আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভাগ্য।

প্রবাসী


কোলকাতার নাম করা সার্জন ডাঃ সুবোধ চন্দ্র সেন। চিকিৎসা শাস্ত্রে যেমনি তার দখল তেমনি তার অপরেশানের হাত। লন্ডন থেকে কৃতিত্বের সাথে এফ,আর,সি,এস পাস করে এসে পিজি হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৮০ সালে। তারপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয় নি তাকে। ক্রমে ক্রমে খ্যাতির শিখরে পৌছেছেন ডাঃ সেন।

নিখিল ভারত সোসাইটি অফ সার্জনস এসোসিয়েশানের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বেশ কয়েকবার। দেশ বিদেশের বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়ামে, আন্তর্জাতিক প্রকাশনায় ভারত বর্ষের প্রতিনিধি বলতেই বোঝাত ডাঃ সেনকে। কোলকাতার পোস্ট গ্রাজুয়েট হাসপাতালের সার্জারীর অধ্যাপক পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছেন কয়েক বছর। সল্ট লেকের নিজের বাড়িতেই তৈরী করেছেন বিশাল হাসপাতাল। যেমন নামডাক সে হাসপাতালের তেমনি খরচ সেখানে।

মা মমতাময়ী দেবীর নাম অনুসারে তার হাসপাতালের নাম রেখেছেন “ মমতাময়ী সার্জিকাল হাসপাতাল এবং পলি ক্লিনিক। ক্যান্সার সার্জারীতে ডাঃ সেনের জুড়ি মেলা ভার। কোলকাতাতে লোকমুখে প্রচলিত আছে যে যাদু আছে ডাঃ সেনের হাতে। শুধুমাত্র কোলকাতা কেন ভারতের অনান্য শহর নগর থেকে রোগীরা এসে উপস্থিত হয় তার হাসপাতালে। ডাঃ সেনের মনে আছে অবসর নেওয়ার পরদিনই স্বয়ং রতন টাটা তাকে টেলিফোনে অনুরোধ জানিয়েছিলেন মুম্বাইয়ের টাটা ক্যান্সার হাসপাতালের সার্জারী বিভাগের দায়িত্ব নিতে।

সে প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে কোলকাতাতেই থেকে গেছেন তিনি। জটিল বা কঠিন অপারেশান হলেই রোগীরা চোখবুজে চলে আসেন ডাঃ সেনের হাসপাতালে। এখন বয়স হয়েছে ডাঃ সেনের । অধীনস্থ ডাক্তারেরাই দেখাশোনা করেন হাসপাতালের । অবসর নেওয়ার পর থেকে ক্রমে ক্রমে রোগী দেখা, অপারেশান করা কমিয়ে দিয়ে এখন সপ্তাহে দুই দিন মাত্র রোগী দেখেন ,অপারেশান করেন কচিত কদাচিৎ।

হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারদের রেফার করা ছাড়া রোগী দেখেন না তিনি। অধীনস্থ ডাক্তারদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া আছে এ ব্যাপারে। রোগী দেখা বা অপারেশানের ক্ষেত্রে তার একমাত্র দুর্বলতা হল বাংলাদেশ। রোগীর বাড়ী বাংলাদেশে হলেই তার সাত খুন মাফ। এ দুর্বলতার কারন হল তার বাবার বাড়ী ছিল নড়াইলের নলদী গ্রামে।

ইদানীং ডাক্তার সেন লক্ষ্য করেছেন বাংলাদেশ থেকে আসা রোগীর পরিমান ক্রমশঃ বাড়ছে। ফলে সে দুর্বলতাতেও কাটছাট করতে হয়েছে তাকে। আগে যেখানে বাংলাদেশে বাড়ী হলেই তাকে দেখানো যেত এখন সেখানে অপেক্ষা করতে হয় কয়েক মাস ।

ঢাকার পিজি হাসপাতাল এবং অনান্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরা জবাব দিয়ে দিয়েছেন রশীদকে । শেষ চেস্টা হিসেবে কোলকাতায় ডাঃ সেন এর হাসপাতালে এসেছে রশীদ।

পর পর দু সপ্তাহ ধরে চেস্টা করেও কোন কুল কিনারা করতে পারে নি সে, ডাক্তার সেনকে দেখানো সম্ভব হয় নি। দেখানোর সবচে’ কাছের যে তারিখ পাওয়া গেছে, তাও দুই মাস পর। ক্রমশঃ খারাপ হচ্ছে রশিদের অবস্থা। আজ সোমবার ডাঃ সেনের রোগী দেখার দিনে শেষ চেস্টা করতে এসেছে রশীদ। রিসিপসানিস্টের একই উত্তর ‘দু মাস পরে আসুন।

বেয়ারাকে ধরাধরি করে ডাঃ সেনের কাছে ছোট চিরকুট পাঠাতে পারল রশীদ। এখানে চিকিৎসা হয়ে যাওয়া পাশের গ্রামের ইসমাইলের কাছ থেকে রশীদ শুনেছে বাংলাদেশের ব্যাপারে ডাঃ সেনের দুর্বলতা আছে। রশীদের চিরকুটে লেখা - রোগীর নাম- আঃ রশীদ, গ্রাম-নলদী, জেলা-নড়াইল, বাংলাদেশ। ডাঃ সেনের হাতে পড়ার মুহুর্ত থেকেই বদলে গেল সব কিছু। সহকারী ডাক্তারকে ডেকে এনে ডাঃ সেন আদেশ দিলেন ঠিক পরের রোগী হিসেবে রশিদকে নিয়ে ভেতরে আসতে।

দেখেশুনে অনতিবিলম্বে রশিদকে ভর্তি করে অপারেশানের ব্যাবস্থা করতে আদেশ দিলেন সহকারীকে। হাসপাতালে সীট খালি নেই, তবে কাল একটা সীট খালি হবে , কিন্তু রশীদের আগে আরো দশ পনেরজন রোগী ভর্তির জন্য অপেক্ষমান – জানাল সহকারী। রশিদকে নিজের বাড়ীতে থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা এবং পরদিনই ভর্তি করে অপারেশানের ব্যাবস্থা করতে সহকারীকে নির্দেশ দিলেন ডাঃ সেন। ডাঃ সেনের বাড়িতে অতিথি হিসেবে জায়গা পেল রশীদ। এত ভাল বাড়িতে থাকা খাওয়া ছিল রশীদের স্বপ্নের অতীত।



পরদিনই রশীদের অপারেশান হল। অপারেশানে রশীদের খরচ হল দশ ভাগের এক ভাগ। নিজে অপারেশান করলেন ডাঃ সেন। সম্পূর্ন সুস্থ্য হয়ে যাওয়ার পর আরো দুই দিন রশীদকে নিজের বাড়িতে রেখে দিলেন ডাঃ সেন। দেশে ফেরার দিন মঙ্গল বার ডাঃ সেন এর অবসরের দিন।

সকালে ডাইনিং টেবিলে রশীদকে নিয়ে খেতে বসে আপনজন ,দেশের মানুষকে পেয়ে ছেলে মানুষের মত প্রশ্ন করা শুরু করলেন ডাঃ সেন ‘গ্রামের নদীতে এখন আগের মত জল হয় কিনা বর্ষাকালে, স্কুলের পাশের দেবদারু গাছটা এখনো আছে কিনা, উত্তর পাড়ার খেলার মাঠে এখনো ফুটবল, হাডুডু দাড়িয়াবাধা খেলা হয় কিনা, বাজারের কালিপদ সাহার দোকান ঠিক আছে কিনা ইত্যাদি। যথা সম্ভব উত্তর দিল রশীদ।

স্মৃতি চারন শুরু করলেন ডাঃ সেন। বাবা সুব্রত সেন ছিলেন এল,এম এফ,ডাক্তার। প্রাক্টিস করতেন নলদী থেকে অল্প দুরের মহকুমা শহর নড়াইলে।

সুবোধ সেনের ছোট বেলা কেটেছে গ্রামে। নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এম,বি,এস পাশ করেন ‘৭০ সালে। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের বছরের মার্চ এর ২৮ তারিখ রাজশাহী মেডিকেল কলেজে হামলা চালালো খান সেনারা । প্রানভয়ে পালালেন ইন্টার্নী ডাক্তার সুবোধ। চলে এলেন নিজের গ্রাম নলদীতে।

বাবা তখনো নড়াইলে প্রাক্টিস করেন। এপ্রিলের গোড়ার দিকে খান সেনারা নড়াইলের দিকে এগিয়ে এলে গ্রামের বাড়িতে চলে এলেন বাবা ডাঃ সুব্রত সেন। পরিস্থিতি ক্রমশঃ খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রান বাঁচাতে ভারতে চলে যেতে হবে অন্য সবার সাথে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন বাবা সুব্রত সেন। সেদিনই বিকেলে বাজার থেকে গফুর রাজাকার সুব্রত বাবুকে ধরে নিয়ে গেল নড়াইলে।

আর ফেরেননি তিনি। প্রতিবেশী হাসেম ভাই সুবোধকে আর দেরী না করে ভারতে পাড়ি জমানোর অনুরোধ করলেন। মাকে সাথে নিয়ে নৌকায় করে সবে মাত্র নদী পার হয়েছেন সুবোধ , গফুর রাজাকার দলবল নিয়ে এসে হামলা চালাল সুবোধদের বাড়িতে। নদীর ওপারের গাছের আড়াল থেকে সুবোধ দেখলেন তাদের বাসন কোষন আসবাবপত্র সব লুট করে নিয়ে যেতে। নিতান্ত অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে দেখলেন তাদের বাড়ী দাউ দাউ করে জ্বলছে।

নদীর ওপারের বাগানের মধ্যে মাকে নিয়ে দিনের বাকী সময় টুকু কাটিয়ে রাতের অন্ধকারে পায়ে হেটে পাড়ি জমালেন ভারতের দিকে। কখনো পায়ে হেটে, কখনো নৌকোয় করে দালালদের সহায়তায় সীমান্ত অতিক্রম করে কোলকাতার গড়িয়ার মামা বাড়িতে প্রান নিয়ে পৌছতে পারলেন সুবোধ এবং মা। বাংলাদেশ স্বাধীন হল। মামারা সুবোধদের ফিরতে দিলেন না। এম,বি,বি, এস ডিগ্রী থাকার সুবাদে চাকরিও পেয়ে গেলেন ডাঃ সুবোধ।

সেই থেকে কোলকাতাতেই রয়ে যাওয়া।

আর শুনতে পারছিল না রশিদ। এবার ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল রশিদ। রশিদ তো রাজাকার গফুরেরই ছেলে। ডাঃ সেন স্বান্তনা দিলেন রশীদকে “ কান্নাকাটি করোনা রশিদ, শান্ত হও, যা হওয়ার তা তো হয়েছে, তাতে তো তোমার আমার কারোরই হাত ছিলনা ।



ডাঃ সেনকে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে বেরিয়ে এল রশিদ। ফেরার পথে বার বার তার মনে হচ্ছিল এর চেয়ে অপরেশান টেবিলে জ্ঞান না ফিরলেই মনে হয় ভাল হত। দেশ ভাগ না হলে , আব্বা যদি ডাঃ সুব্রতকে খুন না করতেন, যদি আব্বা লুটপাট করে তাড়িয়ে না দিতেন, ডাঃ সুবোধ তো হতেন তাদেরই গর্ব , কস্ট করে ভিনদেশে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হত না তাদের। সবই ভাগ্য, কিন্তু কোন অবস্থাতেই তা সৌভাগ্য নয়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।