আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাষ্ট্রের কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে জননিরাপত্তা

হরতাল ও সহিংস রাজনীতির শিকার হয়ে মানুষের প্রাণ যেভাবে ঝরে পড়ছে তাতে জননিরাপত্তা এখন ভয়াবহ হুমকির মুখে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে হরতালকারীরা ধরেই নিয়েছে মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব যেহেতু সরকারের, তাই যত মানুষ নিহত হবে, পঙ্গু হবে, ততই সরকার দুর্বল হবে এবং তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ প্রশস্ত হবে। তাই হয়তো অসহায় মানুষের নির্মম যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দেখার পরও দিনের পর দিন হরতাল দেওয়া হচ্ছে। অবশ্য হরতাল আহ্বানকারী প্রধান দল বিএনপি সকাল-বিকাল সাংবাদিকদের ডেকে বলছেন যে, এ সব কাজ হরতালকারীরা কেউ করছে না। সব কিছুই করছে সরকারি দলের গুণ্ডারা।

বাংলাদেশ বোধহয় বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে শুধু অসত্য কাহিনীর ওপর দাঁড়িয়ে রাজনীতি করা যায় এবং ক্ষমতায়ও যাওয়া যায়। ২০ বছর আগে হয়তো এমন অসত্য বলে পার পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন দুই ডজনেরও বেশি টেলিভিশনের কয়েক ডজন ক্যামেরায় সবকিছু ধরা পড়ছে নিখুঁতভাবে। মানুষ দেখছে কীভাবে হরতালে মিছিল এবং পিকেটারদের অবস্থান থেকে বাস, গাড়ি, সিএনজির ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে। পেট্রল ঢেলে মানুষ গাড়ি নির্বিশেষে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

আতঙ্কিত মানুষ প্রাণভিক্ষা চেয়েও রক্ষা পায় না। নিজেরা সহিংস কাজ করে হরতালকারীরা সব সময়ই তা অস্বীকার করে। তবে মাস দুই আগে বিএনপির অপর ভ্রাতা জামায়াত হরতাল করার সময় ভুল করে আমেরিকান দূতাবাসের গাড়ি ভাঙচুর করে। কথায় আছে পড়বি তো পড় একেবারে মালির ঘাড়ে। তাই জামায়াত ওই হরতালের পর আমেরিকান দূতাবাসের কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে।

হাতেনাতে ধরা না পড়লে জামায়াত এটি কখনো স্বীকার করত না। এর আগে অন্য মেয়াদে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি যখন পর্যায়ক্রমে বিরোধী দলে ছিল তখনো হরতালে দু-চারটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে এবং ভাঙচুর হয়েছে। ওই সময়ে মানুষের ওপর সরাসরি কোনো আক্রমণ হয়নি, দু-চারজন যা হতাহত হয়েছে তা ছিল গণআন্দোলনের পাশর্্বপ্রতিক্রিয়ার নিছক দুর্ঘটনা মাত্র। তবে এবার হরতালে মানুষ পুড়িয়ে মারার অপসংস্কৃতি এনেছে জামায়াত-শিবির।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের মাথার ওপর এখন ফাঁসির দড়ি ঝুলছে।

তাই একাত্তরের মতো প্রতিশোধপরায়ণ অপকর্মে তারা লিপ্ত হয়েছে বিএনপির কাঁধে বন্দুক রেখে। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি ২৩ বছর পাকিস্তানিদের অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করে এবং একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে। সেই দেশে আবার রাজনীতির নামে রক্ত ঝরবে কেন? যদি এমনটি বলা হয় যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনাটি যদি না ঘটত এবং তার ধারাবাহিকতায় দুজন সামরিক শাসক শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যে দূষিত রাজনীতির প্রচলন করেছেন তা যদি বাংলাদেশে প্রবর্তিত না হতো তাহলে আজকের এই রাজনৈতিক সংঘর্ষের সৃষ্টি হতো না, তবে কি সেটা খুব ভুল হবে? এখন যে সাংঘর্ষিক রাজনীতি আমরা দেখছি তার মূল বা শেকড় এখানেই নিহিত। সমস্যার মূলে না গিয়ে এখন তার ডালপালা নিয়ে আমরা টানাটানি করছি। এতে সমস্যার কোনো সমাধান হবে না।

যাক ফিরে আসি আজকের প্রসঙ্গ জননিরাপত্তার আলোচনায়। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে যুদ্ধাপরাধীদের মামলার রায় যখন বের হতে শুরু করল তখন থেকে আজ পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াত এবং হেফাজত স্বতন্ত্রভাবে এবং সম্মিলিতভাবে যা করেছে তার কোনো কিছুই আন্দোলনের সংজ্ঞায় পড়ে না, সব ছিল পরিকল্পিত সন্ত্রাস এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবমাননা। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায় হওয়ার পর জামায়াত-শিবির যেভাবে জাতীয় পতাকায় আগুন দিয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর শহীদ মিনার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, এমন উদাহরণ কি পৃথিবীর কোনো আন্দোলনের ইতিহাসে আছে? তারপর ১ মার্চ বেগম খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত এসে জামায়াত-শিবিরের ওই আন্দোলনের পক্ষে বিএনপি এবং ছাত্রদলকে নামার হুকুম দেওয়ার পর কানসাটের বিদ্যুৎ কেন্দ্র যেভাবে হরতালকারীরা পুড়িয়ে দিল এবং বিশ্রামরত পুলিশকে আক্রমণ করে যেভাবে হত্যা করা হলো তা কি এর আগে এ দেশে বা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে দেখা গেছে বা শোনা গেছে? সুতরাং ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আজ পর্যন্ত জামায়াত বিএনপির হরতালের গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে যে রকম সহিংস কার্যকলাপ চালিয়েছে, গত ৫ মে শাপলা চত্বর থেকে হেফাজত কর্তৃক সরকার উৎখাত ও গৃহযুদ্ধের হুমকি এবং সহিংস পন্থায় হেফাজতের ১৩ দফা দাবি আদায়ের লম্ফঝম্ফ এবং তার প্রতি বিএনপির সমর্থন, সম্প্রতি বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা কর্তৃক দা-কুড়াল নিয়ে মাঠে নামার আহ্বান এবং তারপর বিএনপির ৬০+৬০+৮৪ ঘণ্টার হরতালের বর্বরতা ও বিপন্ন মানবতার দৃশ্য স্পষ্টই বলে দিচ্ছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জননিরাপত্তা এখন ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। গত তিনটি হরতালের সময় টেলিভিশন এবং খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় অসহায় মানুষের পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ছবিগুলো বলে দেয় হরতাল কত বর্বর ও অমানবিক হতে পারে। কত মানুষ মারা গেল, কতজন পঙ্গু হলো, সেটাই কি হরতালের সাফল্যের মাপকাঠি? আহূত হরতালের প্রতি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন যদি থাকবে তাহলে সেখানে সহিংস ঘটনা ঘটিয়ে উত্তাপ ছড়ানোর তো কোনো প্রয়োজন পড়ে না।

হরতালের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন বা প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে দৃশ্যমান হয় হরতালকারীদের দাবির প্রতি কতভাগ মানুষের সমর্থন আছে অথবা নেই। সেখানে গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলে যারা প্রত্যাখ্যান করবে তাদের প্রতি যদি সশস্ত্র ও সহিংস আক্রমণ করা হয় তাহলে তো হরতালের মর্মার্থ এবং উপযোগিতা সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়ে যায়।

গণদাবি আদায়ের জন্য হরতালের স্বরূপ এ দেশের মানুষ দেখেছে ষাটের দশকের শেষের দিকে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময়। ওই সময়ে বরং কখনো কখনো পুলিশ অসহিষ্ণু আচরণ করেছে, হরতালকারীদের পক্ষ থেকে পুলিশের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ কখনো হয়নি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসে কেউ সহিংস হয়নি। দু-একটি খালি গাড়িতে আগুন দেওয়া হলেও আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল শান্তিপূর্ণ লাখো জনতার গগনবিদারী স্লোগান।

তাতে আইয়ুব খানের পতন হয়েছিল। আশির দশকে এরশাদের বিরুদ্ধেও হরতালে এমন নিষ্ঠুরতা দেখা যায়নি, কিন্তু এরশাদের পতন হয়েছে। ১৯৯৬ সালের প্রথমদিকে এবং ২০০৬ সালের আন্দোলনে সহিংস ঘটনা ঘটেছে দুই প্রতিপক্ষের সংঘর্ষে। এখনকার মতো হঠাৎ করে মানুষভর্তি বাস ও রপ্তানি পণ্যে বোঝাই ট্রাকে আগুন ধরিয়ে ব্যাপক হারে মানুষ হত্যার ঘটনা দেখা যায়নি। বিএনপি অনেক সময় বলে তাদের সরকার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে দিচ্ছে না।

এ কথা সত্য বলে ধরে নিলেও বলতে হবে তা কখনো নিরীহ শ্রমজীবী মানুষ হত্যার অজুহাত হতে পারে না, জ্বালাও-পোড়াও এবং রাষ্ট্রের সম্পদ ধ্বংসের লাইসেন্স হতে পারে না। বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে এখন যা চলছে তার পরিণতিতে যেভাবে এবং যে পন্থায় জননিরাপত্তা আজ ভয়ঙ্কর হুমকির মুখে পড়েছে তা এখন সবাই জানেন। কয়েকটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরছি। এক. ২০১২ সালের শেষের দিকে ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সমাবেশ বা সংবর্ধনায় ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেওয়ার কথাতে সবারই অাঁতকে ওঠার কথা।

মুক্তিযোদ্ধা নামের আড়ালে হয়তো তাদের অন্য কোনো পরিকল্পনা ছিল। দেখা গেল আকস্মিকভাবে ছাত্রদল ও যুবদলের ক্যাডাররা সংবর্ধনার দিন ভোরবেলায় ঢাকার রাস্তায় নেমে ব্যাপকভাবে গাড়ি ভাঙচুর এবং কর্তব্যরত নিরস্ত্র পুলিশের ওপর আক্রমণ চালাল। দুই. এ বছরের ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার দুই দিন আগে সকালবেলায় ১০টা-সাড়ে ১০টার দিকে মতিঝিলে ব্যাপক ভাঙচুর এবং গান-পাউডার দিয়ে প্রায় দুই ডজন গাড়িতে আগুন দিল জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা। তিন. ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হওয়ার পর জামায়াত-শিবির দেশব্যাপী ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ চালাল। ধ্বংসযজ্ঞের অংশ হিসেবে পরিকল্পিত আক্রমণ চালানো হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর এবং উপাসনালয়ের ওপর।

নিজেদের ও সাধারণ মানুষের জীবন এবং সম্পদ রক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয় এবং তাতে কয়েকজন শিবির ক্যাডার নিহত হয়। ১ মার্চ বেগম খালেদা জিয়া সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত এসে শিবির ক্যাডারের নিহত হওয়াকে পুলিশের গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করে জামায়াত-শিবিরের ওই আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের যোগদানের নির্দেশ দিলে ওই ধ্বংসযজ্ঞ আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। পুলিশ জীবন বাঁচাতে ও রাষ্ট্রের সম্পদ রক্ষার্থে আত্দরক্ষামূলক ব্যবস্থাকে যদি গণহত্যা বলা হয় তাহলে জননিরাপত্তা কীভাবে সুরক্ষিত হবে। চার. ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ থেকে সরকার উৎখাতের হুমকি দিয়ে ভয়ানক তাণ্ডব চালায়। সমাবেশ থেকে হেফাজতের নেতারা গৃহযুদ্ধের হুমকি দেয়।

ওই দিন রাতে বিএনপি চেয়ারপারসন নির্দেশ দেন হেফাজতের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মাঠে নামার জন্য। ফলে সাধারণ মানুষ এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ভয়ঙ্কর হুমকির মুখে পড়ে। পাঁচ. কিছুদিন আগে হেফাজত নেতা মুফতি ইজহারুল ইসলামের চট্টগ্রামের মাদ্রাসায় বিপুল পরিমাণ বোমা ও গ্রেনেড পাওয়া যায়। গত সপ্তাহে রাজধানীতে শিবিরের কয়েকটি আস্তানা থেকে ককটেল, পেট্রল বোমা ও গান-পাউডারের বিশাল ভাণ্ডার পুলিশ উদ্ধার করেছে। এগুলো জামায়াত-হেফাজত মজুদ করছে কাদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য।

ছয়. জননিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাতে এখন নতুন উপাদান যোগ হয়েছে বাণিজ্যিকভাবে বোমা, ককটেল তৈরি হচ্ছে এবং হরতালের সময় টাকার বিনিময়ে রাস্তায় ভাঙচুর এবং জ্বালাও-পোড়াও করার ব্যবস্থা আছে। জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম (হুজি), হিযবুত তাহরীর এবং জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজিবি)_ এ সব ধর্মান্ধ জিহাদি সংগঠনগুলো বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। এরা এতদিন নিষ্ক্রিয় থাকলেও গোপন কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। এদের অনেক সদস্য আফগানফেরত যোদ্ধা এবং পাকিস্তান ও আফগানিস্তানভিত্তিক তালেবানদের সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। এদের সঙ্গে জামায়াত হেফাজতের আদর্শের তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

এদের সবার কমন শত্রু প্রগতিশীল উদারমনা গণতান্ত্রিক শক্তি এবং মানুষ। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সহিংস হরতালের আড়ালে বড় ধরনের নাশকতামূলক কাজ চালাতে পারে বলে গোয়েন্দা সূত্রে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এদের টার্গেট হতে পারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ওপর আক্রমণ এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা কেপিআই অর্থাৎ কী পয়েন্ট ইস্টলেশনের ওপর নাশকতা চালানো। বাংলাদেশ প্রতিদিনের ১৫ নভেম্বরের সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় একটি বড় খবর ছিল, 'শীর্ষ জঙ্গিরা দেশে ফিরছে, নিচ্ছে নাশকতার প্রস্তুতি, জেগে উঠছে হিযবুত তাহরীর'। জঙ্গি মৌলবাদী শক্তির কোনো জনসম্পৃক্ততা নেই।

তারা ভালো করে জানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তারা কোনো দিন যেতে পারবে না। চরম ডানপন্থি, ধর্মীয় লেবাসধারী এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে অবলম্বন করে যারা রাজনীতি করে সে সব রাজনৈতিক দল বা শক্তিকে তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় রাখতে চায়। উদ্দেশ্য, তারা যেন বাধাহীনভাবে উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার সুযোগ পায়। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের জোগাড় ও প্রশিক্ষণ নিতে পারে এবং সুযোগমতো অদূরভবিষ্যতে আফগানিস্তানের মতো তালেবান স্টাইলে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারে। তার জন্য দেখা যায় এযাবৎ ওই জঙ্গিদের যত আক্রমণ হয়েছে তার সবই ছিল আওয়ামী লীগ এবং উদার সংস্কৃতিমনা রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের ওপর।

বিএনপি ও জামায়াতের ওপর এ পর্যন্ত কোনো আক্রমণ হয়নি। বিএনপি হয়তো শত্রুর শত্রুকে মিত্র মনে করে আপাতত রাজনৈতিক সুবিধা হাসিল করতে চাইতে পারে। কিন্তু আখেরে বিএনপির জন্য তারা একদিন ফ্র্যাংকেনস্টাইন হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে ওই জঙ্গি সংগঠনগুলোর যত অবাধ বিস্তার ঘটেছে ২০০৯-২০১৩ মেয়াদে আওয়ামী লীগের শাসনামলে হয়েছে তার উল্টোটি, তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। জঙ্গিরা সবসময় ঘোলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগে নিজেদের বিস্তার ও প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।

সুতরাং বর্তমানে নির্বাচনকালীন সরকারের দ্বন্দ্বের কারণে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার সুযোগ ওই সন্ত্রাসী জঙ্গি সংগঠনগুলো নেবে সেটাই স্বাভাবিক। নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্বের সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান প্রয়োজন এ কথা যেমন সত্য, তেমনি এ কথাও সত্য যে, চলমান মানুষঘাতী সাংঘর্ষিক রাজনীতির মূল কারণ নির্বাচনকালীন সরকার নয়, এটি মূল সমস্যার ভাসমান লক্ষণ মাত্র। নির্দলীয় সরকার যদি সমাধান হতো তাহলে এতদিনে এই সাংঘর্ষিক রাজনীতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসার কথা ছিল। কারণ ইতোমধ্যে চারটি নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে। তারপরেও আমরা যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই আছি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার মূল কারণ নিহিত আছে ১৯৭৫ সালের পর রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির যে বিভাজন ঘটেছে তার মধ্যে, যার উল্লেখ এই লেখার শুরুতেই করেছি। এই সমস্যার সমাধানে বিএনপিকে সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াত হেফাজতকে ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শন ধর্মনিরপেক্ষ উদার সাংস্কৃতিক চেতনায় ফিরে আসতে হবে।

রাজনীতি যদি হয় মানুষের কল্যাণের জন্য, রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য তাহলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানুষ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এতদিন ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ছিল সবকিছুর ঊর্ধ্বে।

কিন্তু নাইন-ইলেভেনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা এজেন্সি সে দেশের সব মানুষের মোবাইল, ল্যান্ড ফোন, ইন্টারনেটসহ সব ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নজরদারি চালু করেছে। সম্প্রতি এই ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর তা নিয়ে শুরু হয় মহা হৈচৈ। শেষ পর্যন্ত তা গড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের আইন পরিষদ পর্যন্ত। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে কংগ্রেসে এবং সিনেটে ভোটোভুটির মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে গোয়েন্দা সংস্থার ওই নজরদারি ব্যবস্থা বহাল রাখা হয়েছে। তাই আজ দৃঢ়ভাবে বলার সময় এসেছে যে, মানুষের ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘি্নত হয় এমন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি চলতে পারে না।

সুতরাং হরতাল পরিহার করার সময় এসেছে। দেশের অনেক বিদগ্ধজন ইতোমধ্যে মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক এ বিষয়ের ওপর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। জননিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বাহিনীসমূহকে যা যা প্রয়োজন তার সব কিছুই করতে হবে। রাজনীতির নামে দুর্বৃত্তায়ন ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য রুলস্ অব ইনগেজমেন্ট অনুসারে যতটুকু ফোর্স প্রয়োগ করা দরকার তা নির্ধিদ্বায় করতে হবে। সংবিধানের ৩৬ ও ৩৭ অনুচ্ছেদবলে রাষ্ট্র সেই ক্ষমতা তাদের দিয়েছে।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

ই-মেইল : sikder52@gmail.com

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.