালোবাসে। তানজিনারও এই জিনিসটা পছন্দ। গলির মুখে অস্থায়ী বাজার বসেছে।

টমাটো, লেবু, ধনেপাতা, আর একটা মাঝারি সাইজের লাউ কিনল শওকত। তারপর বাজার নিয়ে বাড়ির সামনে চলে আসে। ট্রেনের হুইশেলের শব্দ শুনল। স্টেশন কাছেই। দোতলার সিঁড়িতে ওাঠর সময় ধূপের গন্ধ পেল।

কে ধূপ জ্বালিয়েছে? তানজিনা? দরজা তানজিনাই খুলল। ওর মুখ কেমন গম্ভীর দেখাচ্ছে। কী ব্যাপার? কিছু হয়েছে? তরিতরকারি ভর্তি প্লাস্টিকের ব্যাগটা দিতে দিতে জিগ্যেস করল শওকত। বলছি। তুমি বারান্দায় গিয়ে বসো।

আমি চা নিয়ে আসছি। টেবিলের ওপর বুন্দিয়ার প্যাকেট রেখে শওকত জিগ্যেস করল, রাইসা কোথায়? ও ঘুমাচ্ছে। ঘুমাচ্ছে? এখন? এসে সব বলছি। বলে তানজিনা রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। শওকত কাপড় বদলে হাতমুখ ধুয়ে গায়ে বারান্দায় বসে।

শেষবেলার রোদ মিলিয়ে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ফুটে উঠছে। বাগানের গালপালায় অল্প রোদ লেগে আছে। কাকপাখিরা তারস্বরে চিৎকার করছিল। অক্টোবরের শেষ। এই সময়ে মফস্বলে বেশ কুয়াশা পড়ে।

সন্ধ্যার পরপরই দূরের গ্রাম থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসে। তানজিনা চা নিয়ে এল। চায়ের কাপ নিতে নিতে শওকত জিগ্যেস করে, কী হয়েছে বলো তো? রাইসা আজ একটা মেয়েকে দেখেছে। তানজিনা বলল। শওকত চায়ের কাপটা ঠোঁটের কাছে তুলে এনেছিল, হাত থমকে গেল।

বলল, রাইসা আজ একটা মেয়েকে দেখেছে মানে? আমি রান্না করছিলাম। রাইসাকে বললাম জলপাই ছাদ শুকোতে দিয়ে আসতে। ও গেল। একটু পর ফিরে এসে বলল, ছাদে জলপাই রেখে ফেরার সময় সিঁড়িঘরের ঠিক সামনে একটা মেয়েকে দেখেছে। মেয়েটার গায়ের রং কালো হলেও দারুণ সুন্দরী।

আকাশি রঙের শাড়ি পরা ছিল। রাইসা বলল, তুমি কে ? মেয়েটি বলল, আমি অর্চনা। রাইসা বলল, তুমি কোথায় থাক? মেয়েটি বলল, বলল, আমি এই বাড়িতে থাকি। রাইসা বলল, দেখি না কেন? মেয়েটি বলল, আমাকে তো দেখা যায় না। বলে মেয়েটি অদৃশ্য হয়ে গেল।

তারপর? শওকত কেমন বিমূঢ় বোধ করছিল। তারপর রাইসা টিভি দেখতে-দেখতে ঘুমিয়ে গেল। আমি ওকে অবশ্য তুলে একবার খাইয়ে দিয়েছি। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে একটা সিগারেট ধরালো শওকত। কপালে ভাঁজ পড়েছে।

বলল, রাইসার ভুল দেখেনি তো? অন্য কেউ ছাদে ওঠেনি তো? অমাঃ ও ভুল দেখবে কীভাবে? ছাদের চাবি তো আমাদের কাছেই থাকে। ওহ্ । এই বাড়িটা ভালো না শওকত। আমার আর ভাল্ লাগছে না। কয়েক দিন আগে জুয়েলের মাও বলল এই বাড়িতে নাকি জিনের আছর আছে।

ভাড়াটিয়ারা থাকতে চায় না। কী সব নাকি দেখে। এই কারণে ভাড়া নাকি কম। কাল তোমার ফিরতে দেরি হল। রাইসাকে নিয়ে পড়তে বসিয়েছি।

তখন ঘরে হালকা ধূপের গন্ধ পেয়েছি। শওকত বলল, আমি আজ সিঁড়িতে ওঠার সময় ধূপের গন্ধ পেয়েছি। একতলার হোমিও ডাক্তার ধূপ জ্বালান নি তো? মনে হয় না। ভদ্রলোক তো কিছু দিন ধরে আসছেন না। বলে শওকত এক মুখ ধোঁওয়া ছাড়ে।

ঠিক তখনই তারা মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আছে। অন্ধকার ঘনিয়ে উঠছে। বারান্দায় শীত মাখানো বাতাস ছড়ায় । ওরা ধূপের গন্ধ পায়। তানজিনা চমকে উঠে।

বলে, ধূপের গন্ধ পাচ্ছ? হু। বলে শওকত উঠে দাঁড়ায়। তারপর দ্রুত ঘরের ভিতরে চলে এল। তানজিনা সুইচ অন করে বাতি জ্বালায়। ঘরের বাতাসে তীব্র ধূপের গন্ধ ।

রাইসা বিছানার ওপর গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে। কে ধূপ জ্বালালো? ফিসফিস করে বলল তানজিনা। শওকত কাঁধ ঝাঁকায়। তাকে কেমন বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। কলিংবেল বাজাল।

কে এল? তানজিনা প্রায় আর্ত চিৎকার করে উঠল। ওরা প্রায় দৌড়ে ড্রইংরুমে এল। সুইচ অন করে শওকত বাতি জ্বালালো। দরজা খুলে তীব্র আতরের গন্ধ পেল তানজিনা । চাদরমুড়ি দিয়ে সোলাইমান মিঞা দাঁড়িয়ে আছে।

হাতে কাগজ দিয়ে ঢাকা একটি প্লাস্টিকের গামলা। তার ওপর মিষ্টির একটা প্যাকেট। বলল, সেলাম ম্যাডাম। সালাম। কী ব্যাপার সোলাইমান? সোলাইমান মিঞা হেসে বলল, আইজ চাইনপীরের মাজারে মায়ফিল বইসিলে ম্যাডাম।

আপনাগো জইন্য তবারক নিয়া আরসি । আইজ গুলজারে সবজি খিচুড়ি পাকায়ছিলে। ওহ। এসো, ভিতরে এস। সোলাইমান মিঞা ভিতরে ঢোকে।

তানজিনা জিগ্যেস করে, মিষ্টি কিসের? মিষ্টির প্যাকেট আর খিচুড়ির গামলা ড্রাইনিং টেবিলের ওপর রেখে সোলাইমান মিঞা বলল, আমাগো বাড়িওলায় আশীষ খোনকার আইজ নানা হইছেন, বোঝলেন। এই আনন্দে হে নাকি নবীগঞ্জবাসীরে দাওয়াত করিয়া খাওয়াইবেন কইলেন। আপনাগোও দাওয়াত করিবেন কইলেন । আইজ তিনি আমারে ফোন করিয়া আপনাগোরে মিষ্টি কিন্না খাওয়াইয়া দেতে কইলেন। আচ্ছা, তুমি এখন বস, একটু চা খাও।

বলে তানজিনা রান্নাঘরে চলে যায়। শওকত একটা চেয়ার টেনে বসল। ধূপের গন্ধটা তখনও বাতাসে ভাসছিল। মোবাইলের রিংটোন শুনতে পেল। মোবাইলটা বেডরুমে।

সে দ্র্রুত বেডরুমে চলে আসে। মোবাইল টেবিলের ওপর থেকে তুলে নেয়। রওশন আপা। হ্যাঁ, আপা বলেন। একটু আগে ছোটনের সঙ্গে কথা হল।

ভাইরা আমাদের জমির ভাগ দেবে বলল। আচ্ছা। সে তো ভালো কথা। তারপরও আমরা কাল আসছি, বুঝলি? ঠিক আছে। আসুন না।

বেশি ঝামেলা করতে যাস না আবার। কাল বিকেলেই ফিরে আসব। লোপার আবার পরীক্ষা। না, না ঝামেলার কি আছে। ফোন অফ করে ড্রইংরুমে এসে চেয়ারে বসল শওকত ।

সোলাইমান মিঞা আরষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে। শওকত বলল, সোলাইমান মিঞা? কন ছার। তুমি এই বাড়িতে কত দিন ধরে আছ? পুরানবাড়িত আমি দেখতে আছি জন্মের পরের থন। দূর্গাপাড়ায় আমার মায়ে কাম করতে। আমি তখন ছুড।

দ্যাশ স্বাধীন হইলে পর আমার মায়ে মরল। আমি অথই গাঙে পড়লাম। পুরানবাড়ির মালি আছিল সালামত আলী। বিহারী হইয়াও আমার লালনপালনের ভার লইলেন। তখন মমতাজ ছিনেমা হলের মালিক গুলাম দস্তগীর ছাহেব পুরানবাড়ি কিন্না লইলেন।

তারপর তিনি বিলাত চইলা গেলেন। এইবার পুরানবাড়ি কিন্না লইলেন চকখোলা হাজী কেরামত । তিনি মারা গেলে পর এইবার সুনতানগঞ্জের আশীষ খোনকারে কেনলেন পুরানবাড়ি। পুরানবাড়ি অনেকবার হাত বদল হইছে ছার। তয় তামারে কেউ খেদায় নাই।

শওকত বলল, লোকে বলে পুরানবাড়িতে জিনভূত না কী সব নাকি আছে। তুমি দেখেছ কখনও? লোকে তো হেইয়া কয়। আমি হইলাম চাইনপীরের মুরিদ। জিনপরি আমার কাছে ঘেঁষবে কন সাহসে কন? তয়- তয় কী? শওকতের চোখ সরু হয়ে ওঠে। মিছা কমুনা ছার।

আহা বল না কার্তিক মাস আইলে না ছার ... একডা কালা কইরা সুন্দরী মাইয়ায় ... কথা শেষ হল না। তানজিনা চা নিয়ে এল। তারপর বসতে বসতে বলল, সোলাইমান মিঞা? সোলাইমান মিঞা গরম চা সুরুত করে শব্দ বলল, কন ম্যাডাম। রাইসার স্কুলের আশেপাশে ভাড়াবাড়ি পাওয়া যাবে? সস্তায়? যাইব ম্যাডাম। তয় কার জইন্ন ম্যাডাম? আমাদের জন্য।

আয় হায়। কন কী! আপনারা পুরান বাড়ি ছাইড়া চইল্যা যাইবেন ম্যাডাম? হ্যাঁ। কী বলতে যাবে- বেডরুমের দরজায় শব্দ হল। রাইসা দাঁড়িয়ে। রাইসা তখনও চোখ কচলাচ্ছে।

ঘুমের ঘোর কাটেনি। ও আদুরে গলায় বলল, মা। আমাকে খিচুড়ি দাও না। আর শোন মিষ্টিও দিও। তানজিনা ঝট করে তাকালো শওকতের মুখের দিকে।

খিচুড়ি খাইবা মা? আইয়ো। তোমারে খিচুড়ি দেই। সোলাইমান মিঞা বলল। সারারাত শওকতের ঘুম হল না। একবার ঘুম হল ঠিকই।

আবোলতাবোল স্বপ্ন দেখল। ভোরে বিছানায় শুয়ে ফজরের আজান শুনল। ভোরে হাঁটাহাঁটি না করলে সারাদিন গা ম্যাজম্যাজ করে। মেয়েকে জড়িয়ে তানজিনা ঘুমিয়ে। ও কালই বলেছিল মেয়েকে ফেলে আজ আর হাঁটতে যাবে না।

শওকত চাদর জড়িয়ে মাঙ্কি ক্যাপ পরে নীচে নেমে এল। নীচতলার বাগানে কুয়াশা। ফটকের কাছে সোলাইমান মিঞা। মসজিদে যাচ্ছে হয়তো। এই ভোরেও চাঁদপিরের গলির মুখে মধু ঘোষের মিষ্টির দোকান খোলা।

পাশেই বাসষ্ট্যান্ড। ভিতরে ঢুকে চায়ের অর্ডার দিল শওকত। মাথায় কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কাল সন্ধ্যায় রাইসার আচরণ অস্বাভাবিক ঠেকছে। ও তো ঘুমিয়ে ছিল।

ও জানল কি করে সোলাইমান মিঞা খুচড়ি এনেছে? ও গতকাল দুপুরে কাকে দেখল ছাদে? অর্চনা মেয়েটি কে? সন্ধ্যায় কে ধূপ জ্বালায়? এসবের ব্যাখ্যা কী? শওকত কেবলি ভাবছিল । তানজিনা আর পুরান বাড়িতে থাকতে চাইছে না। সোলাইমান মিঞাকে ও এ মাসের মধ্যেই রাইসার স্কুলের আশেপাশে বাড়ি দেখে রাখতে বলেছে। রাতে সোলাইমান মিঞা কে রাতে ড্রইংরুমে শুতে বলেছে। চা শেষ করে বিল মিটিয়ে দোকানের বাইরে বেড়িয়ে এল শওকত ।

তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে পিচ রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে। বাতাসে ডিজেলের গন্ধ। হাতের ডাইনে একটা সরু গলি। গলির শেষ মাথায় একটা পানাপুকুর। বাঁশঝাড়, তারপর মেঠো পথ ... শওকত প্রাচীন শিব মন্দিরের পাশে সতীর দিঘীর ঘাটে এসে বসল।

দিঘীর ঘাটের ঠিক পাশেই একটা হরীতকী গাছ। ঘাটের ওপর শিশির ভেজা পাতা পড়ে আছে। পরপর দুটো সিগারেট শেষ করল সে। খালি পেটে সে অবশ্য সিগারেট খায় না। তানজিনার বারণ আছে।

আজ ভীষণ অস্থির লাগছিল। কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পেল শওকত। চাদরমুড়ি দিয়ে কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখল-নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। শিব মন্দিরের পুরোহিত।

বৃদ্ধের বয়েস সত্তরের কম হবে না। শ্যামলা মতন গায়ের রং। শক্তসমর্থ শরীর। পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন, আজ আপনাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে যে? জলজ গম্ভীর কন্ঠস্বর। প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শওকত বলল, আপনি কি সুলতানগঞ্জে অনেক দিন ধরে আছেন? হ্যাঁ।

আমার দেশের বাড়ি ছিল যশোর। সুলতানগঞ্জে এসেছি স্বাধীনতার এক বছর আগে। পুরানবাড়ি সর্ম্পকে আপনি কিছু জানেন? লোকজন কেন ওই বাড়িতে থাকতে চায় না। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য চুপ করে রইলেন। পাতার ওপর শিশির পতনের শব্দ ।

কুয়াশায় একটা কাক উড়ে যায়। দিঘীতে কী একটা মাছ যেন ঘাই দেয়। নিস্তরঙ্গ জলে তরঙ্গ ছড়ায়। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বললেন, জানি প্রশ্নটা আপনি করবেন। জানেন মানে? শত্তকত বৃদ্ধের মুখ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল।

এর আগে যারা ওই পুরানবাড়িতে ছিল তারা সবাই আমাকে ওই একই প্রশ্ন করেছে। ওহ্ । শোনেন, বলি তা হলে । বিশ্বাস করবেন কিনা সেটি আপনার ব্যাপার। পুরান বাড়ি এক অশরীরী আছে।

কার্তিক মাসে তাকে দেখা যায়। শওকত চমকে ওঠে। অস্ফুটস্বরে বলল, অশরীরী? মানে? উত্তর না দিয়ে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য চুপ করে থাকেন। বৃদ্ধ পুরোহিত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভোরের এই নির্জনতায় দীর্ঘশ্বাস পতনের শব্দ পরিস্কার শোনা যায়।

প্রায় অনুচ্চস্বরে বৃদ্ধ পুরোহিত বললেন, তখন যুদ্ধের বছর। এক বছর আগে আমি যশোহর থেকে সুলতানগঞ্জে এসেছি। শিব মন্দিরে পূর্জঅচ্চনা করি। রাইচরণ নামে আমার এক সেবায়েত ছিল । ভারি গরিব সে।

রাইচরণের ছিল পরমা সুন্দরী এক যুবতী কন্যা। কন্যার নাম অর্চনা। শওকত চমকে ওঠে। কি নাম বললেন? অর্চনা। ওহ্ ।

অর্থের অভাবে অর্চনার বিবাহ দেওয়া সম্ভব হয়নি। আমিও যে সাহায্য করব আমার সে উপায় ছিল না। কন্যাদায়গ্রস্থ ম্যালেরিয়ায় রাইচরণ মারা যায়। অসহায় অর্চনা পুরাণবাড়িতে কাজ নেয়। পুরান বাড়িতে বাস করত এক পাকিস্তানি পরিবার ।

বাড়ির কর্তা ছিল ব্যবসায়ী। নাম জামশেদ খান। বেগম ছাড়াও এক কন্যা আর তিন পুত্র ছিল তার । অর্চনা হিন্দুঘরের মেয়ে, সন্ধ্যায় মেয়েটি ধূপ জ্বালাত। পাকিস্তানি পরিবারের ধূপের গন্ধটা না-পছন্দ ছিল।

তারা অর্চনাকে ধূপ জ্বালাতে নিষেধ করে। আসলে বাঙালি বলে, কালো বলে, হিন্দু বলে তারা নানান ছুতায় অর্চনার ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করত। পূর্ব-পাকিস্তানে শেখমুজিব পাকিস্তানবিরোধী গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ব্যবসা হাতছাড়া হয়ে যাবে-এই আশঙ্কায় পাকিস্তানিরা আক্রশবশত অর্চনার উপড় রাগ ঝাড়ত। আসলে জামশেদ খান আর তার বড় ছেলে জুনায়েদ খানের নজর পড়ছিল টলটলে শরীরের উপর।

কিন্তু, ... কিন্তু, এসব কথা আপনি জানলেন কী করে? পুরানবাড়ির বাগানে মালি ছিল সালামত আলী । বিহারী হলেও সে ছিল উদার হৃদয়ের। অর্চনা তাকে সব বলেছিল। অর্চনা পালিয়ে যেতে পারছিল না, বাবা নেই, তারাও তাকে এক রকম বন্দি করে রেখেছিল। যুদ্ধ শুরু হলে জামশেদ খান পরিবারকে লাহোর পাঠিয়ে দেন।

পুরানবাড়িতে থাকল সে আর তার বড় ছেলে । পুরানবাড়ি পরে পাকিস্তানি আর্মি অফিসারদের আস্তানা হয়ে উঠেছিল। দিনদিন অর্চনার ওপর অত্যচারের মাত্রা বাড়ছিল। একদিন অর্চনাকে ছাদে নিয়ে তারা ধর্ষন করে। পাকিস্তানি আর্মি অফিসাররাও ছিল।

তারপর মেয়েটার গায়ে কেরোসিন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারে। শওকত চমকে ওঠে। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য চুপ করে থাকেন। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই নির্জনতায় দীর্ঘশ্বাস পরিস্কার শোনা যায়।

প্রায় অনুচ্চস্বরে বললেন, অর্চনাকে তারা পুড়িয়ে মেরেছিল কার্তিক মাসে। বলে বৃদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, আজও কার্তিক মাসে পুরানবাড়িতে অর্চনা ফিরে আসে। সন্ধ্যায় ধূপ জ্বালায়। আপনাদের দারোয়ান সোলাইমান সবই জানে।

ছেলেটা বড় ভালো। চাঁদসাধুর শিষ্য। তার ওপর সাধুর আর্শীবাদ আছে। ঘরসংসার করেনি। ধর্মকর্ম নিয়ে আছে।

বছরে একবার অর্চনাকে দেখার আশায় বেঁচে আছে। অর্চনাকে দেখার আশায় বেঁচে আছে মানে? শওকতকে কেমন হতবাক বিমূঢ় দেখায়। দুই জনের বেশ ভাব। ভাইবোনের সর্ম্পক। হাজার হলেও সোলাইমানের ধর্মপিতা সালামত আলীকে অর্চনা বাবা ডেকেছিল।

কার্তিক মাসের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে সোলাইমান। এসব ... এসব কথা আমাদের আগে বলেননি যে? শওকত অস্ফুটস্বরে জিগ্যেস করে। আমি জানতাম আপনারা এসে আমাকে পুরানবাড়ির রহস্য সম্বন্দে জিজ্ঞেস করবেন। আমি আগ বাড়িয়ে এসব কথা বলে আপনাদের মিছিমিছি আতঙ্কগ্রস্থ করতে চাইনি। ওহ।

শওকত ভাবল নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচায স্বশিক্ষিত বলেই বিচক্ষণ। সে বলল, এখন ... এখন কি করা যায় বলেন তো ? আমরা কি পুরান বাড়ি ছেড়ে দেব? সে আপনাদের ইচ্ছে। বলে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য উঠে চলে গেলেন। বাড়ি ফিরে আসার পথে চাঁদপিরের গলির মুখ থেকে দৈনিক পত্রিকা কিনল শওকত। ঝরঝরে রোদ উঠেছে।

আজ শুক্রবার। অফিস যাবার বালাই নেই। কলিংবেল চাপার পর দরজা খুলল রাইসা। আজ এত সকালে উঠেছে বলে অবাক হল শওকত। রাইসা সাদা রঙের ফ্রক পরে আছে।

মাথায় লম্বা সোনালি চুল। কী টলটলে মায়াবী চোখ। রাইসার হাতে একটা বাটি। বাটিতে কী মুড়কি। মাথায় নেড়ে বলল, মা কই রে? আম্মু, রান্নাঘরে ।

ড্রইংরুমে টিভিটা অন করা। কার্টুন ছবি চলছে। রাইসা দেখছিল। শওকত বারান্দায় চলে আসে। আজ রওশন আপাদের আসার কথা।

বাজারে যেতে হবে। বাজারটা নবীগঞ্জে। নবীগঞ্জের বাজারে টাটকা রুইমাছ পাওয়া যায়। রওশন আপা রুইমাছ পছন্দ করেন। তানজিনা চা নিয়ে এল।

বলল, তোমাকে এখন খিচুড়ি গরম করে দেব? না। বাজার থেকে ফিরে এসে খাব। আচ্ছা, সোলাইমান এসেছিল? সোলাইমান । না তো। তানজিনা অবাক।

তাহলে রাইসাকে মুড়কি কে দিল? মুড়কি? হ্যাঁ। তখন রাইসার বাটিতে মুড়কি দেখলাম। তানজিনা বলল, আশ্চর্য! ও মুড়কি পাবে কই? বুঝেছি। শওকত বলল। মুখে হাসির আভা।

কী বুঝেছ? তানজিনাকে কেমন অস্থির দেখায়। চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, রাইসাকে মুড়কি দিয়েছে অর্চনা। অর্চনা মানে? কি যাতা বলছ! চায়ে চুমুক দিয়ে শওকত বলল, আজ ভোরে শিব মন্দিরে গিয়েছিলাম। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যর সঙ্গে কথা হল। তিনি আমাকে পুরানবাড়ি ইতিহাস বললেন।

কী বললেন তিনি? তানজিনার মুখে রঙিন আভা ছড়ালো। অর্চনা ছিল ...শওকত বলতে থাকে। অর্চনার মর্মস্পর্শী জীবনকাহিনী শুনতে শুনতে তানজিনার ফরসা মুখটি বিষাদে ভরে ওঠে। চোখে জমে বেদনার জল। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে শওকত বলল, যাই, আমি এখন বাজারে যাই।

দাও, আলমারী থেকে টাকা বের করে দাও। তানজিনা গম্ভীরকন্ঠে বলল, শওকত। বল। মেজোভাই ফোন করেছিলেন। আমাকে আর রওশন আপাকে রায়পুরা জমিজমার ভাগ দেবেন বললেন।

শোন, শওকত। আমি জমির যে টাকা পাব আর তোমাদের দেশের বাড়ির যে টাকা আছে সেসব মিলিয়ে চল আমরা এই বাড়িটা কিনে নেই। সস্তাই হওয়ার কথা। দরকার হলে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেবে। এ বছর চাকরি করলে এক টাকাও তো লোন নিলে না।

তুমি আজই বাড়িওলার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বল। শওকত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ওকে। উৎসর্গ: ফজিলাতুননেসা শাপলা। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।