আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নষ্ট রাজনীতি, কষ্টে আছে মানুষ

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান রাজনীতিবিদদের প্রতি নষ্ট রাজনীতি ত্যাগ করে দেশপ্রেম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘যদি আপনারা দেশকে ভালোবাসেন, তাহলে নষ্ট রাজনীতি পরিহার করুন। যে রাজনীতি আইনের শাসন নষ্ট করে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করে, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ায়, ধর্মের নামে মানুষকে হত্যা করতে উসকানি দেয়, সেই রাজনীতি পরিহার করুন। ’
একই সঙ্গে তিনি হরতালের নামে মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারা, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করা, শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করা এবং শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের রুটি-রুজির পথ বন্ধ করারও কঠোর সমালোচনা করেন।
তাঁর এ বিবৃতির উদ্দিষ্ট যে বিরোধী দল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সম্প্রতি হরতালের নামে বিরোধী দল যেসব ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে, গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারছে, তা অবশ্যই নিন্দনীয়। গণতান্ত্রিক কর্মসূচির নামে এসব নষ্ট রাজনীতি চলতে পারে না। কিন্তু অধ্যাপক মিজানুর রহমান বর্ণিত নষ্ট রাজনীতি কি শুধু বিরোধী দল করছে? সরকারি দল, সরকার কি একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা? হরতালের নামে রাস্তায় গাড়ি ভাঙচুর করা যেমন নষ্ট রাজনীতি, তেমনি বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে হামলা চালানো কিংবা তাদের অফিস অবরুদ্ধ করাও সুশাসন নয়।
বর্তমানে দেশে যে নষ্ট রাজনীতি চলছে, তার দায় ক্ষমতাসীনেরাও এড়াতে পারে না। অতীতের কথা বাদ দিলেও গত পাঁচ বছর সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলেছে, সে দাবি নিশ্চয়ই মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান করবেন না।

এই যে নির্বাচন নিয়ে পাঁচ বছর পর পর দেশে মহাদুর্যোগ দেখা দেয়, সেটিও সুশাসনের অভাবের কারণে। যাঁরা মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন নেই, তাঁদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য ছিল সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, দেশকে দুর্নীতি ও দলীয়করণমুক্ত করা। কিন্তু সরকার যে বিপরীত পথেই হাঁটছে তার প্রমাণ দুদক আইনের সর্বশেষ সংশোধনী। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করলে শেখ হাসিনাকে এখন সাবেক স্বৈরাচারের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে হতো না।
মিজানুর রহমানের ভাষায়, দেশে নষ্ট রাজনীতি চলছে বলেই মানুষ কষ্টে আছে।

উদ্বেগে আছে। তারা জানে না আগামীকাল কী হবে। বিএনপির নেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের মুক্তির দাবিতে গত বৃহস্পতিবার সারা দেশে ধর্মঘট পালন করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন। এই সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক শিমুল বিশ্বাস, তিনি আবার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী। আর ধর্মঘট আহ্বানকারী সংগঠনটির কার্যকরী সভাপতি হলেন শাজাহান খান, শেখ হাসিনা সরকারের নৌপরিবহনমন্ত্রী।

সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এবং শাজাহান খানের অত্যন্ত বিশ্বস্ত ওসমান গনি বলেছেন, শিমুল বিশ্বাসকে না ছাড়লে আরও ধর্মঘট হবে। এখন কী বলবেন মন্ত্রী মহোদয়?
আগেভাগে নোটিশ না দিয়ে ২৪ ঘণ্টার জন্য দেশের লাখ লাখ মানুষকে কার্যত গৃহবন্দী করে রেখেছিল এই নষ্ট রাজনীতি এবং দুই দল মিলেই। অনেকে টার্মিনালে গিয়ে জানতে পেরেছেন, ‘দূরপাল্লার সব বাস চলাচল বন্ধ। ’ ওই দিনটিতে যে তরুণদের চাকরিতে যোগদান করার কিংবা চাকরির জন্য যাঁদের ইন্টারভিউ দেওয়ার কথা ছিল, তাঁরা কেউ যেতে পারেননি। গুরুতর রোগীকে নিয়ে যে স্বজনদের ঢাকায় আসার কথা ছিল, তাঁরাও আসতে পারেননি।

গরিব মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষের এক দিনের রোজগার ও পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকল। এর দায় কে নেবে? শাজাহান খান ও শিমুল বিশ্বাসেরা নির্বাচন নিয়ে একসঙ্গে বসতে না পারলেও একসঙ্গে ধর্মঘট করতে পারেন।
অধ্যাপক মিজানুর রহমান হরতালের নামে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারার কথা বলেছেন। এ ধরনের জঘন্য কাজের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের আমরা ধিক্কার জানাই। ঘৃণা করি।

কিন্তু সরকার সেই দুর্বৃত্তদের না ধরে কেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের আটক করে আরও বেশি হরতালকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে? হরতালে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার ঘটনা যারা ঘটাচ্ছে, সরকার তাদের চিহ্নিত করে কেন শাস্তি দিচ্ছে না? মিজানুর রহমানের মানবাধিকার কমিশনও একটি তদন্ত কমিটি করতে পারে। এ ঘটনার তদন্তে খুব বেশি লোকবল দরকার হয় না। প্রয়োজন সদিচ্ছা ও নির্ভীকতা।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হরতালে বিরোধী দলের নৃশংসতার কথা বললেও সরকারের দমন-পীড়নের বিষয়টি বেমালুম চেপে গেছেন। অথচ দুটোই মানবাধিকার লঙ্ঘন।

মানবাধিকার কমিশনকে কেবল বিরোধী দলের হরতাল নিয়ে কথা বললে হবে না, সরকার কোথায় কোথায় নাগরিকের অধিকার হরণ করেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোথায় আইনের অপব্যবহার করেছে, তা-ও বলতে হবে।
মিজানুর রহমান সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানো এবং ধর্মের নামে মানুষ হত্যার কথা বলেছেন। কিন্তু এই সাম্প্রদায়িক হানাহানি বন্ধের উপায় কী? আইনের শাসন। এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদান। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচার হয়নি।

তারা করেনি। কিন্তু এই সরকারের আমলে রামু, সাঁথিয়া, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, বরিশালসহ বিভিন্ন স্থানে যেসব সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেছে, সেগুলোর বিচার কেন হলো না? রামুর ঘটনায় একাধিক তদন্ত হলেও একজন অপরাধীও কেন শাস্তি পেল না? সেটি কি এ কারণে যে এসব ঘটনায় বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সরকারি দলের চেলা-চামুণ্ডারাও জড়িত? এসব ব্যাপারে মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা জানতে চাই।
অধ্যাপক মিজান নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, নষ্ট রাজনীতি আর নষ্ট শাসন হাত ধরাধরি করে চলে। দেশে সুশাসন থাকলে নষ্ট রাজনীতি শিকড় গাড়তে পারে না।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান আইনের শাসন নষ্ট হওয়া এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

আইনের শাসন কখন নষ্ট হয়? যখন আইনপ্রণেতা ও প্রয়োগকারীরা মিলে আইনের অপব্যবহার করেন। বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষিতে প্রভূত উন্নতি হয়েছে, মানুষের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বেড়েছে, দারিদ্র্য কমেছে, এসবই সত্য। কিন্তু আইনের শাসন কায়েম তথা সমভাবে আইনের প্রয়োগ হয়েছে, সে কথা বলা যাবে না। আইনের রক্ষকেরা যে অনেক ক্ষেত্রে ভক্ষকের ভূমিকায় নেমেছেন, তার অন্তত দুটোর সাক্ষী অধ্যাপক মিজানুর রহমান নিজে। এর একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল কাদের এবং অপরজন ঝালকাঠির তরুণ লিমন হোসেন।

দুটো ঘটনায়ই রাষ্ট্রীয় বাহিনী দ্বারা মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে।
গতকাল প্রথম আলোর তৃতীয় পৃষ্ঠায় সচিত্র খবর ছাপা হয়েছে, ‘বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পাচ্ছেন আবদুল কাদের। ’ এতে বলা হয়: বিনা দোষে পুলিশের নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছেন। ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় তাঁকে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ দিতে সুপারিশ করেছে পিএসসি।
বৃহস্পতিবার রাতে কাদেরের সঙ্গে আলাপ হলো।

বললেন, যে পুলিশের হাতে তিনি নিগৃহীত হয়েছেন, সেই পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে মানুষের সেবা করার ইচ্ছা ছিল তাঁর। বললাম, ‘আপনি পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে কর্মস্থলে কয়জনের সেবা করতে পারতেন? গোটা পুলিশ বাহিনীকে ভালো করতে পারতেন না। তার চেয়ে শিক্ষক হয়ে শিক্ষার্থীদের ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিন, যাঁরা পরবর্তী জীবনে পুলিশে চাকরি নিয়ে মানুষের সেবা করবেন, অধিকার হরণ করবেন না। ’
২০১১ সালের ১৫ জুলাই রাতে ইস্কাটন গার্ডেন রোডের খালার বাসা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ফেরার সময় সেগুনবাগিচায় পুলিশ তাঁকে ডাকাত বলে আটক করে। পরদিন খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হেলাল উদ্দিন তাঁকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেন এবং মিথ্যা মামলা দেন।

সে সময় লিখেছিলাম, ‘ওসির চাপাতি ও একজন কাদেরের আর্তনাদ। ’
ঝালকাঠির লিমন হোসেনকে ২০১১ সালের ১৩ মার্চ র‌্যাব গুলি করে একটি পা পঙ্গু করে দেয়। লিমন সে সময় ছিলেন এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র। এবার এইচএসসি পাস করেছেন। তাঁর আশা, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবেন।


কাদেরের নির্যাতনের ঘটনায় ওসির বিরুদ্ধে মামলা হলেও লিমনের ঘটনায় নিজেই আসামি হয়েছেন অবৈধ অস্ত্র এবং র‌্যাবের কাজে বাধা দেওয়ার মিথ্যা অভিযোগে। একটি মামলা এখনো ঝুলছে। হাইকোর্ট নিজ উদ্যোগে কাদের ও লিমনের ঘটনায় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সব ঘটনা তো পত্রিকায় আসে না। ফলে হাইকোর্টের নির্দেশ দেওয়ার সুযোগ নেই।


দুটি ঘটনায় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান আক্রান্ত ব্যক্তির পাশে দাঁড়ালেও তাঁদের ওপর যে অন্যায় হয়েছে, তার প্রতিকার করতে পারেননি। লিমন ও কাদেরেরা নষ্ট শাসনের শিকার। তার পরও তাঁরা দমেননি। লড়েছেন। লড়বেন।

আসুন, আমরা তাঁদের পাশে দাঁড়াই।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.