আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হেনরি কিসিঞ্জারের মানবতাবিরোধী অপরাধ: বাংলাদেশ অধ্যায়


সাংবাদিক খ্রিস্টোফার হিচেন্স তাঁর The Trial of Henry Kissinger বইতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির ফলে সংঘটিত বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী ঘটনার সাথে হেনরি কিসিঞ্জারের সরাসরি সম্পৃক্ততা সংকলিত করেছেন - ভিয়েতনাম যুদ্ধ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ’৭৫ এর সামরিক অভ্যুত্থান, সাইপ্রাসের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মাকারিওসকে হত্যার চক্রান্ত, চিলির সেনাপ্রধান রনে শ্নাইডারকে অপহরণ করে মার্ক্সবাদী রাষ্ট্রপতি সালভাদর এলেন্ডের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান উস্কে দেওয়া, পূর্ব টিমরে গণহত্যা সম্পাদনে ইন্দোনেশীয় সেনাবাহিনীকে সহায়তা প্রদান এবং ওয়াশিংটনে আশ্রয় নেওয়া গ্রিক সামরিক জান্তাবিরোধী এক সাংবাদিককে হত্যাপ্রচেষ্টা। কিসিঞ্জারের ক্রিমিনাল রেকর্ড আসলে আরও অনেক বড়, কিন্তু হিচেন্স বইটিতে শুধু সেসব ঘটনাগুলোতেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন যেগুলোকে আদালতে কিসিঞ্জারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে। বইটিও একটি অভিশংসনের নথির আঙ্গিকে লেখা। কিসিঞ্জারের মানবতাবিরোধী কার্যক্রমের বাংলাদেশ অধ্যায়টি এখানে ভাবানুবাদ করলাম।
আমেরিকার কূটনৈতিক ইতিহাসে মাঝে মাঝে কিছু মানবহিতৈষী কর্মকান্ডের নিদর্শন পাওয়া যায়।

ওসমানী শাসনামলে তুরস্কে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হেনরি মর্গেনথাউ ১৯১৫ সালে দূতাবাস ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন ব্যবহার করে ইতিহাসে প্রথমবারের মত একটি গণহত্যা চিত্রিত করেছিলেন – আর্মেনীয় গণহত্যা। তখনও “জেনোসাইড” শব্দটি প্রণীত হয়নি, মর্গেনথাউয়ের ব্যবহৃত শব্দটি ছিল “race murder”। ১৯৭১ সালে আমেরিকান দূতাবাসের আরেকটি ক্যাবল বার্তায় genocide শব্দটি দেখা গিয়েছিল, ততদিনে শব্দটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। প্রতিবাদমূলক ক্যাবল বার্তাটি পাকিস্তান নামক একটি মুসলমান রাষ্ট্রের বাঙ্গালী অধ্যুষিত পূর্ব উইং হতে প্রেরণ করা হয়েছিল, এই উইংটির আনুষ্ঠানিক নাম “পূর্ব পাকিস্তান” হলেও এর জাতীয়তাবাদি বাসিন্দাদের কাছে “বাংলাদেশ” নামটাই প্রচলিত ছিল। ক্যাবলটির প্রেরণের তারিখ ছিল ৬ এপ্রিল, এবং এর প্রেরক ছিলেন কনসল জেনারেল আর্চার ব্লাড।

এখন আমরা একে “ব্লাড টেলিগ্রাম” নামে জানি।
মর্গেনথাউয়ের মতই বার্তাটি সরাসরি ওয়াশিংটনে প্রেরণ করা হয়েছিল, তবে মর্গেনথাউয়ের বার্তাটির সাথে ব্লাড টেলিগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য ছিল। বার্তাটি কেবল গণহত্যার বিবরণ দেয়নি, একই সাথে এই গণহত্যার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততার প্রতিবাদও জানিয়েছিল। বার্তাটির মূল অংশটি নিম্মরুপ:
আমাদের সরকার গণতন্ত্রের উপর আক্রমণের প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার নৃশংসতার প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

আমাদের সরকার আমাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে, একই সাথে আমাদের সরকার পশ্চিম পাকিস্তানী সরকারকে তোষামোদ করছে ও তাদের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বিরোধী দলীয় নেতাকে(যিনি আবার পশ্চিমা-বান্ধব) গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়ে যেখানে খোদ ইউএসএসআর গণতন্ত্র রক্ষা ও রক্তপাত বন্ধ করার দাবি জানিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের কাছে বার্তা পাঠিয়েছে, সেখানে আমাদের সরকার নিশ্চুপ থেকে নৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রদর্শন করেছে। আওয়ামী লীগের সাথে এই সংঘাত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন ব্যাপার হওয়া বিধায় আমরা হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই অভ্যন্তরীন সংঘাত এখন গণহত্যার নামান্তর হয়ে পড়েছে। আমেরিকান নাগরিকরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারী হিসেবে আমরা আমাদের বর্তমান পলিসির সাথে ভিন্নমত প্রকাশ করছি এবং অবিলম্বে আমাদের প্রকৃত ও দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে আমাদের পলিসি পুনঃনির্ধারণ করার অনুরোধ জানাচ্ছি।


বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক দলের ২০জন সদস্য এই বার্তায় স্বাক্ষর করেছিলেন, স্টেট ডিপার্টমেন্টে পৌছুনোর পর দক্ষিণ এশিয়া ডিভিশনের আরও নয়জন সিনিয়র কর্মকর্তা এতে সই করেছিলেন। ব্লাড টেলিগ্রামের ন্যায় আর কোন ক্যাবল বার্তায় আগে কখনও স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা এত জোড়ালোভাবে স্টেট ডিপার্টমেন্টের পলিসির প্রতিবাদ জানায়নি।
সময়ের প্রয়োজনেই এই টেলিগ্রামটি প্রেরণ করা হয়েছিল। ’৭০ এর ডিসেম্বরে পাকিস্তানী সামরিক শাসকরা এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মত নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার অনুমতি প্রদান করেছিল। বাঙ্গালী-ভিত্তিক সংগঠন আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিব ন্যাশনাল এসেম্বলিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন(পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ১৬৯ আসনে ১৬৭টি আসন জিতেছিল)।

এটা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আধিপত্যের প্রতি পরিস্কার চ্যালেঞ্জ। ১৯৭১ এর মার্চের ৩ তারিখে জাতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। পয়লা মার্চ সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান অধিবেশন বাতিল করলেন। এর প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানে তুমুল বিক্ষোভ ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু হল।
২৫ মার্চ পাক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় আক্রমণ করল।

তারা শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে পাচার করে তাঁর সমর্থকদের গণহারে খুন করতে লাগল। বিদেশী সাংবাদিকদের আগেই শহর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু এই গণহত্যার প্রত্যক্ষ বিবরণী যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস হতে রেডিও ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছিল। আর্চার ব্লাড নিজেই স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও হেনরি কিসিঞ্জারের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের কাছে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন - পাকিস্তানী বাহিনী মেয়েদের একটি ডরমিটরিতে আগুন দিয়ে বাইরে মেশিনগান নিয়ে অপেক্ষা করছিল। মেয়েরা যখন দৌড়ে বের হল, তখন তাদের প্রত্যেককে ব্রাশফায়ার করে মারা হল। এই মেশিনগানগুলো যুক্তরাষ্ট্রই পাকবাহিনীকে সামরিক সহায়তা হিসেবে অনুদান দিয়েছিল।


সাহসী সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাসের বিভিন্ন প্রতিবেদন লন্ডন টাইমস ও সানডে টাইমসে প্রকাশিত হয়েছিল। দমন ও ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ, খুন, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিচ্ছেদ ও শিশুহত্যা সংঘটন করা হয়েছিল। প্রথম তিন দিনেই কমপক্ষে ১০০০০ বেসামরিক নাগরিক খুন হয়েছিলেন। মৃত্যের সংখ্যা সর্বনিম্ম ৫ লাখ দাবি করা হয়েছে, তবে ৩০ লাখ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। যেহেতু প্রত্যেকটি হিন্দু অবধারিতভাবে পাক বাহিনীর রোষানলে পড়ার হুমকিতে ছিলেন(পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরাও অবশ্য রেহাই পাননি), প্রায় ১ কোটি শরণার্থী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

পুরো ব্যাপারটার সারমর্ম হল: ১) প্রথমে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলাফল রদ করা হল ২) একটি গণহত্যার পলিসি বাস্তবায়ন করা হল ৩)একটি অত্যন্ত বিপদজনক আন্তর্জাতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা হল। খুব শীঘ্রই নয়া দিল্লিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিংও প্রতিবাদে সামিল হলেন। তিনি ওয়াশিংটনকে জানালেন যে এই পরিস্থিতিতে পাক আগ্রাসনের বিরুধে নৈতিক অবস্থান নিলে সেটি ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও অনেক কাজে দিবে। ২৯ মার্চে প্রেরিত এক ক্যাবল বার্তাতেই কিটিং ওয়াশিংটনকে হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে ২৫ মার্চের নৃশংসতার ঘটনা গোটা বিশ্বে উন্মোচিত হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে প্রকাশ্যে এই নৃশংসতার জোড়ালো প্রতিবাদ জানানো।
নিক্সন ও কিসিঞ্জার খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিলেন, অর্থাৎ, তাঁরা আর্চার ব্লাডকে ঢাকা হতে প্রত্যাহার করলেন।

নিক্সন ক্ষুদ্ধ হয়ে কিসিঞ্জারকে বলেছিলেন যে রাষ্ট্রদূত কিটিং ভারতীয়দের সাথে হাত মিলিয়েছেন। এপ্রিল মাসে কিসিঞ্জার জেনারেল ইয়াহিয়া খানের “সূক্ষ্মতা ও বিচক্ষণতা” এর প্রশংসা করে একটি কৃতজ্ঞতাবার্তা প্রেরণ করেছিলেন।
আমরা এখন জানি এই জেনারেল নৃশংসতম একটি গণহত্যার জন্য সরাসরি দায়ী হওয়া সত্ত্বেও তাকে কেন এত প্রশ্রয় দেয়া হয়েছিল। ওই এপ্রিল মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের পিংপং দল বেইজিং হতে একটি নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল, চীনারা এই সুযোগে ইয়াহিয়াকে মধ্যস্থতাকারী বানিয়ে নিক্সনের সাথে একটি কূটনৈতিক চ্যানেল খুলেছিল। এই realpolitik এর ছুতোয় নিক্সন-কিসিঞ্জার নিজ দেশের হাতে বাঙ্গালীর রক্তের দাগ লেপটে দিয়েছিলেন।


যারা এখানে realpolitik এর দোহাই দিতে চান, তাদের আরও কিছু তথ্য মাথায় রাখা প্রয়োজন। বেইজিং এবং ওয়াশিংটনের মাঝে অনেক আগে থেকেই একটা ব্যাক চ্যানেল ছিল। এই ব্যাক চ্যানেলের মধ্যস্থতাকারী ছিল Nicolae Ceaușescu শাসিত কমিউনিস্ট রোমানিয়া। কমিউনিস্ট রোমানিয়াও আসলে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় কোন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নয়, তবে অন্তত তখনও কমিউনিস্ট রোমানিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের মত অপরাধী রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি। চীনের Chou En Lai এর সাথে যোগাযোগ করার জন্য ইয়াহিয়া খানকেই যে প্রয়োজন ছিল, তা কিন্তু না।

Chou En Lai যোগাযোগের পূর্বশর্ত হিসেবে ইয়াহিয়া খানকে জুড়ে দেননি। ওয়াশিংটনের এই অভিরুচির একটা ব্যাখ্যা ইতিহাসবিদ Lawrence Lifschultz এর লেখায় পাওয়া যায়: ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলে কিসিঞ্জারের তৎকালীন প্রতিনিধি ছিলেন উইনস্টন লর্ড। এই লর্ড Carnegie Endowment for International Peace এর সদস্য ছিলেন। প্রশাসনের উপরিভাগে যে কৈফিয়ত রচনা করা হয়েছিল সেটা আমরা তাঁর মুখেই শুনি - “আমরা চীনের কাছে নিজেদের নির্ভরযোগ্যতা প্রমাণ করতে চাচ্ছিলাম। আমরা চীনকে দেখাতে চাচ্ছিলাম যে আমরা আমাদের এই পারস্পরিক মিত্রকে সম্মান করি”।

চীনের সাথে দুই দশক ধরে যুদ্ধংদেহী শত্রুতা বজিয়ে রাখার পর পাকিস্তানের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সমর্থন প্রদান করাটা কেমনে মার্কিন সরকারের “নির্ভরযোগ্যতা” এর প্রমাণ হয়, তা কারও কাছেই বোধগম্য হয়নি। সরকারের ভেতরে ও বাইরে অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন যে ওয়াশিংটন স্রেফ ইসলামাবাদকে নিজের পকেটে রাখার জন্য ইয়াহিয়াকে সমর্থন করেছে, এর বেশি কিছু না।
এই গোপন কূটনৈতিক চ্যানেলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুবাদে ইয়াহিয়া খান অনেক ছাড় পেয়েছিলেন যা হয়ত তিনি অন্য পরিস্থিতিতে পেতেন না। তিনি তার তথ্যমন্ত্রীকে বলেছিলেন যে বেইজিং-ওয়াশিংটনের সাথে এই গোপন বোঝাপড়াই তাকে নিরাপদ রাখবে। তথ্যমন্ত্রী G.W. Choudhury পরে লিখেছিলেন, “নিক্সন-কিসিঞ্জারের মিথ্যা আশ্বাস না পেলে ইয়াহিয়া আরও বাস্তববাদী হতেন।

” ইয়াহিয়াকে এভাবে পৃষ্ঠপোষণ করার মাধ্যমে নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি বাঙ্গালী গণহত্যায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছেন।
তবে কিসিঞ্জার শুধু চীনের সাথে যোগাযোগ রক্ষার খাতিরেই লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে – এমনটা ভাবলে ভুল হবে। পরবর্তীতে প্রকাশিত তথ্যের আলোকে এখন এটা পরিস্কার যে নিক্সনের ভারত বিদ্বেষ আর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকানোও কিসিঞ্জারের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। কূটনীতিতে tilt শব্দটার একটা বিশেষ অর্থ আছে – পররাষ্ট্রনীতির যেই সিদ্ধান্তগুলো সরাসরি প্রকাশ করা অত্যন্ত বিব্রতকর, সেগুলোকেই আকারে-ইঙ্গিতে প্রকাশ করাকে “tilt” বলে। এই শব্দটার ব্যুৎপত্তি মূলত এই সময়টাতেই।

’৭১ এর ৬ মার্চে কিসিঞ্জার ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের একটি সভা ডেকেছিলেন, সভায় আগত সবাই আঁচ করতে পেরেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানে একটি বিপর্যয় ঘটতে যাচ্ছে। কিসিঞ্জার এই সভায় কাউকে কোন প্রকার পদক্ষেপ না নিতে অনুরোধ করেছিলেন। কেউ কেউ প্রস্তাব করেছিল যে জেনারেল ইয়াহিয়াকে সাবধান করে দেওয়া উচিত, অর্থাৎ নির্বাচনের ফলাফলকে সম্মান করা উচিত, কিন্তু কিসিঞ্জার সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেন।
জুলাই মাসে চীন থেকে ফিরে কিসিঞ্জার মাওবাদীদের ভাষায় বলতে লাগলেন যে রাশিয়া ও ভারত চক্রান্ত করে পাকিস্তান ভেঙে এর কিছু অংশ ভারতে সংযুক্ত করার পায়তারা করছে, যাতে চীন পাকিস্তানের পক্ষ নিতে বাধ্য হয়। এই উদ্দেশ্যে তিনি এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার USS Enterpriseকে কোন মিশন স্টেটমেন্ট ছাড়াই ভিয়েতনাম হতে বঙ্গোপসাগরে প্রেরণ করার জন্য এডমিরাল এলমো জুমওয়াল্টকে রীতিমত জ্বালাতন করেছিলেন, কিন্তু সিআইএ এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের কোন বিশ্লেষক এই অদ্ভুত ভবিষ্যদ্বানী সমর্থন করতে রাজি হয়নি।

সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের একটি সভায় কিসিঞ্জার এ নিয়ে বিষোদগার করেছিলেন, “প্রেসিডেন্ট আমাকে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকতে বলছেন, অথচ আমি যত প্রস্তাবনা পাচ্ছি সবই বিপরীত দিকে ঝুঁকছে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি যেন একটা পাগলাগারদে আছি। ” নিক্সনের হোয়াইট হাউজ অবশ্য পাগলাগারদ হওয়ার পথেই হাটছিল, কিন্তু কিসিঞ্জারের শ্রোতারা কেবল তখন এটা লক্ষ করেছিলেন যে ওয়াশিংটনের চক্রান্ত করার ভাষায় একটি নতুন শব্দ যুক্ত হয়েছে – “tilt”।
The President always says to tilt towards Pakistan
আর কিছু না হলেও এটা অন্তত সত্য। “চীন কূটনীতি” শুরু করার অনেক আগে, এমনকি সমাজতন্ত্রী চীনের বিরুদ্ধে বাক্যবাণ হানার সময়ও নিক্সন ভারত সরকারের প্রতি ঘৃণা এবং পাকিস্তানের প্রতি কোমলতা প্রকাশ করতেন।

নিক্সনের অনেক জীবনচরিত লেখক ও কিসিঞ্জারের মত ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরাও লক্ষ করেছিলেন যে নিক্সন ব্যক্তি ইন্দিরা গান্ধীকে ঘৃণা করতেন। ইন্দিরাকে তিনি “that bitch” বলে অভিহিত করতেন, একবার হোয়াইট হাউজে তাঁর কক্ষের বাইরে ইন্দিরাকে টানা ৪৫ মিনিট অপেক্ষমান রেখেছিলেন। মূলত পন্ডিত নেহেরুর সূত্রেই নিক্সন ইন্দিরাকে ঘৃণা করতেন। নেহেরু সমর্থিত মাকারিওস, টিটো এবং সুকর্ণ প্রভৃতি Non-Aligned Movement নেতৃবৃন্দদেরও তিনি ঘৃণা করতেন। চীনের সাথে সংলাপে ইয়াহিয়া ভূমিকা না রাখলেও নিক্সন তবুও ইয়াহিয়াকেই পৃষ্ঠপোষণ করতেন।


কিসিঞ্জার সেক্রেটারি অব স্টেট হওয়ার পর আওয়ামী লীগ প্রধান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার জনক শেখ মুজিবের প্রতি যে মনোভাব প্রদর্শন করেছিলেন, তাতেও নিক্সন প্রশাসনের এই বাংলাদেশ-বৈরী মনোভাব প্রস্ফুটিত হয়। বাংলাদেশ ইস্যুকে কিসিঞ্জার যেভাবে পরিচালনা করেছিলেন তার জন্য তাকে মিডিয়াতে তীব্রভাবে সমালোচিত হতে হয়েছিল, চীনের সাথে কূটনীতিতে তার আপাতঃ সাফল্য এই সমালোচনার ভারে চাপা পড়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশীদের এবং তাদের নেতাকে তিনি ঘৃণা করতে শুরু করেছিলেন, এমনকি তিনি মুজিবকে চিলির রাষ্ট্রপতি সালভাদর এলেন্দের সাথেও তুলনা করেছিলেন।
১৯৭৩ সালে সেক্রেটারি অব স্টেট হয়েই তিনি ’৭১ এ ব্লাড টেলিগ্রামে স্বাক্ষরকারী সব কর্মকর্তার পদোবনতি করলেন। এরপরে ’৭৪ এ মুজিব যখন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ওয়াশিংটনে সফররত ছিলেন, তখন তিনি একাধিকবার মুজিবকে বেকায়দায় ফেললেন।

ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট ফোর্ড মুজিবের সাথে ১৫ মিনিট আলোচনা করেছিলেন, কিসিঞ্জার সেই আলোচনায় উপস্থিত থাকতে অস্বীকৃতি জানালেন। কিসিঞ্জারের বন্ধুপ্রতিম ইয়াহিয়া খানের হাতে বিধ্বস্ত দেশটিকে বাঁচানোর জন্য মুজিব দেনা মওকুফ ও জরুরিভিত্তিতে ত্রাণ সহায়তা প্রার্থনা করেছিলেন, কিসিঞ্জার সেটারও বিরোধীতা করলেন। কিসিঞ্জারের সহকারী রবার্ট মরিসকে উদ্ধৃত করি: “কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সম্পর্কিত সবকিছুতে হাত গুটিয়ে রাখার পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। যেহেতু তারা আমাদের মিত্ররাষ্ট্র হতে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছে, তাহলে তারা নিজেরাই নিজেদের দেখভাল করুক। ” এই সময়টাতেই কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে “তলাবিহীন ঝুড়ি” আখ্যা দিয়েছিলেন।

সেই সময়ে কথাটির মধ্যে যতটুকু সত্যতা ছিল, তার জন্য কিসিঞ্জার পুরোভাগে দায়ী ছিলেন।
’৭৪ এর নভেম্বরে কিসিঞ্জার মুখ রক্ষা করার জন্য ওই অঞ্চলে সফর করেছিলেন। বাংলাদেশে ৮ ঘন্টা যাত্রাবিরতিতে ৩ মিনিটের একটি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে তিনি ব্যাখ্যা করতে রাজি হননি কেন তিনি ’৭১ এ বঙ্গোপসাগরে USS Enterprise প্রেরণ করেছিলেন। আমরা এখন জানি সেদিন বাংলাদেশ ত্যাগ করার কয়েক সপ্তাহ পরেই ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে কিছু বাংলাদেশী সেনা কর্মকর্তা মুজিবের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করার চক্রান্ত করছিল। ’৭৫ এর ১৪ আগস্ট মুজিব সহ তাঁর পরিবারের চল্লিশ জন সদস্যকে এক সামরিক অভ্যুত্থানে খুন করা হয়।

মুজিবের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদেরকে কয়েক মাস পর কারাগারে বেয়নেট চার্জ করে খুন করা হয়।
ওই একই সময়ে সিনেট ফরেন রিলেশন্স কমিটি তৃতীয় বিশ্বে সিআইএর গুপ্তহত্যাবৃত্তি ও অপতৎপরতা নিয়ে তদন্ত করছিল। তখনও আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতির two track পন্থাটা প্রকাশিত হয়নি। এটা এমন একটা পন্থা যেখানে দূতাবাসের গোয়েন্দা ও সামরিক কর্মকর্তারা রাষ্ট্রদূতের অগোচরে ওয়াশিংটন হতে গোপন প্রাপ্তাধিকারবলে গোয়েন্দা ও সামরিক তৎপরতা পরিচালনা করেন। অর্থাৎ, একই দূতাবাসে প্রকাশ্যে ও গোপনে দু’টো সমান্তরাল প্রশাসন কাজ করে।

সালভাদর এলেন্দেকে গুপ্তহত্যা প্রচেষ্টার সময় চিলির মার্কিন দূতাবাসে এই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল, রাষ্ট্রদূত এড কোরি এই ব্যাপারে অন্ধকারে ছিলেন। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের Lawrence Lifschultz গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে বাংলাদেশেও একটি two track পন্থা অবলম্বন করা হয়েছিল।
মুজিবকে কতল করে তরুণ সামরিক কর্মকর্তারা যেই লোককে রাষ্ট্রপতির আসনে বসিয়েছিল, সেই খোন্দকার মোশতাক আওয়ামী লীগের ডানপন্থী অংশের নেতা ছিলেন। তিনি অনেক কষ্ট করে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে এই অভ্যুত্থান সম্পর্কে তিনি কিছুই জানতেন না; তাঁর দাবি মতে ফারুক-রশিদ ও অন্যান্য খুনীদের নেতৃত্বাধীন তিন শত জওয়ান সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে এই হত্যাযজ্ঞ সংঘটন করেছিল। তিনি এও দাবি করেছিলেন যে ওই সেনা কর্মকর্তাদের আগে তিনি কখনওই দেখেননি।

এই অস্বীকৃতিগুলো আসলে আনুষ্ঠানিক আচার, এটিকেটের অংশ। বিশ্বের কোথাও রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ঘটার পর ওয়াশিংটন যখন বিবৃতি দেয় যে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও সর্বশক্তিমান গোয়েন্দাসংস্থা অমুক বা তমুক ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানে না, সেটাও আসলে এই আনুষ্ঠানিক আচারেরই অংশ। মুজিবহত্যার পর প্রোটোকল মেনে ওয়াশিংটন ওই একই বিবৃতি প্রদান করেছিল।
এই হত্যাযজ্ঞের অফিশিয়াল গল্পটা একটু নাড়াচাড়া করলেই ভেঙে পড়ে। অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে এন্থনি মাসকারেনহাসের সাথে সাক্ষাৎকারে মেজর রশিদ স্বীকার করেছিলেন যে তারা মোশতাকের সাথে অভ্যুত্থানের অনেক আগেই সাক্ষাত করেছিলেন, এমনকি অভ্যুথানের কয়েকদিন আগেও সাক্ষাৎ করেছিলেন।

বস্তুত, মুজিব হত্যার ছয় মাস আগে এক উর্ধ্বতন বাঙ্গালী সেনা কর্মকর্তার সাথে মোশতাকের গোপন বৈঠকের প্রমাণ আছে। ২০০০ সালের ডিসেম্বরে একটি বাংলাদেশী কোর্টে এই খুনীদেরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। দণ্ডপ্রাপ্তদের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রিত হওয়ায় দণ্ড বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কোন সাধারণ বাঙ্গালী অভিবাসীর পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে এরুপ আশ্রয় লাভ করা সম্ভব নয়।
তবে ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বুস্টার জানতেন যে দূতাবাসে একটি সম্ভাব্য অভ্যুত্থান নিয়ে আলোচনা চলছে।

তিনি এও জানতেন যে সিআইএর অপতৎপরতা নিয়ে কংগ্রেসের তদন্তের ফলে অনেক অসতর্ক পররাষ্ট্র কর্মকর্তার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়েছে। তিনি তৎক্ষণাৎ সেনাকর্মকর্তাদের সাথে তার দূতাবাসের সব প্রকার যোগাযোগ রদ করার নির্দেশ দিলেন। ১৪ আগস্টের অভ্যুত্থানে তিনি সঙ্গত কারণেই অত্যন্ত আতংকিত হয়েছিলেন; যেসব ব্যক্তিবর্গের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করার জন্য তিনি আনুষ্ঠানিক নির্দেশ দিয়েছিলেন, ঠিক সেসব ব্যক্তিবর্গই অভ্যুত্থান সংঘটন করার কথা স্বীকার করেছে। দূতাবাসের সূত্রের মাধ্যমে Lifschultz পরে আশ্বস্ত হয়েছিলেন যে - ১) দূতাবাসের কর্মকর্তাদের কাছে অভুত্থানকারীরা সাহায্যের জন্য এসেছিল এবং দূতাবাসের কর্মকর্তারা মোটেই তাদেরকে নিরুৎসাহিত করেনি ২) রাষ্ট্রদূত বুস্টার পরে বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর অগোচরে সিআইএ কর্মকর্তারা অনেক দিন ধরেই ওয়াশিংটনের সাথে ব্যাক চ্যানেলে যোগাযোগ করে আসছে। ১৯৭৮ সালে Lifschultz ঢাকার সিআইএ স্টেশনের তৎকালীন প্রধান ফিলিপ চেরির একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন।

চেরি সিআইএ স্টেশনে দায়িত্ব পালন করার কথা এড়িয়ে গিয়েছিলেন, তবে তিনি একটা আগ্রহোদ্দীপক কথা বলেছিলেন - “আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে কিছু কিছু রাজনীতিবিদ প্রায়ই দূতাবাসের শরণাপন্ন হন, এবং দূতাবাসে তাদের হয়ত কিছু লিংকও থাকে। আবার অনেক সময় এসব রাজনীতিবিদরা ভুলবশঃত মনে করেন যে তাদের লিংক আছে, যদিও বাস্তবে দূতাবাস হতে তাদেরকে সহায়তা করার কোন পরিকল্পনা থাকে না। ” এখানে লক্ষণীয় যে ফিলিপ চেরি তাঁর বক্তব্যে সুনির্দিষ্টভাবে “রাজনীতিবিদ” শব্দটি ব্যবহার করেছেন, “অফিসার” ব্যবহার করেননি। বলা বাহুল্য, যেসব রাজনীতিবিদ বিশ্বাস করেন যে দূতাবাসে তাদের লিংক আছে, দূতাবাস সেই বিশ্বাসভঙ্গে উদ্যত না হলে তারা সেই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তী কর্মকান্ড পরিচালনা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সাথে, বিশেষ করে খোদ হেনরি কিসিঞ্জারের সাথে তার সংযোগ থাকার ব্যাপারটা খোন্দকার মোশতাক কেবল “বিশ্বাস” করতেন না, তার আসলেই সেই লিংক ছিল।

সেই ’৭১ থেকেই তাদের মাঝে যোগাযোগ ছিল। বাংলাদেশে কিসিঞ্জারের পলিসির বিরুদ্ধে মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের অভূতপূর্ব প্রতিবাদের পর ’৭৩ সালে Carnegie Endowment for International Peace(Foreign policy সাময়িকীটির প্রকাশক) মার্কিন সরকারের ’৭১ এর গণহত্যাকারীদের পক্ষাবলম্ববন করা নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিল। স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও সিআইএ’র দেড় শতরও বেশি উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সাক্ষাৎকার প্রদানে সম্মত হয়েছিলেন। গবেষণাটির তত্ত্বাবধানে ছিলেন কিসিঞ্জারের প্রাক্তন সহযোগী রজার মরিস। কার্নেগিতে অভ্যন্তরীন মতপার্থক্যের কারণে এই নয় মাসব্যাপী গবেষণার ফলাফল কখনও প্রকাশ করা হয়নি, তবে Lifschultz গবেষণাটি হাতে পেয়েছিলেন।

সেখান থেকে নিঃসন্দেহে নিম্মের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।
’৭১ এ হেনরি কিসিঞ্জার নির্বাচনে জয়লাভ করা আওয়ামী লীগের মাঝে অন্তঃকোলহ উস্কে দিয়ে তাদের স্বাধীনতার দাবিকে প্রশমিত করতে চেয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি নিজেই খোন্দকার মোশতাকের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং মোশতাকদের ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে স্বাধীনতার মূল দাবিটি বিসর্জন দেওয়ার জন্য প্রণোদনা দিয়েছিলেন। সম্প্রতি প্রকাশিত “Memorandum for the Record” নামক এক নথিতে ’৭১ এর ১১ আগস্টে নিক্সন, কিসিঞ্জার এবং অন্যান্যদের মাঝে একটি সভার ব্যাপারে আমরা জানতে পারি। আন্ডারসেক্রেটারি অব স্টেট জন আরউইন জানাচ্ছেন, “আমরা সম্প্রতি জানতে পেরেছি যে কলকাতায় কিছু আওয়ামী লীগ নেতা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার দাবি প্রত্যাহার করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া খানের সাথে সংলাপের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

” এখানে ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞের পর কলকাতায় অবস্থান নেওয়া প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কথা বলা হচ্ছে, এবং কতিপয় আওয়ামী নেতার ইয়াহিয়া খানের সাথে সংলাপে বসার অভিপ্রায় প্রকাশ করাটা পরিস্কারভাবেই প্রবাসী সরকারকে কূটাঘাত করার একটি চক্রান্ত। এই নাদান পদক্ষেপের ফলাফলে মোশতাক অকটোবার মাস হতে গৃহবন্দী হন, এবং এক দশক পর নয়া দিল্লির দূতাবাসে প্রতিস্থাপিত রাজনৈতিক কর্মকর্তা জর্জ গ্রিফিনকে অপ্রত্যাশিত ঘোষণা করা হয়।
সামরিক অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাকারীরা Lifschultzকে জানিয়েছিল যে তারা নিজেরাও একটি two track পলিসি অনুসরণ করছিল। বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত হওয়া তরুণ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আরেকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন যিনি অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুত হলেও কিছুটা সংশয়ী ছিলেন – তিনি হলেন জিয়াউর রহমান, দেশটির ভবিষ্যত স্বৈরশাসক। এই দু’টো গোষ্ঠীই স্বীকার করেছে যে তারা আগেই দূতাবাস হতে আশ্বাস পেয়েছিল যে মুজিবকে হটানো “কোন সমস্যা না”।

Lifschultz এর হয়ে ঘটনাটির তদন্ত করা হাউজ ফরেন এফেয়ার্স কমিটির কংগ্রেসম্যান স্টিফেন জে. সোলার্জ পরে এটি আংশিক নিশ্চিত করেছিলেন। ১৯৮০ সালের জুন ৩ তারিখে লেখা একটি পত্রে তিনি বলেন:
মুজিব সরকারের প্রতিপক্ষদের সাথে ’৭৪ এর নভেম্বর হতে ’৭৫ এর জানুয়ারী পর্যন্ত্য দূতাবাসে সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘটনাসমূহ স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবারও অস্বীকার করেনি।
পত্রটিতে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, “তবে ডিপার্টমেন্ট দাবি করেছে যে মুজিবকে তারা এই সভাগুলোর ব্যাপারে অবহিত করেছিল এবং একটি সম্ভাব্য অভ্যুথানের ব্যাপারে সাবধানও করেছিল। ” স্টেট ডিপার্টমেন্টের এই পরোক্ত দাবিটি আগে কখনও করা হয়নি, আর যখন প্রথমবারের মত এই দাবি করা হয়েছে তার অনেক আগেই মুজিব অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন, তাই মুজিবের ভাষ্য শুনে এই দাবির সত্য-মিথ্যা নির্ণয় করারও কোন উপায় ছিল না। এই দাবিটি অত্যন্ত সন্দেহজনক হলেও দূতাবাসে গোপন আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে স্টেট ডিপার্টমেন্টের পরোক্ষ স্বীকারোক্তি অনেক বেশি শক্তিশালী।


এই ঘটনায় সিআইএর সম্পৃক্ততার প্রশ্নগুলো কংগ্রেসম্যান সোলার্জ Permanent Select Committee এর কংগ্রেসম্যান লেস এসপিনের কার্যালয়ে ফরওয়ার্ড করেছিলেন। এই কমিটির হাতে সিআইএর গোপন ক্যাবল বার্তাগুলো উত্তোলন করার ক্ষমতা ছিল। তবে সোলার্জের চিঠি যেকোন কারণেই হোক কংগ্রেসম্যান এসপিনের কার্যালয়ে পৌছেনি, আর তার কিছুকাল পরেই ওয়াশিংটনে নতুন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যানের আগমন ঘটায় এই তদন্তের আর অগ্রগতি হয়নি। সমন জারি করার ক্ষমতাসম্পন্ন কোন কংগ্রেশনাল কমিটি ঘটনাটি পুনঃতদন্ত করলে হয়ত ওয়াশিংটনের সাথে অভ্যুত্থানকারীদের সরাসরি সংযোগ নির্ধারণ করা যাবে। এছাড়াও ’৭১ এ গণহত্যার কূটনীতি আর ’৭৫ এর অভ্যুত্থানের কূটনীতিতে ওয়াশিংটনের ভূমিকা নিয়ে প্রচুর নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে।

তবে অফিশিয়াল যোগাযোগের দালিলিক প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত্য এই সংযোগ ভুল প্রমাণ করার দায়িত্বটা তাদের উপরই বর্তায় যারা এসব কিছুকে স্রেফ “কোইনসিডেন্স” বলে উড়িয়ে দিতে চায়।
টীকা:
realpolitik - মতাদর্শ কিংবা নৈতিকতার বদলে ক্ষমতা ও বৈষয়িক বিবেচনাকে ভিত্তি করে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পলিসি প্রণয়ন করা।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.