আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খায়রুল হত্যার মূল হোতারা চিহ্নিত

সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল কাঁচা টাকার অফুরন্ত রাজ ভাণ্ডার- সেখানে বস কালাইম্যা হচ্ছেন চাঁদাবাজির মহারাজ। সায়েদাবাদ থেকে চলাচলকারী ৪১টি রুটের ৬ সহস্রাধিক গাড়ি, টার্মিনালের পার্কিং লটসহ অর্ধশতাধিক খাতের চাঁদা হিসেবে প্রতিদিন তিনি এককভাবেই পকেটস্থ করেন ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। বিরাট অংকের এ চাঁদাবাজিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখতে বস কালাইম্যা যখন যাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেছেন তাকেই দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিতে হয়েছে। তারই নির্মম আক্রোশের সর্বশেষ শিকার হন ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের নেতা ও সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খায়রুল মোল্লা। গত ৭ নভেম্বর রাজধানীর মতিঝিল এলাকার সমবায় ব্যাংক ভবনের সিঁড়িতে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত ও গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়।

খায়রুল হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত পরিবহন মালিক সমিতির নেতা আবুল কালাম ওরফে বস কালাইম্যাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদকালে এসব তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশ। ২০ নভেম্বর রাতে রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড় এলাকায় অভিযান চালিয়ে বস কালাইম্যাকে গ্রেফতার করা হয় এবং আদালতের আদেশে ছয় দিনের রিমান্ডে নিয়ে তাকে ডিএমপি গোয়েন্দা বিভাগে (ডিবি) ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ডিবির দায়িত্বশীল সূত্র বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানায়, রিমান্ডে নেওয়ার একদিন পর থেকেই খায়রুল হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আবুল কালাম অকপটে সব তথ্য প্রকাশ করে দিচ্ছেন। তাছাড়া কৌশলী জিজ্ঞাসাবাদে সায়েদাবাদ টার্মিনালকেন্দ্রিক চাঁদাবাজি, খুনখারাবি এবং নিজের অবিশ্বাস্য উত্থান নিয়ে তিনি যেসব বর্ণনা দিয়েছেন তা জেনে ঝানু গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও রীতিমতো অবাক হয়েছেন। আবুল কালামের উদ্ধৃতি দিয়ে খায়রুল হত্যা মামলার তদন্ত তদারককারী সিনিয়র ডিবি কর্মকর্তা জানান, টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজির আধিপত্য নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্বে গত ২৯ বছরে সায়েদাবাদে ৪৩টি লাশ পড়েছে।

প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো না কোনোভাবে চাঁদাবাজ এ মহারাজের সম্পৃক্ততা রয়েছে। ১৯৮৪ সাল থেকেই ধারাবাহিক খুনোখুনির ঘটনা ঘটলেও মাত্র চারটি হত্যা মামলায় আবুল কালামকে মূল পরিকল্পনাকারী-হুকুমদাতা হিসেবে চিহ্নিত করা গেছে। ১৯৯৩ সালে সংঘটিত বহুল আলোচিত পরিবহন শ্রমিক নেতা জাকির হোসেন ও ডাবলু মিয়া এবং ২০০২ সালে পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু নাছের মোহাম্মদ তোহা ও সর্বশেষ খায়রুল মোল্লা হত্যা মামলায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে তিনি অঢেল টাকা ঢেলে ও নানামুখী প্রভাব খাটিয়ে নিজের সম্পৃক্ততা আড়াল করতে সক্ষম হন। অতি সম্প্রতি সংঘটিত খায়রুল হত্যা মামলার ক্ষেত্রেও নিজের নাম কেটে তবেই থানায় এজাহার নিতে বাধ্য করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

ওই হত্যাকাণ্ডের পরপরই খায়রুলের স্ত্রী শেফালী আলম পত্রিকার সাংবাদিকদের কাছে ও টিভি চ্যানেলগুলোতে দেওয়া বক্তব্যে সরাসরি আবুল কালামকে দায়ী করলেও এজাহারে তার নামটি লিখতে পারেননি। প্রভাবশালী মহলের চাপ ও নানা দেনদরবারের কারণে হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পর মতিঝিল থানায় খায়রুল হত্যা মামলাটি লিপিবদ্ধ করা হয়। মামলায় আসামি করা হয় তৈয়ব আলী, আলী আকবর বাবুল, জাফর, সেন্টু, সুমন, দুর্জয় ও বাচ্চুসহ অজ্ঞাত আরও ৪-৫ জনকে। লিখিত এজাহারে শেফালী আলম অভিযোগ করেন, টার্মিনালের ইজারা নেওয়া পার্কিং লটের টোল আদায়কে কেন্দ্র করেই তার স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আবুল কালাম নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে খায়রুল হত্যাকাণ্ডটি 'রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড' হিসেবে চিহ্নিত করে আওয়ামী লীগ নেতা মুশফিকুল মান্নান বায়ুর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা চালান।

যুবলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মহীউদ্দিন আহমেদ মহীর দিকে অভিযোগ তুলেও তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিভ্রান্ত করার পাঁয়তারা চালান।

গত ১৪ নভেম্বর খায়রুল হত্যা মামলার তদন্ত ডিবিতে হস্তান্তরের ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই এজাহারভুক্ত ও সন্দেহভাজন সাতজনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দারা। হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া আসামিদের ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতেই সায়েদাবাদ টার্মিনালের গডফাদার খ্যাত পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালামকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর থেকেই কালামের সহযোগীরা তাকে এ মামলা থেকে বাঁচাতে ১০ কোটি টাকার মিশন নিয়ে চেষ্টা তদবির চালাচ্ছে বলে চাউর আছে।

কালাইম্যার অবিশ্বাস্য উত্থান কাহিনী : আবুল কালামের জন্ম নোয়াখালী জেলার সেনবাগ পৌর সদরের চরম অভাবগ্রস্ত পরিবারে।

দারিদ্র্যের কারণেই তৃতীয় শ্রেণীতে উঠেই পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে কাজের সন্ধানে ঢাকায় পাড়ি জমান। সায়েদাবাদ খালপাড়ে জুন্নু মেকারের দোকানে গাড়ির চাকা ধোয়া-মোছা কাজের মধ্য দিয়েই কর্মজীবন শুরু হয় তার। পরবর্তীতে হেলপারির ফাঁকে ফাঁকেই গাড়ির চালক হয়ে ওঠেন কালাম। টার্মিনাল সংশ্লিষ্টদের সাহায্য-সহায়তায় পাড়ি জমান সৌদি আরব। ১৯৮৪ সালে ফিরে এসেই পুরনো-ভাঙাচোরা একটি মিনিবাস কিনে সায়েদাবাদ-নোয়াখালী সেনবাগ রুটে যাত্রীবহন শুরু করেন।

যাত্রীসেবা নামক একটি পৃথক মালিক গ্রুপের আওতায় অন্তর্ভুক্ত হন তিনি। সে সময় সায়েদাবাদ টার্মিনালসহ আশপাশের অপরাধ সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক ছিলেন আরজু-নাজিম-মুন্না। সুযোগ বুঝে তাদেরই ফুট-ফরমায়েশ পালনের বিশ্বস্ত সহকারী হয়ে ওঠেন কালাম। তাদের ওপর ভর করেই পরবর্তীতে সায়েদাবাদ টার্মিনালের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠেন তিনি, আর তাকে পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। খায়রুল হত্যা মামলার তদন্তকারী মহানগর ডিবি (পূর্ব)-৩ টিমের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) জুয়েল রানা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, জিজ্ঞাসাবাদকালে আবুল কালাম তার অবিশ্বাস্য উত্থান ও জিঘাংসামূলক কর্মকাণ্ডের বিস্তৃত বিবরণ তুলে ধরেছেন।

১৯৮৪ সালে তিনি সায়েদাবাদ টার্মিনালে আসা-যাওয়া করলেও ১৯৮৬ সাল থেকে টার্মিনালের চাঁদায় ভাগ বসান। এর পর নানা চড়াই-উৎরাই পেরোতে হলেও বিগত ১৭ বছর ধরে কালাম সায়েদাবাদ টার্মিনালের চাঁদা সাম্রাজ্যে একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে আছেন। অভাবনীয় পরিমাণের সহায় সম্পদও গড়েছেন। কালামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানায়, সেনবাগ থানা সদরসহ গ্রাম পর্যায়ের চারটি মৌজায় প্রায় ২০০ একর জমি কিনেছেন, মোহাম্মদপুরের ২৩ শেরশাহসূরী রোডে বিশাল আয়তনের ৬ তলা আলীশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন। সায়েদাবাদ টার্মিনালের পেট্রোলপাম্প সংলগ্ন আরেকটি ছয়তলা বাড়ি কিনতেই তার ব্যয় হয়েছে আড়াই কোটি টাকা।

বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রতিটি রুটেই তার মালিকানাধীন মিনিবাস ও চেয়ারকোচ চলাচল করে থাকে। তার ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানায়, খুবই ধূর্ত কালাম স্বনামে, বেনামে, সহযোগী-পরিজনদের নামে অন্তত ৬০টি গাড়ি রাস্তায় নামালেও সবগুলোর তিনিই প্রকৃত মালিক।

রাজধানীর বনানী, সেগুনবাগিচা ও স্বামীবাগ এলাকার কয়েকটি ডেভেলপার কোম্পানিতেও কালামের দারুণ কদর। তারা অঘোষিতভাবে কালামের মোটা অংকের টাকা বাণিজ্যে খাটাতে পারছেন, তবে তাদের প্রতিটি নতুন অ্যাপার্টমেন্টেই অন্তত একটি ভিআইপি স্যুট তাকে সবচেয়ে কম দামে লিখে দেওয়ার শর্ত থাকে। এভাবে গত পাঁচ বছরে কমপক্ষে ১৬টি ফ্ল্যাটের মালিক বনেছেন কালাম।

শুধু দেশেই নয়, মালয়েশিয়ার পেনাং শহরে থ্রি-স্টার হোটেলের আদলে ১০ তলার অভিজাত বাড়ি গড়েছেন তিনি। বাড়িটির ছাদে লাল-সবুজ রঙের দৃষ্টি আকর্ষণীয় আমব্রেলা স্থাপিত রয়েছে। তাতে লেখা আছে 'কালাম লজ-পেনাং'। ওই ভবনের ৪০টি ফ্ল্যাট বিক্রি করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে। প্রতি মাসেই হাওয়া বদল করতে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়ায় নিজ বাড়িতেই ঘুরতে যান কালাম।

ফিলিপাইনি কয়েকজন তরুণীকে তিনি রক্ষিতা হিসেবে পেনাংয়ের বাড়িতে রাখেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। দেশ থেকে প্রভাবশালী আমলা, প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই মালয়েশিয়ায় গিয়ে 'কালামের মেহমান' হিসেবে তার ফ্ল্যাটে আরাম-আয়েশ করে থাকেন।

আধিপত্য বহালে জিঘাংসা : আধিপত্য নিশ্চিত রাখতে আবুল কালাম প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারদলীয় নেতা, শীর্ষ সন্ত্রাসী, বিভিন্ন দল-উপদলসহ ঘাটে ঘাটে মাসোহারা দেন ঠিকই, তবে তা চাঁদাবাজির তুলনায় ছিটেফোঁটা। মাসিকভিত্তিক বেতন-মাসোহারা পদ্ধতির বাইরে দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদার টাকা বণ্টন করে নিতে কেউ চেষ্টা করলেই তার আর রেহাই ছিল না। কালামের কূটবুদ্ধি, অর্থবিত্তের প্রভাব, দুর্ধর্ষ অস্ত্রবাজ ক্যাডার বাহিনীর হাতে তারই এক সময়ের আশ্রয়দাতা আরজু, নাজিমকে জীবন হারাতে হয়েছে।

মুন্না নিহত হন ক্রসফায়ারে। আধিপত্য বিস্তারের রেশ ধরেই জাকির, ডাবলু, তোহা, জাহাঙ্গীর, মোহন, আঙ্গুর, জাহেদ আলী, আলাউদ্দিন, পিংকুসহ একের পর এক পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতা ধারাবাহিক খুনোখুনির শিকার হন। কালামের অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বরাবরই যেসব সন্ত্রাসী তার একান্ত অনুগত হয়ে কাজ করে তারা হচ্ছে- ফকির চাঁন, সিদ্দিক, জাফর, সেন্টু, সুমন, দুর্জয়, বাচ্চুসহ ১৫-১৬ জন। তাদের সবার নামে একডজনেরও বেশি মামলা রয়েছে। তার দলে হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ফেরার আসামিও রয়েছে তিনজন।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.