আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইয়াবার থাবায় বিপন্ন তারুণ্য

রমনা এলাকার বাসিন্দা আফরোজা আহমেদ (ছদ্মনাম) তার কলেজ পড়ুয়া ছেলে সাবিলকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত। স্বনামধন্য স্কুল থেকে যে ছেলেটি পঞ্চম শ্রেণীতে পেয়েছিল বৃত্তি, এসএসসিতেও গোল্ডেন। সেই ছেলে কি না এইচএসসিতে ফেল! প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা ছেলেটি যেন আগের মতো আর নেই। ছেলের এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ দীর্ঘ দিন ধরে খোঁজ নিয়ে আফরোজা যা জানতে পারেন, তা রীতিমতো অাঁতকে ওঠার মতো। ছেলে তার মরণনেশা ইয়াবায় আসক্ত।

ছেলের বাবাকেও এ বিষয়ে বলতে পারছেন না তিনি। একা একা ছেলেকে বোঝান। ছেলেটি বোঝে না। নীরবে নিভৃতে কাঁদতে কাঁদতে আফরোজা নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিয়েও তিনি তার ছেলেকে ইয়াবার পথ থেকে ফেরাতে পারছেন না।

আফরোজা তার একমাত্র সন্তানের জীবন নিয়েই এখন শঙ্কিত।

আফরোজার মতো হাজারো মায়ের কান্না এখন ঘরে ঘরে। ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবার সর্বনাশা থাবায় বিপন্ন হয়ে পড়েছে এমন অসংখ্য পরিবারের সন্তানদের জীবন। নেশায় আসক্ত হয়ে পড়া ছেলে-মেয়েদের মায়ের কান্নাও থামছে না। অসহায় এই মায়েদের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে।

আফরোজা আহমেদ জানান, সামাজিক অবস্থার কারণে তার ছেলের আসক্তি নিয়ে তিনি কাউকে বলতে পারছেন না। ছেলের বাবা একজন ব্যবসায়ী। সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। তিনি এ ঘটনাটি শুনলে কী হতে পারে তা তিনি ভেবে পাচ্ছেন না। অগত্যা একাই চুপে চুপে খবর নিয়েছেন ছেলের ব্যাপারে।

পুলিশের কাছে গিয়ে পরামর্শ চেয়েছেন। কোনো লাভ হয়নি। আফরোজা বলেন, এখন আমার কান্না করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই।

একইভাবে বনানীর বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ শিক্ষার্থীকে নিয়ে বিব্রত বাবা উচ্চপদস্থ আমলা। ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করে বাইরে বের হয়, কিন্তু ফেরে অনেক রাতে।

আচরণগত পার্থক্য ধরা পড়ে অভিভাবকদের কাছে। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে বেরিয়ে আসে মূল তথ্য। ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েছে তাদের সন্তান। চিকিৎসা দেওয়া হয়। ছেলে সুস্থ হয়ে ফিরে আসে।

আবারও কলেজে যায়। কিন্তু ইয়াবা তার পিছু ছাড়ে না। বাবা না জানলেও বুঝতে পারে তার মা। তিনি ছেলেটির পিছু নেয়। কোথায় যায়, কী করে খবর নেওয়ার চেষ্টা করে।

মায়ের কাছে ধরাও পড়ে। কিন্তু ছেলেটিকে ফেরাতে পারেন না। ছেলেটির বাবা জানেন, ছেলে সুস্থ। কিন্তু মায়ের আর্তনাদ শোনার কেউ নেই।

জানা গেছে, ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক এলাকায় নির্বিঘ্নে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা।

অভিযোগ রয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সামনে বিক্রি হলেও রহস্যজনক কারণে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। প্রথম দিকে ইয়াবা সীমাবদ্ধ ছিল উচ্চবিত্তদের মধ্যে। এখন সমাজের সব শ্রেণীর মানুষই এই নেশায় আসক্ত। বিস্তার বাড়ার পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে প্রশাসনের রহস্যময় নীরবতা। এছাড়া নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে কথিত সমাজসেবীদের অনেকের নামই উঠে এসেছে, যারা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।

তাদের সহযোগিতায় প্রতিদিন কয়েক লাখ ইয়াবা ঢুকছে বাংলাদেশে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ডিন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, এটি সেবনে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ বৃদ্ধি, হজমশক্তি নষ্ট করা এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়া, পিঠে ব্যথা, ফুসফুস ও কিডনি নষ্ট হওয়া ও টাক পড়ার আশঙ্কা থাকে। মনে হতাশা, বিষাদ, ভয়, অনিশ্চয়তার উদ্ভব হতে পারে। এছাড়া এটি আচরণগতভাবে সহিংস করে তুলতে পারে। র্যাবের মহাপরিচালক মোখলেসুর রহমান বলেন, ইয়াবার বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযান চলছেই।

তথ্য পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই র্যাব অভিযান পরিচালনা করছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, ইয়াবার নেটওয়ার্ক পরিচালিত হয় কঙ্বাজারের টেকনাফ থেকে। আর তা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী কয়েক ব্যক্তি। রাজধানীর বনানী, গুলশান ও বারিধারায় রয়েছে তাদেরই মাফিয়া চক্র। এ চক্রের সদস্য রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে বিত্তশালী কয়েকজন ব্যবসায়ী।

ইয়াবা ব্যবসায় তারা বানিয়ে ফেলেছেন রাতারাতি কোটি কোটি টাকা। একসময় মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ইয়াবা প্রবেশ করলেও এখন দেশেই তা তৈরি হচ্ছে। থাইল্যান্ড থেকে কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও কারিগর এনে গোপনে তৈরি করা হচ্ছে এগুলো। র্যাবের অভিযানে এ রকম বেশ কয়েকটি কারাখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। সূত্রগুলো বলছে, তবে দেশে তৈরি হলেও থেমে নেই ইয়াবার প্রবেশ।

থাইল্যান্ড থেকে বিস্তার শুরু হলেও মিয়ানমার থেকে নাফ নদী পার হয়ে কঙ্বাজারের টেকনাফ দিয়ে চলে আসছে ইয়াবার চালান। এর বাইরে কঙ্বাজারের উখিয়ার গুন্দুম সীমান্ত দিয়েও ঢুকছে ইয়াবা। কঙ্বাজার থেকে রাজধানীতে ইয়াবা ছড়াচ্ছে এখানকার ৯টি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এদের রয়েছে সাব-গ্রুপ। কঙ্বাজারের বিভিন্ন এলাকার এক শ্রেণীর মধ্য ও নিম্নবিত্ত বেকার যুবকদের ৮ বা ১০ জনের দল বাসে বা ট্রেনে ঢাকায় আসে।

তারাই মূলত এর বাহক। ছোট আকারের এই ট্যাবলেট বহনের কায়দাও অভিনব। শার্টের কলারে, মুঠোফোনের ভেতর, প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে পায়ুপথে ঢুকিয়ে আনার রেকর্ডও রয়েছে। ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পথে টঙ্গী স্টেশনে নেমে যায় তারা। ওখান থেকে মুঠোফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে জোনভিত্তিক নেতার কাছে ইয়াবা পেঁৗছে দেওয়া হয়।

আর এগুলো বিক্রি করা হয় শুধু পরিচিত সেবীদের কাছেই। ইয়াবার বিত্তভিত্তিক নেটওয়ার্ক শুরু হয় নগরীর গুলশান-বারিধারা থেকে। পরে বনানী, নিকেতন ও উত্তরায় তা ছড়িয়ে পড়ে। এসব নেটওয়ার্কে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা জড়িয়ে পড়ে। অভিজাত এলাকাগুলোর ক্লাব, রেস্তোরাঁ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল-কলেজ টার্গেট করে বিস্তারকারীরা।

ওই সময় র্যাব নেটওয়ার্কের অনেককেই গ্রেফতার করে। বনানী থানা পুলিশ জুনায়েদ নামে এক তরুণকে গ্রেফতার করে গত রবিবার। এই জুনায়েদ নিয়ন্ত্রণ করছে অভিজাত এলাকার মাদক সাম্রাজ্য। জুনায়েদ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছেলে-মেয়েদের টার্গেট করে ইয়াবায় আসক্ত করছে বলে পুলিশ জানায়। প্রথম দিকে জুনায়েদ সবাইকে ফ্রি সরবরাহ করত।

পরবর্তীতে তারা সবাই ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ে। গত দুই বছরে স্কুল-কলেজের শত শত ছাত্র- ছাত্রীকে ইয়াবায় আসক্তিতে নিয়ে এসেছে।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.