আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রূপালী পর্দার এক প্রতিবাদ : ঋত্বিক তার নাম

গল্পের রাজত্বে বসবাস করছি আপাতত
ঋত্বিকের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি ‘‘ছবি লোকে দেখে। ছবি দেখানোর সুযোগ যতদিন খোলা থাকবে, ততদিন মানুষকে দেখাতে আর নিজের পেটের ভাতের জন্য ছবি করে যাবো। কালকে বা দশ বছর পরে যদি সিনেমার চেয়ে ভালো কোনও মিডিয়াম বেরোয় আর দশবছর পর যদি আমি বেঁচে থাকি, তাহলে সিনেমাকে লাথি মেরে আমি সেখানে চলে যাবো। সিনেমার প্রেমে নেশায় আমি পড়িনি। আই ডু নট লাভ ফিল্ম ।

’’ এখনও যারা বাংলা চলচ্চিত্রের নেশায় বুদ হয়ে আছেন তারা এই বাক্যগুলো পড়লেই বলতে পারবেন, শুধু এ দেশেই নয়, বিশ্বের কোথাও আর একজনও চলচ্চিত্র পরিচালক নেই যিনি এই ভাষায়, এই ভঙ্গিতে কথা বলতে পারেন, অনিবার্য এবং নিশ্চিতভাবেই তিনি ঋত্বিক ঘটক। শিল্পের জন্য শিল্প এই বুর্জোয়া নেশায় যারা তাল-জ্ঞান হারিয়েছেন তাদের জন্য ঋত্বিকের ছবি, ঋত্বিকের কথা এবং স্বয়ং ঋত্বিক এক জ্বলন্ত প্রতিবাদ। তাকে হজম করা মধ্যবিত্ত কিংবা তথাকথিত ‘ভদ্দরনোকের’ রুচিতে বড়ই কঠিন। তিনি সহজ পাচ্য নয়। কেননা, সিনেমা তিনি খ্যাতির জন্য, অর্থ-বিত্তের জন্য করেননি।

দুইটা-তিনটা গান, নায়ক-নায়িকার রোমান্স, একটা দূর্ধষ ভিলেন অথবা বাংলার প্রকৃতি, রাবীন্দ্রিক গল্পবুনন এইসব তার ধাতে নেই। থাকার কথাও নয়। নিজে যদিও বলেছেন ভাতের জন্য সিনেমা বানান তিনি, আসলে ব্যাপারটা তারচেয়ে বেশি। সোজা করে বললে খেটে খাওয়া মানুষের জন্য, শ্রম ও ঘামের জন্য ছবি বানিয়েছেন তিনি। নিজেকে কোন শিল্পী ভাবার মতো বিলাশিতায় ভূগতেন না তিনি, তাই শ্রমিকের মতো ছবির কাজ করতেন।

ছবিটাকে তিনি জনমানুষের হাতিয়াড় বানিয়ে ফেলেছিলেন ঋত্বিক। গণনাট্য আন্দোলন করা ঋত্বিক ঠিকই জানতেন বছরে শতাধিক মঞ্চ নাটক করে যতো মানুষের কাছে পৌঁছানো যায় তার চেয়ে বেশি পৌঁছানো যায় রূপালী ফিতার মাধ্যমে। তাই চলচ্চিত্রের পর্দাটাকে তিনি ক্যানভাস করে নিয়েছিলেন। বলা দরকার, ¯্রফে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন না তিনি। বিশ্বের আর দশজন চলচ্চিত্র নির্মাতা যখন ভাল, শিল্প কিংবা বাণিজ্য সফল ছবি বানাতে পারলেই বর্তে যেতেন ঋত্বিক তখন চলচ্চিত্রকে প্রতিবাদ বানাতে চাইতেন।

তিনি স্পষ্টতই বলতেন ''আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাব যে, ইট ইজ নট এন ইমেজিনারি স্টোরি বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে হাতুড়ি মেরে বোঝাব যে যা দেখছেন তা একটা কল্পিত ঘটনা, কিন্তু এর মধ্যে যেটা বোঝাতে চাইছি আমার সেই থিসিসটা বুঝুন, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি, সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই আমি আপনাকে এলিয়েন্ট করব প্রতি মুহূর্তে। যদি আপনি সচেতন হয়ে উঠেন, ছবি দেখে বাইরের সেই সামাজিক বাধা দুর্নীতি বদলের কাজে লিপ্ত হয়ে উঠেন, আমার প্রোটেস্টাকে যদি আপনার মধ্যে চাপিয়ে দিতে পারি তবেই শিল্পী হিসেবে আমার সার্থকতা। '' পুরান ঢাকার জিন্দাবাহর লেনে অভিজাত ঘটক পরিবারে তার জন্ম। বাবা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।

বাবা মা’র নবম সন্তান ঋত্বিক স্কুলে পড়াকাল থেকেই শ্রেণী সংগ্রাম বিষয়ে বুঝতে থাকেন। তার বেড়ে ওঠা ও বড় হওয়ার সাথে সাথে দুই বাংলার বিভাজন, শরনার্থী হিসাবে এই বাংলা ছেড়ে পশ্চিমবাংলায় গমণ, দূর্ভিক্ষ ইত্যাদি তাকে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। গণ নাট্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে তিনি মঞ্চে কাজ শুরু করেন। গণ মানুষের জন্য নাটক লেখা, পরিচালনা করা, অভিনয় করা শুরু করেন। পাশাপাশি গল্প লেখাও শুরু করেন।

বড় ভাই কবি লেখক মনীশ ঘটকও গণণাট্য কেন্দ্র ও তেভাগা আন্দোলনের সাথে জড়িতে ছিলেন। তার মেয়ে মহাশ্বেতা দেবী পরবর্তীতে বিখ্যাত লেখিকা হন। যাহোক কালো সায়র নাটক রচনা দিয়ে মঞ্চে কাজ শুরু করেন। এইরপরই ১৯৫১ সালে গণনাট্যে কিংবদন্তী তুল্য প্রযোজনা নবান্নতে তিনি অভিনয় করেন। ব্রেখট ও গোগলের একাধিক মঞ্চ নাটক তিনি অনুবাদ করেন।

১৯৫০ সালে মিাই ঘোষের ছিন্নমূল চলচ্চিত্রে তিনি অভিনেতা ও সহপারিচাল হিসাবে কাজ করেন। এর আগেই তিনি বিশ্ব চলচ্চিত্রের একাধিক কাজ গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করেন এবং নতুন এই মাধ্যমের গণমানুষের কাছে পৌঁছানোর শক্তিটা অনুধাবন করেন। ১৯৫২ তে নাগরিক নির্মাণ করলেও তা মুক্তি পায়নি, তার প্রথম মুক্তি প্রাপ্ত চলচ্চিত্র অযান্ত্রিক ১৯৫৮ সালে মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথেই বোঝা যায় তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে একটা নতুন ভঙ্গি এনেছেন। এরপর একে একে আটটি পূর্ণদৈর্ঘ চলচ্চিত্র দিয়ে ঋত¦িক রীতিমতো কাল্ট হয়ে ওঠেন। চলচ্চিত্রের মতো তারকা খচিত বিশাল মাধ্যমে শ্রমিকের মতো কাজ করতে ঋত্বিক।

বাংলা মদ আর বিড়ির টানে বুদ হয়ে থাকা ঋতিক্ব জীবনের শেষ কয়েকটা দিন মানসিক সমস্যায় ভূগেছেন। পাগলাগারদেই কেটেছে তার দিনগুলি। এটাই স্বাভাবিক, কেননা, যে সমাজ ঋত্বিক চেয়েছিলেন আর যে সমাজে তিনি বসবাস করেছেন তার যোজন যোজন ফারাকটা একদিন যে কোন সংবেদনশীল শিল্পীকে এ পথে ঠেলে দেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঋত্বিকের জন্মদিনে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, তার দুটি চলচ্চিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে। তিতাস একটি নদীর নাম ছবি সম্পর্কে তিনি নিজে বলেছেন, ‘ তিতাস পূর্ব বাংলার একটা খ-জীবন, এটি একটি সৎ লেখা।

ইদানীং সচরাচর বাংলাদেশে (দুই বাংলাতেই) এ রকম লেখার দেখা পাওয়া যায় না। এর মধ্যে আছে প্রচুর নাটকীয় উপাদান, আছে দর্শনধারী ঘটনাবলী, আছে শ্রোতব্য বহু প্রাচীন সঙ্গীতের টুকরো - সব মিলিয়ে একটা অনাবিল আনন্দ ও অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করা যায়। ব্যাপারটা ছবিতে ধরা পড়াার জন্য জন্ম থেকেই কাঁদছিল। ... অদ্বৈতবাবু অনেক অতিকথন করেন। কিন্তু লেখাটা একেবারে প্রাণ থেকে, ভেতর থেকে লেখা।

আমি নিজেও বাবুর চোখ দিয়ে না দেখে ওইভাবে ভেতর থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। অদ্বৈতবাবু যে সময়ে তিতাস নদী দেখেছেন, তখন তিতাস ও তার তীরবর্তী গ্রামীণ সভ্যতা মরতে বসেছে। বইয়ে তিতাস একটি নদীর নাম। তিনি এর পরের পুণর্জীবনটা দেখতে যাননি। আমি দেখাতে চাই যে, মৃত্যুর পরেও এই পুণর্জীবন হচ্ছে।

তিতাস এখন আবার যৌবনবতী। আমার ছবিতে গ্রাম নায়ক, তিতাস নায়িকা। ’’ অযান্ত্রিকে যেমন প্রথম বাংলা চলচ্চিত্রে একটা যন্ত্রের বেদনা দেখতে পাই তিতাস একটি নদীর নামে তেমনি একটি নদী ও তিরবর্তী গ্রামের যন্ত্রণা দেখতে পাই। অন্যদিকে তার শেষ ছবি যুক্তি তক্ক আর গপ্পোকে তার আত্মজীবনিমূলক চলচ্চিত্র বলা হয়। এ ধরণের চলচ্চিত্রও ঋত্বিকের হাত ধরেই আমরা বাংলায় প্রথম দেখতে পাই।

আসুন বিস্তৃত জানা যাক এই দুটি ছবি নিয়ে। এইখানে দেখুনযুক্তি তক্কো আর গপ্পো এইখানে দেখুন মেঘে ঢাকা তারা সম্মাননা ভারত সরকারের পদ্মশ্রী পুরস্কার : ১৯৭০ মুসাফির : ৫ম জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে তৃতীয় সেরা চলচ্চিত্র হিসাবে সম্মাননা পদক, ১৯৫৭ সাল মধূমতি : ফিল্মফেয়ারে সেরা কাহিনীর মনোনয়ন, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার : রজত কমল পদক, যুক্তি তক্কো আর গপ্পো, ১৯৭৪ সেরা চলচ্চিত্র পরিচালক পুরস্কার, বাংলাদেশ সিনে জার্নালিস্ট এসোসিয়েন : তিতাস একটি নদীর নাম, অযান্ত্রিক : ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ প্রদর্শন ১৯৫৯ সুবর্ণরেখা : সিনেমায়া পত্রিকার জরিপে সমালোচকদের ভোটে এশিয়ার সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের মধ্যে ১১তম স্থান লাভ, ১৯৯৮ সাইট এ- সাউন্ড ম্যাগাজিনের আয়োজনে চলচ্চিত্র প্ররিচালক ও সমালোচকদের ভোটে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র সমূহের মধ্যে মেঘে ঢাকা তারা ২৩১ তম এবং কোমল গান্ধার ৩৪৬ তম অবস্থানে ঠাই পায় : ২০০২ ব্রিটিশ ফিল্ম ই›ন্সটিট্যুটের সমালোচক ও দর্শক জরিপে তিতাস একটি নদীর নাম সেরা দশ বাংলা চলচ্চিত্রের তালিকায় শীর্ষে ঠাঁই পায় : ২০০৭ হীরের প্রজাপতি : শ্রেষ্ঠ শিশুতোষ চলচ্চিত্র পুরস্কার (প্রধাণ মন্ত্রীর স্বর্ণ পদক), ৬ তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ১৯৭০ পূর্ণদৈর্ঘ চলচ্চিত্র নাগরিক (১৯৫২) (প্রথম চলচ্চিত্র হলেও এটি মুক্তি পেয়েছে তার মৃত্যুর পর, ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ সাল) অযান্ত্রিক (১৯৫৭) বাড়ি থেকে পালিয়ে (১৯৫৮) মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০) কোমল গান্ধার (১৯৬১) সুবর্ণরেখা (১৯৬১) তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩) যুক্তি তক্কো গপ্পো (১৯৭৪) স্বল্পদৈর্ঘ চলচ্চিত্র ফিয়ার (১৯৬৫) (হিন্দি) রঁদেভূ (১৯৬৫) (হিন্দি) সিভিল ডিফেন্স (১৯৬৫) দুর্বার গতি পদ্মা (১৯৭১) তথ্যচিত্র আদিবাসীও কা জীবন স্রোত (১৯৫৫) (হিন্দি) বিহার কা দর্শনীয়া স্থান (১৯৫৫) (হিন্দি) সায়েন্টিস অফ টুমরো (১৯৬৭) ইয়ে কৌন (১৯৭০) (হিন্দি) আমার লেলিন (১৯৭০) পুরুলিয়ার ছৌ (১০৭০) চিত্রনাট্য মুসাফির (১৯৫৭) মধুমতী (১৯৫৮) স্বরলিপি (১৯৬০) কুমারী মন (১৯৬২) দ্বিপের নাম টিয়া রঙ (১৯৬৩) রাজকন্যা (১৯৬৫) অভিনেতা ঋত্বিক তথাপি (১৯৫০) ছিন্নমূল (১৯৫১) কুমারী মন (১৯৬২) সুবর্ন-রেখা (১৯৬২) তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩) যুক্তি,তক্কো,আর গপ্পো (১৯৭৪) মঞ্চে ঋত্বিক চন্দ্রগুপ্ত (অভিনেতা) অচলায়তন (নির্দেশক ও অভিনেতা) কালো সায়র (নির্দেশক ও অভিনেতা) কলঙ্ক (অভিনেতা) দলিল (নির্দেশক ও অভিনেতা) কত ধানে কত চাল (নির্দেশক ও অভিনেতা) অফিসার (অভিনেতা) গ্যালিলিও চরিত জাগরণ (অভিনেতা) জলন্ত (রচনা) জ্বালা (রচনা) ডাকঘর (নির্দেশনা) ঢেউ (নির্দেশনা) ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান বানে (রচনা) নবান্ন (নির্দেশনা) নীলদর্পন (অভিনেতা) পরিত্রাণ (অভিনয়) ফাল্গুনি (অভিনয়) বিদ্যাসাগর (নির্দেশনা) বিসর্জন (নির্দেশনা) ম্যাকবেথ (অভিনেতা) রাজা (নির্দেশনা) সাঁকো (অভিনেতা) সেই মেয়ে (নির্দেশনা) হযবরল (নির্দেশনা) অসমাপ্ত কাজ পূর্ণদৈর্ঘ চলচ্চিত্র অরূপকথা/বেদেনী (১৯৫০-৫৩) কত অজানারে (১৯৫৯) বগলার বাংলাদর্শন (১৯৬৪) রঙের গোলাম (১৯৬৮) তথ্যচিত্র উস্তাদ আলাউদ্দিন খান (১৯৬৩) ইন্দিরা গান্ধী (১৯৭২) রামকিঙ্কর : এ পারসোনালিটি স্টাডি (১৯৭৫), পরবর্তীতে ছেলে এটি সমাপ্ত করেন জন্ম : নভেম্বর ১৯২৫, ঢাকা দেহান্তর : ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬, কলকাতা
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।