আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইয়াবার চেয়ে ভয়াবহ মাদক হান্টারের আগ্রাসী থাবায় ভাসছে দেশ

নেশার সাম্রাজ্যে ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিলের বাজারকেও হার মানিয়েছে যমুনা গ্রুপের হান্টার বিয়ার। এ বিয়ারের আগ্রাসী থাবায় শহর-বন্দর-জনপদ জুড়ে বেসামাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। 'অল্প টাকায় কড়া নেশার হান্টার' ছাত্র, যুবক, তরুণদের গিলে খাচ্ছে রীতিমতো। হান্টার বিয়ারের জোয়ারে ভাসছে রাজধানীসহ সারা দেশ। প্রতিদিনই বিক্রি হচ্ছে কোটি কোটি টাকার এই মাদক।

হাত বাড়ালেই মিলছে। নেশার সাম্রাজ্যে দীর্ঘ দিন ফেনসিডিলের একক কর্তৃত্ব ভেঙে কয়েক বছর ধরে ছিল ইয়াবার ছড়াছড়ি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবার বাজারকে তুচ্ছ করে হান্টার বিয়ারই নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের গোটা মাদক বাণিজ্য।

অপেক্ষাকৃত কম টাকায় অধিক অ্যালকোহলযুক্ত হান্টার বিয়ার পাওয়া যায় বলে আসক্তরাও তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় যেখানে-সেখানে পাওয়া যাচ্ছে হান্টার।

ফলে যে কেউ তা সংগ্রহ করে কড়া নেশায় বুঁদ হয়ে থাকছে। মহানগর থেকে জেলা শহর পেরিয়ে উপজেলা সদরেও হান্টার সেবনের ডজন ডজন মাদক আখড়া গড়ে উঠছে। সন্ধ্যা না পেরোতেই হান্টার মাদকের আখড়াগুলো জমজমাট হয়ে ওঠে। মুসলিমপ্রধান দেশে যমুনা গ্রুপই একমাত্র মাদক বিয়ার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। তাদের উৎপাদনকৃত হান্টার বিয়ার দেশে অবাধে বাজারজাতকরণের মাধ্যমে যুবক, ছাত্র, কৃষক, পেশাজীবী তথা সর্বসাধারণকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে।

বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যমুনা গ্রুপের বিয়ার উৎপাদন স্থগিত করা হলেও বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠানটি পুরোদমে বিয়ার উৎপাদন ও বাজারজাতের সুযোগ লাভ করে। শুধু তাই নয়, পণ্যটি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে কোনোরূপ নিয়মনীতিরও তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। বরং একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন অননুমোদিত বার, রেস্টুরেন্ট, হোটেলসহ গ্রামগঞ্জের হাটবাজারও হান্টার বিয়ারে সয়লাব হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, যমুনা গ্রুপ জেলা-উপজেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে হান্টার বিয়ারের অবৈধ বিপণনের সুবিধার্থে বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে।

শহরের গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্রামগঞ্জের আনাচে-কানাচে এমনকি মুদি দোকানেও এর প্রাপ্তি সুলভ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মুদি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে প্রসাধনী বিক্রেতাও রাতারাতি পেশাদার মাদক ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়ে যাচ্ছেন। তাদের মাধ্যমেই হান্টার বিয়ার খোলা বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে ব্যাপকভাবে। সহজলভ্য হওয়ায় যুবসমাজ ছাড়াও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত ঝুঁকে পড়ছে মাদকে। একদিকে অধিক অ্যালকোহলযুক্ত বিয়ার পানে আসক্ত হয়ে পড়ছে ছাত্রছাত্রী ও যুবসমাজ, অন্যদিকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুতই অবনতি ঘটছে।

মাদক অধিদফতরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, হান্টার বিয়ারের ক্যানে মাত্র ৫ পার্সেন্ট অ্যালকোহল থাকার কথা লেখা হলেও বাস্তবে এ বিয়ারে ১২ পার্সেন্টের বেশি অ্যালকোহল রয়েছে। হান্টারের বিভিন্ন চালান পর্যবেক্ষণ করে ক্যানগুলোর মধ্যে সরাসরি রেকটিফাইড স্পিরিট (আরএস) মেশানোর নজিরও পাওয়া গেছে। এসব বিষয় উল্লেখ করে গত সেপ্টেম্বরেও হান্টারের বিরুদ্ধে ঊধর্্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়। কিন্তু প্রভাবশালী চক্রটির অব্যাহত হুমকি ও চাপের কারণে কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোনো রকম ব্যবস্থা নিতে পারেননি।

লাইসেন্স জোটায় যেভাবে : যমুনা গ্রুপ ২০০২ সালে বিনিয়োগ বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ক্রাউন ও হান্টার নামে পানীয় তৈরির প্লান্ট স্থাপন করে।

পানীয় তৈরির জন্য বাধ্যতামূলক থাকা সত্ত্বেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে লাইসেন্স নেওয়া হয়নি। অনুমোদন ছাড়াই অবৈধভাবে মদ উৎপাদন ও বাজারজাত শুরু করে যমুনা গ্রুপ। সে সময় হান্টার নামে যে পানীয় বাজারজাত করা হচ্ছিল তাতে যথাক্রমে ৪ দশমিক ৮ এবং ৩ দশমিক ৮ শতাংশ অ্যালকোহল ছিল। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে দেশব্যাপী ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ২০০৪ সালের ৩ মার্চ কারখানাটি সিলগালা করে দেয় এবং সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কালিয়াকৈর থানায় মামলা করে।

যমুনা গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ক্রাউন বেভারেজের পক্ষ থেকে ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা হয়। কিন্তু দেশের আইনের বাধ্যবাধকতা থাকায় সে সময় ক্রাউন বেভারেজকে মদ উৎপাদনের লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে তাদের বিরুদ্ধে কালিয়াকৈর থানায় দায়ের করা মামলা দ্রুত বিচার আদালতে স্থানান্তর করা হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করে ক্রাউন বেভারেজ কোম্পানি। ২০০৫ সালের ৩ মার্চ হাইকোর্ট এ মামলায় রায় দিয়ে যমুনা গ্রুপকে মদের লাইসেন্স দেওয়ার নির্দেশ দেন।

কিন্তু সে সময় জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধের সরকার থাকায় হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে হাইকোর্ট এ বিষয়ে আর কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। উল্লেখ্য, ক্রাউন ও হান্টারসহ মদ-জাতীয় পানীয় উৎপাদনের লাইসেন্স নিয়ে যমুনা গ্রুপের কর্ণধার নুরুল ইসলাম বাবুলের সঙ্গে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের তীব্র বিরোধ মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়। তখন লাইসেন্স আদায়ে যমুনা গ্রুপ ব্যর্থ হয়। ২০০৮ সালের ২ ডিসেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় হাইকোর্ট মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের দায়ের করা সেই আপিল খারিজ করে দেন।

পরে ২০০৯ সালের ৩ জানুয়ারি এ রায়ের ওপর রিভিউ পিটিশন করা হয়। এ রিভিউ পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২৮ জুন কিছু সংশোধনী এনে যমুনা গ্রুপ মদ উৎপাদনের লাইসেন্স পায়। আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতেই বর্তমান সরকার গত বছরের ২৯ জুন যমুনা গ্রুপকে মদ উৎপাদনের লাইসেন্স প্রদান করে।

লাইসেন্স দেওয়ায় নয়া বিড়ম্বনা : সিনিয়র আইনবিদরা জানান, বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদ (১) অনুযায়ী আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ছাড়া মদ ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য সরকারের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা রয়েছে। এ ধারাটি ১৯৭২ সালের সংবিধানেই সংযোজিত হয়েছে।

কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী সরকার মদের লাইসেন্স না দেওয়ার ব্যাপারে সক্রিয় কোনো ভূমিকা নেয়নি।

এদিকে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ক্রাউন বেভারেজ লিমিটেড কোম্পানিকে মদের লাইসেন্স দেওয়ায় এখন অনেক কোম্পানি আরও মদের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য আবেদন করেছে। নতুন কোম্পানিগুলোর যুক্তি হলো, ক্রাউন বেভারেজকে মদ তৈরির লাইসেন্স দিলে অন্য কোম্পানিকে কেন দেওয়া হবে না। সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের ঊধর্্বতন সূত্রে জানা গেছে, এ যুক্তির কারণে নতুন কোম্পানিগুলোকে অধিদফতর নতুন লাইসেন্স দিতে বাধ্য হবে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশে আরও কয়েকটি কোম্পানি মদ উৎপাদনের লাইসেন্স পেতে যাচ্ছে।

'জাতিকে মেধাশূন্য মাতাল বানাচ্ছে যমুনা গ্রুপ' : এদিকে দেশের ১ হাজার ১ জন পেশাজীবী নাগরিক গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছেন, যমুনা গ্রুপ দেশের প্রতিভাবান মেধাবীদের মাদকের নেশায় ফেলে তাদের প্রতিভা ধ্বংস করে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার চক্রান্তে মেতে উঠেছে। তারা যে রেকটিফাইড স্পিরিট ও হান্টার উৎপাদন করে বিপণন করছে তা অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানানো হয় বিবৃতিতে।

পেশাজীবী নাগরিকরা বলেন, যমুনা গ্রুপ কসমেটিকস ব্যবসার আড়ালে আগামী প্রজন্মের উঠতি বয়সের মেধাবীদের মাতাল বানিয়ে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিলীন করার গভীর চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বলেন, যাদের ব্যর্থতার কারণে অবৈধ রেকটিফাইড স্পিরিট ও হান্টার উৎপাদন ও বিপণন করা হচ্ছে তাদেরসহ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

পেশাজীবীরা বলেন, সরকার দেশের মেধাবীদের ভয়ানক মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা করতে অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে দেশবাসী যমুনা গ্রুপের অবৈধ বাণিজ্য ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ সরকারের নীরবতার প্রতিবাদে মাঠে নামতে বাধ্য হবে।

পেশাজীবীদের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এই যমুনা গ্রুপ তাদের উৎপাদিত সাবানকে ১০০% হালাল বলে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে মনোপলি ব্যবসা করে এখন মুসলিম অধ্যুষিত পীর-আউলিয়ার দেশে হারাম মাদক উৎপাদন করতে দ্বিধা করছে না। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যে ক্রাউন, হান্টারের উৎপাদন আন্দোলন করে বন্ধ করা হয়েছিল বর্তমান সরকারের সময়ে এসে কীভাবে তা আবার উৎপাদন ও বিপণন করার সুযোগ পেল দেশের মানুষ তা জানতে চায়। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রযেছেন ইঞ্জিনিয়ার আমিনুল ইসলাম, ড. মনির হোসেন, কৃষিবিদ মুশতাক আহমেদ, প্রিন্সিপাল আজিজুল আজিম, ডা. শাজাহান মিয়া, মুন্সী আবদুল কাদির, প্রফেসর আতিকুর রহমান, মুফতি আতিকুল ইসলাম, মাওলানা ছগির উদ্দীন, সমাজসেবী রেজওয়ানুল ইসলাম নাহিদ, আখলাকুল আনওয়ার, ডা. অজয় কুমার শীল, প্রফেসর নিমাই চন্দ্র, ছাত্রনেতা আবদুল গফুর সরকার, কৃষিবিদ ফজলুল হক আলমগীর, আহসান হাবীব প্রমুখ।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.