আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাবর আলীর দ্বিতীয় সত্তা

অহংকার করবার মতো কিছু না থাকা সত্ত্বেও এই ধরাধামে এমন অনেক মনুষ্যের বসবাস, যারা নিজেকে অন্যের চেয়েও অধিকতর উচ্চশিক্ষিত, কিংবা জ্ঞানী বলে মনে করতে এতটুকু দ্বিধা বোধ করেন না। যার হয়তো নেই কোনো ভিত্তি, হয়তো অন্তঃসারশূন্য কিংবা হতে পারে বায়বীয়। তারপরও তারা আচ্ছন্ন হয়ে থাকে তাদের মিছে অহংবোধে। নবাব হাবিবুল্লা বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক মোহাম্মদ বাবর আলীও তেমনি একজন মানুষ। ক্লাসে এসে যতনা ছাত্রদের উদ্দেশ্যে পাঠদান তার চেয়েও বেশি সময় তিনি ব্যয় করেন আত্দগুণ কীর্তন ও আকণ্ঠ নিমগ্ন থাকেন নিজের প্রশংসায়।

বিদ্যার্থীদের যে কারও তুচ্ছ ভ্রম আবিষ্কারে বাবর আলী সিদ্ধহস্ত। শিক্ষক বাবর আলী সম্পর্কে এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঈষৎ উদাস মনে ওমরের দৃষ্টি শ্রেণিকক্ষের জানালা ভেদ করে বাইরে নিক্ষিপ্ত হলো। মধ্য গগনের তপ্ত রোদের আলো মাঠের সবুজ ঘাসের উপর পড়ে চিকচিক করছিল।

গণিত শিক্ষক বাবর আলী, অমসৃণ ও কর্কশ কণ্ঠে খেঁকিয়ে উঠলেন, এই_ ওমর তোর মন কোথায়? ক্লাসে, নাকি বাইরে? জানালা দিয়ে দেখছিস টা কী? বাবর আলীর বিটকেল বেসুরো চিৎকারে স্বম্বিৎ ফিরে পায় ওমর। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে নিজ খাতায় অঙ্ক কষার কপট ভান করে সে।

ছাত্রদের উপর অত্যাচার-নিপীড়ন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাবর আলীর শরীরটিও যেন দৈর্ঘ্যে না বেড়ে ক্রমাগত শুধু প্রস্থেই বেড়ে চলেছে। তার শরীরিক অবয়বটি এখন দেখতে অনেকটা মদ কিংবা দ্রাক্ষারস সংরক্ষণের জন্য তৈরি কাঠের পিপের মতো দেখায় দুপাশ সরু কিন্তু মধ্যদেশ স্ফিত। শুধু পিপের উপরিভাগে যদি বাবর আলীর ছোট্ট মাথাটি জুড়ে দেওয়া যেত তবে ষোলকলা পূর্ণ করে মদের পিপেটিতেই তার সম্পূর্ণ দেহ অবয়বটি ফুটে ওঠত।

চার-পাঁচ বছর আগে বাবর আলী যেদিন স্কুলটিতে প্রথম পদার্পণ করেছিলেন সে দিনটির কথা ওমরের এখনো স্পষ্ট মনে আছে। ওমরের মনে পড়ে গেল ওই দিন বাবর আলীর পরনে ছিল অতিশয় চোলা একটি হাফ হাতা শার্ট ও ফুল প্যান্ট।

ওমরের ওই দিনের কথা তার মানসপটে জীবন্ত হয়ে আছে যে কারণে, সেটি হচ্ছে বাবর আলী ফুল প্যান্টের সঙ্গে পায়ে পড়েছিলেন সবুজ রঙের এক জোড়া রূপসা চপ্পল। ফুল প্যান্টের সঙ্গে স্পঞ্জের সবুজ চপ্পল জোড়া কিছুতেই মানানসই মনে হচ্ছিল না। ক্লাসের অনেকেই মুখ টিপে হেসেছিল নিশ্চয়ই। পাঁচ বছর আগের কথা। অনেক কিছুই আজ আর মনে নেই ওমরের।

এসব সাত-পাঁচ ভাবছিল আর অঙ্কগুলো ব্লাক বোর্ড থেকে দেখে দেখে বিধবাদের ধবধবে সাদা থান কাপড়ের মতো খাতায় তুলছিল ওমর। হঠাৎ পেছনের দিকের একটি বেঞ্চে শোরগোল পড়ে গেল।

বাবর আলী মৃদুল নামের একটি ছেলেকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, _ এই তুই অঙ্ক না কষে এত মনোযোগ দিয়ে ক্লাসে কী পড়ছিস? মৃদুল তাড়াহুড়ো করে কিছু একটা আড়াল করার চেষ্টা করতেই বাবর আলী তাকে হাতে নাতে ধরে ফেললেন। বাবর আলী হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ওগুলো এক্ষুণি আমার হাতে দে। নইলে চাবকে গায়ের চামড়া তুলে নেব।

বাধ্য হয়ে মৃদুল তার হাতের বইটি বাবর আলীর হাতে তুলে দিল।

বাবর আলী বইটির ওপর কিছু সময় চোখ বুলিয়ে সবিস্ময়ে চোখ দুটো বিস্ফোরিত করে মৃদুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, _সবে মাত্র তোরা দশম শ্রেণির ছাত্র। এই বয়সেই তোদের এত অধঃপতন। ছি! ছি! ছি! আমি ঘেন্নায় মরে যাচ্ছি। এই কী তোদের রুচি! লেখাপড়া বাদ দিয়ে শেষ পর্যন্ত রসময় গুপ্তের সাহিত্য হাতে তুলে নিয়েছিস? আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারি না, তোদের মনে এতটা পচন ধরেছে।

তোদের আর দোষ কী তোদের এই যুগটাকেই ঘুণপোকায় ধরেছে। ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তোদের এই সমাজ। ভেবেছিলাম তোরা লেখাপড়া শিখে আমার মতো কিংবা আমাদের মতো বিদ্বান হবি। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। ভুল বললাম আসলে গুঁড়ে বালি নয়, গুড়ে বিষ।

অথচ আমরা যখন তোদের বয়সী ছিলাম কী সাত্তি্বক জীবনই না পার করেছি আমরা। রোজ নিয়ম করে ক্লাসে উপস্থিত হতাম। ক্লাসের পড়া সব ঠিক ঠাক মতো তৈরি করে নিতাম। স্কুলের শিক্ষকরাও আমাদের খুব পছন্দ করতেন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে হাত মুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে বসে যেতাম বই নিয়ে।

লেখাপড়া চলত অনেক রাত অবধি। তোদের মতো হতচ্ছাড়া নচ্ছাড় কিংবা বদের হাড্ডি ছিলাম না কোনোকালেই। ক্লাসে সব সময় খুব ভালো রেজাল্ট করতাম।

বাবর আলী এবার ছাত্রদের উদ্দেশ করে বললেন _এই গুরুতর অপরাধের বিচার হতে হবে।

স্কুলের অফিস থেকে হৃষ্টপুষ্ট দুটো জালি বেত নিয়ে আসা হলো।

সেগুলোকে ওমর সযত্নে রাখল টেবিলটির ওপর। মৃদুল নামের ছাত্রটিকে ডাকা হলো বাবর আলী যেখানটায় বসে আছেন সেই টেবিলটির সামনে। বাবর আলী তাকে উদ্দেশ করে বললেন, _হাত দুটো আমার সামনে সোজা করে মেলে ধর। মৃদুল রোবটের মতো, নাহ রোবটের মতো কথাটি ঠিক হলো না, সে অনেকটা হিপ্নোটাইজড হওয়া মানুষের মতো হাত দুটো সম্প্রসারিত করে পেতে রাখল বাবর আলীর হাতের নাগালের মধ্যে।

মৃদুলের চোখ দুটি মুদিত, সে সম্ভবত ভয়ে চোখ বুজে আছে।

সপাং ... সপাং ... সপাং বেত্রাঘাতের শব্দ হলো সম্ভবত মিনিট দুয়েক। মৃদুল তখন ক্ষোভে অভিমানে ও অপমানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সেখানটায়। বাবর আলী ছাত্রদের উদ্দেশে ঘোষণা করলেন, যদি এ ধরনের কোনো কুরুচিপূর্ণ সাহিত্য কারও কাছ থেকে পাওয়া যায় তবে তাকে লাল কালির টিসি ও সঙ্গে শুধু অর্ধচন্দ্র নয়, বরং পূর্ণচন্দ্র দিয়ে এই স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে।

বাবর আলীর বয়ানকৃত এই কুরুচিপূর্ণ সাহিত্য কার কাছে নেই? ক্লাসের সবচেয়ে ভোলাভালা জাফর, অতি ধূর্ত প্রকৃতির রঞ্জু, ক্লাসের চৌকস ছাত্র ওমর, সবচেয়ে খর্বকায় ছেলে গেদু যার আসল নাম মনি কিন্তু মনি নামটা হাজার লাখ টন মাটির নিচে কোনো এক অজানা কারণে চাপা পড়ে গেছে, গেদু নামের আড়ালে। সবচেয়ে লম্বা ও রোগা পটকা সাজিদ।

সবার কাছেই আছে রসময় গুপ্তের রগরগে বর্ণনায় ভরপুর সেই নিষিদ্ধ সাহিত্য। এরা সবাই হঠাৎ ঈষৎ বিড়বিড় করে বলল, _এখন কী উপায়?

ক্লাস শেষে পড়ন্ত বিকালে সূর্য অনেকটাই হেলে পড়েছে পশ্চিমে। অস্তমিত সূর্য, নিকষ কালো অন্ধকারের আগমনী বার্তা বয়ে আনে। সেই কুচকুচে কালো অন্ধকার সংক্রমিত হয় ওমর, গেদু, রঞ্জু কিংবা সাজিদদের মনেও।

রঞ্জু কিছুটা হতাশ মিশেল কণ্ঠে বলে সব বইগুলো একত্রে বিক্রির ব্যবস্থা করলে কেমন হয়?

গেদুর গলায় কিছুটা আশ্চর্যের ভাব!

মৃদুল বলে, _আমি কিন্তু ওসব কেনাবেচার মধ্যে আর নেই বাপু যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে।

অনেক বাহাস ও বিতণ্ডার পর সিদ্ধান্ত হলো, ওগুলো সব পুড়িয়ে ফেলাই ভালো।

পরদিন। স্কুল বন্ধ। সাপ্তাহিক ছুটি। সবাই মিলে বইগুলোকে বগলদাবা করে নিয়ে হাজির হলো স্কুল থেকে অনেক দূরে গড়ের মাঠের এক প্রান্তে একটি প্রকাণ্ড অশ্বত্থ গাছের নিচে।

সব বই স্তূপ করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। চোখের সামনে পুড়ে ভস্মীভূত হলো সব নিষিদ্ধ সাহিত্য। বইগুলো পুড়ে ভস্মীভূত হলো ঠিকই কিন্তু সবার মনের আগুন প্রশমিত হওয়ার পরিবর্তে উল্টো সে আগুন আরও দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। বেশ কিছুদিন আগুনের ঊধর্্বমুখী শিখা হয়তো চাপা দিয়ে রাখা গেল ঠিকই কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এদের সবার মনে নানারকম হাপিত্যেশ ও উসখুস শুরু হলো। কিন্তু কোথায় পাবে ওরা ওসব বই।

সব তো পুড়ে ছাই হয়ে মিশে গেছে মাটিতে।

ক্লাসের সবচেয়ে চৌকস ছাত্র ওমর ওদের সবার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মনে মনে একটি বুদ্ধি অাঁটে। ওমর, রঞ্জুকে উদ্দেশ করে একটি প্রস্তাব রাখল, বন্ধু দুঃখ করিস না। আমি নিজে ওরকম সাহিত্য রচনা করে তোদের দেখাব।

রঞ্জু আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলল, সত্যি তুই পারবি লিখতে ওরকম সাহিত্য?

_ আলবৎ পারব।

তবে তোকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে ওগুলো তুই ক্লাসে আনতে পারবি না।

_ নিয়ে আসার তো প্রশ্নই ওঠে না। বরং বাড়িতেও ওগুলো লুকিয়ে রাখব কোনো দুর্ভেদ্য প্রকোষ্ঠে, যাতে কেউ এর টিকিটি পর্যন্ত খুঁজে না পায়।

কিছুদিনের মধ্যে রঞ্জু হাতে পেল রুল করা সুন্দর একটি খাতায় খুশখত বর্ণাক্ষরে একখণ্ড নিষিদ্ধ সাহিত্যের পাণ্ডুলিপি। ওমরের সুন্দর হস্তলিপিতে সত্যি সত্যিই বেশ নয়নসুখ হয়।

বক পক্ষীর পালকের মতো সাদা খাতায় কালো কালি দিয়ে রচিত নিষিদ্ধ সাহিত্যখানা যেন কোনো শিল্পীর পটে অাঁকা ছবির মতো মনে হয়।

রঞ্জু খাতা দ্রুত পৃষ্ঠা উল্টোতে থাকে। দু চার পৃষ্ঠা পড়ার পর ওমরকে উদ্দেশ্য করে রঞ্জু বলে লেখাটা কিন্তু বেশ চমৎকার হয়েছে রে দোস্ত। কিন্তু ভাষাটি বেশ একটু খটমটে লাগছে।

ওমর কিছুটা আত্মদাম্ভিকতার সঙ্গে বলে, _বুঝেছিস আহাম্মক, আমার সাহিত্য বলে কথা।

ভাষাটিকে তো কিছুটা গুরুপাকে সমৃদ্ধ করতেই হয়। তা না হলে আমার পাণ্ডিত্যটুকু আর থাকে কোথায় বল?

তুলোর মতো পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ উড়িয়ে, প্রকৃতিতে শরতের সাদা রঙ মেখে, হেমন্তের নবান্নের ঘ্রাণে চারপাশ আমোদিত করে কিংবা ঋতুরাজ বসন্তের পাতা ঝরা নগ্ন বৃক্ষরাজির উচ্ছ্বাসে সবকিছু চলছিল সুন্দর ও সাবলীলভাবে।

যে কোনো সাধারণ দিনের মতোই একদিন বাবর আলী যথারীতি শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদের অঙ্ক কষা শেখাচ্ছিলেন। হঠাৎ তার নজরে এলো রাজা নামের ছাত্রটি অঙ্ক কষা ফেলে রেখে মনোযোগ দিয়ে কী যেন পড়ছে। সুচতুর বাবর আলী দ্রুত বেগে ধাবিত হলেন সেই ছাত্রটির দিকে দেখি বাচাধন অঙ্ক কষা ফেলে রেখে কী পড়া হচ্ছে ক্লাসে?

_ না, মানে ইয়ে ... স্যার আমি কিছুই পড়ছি না।

_ ভালোয় ভালোয় বলছি খাতাটি আমার হাতে দে। নইলে...

অগত্যা সীমাহীন অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও কম্পমান হাতে রাজা তার খাতাটি তুলে দিতে এক প্রকার বাধ্য হয় বাবর আলীর হাতে।

রাজার কাছ থেকে জানা গেল আসলে খাতাটি তার নিজের নয়। সে এটি ধার করেছে রঞ্জুর কাছ থেকে। রঞ্জুকে দু'ঘা উত্তম মধ্যম বসিয়ে দিতেই সে অকপটে স্বীকার করে নিল, ওগুলো আসলে তার নিজের নয়।

এগুলো লিখে দিয়েছে আর কেউ নয় ভালো ছাত্রের পোশাকধারী স্বয়ং ওমর।

ক্রোধে উন্মত্ত বাবর আলীর পাঁচ আঙ্গুলে কপালের দুপাশের শিরাগুলো যেন দপদপ করে কাঁপছে। তিনি ক্লাসে ওমরকে কিছু না বলে শুধু ক্লাস শেষে তার সঙ্গে শিক্ষকদের বিশ্রাম কক্ষে দেখা করতে বললেন।

ক্লাস শেষ হতে হতে বেলা গড়াল পাঁচটায়। মনের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো অবিরাম দুরু দুরু কাঁপুনি নিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত ওমর হাজির হলো বাবর আলীর সামনে।

ততক্ষণে ওমরের স্নায়ুপুঞ্জে শুরু হয়েছে টর্নেডো কিংবা তাইফুন। এক লহমায় ওমরের মনে হলো সে যেন মূর্ছা যাচ্ছে।

ক্রোধান্ধ বাবর আলী ওমরকে বললেন, এগুলো কী তুই লিখেছিস?

ওমরের নির্লাজ স্বীকারোক্তি_ হ্যাঁ, ওগুলো আমিই লিখেছি।

বাবর আলী ঈষৎ আক্ষেপের সুরে বললেন, _ তোদের সবার কী হয়েছে বল তো? তোরা কী সবাই সদ্য যৌবনের রঙিন নেশায় মাতাল কিংবা মনের বিরামহীন লিপ্সায় পাগল হয়ে গেলি? আমি ভেবেছিলাম তুই অন্তত একটি আশাতীত রেজাল্ট করে এই স্কুলের মুখ রাখবি। কিন্তু আমি এটা জেনে আশ্চর্যান্বিত হয়েছি, তোর এই লজ্জাতুর মনোভাবের আড়ালে লুকিয়ে আছে লালসাময় নারীর উপস্থিতি।

_স্যার, আমাকে এবারের মতো ক্ষমা করে দিন। কথাগুলো বলার সময় ওমরের কণ্ঠটি বারংবার কেঁপে কেঁপে উঠছিল।

_তুই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছিস ওমর। আমি কাল তোদের বাসায় এসে বিষয়টি নিয়ে তোর বাবার সঙ্গে কথা বলব। তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নেবে স্কুল কর্তৃপক্ষ।

_স্যার, যা শাস্তি হয় আমাকে দিন। প্রয়োজনে স্কুল থেকে টিসি দিয়ে বিদায় করে দিন। দয়া করে এর মধ্যে আমার বাবা-মাকে জড়াবেন না।

_বাছাধন, অন্যায় করার সময় বাবা-মার কথা মনে পড়েনি?

পরদিন রাতে বাবর আলী এসে হাজির হলেন ওমরের বাসায়। ওমরের বাবা একজন শিক্ষা বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা নিপাট সহজ-সরল ভালো মানুষ।

বাবর আলীর মুখ থেকে নিজের ছেলের সম্পর্কে সবকিছুই মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। বিষয়গুলো বর্ণনা করে বাবর আলী যেন সীমাহীন পরিতৃপ্তি ও সুখ লাভ করলেন। ওমরের বাবা কী বলেন সেই আশায় তিনি কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ওমরের বাবার দিকে। কিছু সময়ের জন্য আশ্চর্য এক নীরবতা, তারপর সেই নীরবতা ভেঙে ওমরের বাবা বদিউজ্জামানই মুখ খুললেন দেখুন মাস্টার সাহেব, ছেলেকে স্কুলে পাঠানো হয়েছে শিক্ষা গ্রহণ করতে কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, সে পথভ্রষ্ট হয়েছে।

বাবর আলীর জন্য নাস্তা পানির ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও তিনি শুধু চা মুখে তুলেই ওমরদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।

বাবর আলীর চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ওমর হঠাৎ লক্ষ্য করল তার অপ্রিয় গণিত শিক্ষকটি তার কাঁধের উত্তরীয় ব্যাগটি ভুলবশত টেবিলের ওপর ফেলে রেখে গেছেন।

মেঘলা সকাল। আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ সাদাকালো অজস্র মেঘমালার কারণে বোঝা যাচ্ছে না, বেলা আসলে গড়িয়েছে বেশ খানিকটাই। আসন্ন ঝড় জলের সম্ভবনায় একটি ছাতা সঙ্গে নিয়ে ওমর পা বাড়াল রাস্তা ধরে। হেঁটে গেলে বাবর আলীর বাড়ি পেঁৗছাতে সময় নেয় বিশ থেকে পঁচিশ মিনিটের মতো।

সে জন্য রিকশা নেওয়ার কোনো মানে হয় না। আদর্্রতা সমেত দমকা বাতাসে হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিল ওমরের। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটি অনতিবৃহৎ মাঠ পেরিয়ে একটি সাধারণ দ্বিতল বাড়ির সমনে এসে দাঁড়াল, দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাড়িটি পুরাতন। সাপের গায়ের ছাপের মতো ছোপ ছোপ সবুজ শ্যাওলা গজিয়ে সম্পূর্ণ বাড়িটি চিরহরিৎ বর্ণ ধারণ করেছে। সম্ভবত চলমান পরিস্থিতির কারণে দুরু দুরু কাঁপছে তার হৃদয়।

অল্প ইতস্তত করার পর বুকের ভেতর বেশ খানিকটা সাহস তুলে এনে কড়া নাড়ল ওমর একবার, দুবার, বেশ কয়েকবার দরজাটি সম্ভবত ভেজানোই ছিল। অল্প একটু ধাক্কা দিতেই দুয়ারটি খুলে গেল, কচ্চপের মতো মুণ্ডটি ভেতরে ঢুকিয়ে ওমর দেখার চেষ্টা করল কক্ষটিতে কারও অস্তিত্ব আছে কিনা ? না কেউ নেই। ঠিক সেই মুহূর্তে স্নান ঘর থেকে বাবর আলী চেচিয়ে উঠলেন। কে? মাজেদা এলি নাকি রে?

মাজেদা নামের মেয়েটি সম্ভবত বাবর আলীর বাসায় ঝিয়ের কাজ করে মনে মনে ভাবে ওমর। না, স্যার আমি ওমর।

গতকাল আপনি আপনার ব্যাগটি আমাদের বাড়িতে ফেলে এসেছিলেন। আমি ওটি ফেরত দিতে চলে এলাম।

ভালোই করেছিস বেশ খানিকটা প্রসন্ন গলায় কথাগুলো স্নানঘর থেকেই বলে বাবর আলী। তুই খানিকক্ষণ অপেক্ষা কর আমি গোসল সেরে এক্ষুণি আসছি।

বাবর আলী অকৃতদার আর তাই ঘরে আসবাবের তেমন একটা বালাই নেই।

কৌণিক এই ঘরটির এক পাশে তক্তপোশ। তক্তপোশ ঘেঁষে একটি টেবিল ও চেয়ার অনতি দূরে একটি আলনা। সেখানে ঝুলছে দু-একটি শার্ট প্যান্ট কিছু লুঙ্গি ও ফতুয়া। টেবিলের ওপর শোভা পাচ্ছে একটি খোয়াবনামা, একটি এ টি দেবের ইংরাজি অভিধান এবং দু-চারটি ভিন্ন জাতীয় বই। ঘরটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন ক্লাসের সদ্য সমাপ্ত পরীক্ষার খাতা ও কাগজপত্রের অবিন্যস্ত স্তূপ।

উপকরণহীন সেই ঘরে বিমূঢ় হয়ে ওমর বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। তক্তপোশের ওপর দুটি বালিশের নিচে একটি বইয়ের কিছু অংশ বাইরে বেরিয়ে আছে। ওমরের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল সেই বইগুলোর দিকে। বইগুলোর উপড় চোখ বুলাতেই বিদ্যুৎপৃষ্টের মতো অবস্থা হলো ওমরের। তার নিজের চোখ দুটোকেই সে বিশ্বাস করতে পারছে না।

তিনটি বইয়ের একটি কামদেব রচিত_ মধ্যরাতের সুখ, দ্বিতীয়টি রতি দেব রচিত_ আমার কাছে এসো নিশিতে এবং তৃতীয়টি_ সুখদেবের বৌদির অন্তর জ্বালা। একটি বইয়ের পৃষ্ঠা উলটাতেই ওমর দেখতে পেল সেখানে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা রয়েছে মোহাম্মদ বাবর আলী, দশম শ্রেণি, ক্ষিতিশমোহন বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়।

কাঁচাপাকা কেশভর্তি সিক্ত মাথাটিতে তোয়ালে ঘষতে ঘষতে স্নান ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বাবর আলী। বাবর আলীর চোখ পড়ল ওমরের হাতে রক্ষিত বইগুলোর উপড়। ওমর ও বাবর আলী একজন আর একজনের দিকে চেয়ে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ।

এক অসীম নিস্তব্ধতার ঘোমটায় ঢাকল চারপাশ।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.