আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বাধীনতা হারাল দুদক

সরকারি কর্মকর্তাদের খুশি করতে মেয়াদের শেষ সময়ে এসে নির্বাচনী অঙ্গীকার ভঙ্গ করল আওয়ামী লীগ সরকার। আওয়ামী লীগের ইশতেহারের দ্বিতীয় অগ্রাধিকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা বিষয়ে বলা ছিল, দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে। অথচ আইন সংশোধন করে দুদকের ক্ষমতা খর্ব করল সরকার।

গত রোববার জাতীয় সংসদে দুদক আইনের সংশোধন করা হয়েছে। এ আইনে নতুন একটি ধারা (৩২ক) যুক্ত করে বলা হয়েছে, সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে সরকারের অনুমোদন লাগবে।

দুদকের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সদ্য সংশোধিত আইনে ৩২ক ধারা যোগ করে ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে। পুরো বিষয়টি সংবিধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। আর দুদককে স্বাধীন ঘোষণা করে একই সঙ্গে নতুন এ ধারা চাপিয়ে দিলে দুদক স্বাধীন হবে কীভাবে?

সরকারি কর্মকর্তাদের ছাড় দিয়ে দুদক আইন সংশোধনের উদ্যোগ ২০১০ সালেই নিয়েছিল সরকার। ২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত উন্নয়ন ফোরামের বৈঠকে (বিডিএফ) এ নিয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন দাতা দেশ সংস্থার প্রতিনিধিরা। সে সময় অর্থমন্ত্রীকে এর জবাব দিতে হয়।

তিনি জানিয়েছিলেন, বিষয়টি প্রস্তাব পর্যায়ে। আর সরকার এমন কিছু করবে না, যাতে দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। এরপর এ-সংক্রান্ত বিলটি স্থায়ী কমিটিতে থাকার সময় অর্থমন্ত্রী এ ধরনের কোনো বিধান না রাখার জন্য কমিটিকে চিঠিও দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। দাতারাও এখন আবার দুদকের আইন সংশোধনের জন্য আপত্তি জানাচ্ছে।

দুদক আইন সংশোধন করতে গিয়ে আরও একটি নজির ভাঙা হয়েছে। জাতীয় সংসদে বিল আকারে উত্থাপনের সময় ৩২ক ধারাটি ছিল না। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি এ ধারাটি অন্তর্ভুক্ত করার কোনো সুপারিশও করেনি। তার পরও আলাদা করে সংশোধনী এনে দ্রুততার সঙ্গে পাস করা হয় বিলটি। এভাবে বিল পাসের আর কোনো উদাহরণ জাতীয় সংসদের সূত্রগুলো জানাতে পারেনি।

জাতীয় সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকা এ বিলটি তাড়াহুড়া করেই পাস করা হয়েছে। ২০১১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) ২০১১ নামের বিলটি জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়েছিল। এরপর সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য নিয়মানুযায়ী স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। কমিটি ১২টি সভা করে সুপারিশ চূড়ান্ত করে। সেখানে ৩২ক নামে কোনো ধারাই ছিল না।

এ-সংক্রান্ত রিপোর্টটি ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে চূড়ান্ত হয়ে ছাপানোর কাজও সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই বিলটি পাস করা হয় ১০ নভেম্বর।

২০০৪ সালে পাস হওয়া দুদকের মূল আইনের ২৪ ধারায় বলা আছে, দায়িত্ব পালনে দুদকের স্বাধীনতা থাকবে। নতুন একটি ধারা যুক্ত হওয়ায় দুদকের সেই স্বাধীনতা আর থাকল না। এ নিয়ে ইতিমধ্যে নানা মহল থেকেই সমালোচনা করা হচ্ছে।

দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি) এক বিবৃতিতে বলেছে, মেয়াদের শেষ পর্যায়ে সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক এ সংশোধনী পাস শুধু হতাশাজনকই নয়, সরকারের জন্য আত্মঘাতমূলক।

তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, আইনে দুদকের স্বাধীনতা থাকলেও সংস্থাটি কখনোই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্যদের ছাড় দেওয়ার একাধিক উদাহরণ আছে দুদকের বিরুদ্ধে। যেমন, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির মামলায় রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিনজনকেই মামলায় আসামি করা হয়নি। এ তিনজন হলেন সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী এবং সরকারদলীয় হুইপ নুর-এ-আলম চৌধুরীর ভাই নিক্সন চৌধুরী।

এ ছাড়া রেলপথমন্ত্রীর এপিএসের কাছ থেকে ৭০ লাখ টাকা উদ্ধারের ঘটনায় মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাম এলেও তাঁকে মামলা থেকে বাদ দেয় দুদক। একইভাবে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা মোদাচ্ছের আলী এবং বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারির ঘটনায় গাজীপুরের সাংসদ রহমত আলীর ছেলে জামিল হাসান ও কুমিল্লার সাংসদ সুবিদ আলী ভুঁইয়ার ছেলে মোহাম্মদ আলীর নাম থাকলেও এজাহারে তা অন্তর্ভুক্ত করেনি দুদক।

পদ্মা সেতুর মামলার ঘটনায় সাবেক সেতু বিভাগের সচিব মোশারফ হোসেন ভূঁইয়াকে আসামি করে গ্রেপ্তারের ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সরকারি কর্মকর্তারা। একই ঘটনায় রাজনীতিবিদদের বাদ দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করায় চাপ বাড়ে সরকারের ওপর। সে সময় সরকারি কর্মকর্তারা এ ঘটনার প্রতিবাদও জানান।

এর পরে অবশেষে মামলার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হলো সরকারি কর্মকর্তাদের।

এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে দুদকের চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান এ অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। তবে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে নতুন একটি তথ্যও দিয়েছেন তিনি। দুদকের চেয়ারম্যান বলেন, পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে সচিব জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তিনি মন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশে কাজ করেছেন। কিন্তু মন্ত্রী কোথাও লিখিত অনুমোদন দিয়েছেন, এমন প্রমাণ মেলেনি।

বরং সচিবের বিরুদ্ধে দালিলিক প্রমাণ রয়েছে বলেই তাঁর বিরুদ্ধে আমরা মামলা করেছি।

এত দিন ধরে দুদক বলে আসছে, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই। আর গতকাল দুদকের চেয়ারম্যান বললেন, মন্ত্রী মৌখিক নির্দেশ দিয়েছিলেন। এর পরেও ছাড় দেওয়া হয়েছিল সৈয়দ আবুল হোসেনকে। মূলত দুদকের ক্ষমতা আগেও কম ছিল, এখন পুরোটাই গেল।

সরকারি সূত্রগুলো বলছে, মূলত নির্বাচন সামনে রেখে নানাভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের খুশি করছে সরকার। বেতন-ভাতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেওয়া হচ্ছে পদোন্নতি। আর এখন করা হলো দুদক আইনের সংশোধন। ফলে দুর্নীতি করলেও সরকারি দলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে ছাড় পাবেন সরকারি কর্মকর্তারাও।

টিআইবি মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এ প্রসঙ্গে বলেছে, দুদকের আইন সংশোধন রাজনীতিবিদ ও কর্মকর্তাদের আঁতাতের ফল।

সরকারের হস্তক্ষেপ এখন বাড়বে

 

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.