আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খুনের বছর ২০১৩

খুন আর খুন। পুরো ২০১৩ সালই ছিল রীতিমতো খুনের বছর। বছরের প্রায় প্রতিটি দিনই রক্তের হোলি খেলেছে দুর্বৃত্তরা। পিছিয়ে ছিলেন না আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরাও। রাজনৈতিক সহিংতা দূরীকরণের নামে গুম, ক্রসফায়ার আর অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে মানুষ হত্যা করে ওই হোলি খেলায় অংশ নিয়েছিলেন তারাও।

সর্বোচ্চ নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিলেও ঘরে-রাইরে এমনকি বেডরুমেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে সাধারণ মানুষ। ঘর থেকে বের হয়ে সুস্থভাবে পুনরায় ফিরতে পারবে কি না এমন আশঙ্কায় দেশবাসীর কেটেছে প্রতিটি মুহূর্ত। বেডরুমও ছিল অরক্ষিত। এর সর্বশেষ উদাহরণ ২৫ ডিসেম্বর। ওইদিন সকালে রাজধানীর পশ্চিম রামপুরার বাসায় বেডরুমেই খুন হন একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রবীণ ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমদ।

এর ঠিক চার দিন আগেই রাজধানীর গোপীবাগে একটি বাসায় চাঞ্চল্যকর সিঙ্ মার্ডারের ঘটনা ঘটে। এভাবে বছরের শুরুতে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে রাজধানীতে ব্লগার আহমেদ রাজীব, পুলিশ কর্মকর্তা মাফফুজুর রহমান দম্পতি, যুবলীগ নেতা মিল্কি, নারায়ণগঞ্জে ত্বকি, শেষ দিকে পটুয়াখালীর গলাচিপায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসক ডা. মাকলুকুর রহমান হত্যাকাণ্ড রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি করে। এসব আলোচিত হত্যাকাণ্ড ছাড়াও বছরজুড়েই গুম-গুপ্তহত্যার ঘটনা ছিল অহরহ। নদী, ডোবা, সড়কের পাশ ও ডাস্টবিন থেকে মৃতদেহ আর খণ্ড খণ্ড হাড়গোড় উদ্ধার দেশের আইনশৃঙ্খলার অসহায় অবস্থা তুলে ধরে। বিশেষ করে বছরের শেষ দিকের রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে চরম উদ্বেগের মধ্যে সময় পার করে মানুষ।

রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হয়ে কেবল এক দিনেই সারা দেশে ১৪টি তাজা প্রাণ ঝরেছে এমন ঘটনাও ঘটেছে ১৫ ডিসেম্বর। অস্বাভাবিক মৃত্যুও ২০১৩ সালে রীতিমতো স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে পরিণত হয়। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান মতে, চলতি বছর গত ১১ মাসে সারা দেশে খুন হয়েছে ৩ হাজার ৯৮৬ জন। ওই হিসেবে গড়ে প্রতিদিন খুন হয়েছে ১২ জন। ২০১২ সালে একই সময়ে খুনের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৮২১টি।

তবে গত চার মাসে এ সংখ্যা প্রতিদিনে ১৪ জন ছাড়িয়েছে। ২০১২ সালে প্রতিদিন গড়ে খুনের সংখ্যা ছিল ১১টি। মানবাধিকার কর্মী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলের আশঙ্কায় বছরের শেষ দিকে এসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তাই খুনাখুনিসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনা বাড়িয়ে দিয়েছে। সামাজিক-পারিবারিক অবক্ষয় থেকেও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

তবে এ তথ্য মানতে নারাজ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার। তিনি জানান, দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে ছিল। হত্যাকাণ্ডসহ সব অপরাধের ঘটনায় মামলা হয়েছে, আসামিদেরও আইনের আওতায় আনা হয়েছে। শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি বিবেচনা করা যাবে না। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হয়েছে ৪৯২ জন।

৮১৯টি রাজনৈতিক সহিংসতায় আহত হয়েছে ২২ হাজার মানুষ। প্রায় ৪ হাজারের অধিক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে আলোচিত কয়েকটির চিত্র তুলে ধরা হলো। ব্লগার রাজীব হত্যাকাণ্ড : ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে মিরপুরের পলাশনগরে বাসার সামনে ব্লগার রাজীব হায়দার শোভনকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ১৪ দিন পর ১ মার্চ ডিবি পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ (২২), মাকসুদুল হাসান অনিক, এহসান রেজা রুম্মান, নাঈম সিকদার ইরাদ ও নাফিস ইমতিয়াজকে গ্রেফতার করে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী হত্যায় ব্যবহৃত চাপাতি, চারটি ছোরা ও একটি বাইসাইকেল উদ্ধার করা হয়।

গ্রেফতারকৃতরা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। মামলার তদারককারী ডিবি পুলিশের এসি তৌহিদুল ইসলাম জানান, রাজীব হত্যার সঙ্গে জড়িতরা আল-কায়েদার একাংশের নেতা আনোয়ার উল্লাহ আওলাকির বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন। নারায়ণগঞ্জে ত্বকি হত্যাকাণ্ড : ব্লগার রাজীব হত্যাকাণ্ডের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই ৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে মেধাবী ছাত্র ত্বকির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার দুই দিন আগে ত্বকি রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছিল। সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের একমাত্র পুত্র আজমীরি ওসমানের টর্চার সেলে ত্বকিকে নির্মমভাবে খুন করা হয় বলে পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে।

ঘাতকরা ত্বকির চোখ, মুখ ও অণ্ডকোষসহ শরীরের বিভিন্ন স্থান থেঁতলে দিয়েছিল। ত্বকি হত্যাকাণ্ডের জট খুলেছে। ঘাতকরাও চিহ্নিত। মামলার চার্জশিট দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হলেও মূল ঘাতকরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। যুবলীগ নেতা মিল্কি হত্যাকাণ্ড : ৩০ জুলাই রাতে গুলশানের শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় যুবলীগের ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কিকে।

সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত মিল্কিকে খুন করার ভিডিও ফুটেজ অ্যাকশননির্ভর ছবিকেও রীতিমতো হার মানিয়েছে। ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার অন্য যুবলীগ নেতা তারেক ক্রসফায়ারে নিহত হন। এর পর থেকেই থমকে আছে মামলার তদন্ত কার্যক্রম। হত্যাকাণ্ডের দুই পরিকল্পনাকারী এবং মামলার এজাহারভুক্ত আসামি যুবলীগ নেতা সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল ও ওয়াহিদুল ইসলাম আরিফকে এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। স্ত্রীসহ পুলিশ কর্মকর্তা খুন : ১৪ আগস্ট পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও স্ত্রী স্বপ্না রহমান খুন হন।

হত্যাকাণ্ডের এক দিন পর চামেলীবাগের ফ্ল্যাট থেকে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। অবাধ চলাফেরা আর নেশা করায় বাধা দেওয়ায় দম্পতির সন্তান ঐশী ধারাল চাকু দিয়ে মা-বাবাকে কুপিয়ে হত্যা করে। এরপর বেডরুম থেকে লাশ টেনেহিঁচড়ে বাথরুমে আটকে রেখে কাজের মেয়ে সুমি ও ছোট ভাই ঐহীকে নিয়ে পালিয়ে যায়। হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে ঐশী। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ঐশীর বন্ধু জনি, রনি ও কাজের মেয়ে সুমির সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার কথা জানায় তদন্তকারী সংস্থা।

পুলিশ কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ড : ২৯ আগস্ট সকালে রাজধানীর রামপুরার বাসায় ঢুকে প্রকাশ্য দিবালোকে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফজলুল করিম খানকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ঘটনার চার মাস পার হয়ে গেলেও হত্যাকাণ্ডের কারণ জানতে পারেনি পুলিশ। গ্রেফতার হয়নি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত কোনো আসামিও।

উপজেলা চেয়ারম্যান নিহত : ১ সেপ্টেম্বর বিকালে ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে উপজেলা চেয়ারম্যান ফোরকান উদ্দিন সেলিম নিহত হন। ধোবাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে খাবার বিতরণকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে তিনি নিহত হন।

মতিঝিলে আওয়ামী লীগ নেতা খুন : রাজধানীর মতিঝিলে ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় প্রকাশ্যে ডেমরা-যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, সায়েদাবাদ টার্মিনালের পরিবহন নেতা খায়রুল আলম মোল্লাকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজ দলের প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হন খায়রুল। সাঈদীর মামলার সাক্ষী খুন : ৮ ডিসেম্বর রাতে পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলার পাড়েরহাট ইউনিয়নের হোগলাবুনিয়া গ্রামের মোস্তফা হাওলাদারকে কুপিয়ে জখম করা হয়। মোস্তফা মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার সাক্ষী ছিলেন। ঘটনার দুই দিন ১০ ডিসেম্বর রাত আড়াইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, মানবতাবিরোধী মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ায় মোস্তফাকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করেছে।

ডা. মাকলুকুর রহমান হত্যাকাণ্ড : ৮ ডিসেম্বর পটুয়াখালীর গলাচিপা উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পুকুরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসক মাকলুকুর রহমানের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। পরিবারের সদস্য ও সহকর্মীরা ওই ঘটনাকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করেছেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পল্লী অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসা সেবা দিতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ ৫৬ জনের একটি দল ৫ ডিসেম্বর গলাচিপায় প্রতিষ্ঠানের উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়েছিল। তবে এ ঘটনা নিয়ে রহস্যজনক কারণে নীরব আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা।

গোপীবাগে ছয় খুন : রাজধানীর গোপীবাগের অভয় দাস লেনে ২১ ডিসেম্বর একই বাসায় হাত-পা বেঁধে কথিত ইমাম মাহদির প্রধান সেনাপতি, পীর লুৎফর রহমান ফারুকসহ ছয়জনকে জবাই করে হত্যা করা হয়। ধর্মীয় মতবিরোধের কারণেই কোনো উগ্রবাদী সংগঠন তাদের হত্যা করেছে বলে জানিয়েছে র্যাব-পুলিশ। তবে উগ্রবাদীদের দিকে সন্দেহের তীর নিক্ষেপ করেই মামলার তদন্ত কার্যক্রম থমকে আছে। ঘটনার এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

এর আগে খুলনার খালিশপুরে ঈদুল ফিতরের আগের দিন ৮ আগস্ট ধর্মীয় মতবাদ প্রচারের কারণে অজ্ঞাত দুই দুর্বৃত্তের হাতে খুন হন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক তৈয়েবুর রহমান (৭০) ও তার ছেলে নাজমুন মনির (১৩)।

তবে পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।

সাংবাদিক আফতাব আহমদ হত্যাকাণ্ড : সর্বশেষ ২৪ ডিসেম্বর নিজ বাসায় খুন হন একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রবীণ ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমদ। দুর্বৃত্তরা নৃশংসভাবে তাকে হত্যার পর বাসার মালামাল ও টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। ঘটনার চার দিন পেরিয়ে গেলেও কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। উদ্ধার হয়নি হত্যাকাণ্ডের মোটিভ।

খুনের ঘটনায় তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক হুমায়ুন কবির ও অজ্ঞাত এক রাজমিস্ত্রিকে খুঁজছে পুলিশ।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।