আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতি: পাঠ পর্যালোচনা ০২

বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতি: পাঠ পর্যালোচনা ০১

বার্ষিক ২,০০০ টাকা নীট মুনাফা’র পাশাপাশি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার (৭.৫% থেকে ৯%) মূল স্রোতের প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশি হওয়ার কারণে, এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফলে সৃষ্ট চলমান সামাজিক বৈষম্য অপরিবর্তিত থাকলে অর্থনীতির সাম্প্রদায়িকী-করণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেছেন অধ্যাপক আবুল বারাকাত। বার্ষিক নীট মুনাফার খাত-প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক যে চিত্র তিনি তুলে ধরেন তা থেকে দেখা যায় মোট নীট মুনাফার শতকরা ২৭ ভাগ আসে আর্থিক প্রতিষ্ঠান তথা ব্যাংক, বীমা, লিজিং কোম্পানি’গুলো থেকে। এরপর সর্বোচ্চ ১৮.৮% আসে বেসরকারি সংস্থা, ট্রাস্ট, ফাউন্ডেশন কিংবা অন্যান্য খাত থেকে; বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান (খুচরা, পাইকারি, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর) থেকে আসে ১০.৮%, ঔষধ শিল্প, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো যোগান দেয় ১০.৪ ভাগ মুনাফা; শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে মুনাফা আসার পরিমাণ শতকরা ৯.২ ভাগ, ৮.৫ ভাগ আসে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা থেকে, সংবাদ মাধ্যম এবং তথ্য প্রযুক্তি খাত যোগান দেয় মুনাফার ৭.৮ ভাগ এবং সর্বনিম্ন ৭.৫ ভাগ মুনাফা আসে যোগাযোগ বা পরিবহন খাত থেকে। (১) এর পাশাপাশি প্রতি বছর অনুদান হিসেবে বিভিন্ন দেশ কিংবা বৈদেশিক সাহায্য-সংস্থা থেকে-ও এরা প্রচুর অর্থ পেয়ে থাকে। (২)
বইটিতে যে বিষয়টি কোথাও আলাদাভাবে কিংবা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়নি সেটি হচ্ছে এই পুরো অর্থনৈতিক চক্রটি কেন্দ্রীভূত, অর্থাৎ এখানে কেউ আলাদা আলাদা ভাবে ব্যবসা করেনা, সাংগঠনিক একটা কাঠামোর ভেতর থেকে সম্পূর্ণ মূলধন পরিচালিত হয় এবং তার প্রায় সমস্ত সুবিধাভোগী একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী।

একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। ধরে নেই, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিবির নেতা ‘ছ’ ব্যবসা করবে, তার মূলধন যোগান দেবে জামাত, প্রয়োজন হলে সে ঋণ নেবে ইসলামী ব্যাংক থেকে, যে ব্যবসা করবে তার কাঠামো থেকে শুরু করে সবকিছু’তে সংগঠন সহায়তা করবে, আপাত দৃষ্টিতে ব্যবসার মালিক ‘ছ’ হলে-ও মূল মালিকানা দলের, ‘ছ’ একটা নির্দিষ্ট অংশের মুনাফা পাবে। দল যদি চায় তাহলে সম্পূর্ণ ব্যবসার মূলধন দলের প্রয়োজনে দল’কে দিতে সে বাধ্য থাকে। এর বাইরে কোনকিছু হয় বলে জানা নেই। এই কাঠামো সুনিয়ন্ত্রিত, এর বাইরে যাওয়ার উপায় নেই, যেমন উপায় নেই এই কাঠামোর ভেতর কারও পক্ষে উঁকি দিয়ে দেখা কিংবা তদন্ত করা।

গোপনীয়তার যে মানদণ্ড এখানে তৈরি করা হয়েছে তাকে কেবলমাত্র মাফিয়াদে’র ‘ওমের্তা’র সাথে তুলনা করা চলে। দলে ক্ষমতার উপর-কাঠামো’তে থাকা অবস্থায় দল ছাড়লে অপঘাতে মৃত্যু নিশ্চিত।
মৌলবাদের অর্থনীতি বিশ্লেষণ করে কয়েকটা উপসংহার তুলে ধরা হয়েছে: ১) তারা স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদে সম্ভাব্য উচ্চ মুনাফা অর্জনের খাত-সমূহে বিনিয়োগ করে; অর্থাৎ পারলৌকিক জীবন নিয়ে লৌকিকতায় তারা যতই পারদর্শিতা প্রদর্শন করুক না কেন ইহলৌকিক-পার্থিব জীবন নিয়ে তারা অনেকের চাইতে বেশি অধিকতর সজাগ-সচেতন; ২) তারা স্ট্র্যাটেজিক বিনিয়োগে অধিক উৎসাহী; ৩) বিনিয়োগের খাত নির্ধারণে তারা দ্রুত জনগণের সাথে সম্পৃক্ত হবার ক্ষেত্রগুলোকেই বেছে নিয়েছে; ৪) তাদের খাত-প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক বিনিয়োগ কাঠামো যথেষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ; ৫) তাদের বার্ষিক নীট মুনাফার মাত্র ১০% সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ করে ৫০,০০০ দলীয় সদস্য পূর্ণকালীন নিযুক্তি দেয়া সম্ভব। তারা সেটা করে এবং অন্যান্য খাতে ক্রস-ভর্তুকি দেয়; ৬) সরকারী-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানে উগ্র সাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন ক্যাডারদের পরিকল্পিতভাবে অন্তর্ভুক্তির জন্য তারা তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা অপব্যবহার করে; ৭) সশস্ত্র জঙ্গিরা এতই সংগঠিত এবং শক্তিমান যে জঙ্গিরা ধরা পড়লে তাদের আনুষ্ঠানিক ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল এবং ক্ষমতার ভিতরে কোন কোন শক্তি তাদের ছেড়ে দেবার জন্য প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রক্ষমতা অপপ্রয়োগ করে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে অদৃশ্য শক্তি প্রয়োগ করে লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়; চিহ্নিত জঙ্গিদের ছেড়ে দিতে হয় আর তাদের নিয়ন্ত্রক গডফাদাররা সম্পূর্ণ ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায় (আজ পর্যন্ত রগ কেটে কিংবা কুপিয়ে কোন ছাত্র হত্যার জন্য কোন শিবির নেতা কিংবা কর্মীর বিচার হয়নি, বরং যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের বেশ কয়েকজন নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত হয়েছে)।
এই সংগঠিত কাঠামোর ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতি’র মূল কারণ বিশ্লেষণে অধ্যাপক আবুল বারাকাত ইতিহাসের বিভিন্ন ধারাপাতের উপর আলোকপাত করেছেন যা আপাত দৃষ্টিতে সংক্ষেপিত মনে হতে পারে কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ।

তাঁর মতে, বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চাইতে বেশি; পাশাপাশি লুণ্ঠন সংস্কৃতি’র যে চরিত্র তার মূল নিয়ামক হিসেবে তিনি ২০ লক্ষ দুর্বৃত্ত’কে দায়ী করেছেন যারা সাংগঠনিক দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে দেশের বাকি মানুষ’কে জিম্মি করে রেখেছেন। তাঁর মতে, এই ২০ লক্ষ দুর্বৃত্ত গত চার দশকে বাংলাদেশে আসা বৈদেশিক সাহায্যের শতকরা ৭৫% লুট করেছে, এই গোষ্ঠীটিই সবধরনের দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের পৃষ্ঠপোষক এবং এদের কারণে বাংলাদেশে জনকল্যাণমুখী যে-কোন প্রয়াসের সুফল সাধারণ মানুষ পায়না। এর ফলে মানুষ ক্রমাগত বিপন্ন হয়েছে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপর আস্থা হারিয়েছে এবং এই আস্থাহীনতাই একসময় নিয়মে পরিণত হয়েছে, যার ফলে ব্যাপক সংখ্যক সাধারণ জনমানুষ উত্তরোত্তর অধিক হারে “নিয়তি” নির্ভর হয়েছে। এই “নিয়তি” নির্ভরতার উপর ভিত্তি করে প্রসার ঘটেছে মৌলবাদের অর্থনীতির!
পূর্ব বাংলায় ইসলাম ধর্মের প্রসারের ইতিহাস লেখায় অসম্পূর্ণতা কিংবা সেই ইতিহাস বিশ্লেষণে যে দুর্বলতা আছে তা তিনি মেনে নেন, কিন্তু সেই প্রসারে সূফীবাদের প্রভাব’কেই তিনি মূলত স্বীকৃতি দেন। পূর্ব বাংলায় ইসলাম ধর্মের প্রসারে প্রচলিত ব্যাখ্যায় চার ধারার বক্তব্য পাওয়া যায়, এগুলো হচ্ছে ১) অভিবাসন (Migration) ২) তরবারি (Sword) ৩) পৃষ্ঠপোষকতা (Patronage) এবং ৪) সামাজিক মুক্তি (social liberation)।

কিন্তু তিনি সূফীবাদের প্রভাব স্বীকৃতি দিতে যেয়ে এই চারটি ধারা’র প্রভাবের চাইতে বেশি গুরুত্ব প্রদান করে ভিন্ন একটা জায়গায় এবং সেই যোগসূত্র ধরে তিনি খুঁজে দেখেছেন মৌলবাদের অর্থনীতির বিস্তৃতির প্রাসঙ্গিকতা। তিনি রিচার্ড ইটনের `The Rise of Islam and the Bengal Frontier- 1206 - 1760' বই এর সূত্র ধরে বলেন, “এখানে ইসলাম বিকশিত হয়েছে কৃষিভিত্তিক সভ্যতা বিকাশের অনুষঙ্গ হিসেবে। ইসলাম ধর্মের সুফি সাধকসহ অন্যান্য অনেক ধর্ম প্রচারক এ দেশে সামন্তবাদ ও ঔপনিবেশ বিরোধী লড়াই-সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন; এমন কি নেতৃত্ব দিয়েছেন। এবং সুফি-ওলামারা ধর্মের উদারনৈতিক-মানবিক যুক্তি ব্যবহার করেই তা করেছেন। ” যে কারণে এ দেশে ইসলাম ধর্মের ঐতিহাসিক মূলধারার (সূফীবাদ) বিকাশের সাথে বর্তমান মৌলবাদি রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিপরীতধর্মী পার্থক্য’টা তিনি স্পষ্টভাবে খুঁজে নেন।


বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে সামন্তবাদী উৎপাদন সম্পর্ক ক্ষয় হলেও সেই সামন্তবাদী মানস কাঠামো বিলুপ্ত হয়নি। তিনি মনে করেন পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কও বিকশিত হয়নি; বরং বিকশিত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের নিকৃষ্ট পুঁজি যা উৎপাদনশীল বিনিয়োগে কোন ভূমিকা রাখেনি। তাঁর মতে এর সবচাইতে নিকৃষ্ট প্রভাব পড়েছে কৃষিখাতে। এরই ধারাবাহিকতায় উপরে উল্লেখিত “নিয়তি”নির্ভরতা সবচাইতে বেশি বেড়েছে কৃষি-প্রধান অর্থনীতিতে যেখানে ৬০ ভাগ কৃষক ভূমিহীন। এই কৃষি ভিত্তির উপর যে ধর্ম ঐতিহাসিকভাবে বিকশিত হয়েছে, সেই কৃষি-ভিত্তিতে দারিদ্র আর অসহায়ত্ব যখন মানুষ’কে নিয়তি নির্ভর করে তোলে তখন যে ‘ভ্যাকুয়াম’ তৈরি হয় সেই ভ্যাকুয়ামটিই মৌলবাদী রাজনীতি বিকাশের জন্য সবচাইতে সহায়ক বলে তিনি মনে করেন।

তাঁর ভাষায়, “এই ভ্যাকুয়াম-টাই ব্যবহার করেছে মৌলবাদী রাজনীতি.... মানুষের সামনে এখন আর রাজনৈতিক Role Model বলে কিছু নেই-- এসব প্রবণতা যে হতাশা-নিরাশা সৃষ্টি করেছে সেগুলোই হয়ে দাঁড়িয়েছে উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের সংগঠনের বিস্তৃতির সহায়ক উপাদান। ”
চলবে....

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.