আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জার্মানিতে ব্লু-কার্ডঃ উচ্চশিক্ষিত প্রবাসীদের জন্য সুবর্ন সুযোগ


ব্লু-কার্ডঃ প্রবাসীদের জন্য খুলছে জার্মানির দরজা

২০০০ সালের আগে জার্মানিতে বাইরে থেকে কেউ এসে কাজ করবে- এটা ছিল চিন্তার বাইরে। এই দেশের মানুষ ছিল রক্ষণশীল, আমেরিকা কানাডার মতন মাইগ্রেশন বলে কিছুতে এখানে কেউ বিশ্বাস করত না। আর দেশের অর্থনীতি আত্মনির্ভরতা থেকে এরকম কিছুর প্রয়োজনীয়তাও কেউ অনুভব করেনি। একারণে এখানে ছিল না বিদেশীদের কাউকে কাজের অনুমতি দেবার মতন কোন আইনও। এখানে বড়জোর পড়াশোনা শেষ করা যেত, কিন্তু পড়া শেষ করে আবার সবাই যে যার দেশে ফিরে যাবে এইটাই ধরে নেওয়া হত।

আশি বা নব্বইয়ের দশকে জার্মানিতে পাড়ি দিয়েছিল অনেক বাংলাদেশী, যাদের অনেকেই পরবর্তীতে এখানে থেকে গিয়েছিলেন। তবে এদের সিংহভাগ থেকে গিয়েছেন রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বা কোন জার্মান নাগরিককে বিয়ে করে। কাজের অনুমতি না থাকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে জার্মানিতে এসে ভদ্র চাকুরী করে বসত গড়েছেন, এদের সংখ্যা ছিল হাতে গণা দুই একজন।

নব্বইয়ের দশকেও যখন জার্মান অর্থনীতির ক্রমাগত বুম অব্যাহত থাকল, দক্ষ কর্মশক্তির অভাবটাও প্রকট হতে থাকল ক্রমেই। সেইসাথে বাড়তে থাকল কলকারখানাতে বিদেশী দক্ষ শ্রমিক নেবার জন্য ইউনিয়ন এবং রাজনৈতিক চাপ।

তবে এর বিপক্ষেও ছিল অনেক জনমত। অবশেষে ২০০০ সালে প্রথম জার্মানিতে গ্রিন কার্ড নামে ৫ বছরের জন্য একটা পাইলট প্রজেক্ট চালু হল। এর আওতায় শুধুমাত্র উচ্চ বেতন ধারীদেরকে জার্মানিতে সরাসরি কাজ নিয়ে আসার অনুমতি দেয়া হল। পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রির ফান্ডিং দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হতে শুরু হল ইংরেজিতে মাস্টার্স কোর্স। সেই থেকেই মূলত শুরু হল জার্মানিতে দক্ষ এবং উচ্চশিক্ষিত মাইগ্রেটদের আগমন।



তবে এই গ্রিন কার্ডটাও ছিল শুধুমাত্র সাময়িক কাজের অনুমতি মাত্র। এখানেও ধরে নেওয়া হল যে, এই দক্ষ শ্রমিকরা কয়েক বছর কাজ করে আবার স্ব স্ব দেশে ফিরে চলে যাবে। নামে মাত্র একটা অপশন থাকল, যারা বছরে ৮৭,০০০ ইউরো আয় করবে তাদেরকে সাথে সাথে স্থায়ী বাসস্থান দিয়ে দেয়া হবে। এই ক্যাটাগরিতে পাঁচ বছরে ১০০ জন বিদেশীকেও পাওয়া গেল না, গ্রিন কার্ড নিয়ে কাজ করতে এসেও জার্মানিতে পাকা ভাবে থেকে যাওয়াটা রয়ে গেল প্রায় অসম্ভবের মতন। এই কাজের অনুমতি পেতে হলেও ছিল অনেক ঝক্কিঝামেলা।

নতুন পদে বিদেশী কাউকে নেওয়ার আগে ফার্মগুলোকে আগে এক মাস ধরে বিজ্ঞাপন দিয়ে রাখতে হত যদি সমমানের কোন জার্মান নাগরিক পাওয়া যায়। এক মাস পর কাউকে পাওয়া না গেলে তবেই মাত্র বিদেশীদের নেওয়া যেত। এখানে যারা পড়তে আসত, তাদেরকে পাশ করার আগেই চাকরি যোগাড় করতে হত। তা না হলে পাশ করার সাথে সাথেই ভিসা শেষ, চাকরি খোঁজার জন্য কোন ধরণের ভিসার নিয়ম ছিল না।

অর্থনীতি যতই শক্তিশালী হতে থাকুক, একটা ব্যাপারে জার্মানি পিছিয়ে ছিল অনেকদিন থেকেই।

আর সেটা হল ঋণাত্মক জন্মহার। এই দেশে কাজ শেষ করার পর সব বুড়োবুড়ি মোটা অঙ্কের পেনশন পায়, সেই টাকার যোগান হয় মূলত যারা কাজ করছে তাদের দেয়া ট্যাক্স থেকে। এই দেশের প্রচলিত সিস্টেমের জন্য আরেকটা খারাপ খবর ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতি। বুড়োবুড়িরা সহজে মরছে না, কিন্তু সরকার বাধ্য থাকছে তাদেরকে মৃত্যু পর্যন্ত পেনশন ও চিকিৎসা ভাতা দিতে। একসময় জার্মানদের উপলব্ধি হল, জন্মহার কম থাকায় কোনভাবেই সব কর্মরত শ্রমিকদের ট্যাক্স দিয়েও একসময় আর পেনশনের ভাতা যোগাড় করা সম্ভব নয়।

ধারণা করা হয়, আনুমানিক ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের পর থেকেই পেনশন ভাতা দেয়ার জন্য অন্য পথ খুঁজতে হবে সরকারকে। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে ২০১২ সালের আগস্ট মাস থেকে খুলে গেল জার্মানিতে বিদেশীদের কাজ করার পথ। এইবার আগেকার কঠিন অবাস্তব নিয়ম কানুন বাদ দিয়ে ঢেলে সাজানো হল বিদেশী দক্ষ কর্মী নেবার আইন কানুন গুলোকে। চালু হল জার্মানিতে ব্লু-কার্ড।

এই নতুন নিয়মের মধ্যে চারটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আসল:

1. ব্লু-কার্ড পাবার জন্য বেতনের সীমা কমিয়ে আনা।


2. পরিবারের জন্য সহজ ভিসার নিয়ম ও তাদের জন্য কাজ করার অনুমতি।
3. সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার দ্রুত করন। কাজ পেলে সাথে সাথেই কাজ ও থাকার অনুমতি, কোন ধরণের বিলম্ব ছাড়াই।
4. এখানে পড়তে আসা ছাত্র ছাত্রীদের জন্য কাজের অনুমতি বাড়ানো, পড়া শেষ করার পর শুধুমাত্র চাকুরী খোঁজার জন্য ভিসা দেয়া ইত্যাদি।

ব্লু-কার্ড বেতন সীমাঃ
যাদেরই জার্মানির যেকোনো ইউনিভার্সিটির ডিগ্রী বা জার্মান সমমানের ডিগ্রী অন্যদেশ থেকে নেওয়া আছে, এবং তারা যদি বছরে ৪৭,৬০০ ইউরোর বেশি বেতন পায় এমন চাকুরী খুঁজে পায়, তাহলে তারা ব্লু-কার্ডের জন্য যোগ্য বলে গণ্য হবে।

ন্যাচারাল সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিত, আইটি বা ডাক্তারসহ যেসব ক্ষেত্রে জার্মানিতে দক্ষ লোকের বিশেষ ঘাটতি আছে, সেইসব বিষয়ে এই বেতন সীমার পরিমাণ এই মুহূর্তে বছরে ৩৭,১২৮ ইউরো।

ব্লু-কার্ড বাংলাদেশ থেকেও সরাসরি পাওয়া সম্ভব। এর জন্য বাংলাদেশের রিকগনাইজড ডিগ্রি পাওয়াই যথেষ্ট। কেউ চাইলেই বাংলাদেশে বসেও ইন্টারনেটে জব সার্চ করতে পারে, এর জন্য জার্মান সরকার থেকে ইংরেজিতে বেশ কিছু সাইট অনুমোদন করা হয়েছে। এরজন্য জার্মান কর্মসংস্থানের ওয়েব সাইট দিয়ে শুরু করা যেতে পারে।



কাজের অনুমতিতে কোন বিলম্ব থাকছে না
জার্মানিতে বিদেশীদের কর্মসংস্থানের জন্য যে সরকারি সংস্থাটি নিয়োজিত আছে, সেটি হল সাভ (Zentrale Auslands und Fachvermittlung (ZAV))। যারা প্রথম ক্যাটাগরিতে ব্লু-কার্ড পাচ্ছে (বাৎসরিক বেতন ৪৭,৬০০ ইউরো বা তার বেশি), এদের জন্য সাভ থেকে অনুমতি নেবার কোন প্রয়োজন থাকছে না। আবেদন করার সাথে সাথেই এমব্যাসি থেকে জার্মানির কাজ ও থাকার প্রাথমিক অনুমোদন পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে ব্লু-কার্ড পাচ্ছে (বাৎসরিক বেতন ৩৭,১২৮ ইউরো বা তার বেশি), তাদের জন্য অবশ্য আবেদনের পর সাভের অনুমতি নিতে হবে।

উদাহরণ ১ (বাংলাদেশ থেকে সরাসরি জার্মানিতে আসতে হলে)

ধরা যাক, বুয়েট থেকে ব্যাচেলর/মাস্টার্স পাশ করে একটি ছেলে/মেয়ে জার্মানির কোন কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে আসতে চায়।

তার জন্য স্টেপগুলো এমন হবেঃ
1. ইন্টারনেটে বসে পছন্দমতন স্পেশালাইজেশন অনুযায়ী জব খুঁজে বের করা।
2. নেটে বসেই আবেদন, সার্টিফিকেট ইত্যাদি কাগজ পাঠিয়ে দেয়া।
3. অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক ইন্টার্ভিউ হয় ফোনে, প্রার্থী পছন্দ হলে ফ্লাইট ও হোটেল ভাড়াসহ ইন্টার্ভিউতে সরাসরি আমন্ত্রণ জানানো হবে।
4. চাকুরীর কন্ট্রাক্ট পেপার নিয়ে ঢাকাস্থ জার্মান এমব্যাসিতে ভিসার আবেদন জমা দেয়ার পর বেতনের ক্যাটাগরির উপর নির্ভর করে ভিসার জন্য এক থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত লাগতে পারে। প্রাথমিক ভিসার সময়কাল তিন মাস।

এটা জার্মানিতে আসার পর পরই চার বছর পর্যন্ত বাড়ানো যায়।
5. দেশ থেকে মনে করে রসমালাই নিয়ে আমার বাসায় হাজির হওয়া (অপশনাল )।

উদাহরণ ২ (বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রী যারা জার্মানিতে পড়াশোনা করেছে)

যারা জার্মানিতে এসে ডিগ্রী নিয়েছে, তাদের জন্য স্টেপগুলো আরেকটু সহজ। ব্লু-কার্ডের নিয়মের সাথে সাথে এখানে পড়া শেষ করার পর ১৮ মাসের জন্য শুধুমাত্র একটা চাকুরী খুঁজে নেবার জন্য ভিসা দেওয়ার নিয়ম হয়েছে। এদেরকে যা করতে হবেঃ
1. পড়া শেষ করে জার্মানিতে ১৮ মাসের মধ্যে চাকরি খুঁজে বের করা।


2. চাকরির কন্ট্রাক্ট নিয়ে ফরেন অফিসে থাকা ও কাজের পারমিট চেয়ে আবেদন করা।
3. কোন জার্মান এই জব করতে পারত কিনা- এই জাতীয় কোন ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই সাথে সাথে এদেরকে চার বছর পর্যন্ত ভিসা ও কাজের অনুমতি দেয়া হবে।

অন্যান্য নতুন কিছু সুযোগ-সুবিধাঃ
1. জার্মানিতে উচ্চশিক্ষায় আগত ছাত্র-ছাত্রীদের কাজের অনুমতি আগেকার ৯০ দিন থেকে বাড়িয়ে এখন থেকে বছরে ১২০ দিন করা হয়েছে।
2. ইচ্ছে করলে বাংলাদেশ থেকে ৬ মাসের জন্য শুধুমাত্র চাকরির সন্ধানে জার্মানিতে আসার ভিসা পাওয়া যায়। এই সময়ে কোন চাকরি খুঁজে পেলে, বাকিসব প্রক্রিয়া উপরের উদাহরণ ২ এর মতন হবে।


3. ব্লু-কার্ড প্রাপ্তদের পরিবার (স্বামী/স্ত্রী) সাথে সাথেই ভিসা ও যেকোনো কাজের অনুমতি পাবেন।

স্থায়ী আবাসনঃ
• ব্লু-কার্ড পাওয়ার ৩৩ মাস পরই জার্মানিতে স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি পাওয়া যাবে। এমনকি কারোও যদি জার্মান ভাষা ভাল ভাবে শেখা থাকে (বি১ লেভেল), তাহলে তারা ব্লু-কার্ড পাবার মাত্র ২১ মাসের পরেই স্থায়ী আবাসনের অনুমতি পাবে। উল্লেখ্য, ব্লু-কার্ড ছাড়াও পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট পাওয়া সম্ভব, তবে তার জন্য প্রায় ৫ বছর সময় লাগে।
• যারা জার্মানিতে পড়াশোনা করেছে, তারা ব্লু-কার্ড পাবার ২ বছর পরেই স্থায়ী আবাসনের অনুমতি পাবে।


• গবেষক, বিজ্ঞানী বা ইন্ডাস্ট্রিতে উঁচু পদে অধিষ্ঠিতদের (অথবা বছরে ৬৫,০০০ হাজার ইউরোর উপরে বেতন) সাথে সাথে জার্মানিতে স্থায়ী আবাসনের অনুমতি দেয়া হবে।

তথ্যসূত্রঃ
http://www.zav.de/arbeitsmarktzulassung
http://www.arbeitsagentur.de/
http://www.bamf.de
http://www.gesetze-im-internet.de
 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.