আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সহিংসতায় আক্রান্ত প্রতিবন্ধী

প্রতিবন্ধীদের অধিকার সুরক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে মঙ্গলবার যেখানে বিশ্বজুড়ে প্রতিবন্ধী দিবস পালিত হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সহিংসতায় হরতালকারীদের আগুনে পুড়ছে প্রতিবন্ধীদের বহনকারী গাড়িও।
বিরোধী দলের অবরোধের মধ্যে গত শনিবার রাতে রাজধানীর মালিবাগে বাসে পেট্রোল বোমা ছোড়ার পর আহত হন শারীরিক প্রতিবন্ধী মহিউদ্দিন (৩৫)। ওই বাসে চড়ে পুরান ঢাকা থেকে বনশ্রীর বাসায় ফিরছিলেন তিনি।
এর আগে গত ১০ নভেম্বর ফরিদপুরে একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে বোমা বিস্ফোরণে দুই শিক্ষার্থী আহত হয়। পরদিন যাত্রাবাড়ীতে বাসে আগুনে অন্য সাত জনের সঙ্গে ঝলসে যায় প্রতিবন্ধী আব্দুল মান্নানের (৩৫) শরীর।


হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে মহিউদ্দিন জানান, শনিবার রাত ৮টার দিকে সু-প্রভাত পরিবহনের একটি বাস লক্ষ্য করে দুটি পেট্রোল বোমা ছোড়া হলে গাড়িটি ফুটপাতের উপর উঠিয়ে দেয় চালক। এসময় বাসের নিচে চাপা পড়ে হাবিবুর রহমান নামে এক কাপড় ব্যবসায়ী মারা যান। আগুনে দগ্ধ হন তিনজন, আর গোলাম কিবরিয়া নামে এক আইনজীবীর বাঁ হাত বিছিন্ন হয়ে যায়।
মহিউদ্দিন ওই বাসে ছিলেন। তড়িঘড়ি করে নামতে গিয়ে বাঁ পা ভেঙে যায় তার।

প্রথমে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সেখান থেকে মহাখালী মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে।
মহিউদ্দিনের স্ত্রী নূর নাহার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধী মহিউদ্দিনের সদরঘাটে ‘আইডিয়েল ক্লাস’ নামে একটি পাঞ্জাবির দোকান রয়েছে।
তিন মাস বয়সে পোলিওর কারণে তার বাঁ পা সরু ও দুর্বল হয়ে যায়। একারণে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন তিনি।



“তড়িঘড়ি নামতে গিয়ে সেই পা-তিন জায়গায় ভেঙেছে তার,” বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন নূর নাহার।
সোমবার রাতে মহিউদ্দিনের ভাঙা পাযে অস্ত্রোপচার হয়েছে বলে জানান তিনি।
নূর নাহার বলেন, নূরসাবা নামে সাত বছরের এক মেয়ে, নিজাম উদ্দিন ও শাকিল নামে পাঁচ ও তিন বছরের দুটি ছেলে রয়েছে তাদের।
সাড়ে ১১ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে বনশ্রীর ওই বাসায় থাকেন তারা।
প্রতিবন্ধী হলেও মহিউদ্দিনের দোকানের আয়েই চলে তাদের সংসার।

কিন্তু সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ভাঙা পা নিয়ে হাসপাতালে শুয়ে থাকায় দোকানটি খোলার কেউ নেই।
“এখন আমরা কী করবো, কিভাবে চলবো,” বলেন নূর নাহার।
গত ১১ নভেম্বর বিরোধী দলের হরতালে যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে চলন্ত বাসে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হন প্রতিবন্ধী আব্দুল মান্নান (৩৫)। আগুনে তার শরীরের ১৯ ভাগ পুড়ে যায় বলে চিকিৎসকরা জানান।
মিনিবাসের আগুন মান্নানের শরীরই শুধু পোড়ায়নি, হারাতে হয়েছে দীর্ঘদিনের পথচলার পাথেয় ক্রাচও।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বায়তুল মোকাররম কার্যালয়ের প্রকাশনা বিভাগে চাকরি করেন মান্নান। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে ক্রাচে ভর দিয়ে কার্যালয়ে যাতায়াত করেন। গুলিস্তান থেকে ওই বাসে চড়ে বাসায় ফিরছিলেন তিনি।
ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে কান্না জড়িত কণ্ঠে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মান্নান বলেন, “কমল পরিবহনের একটি বাসে করে সিদ্ধিরগঞ্জের মৌচাকের বাসায় ফিরছিলাম। আমি বাসের শেষ আসনের আগের আসনে বসি।


“বাসে যখন আগুন দেয়া হয় তখন একসঙ্গে পুরো বাসটি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। বাস থামাতেও একটু সময় নেয় চালক। সবাই যার যার মতো নামছে। কিন্তু আমি কিভাবে নামবো? হৈ-চৈর মধ্যে আমার ক্র্যাচটিও পাচ্ছিলাম না। অন্য কোনো উপায় না দেখে হামাগুঁড়ি দিয়ে বাস থেকে নামি।


তৌহিদুল ইসলাম নামে তার দুই বছরের এক ছেলে রয়েছে জানিয়ে মান্নান বলেন, “আমার স্ত্রী এখন সন্তানসম্ভবা। যদি হামাগুঁড়ি দিয়ে না নামতে পারতাম তাহলে আমার সন্তান তো এতিম হতো। ”
বাসে আগুন দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “প্রতিবাদের অনেক ভাষা আছে। আর হরতালে কোন ধরনের মানুষ বাসা থেকে বের হন তা হরতালকারীদের বুঝা উচিত। ”
জন্মের কয়েক মাস পর টাইফয়েড জ্বরে ডান পা অকেজো হয়ে যায় মান্নানের।

এরপর প্রতিবন্ধী জীবনে নানা প্রতিবন্ধকতা পাড়ি দিয়ে আসেন তিনি।
সেই বঞ্চনার কথাও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে তুলে ধরেছেন এই সংগ্রামী মানুষটি।
“জীবনের সব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়েছি। চাকরিতে লিখিত পরীক্ষায়ও ভাল ফল করেছি। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়তাম, কারণ আমি শারীরিক প্রতিবন্ধী, পঙ্গু।


তিনি জানান, ছয় মাস বয়সেই পোলিওতে ডান পা হারান। ১০ বছর বয়স পর্যন্ত হামাগুঁড়ি দিয়ে চলতেন। পরে ক্রাচে ভর দিয়ে শুরু হয় তার পথ চলা। দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল সব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়েছেন।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ধর্মীয় শিক্ষক পদে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে সেকশন অফিসার হিসেবে, সরকারি হাই স্কুলসহ অন্তত ১৫ জায়গায় চাকরির জন্য লিখিত পরীক্ষায় পাস করলেও মৌখিকে বাদ পড়েছেন।


বর্তমানে ইসলামী ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা বিভাগে ইসলামী বিশ্বকোষ ও অনুবাদ কেন্দ্রে একটি প্রকল্পের আওতায় চাকরি করেন। ২০০৮ সালে লিখিত পরীক্ষায় অনেক নম্বর পাওয়ায় ৯ হাজার টাকা বেতনে চাকরিটি পান বলে জানান মান্নান।
মান্নানের আগে রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয় ফরিদপুরের দুই প্রতিবন্ধী শিশু।
বিরোধী দলের হরতালের মধ্যে গত ১০ নভেম্বর বেলা পৌনে ১২টায় ফরিদপুর শহরের রাজবাড়ী রাস্তার মোড় এলাকায় বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বোমা বিস্ফোরণে দুই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশু আহত হয়।
আহত হুমায়ূন কবিরের (১২) বাড়ি রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলায় এবং রায়হান ব্যাপারীর (১০) বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলায়।

তারা দুজনই ওই বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র।

বোমায় হুমায়ূনের ডান পায়ের হাঁটুতে জখম হয়। আর রায়হানের ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে লাগে বোমার স্প্লিন্টার।
এর আগে গত ২৮ অক্টোবর হরতাল সমর্থকদের আগুনে পুড়ে যায় মানিকগঞ্জ অটিস্টিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন নিবাসের (রহম) শিক্ষার্থীদের বহনকারী গাড়ি।
ওই দিন রাতে মানিকগঞ্জ শহরের বেউথা এলাকায় প্রতিবন্ধীদের বহনকারী লেগুনাটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় বলে পুলিশ জানায়।


প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাজনীন বেগম ইভা জানান, এক ব্যক্তি লেগুনাটি অনুদান হিসেবে দিয়েছিলেন। ৩০ জন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুকে আনা- নেয়ার কাজে এটি ব্যবহার করা হতো।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গাড়িতে ভাংচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। হতাহত হয়েছে নারী, শিশুসহ অনেক মানুষ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল বলেন, এ পর‌্যন্ত হরতাল-অবরোধে  আগুনে দগ্ধ অর্ধ শতাধিক মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হযেছেন।

তাদের মধ্যে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে ৩২ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

সোর্স: http://bangla.bdnews24.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.