আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জার্মানিতে এক রাতে

এটা ঠিক ভ্রমন কাহিনী না। তবু অজানা এক দেশে অদ্ভুত এক নির্ঘুম রাতের ঘটনা বলতে ইচ্ছে করছে।

আমি তখন মাস্টার্স করার জন্য জার্মানি গিয়েছি। Konstanz University র যে হোস্টেলে আমি উঠেছি সেটা একটা দোতলা বিল্ডিং। অনেকগুলো দুই রুমের ছোট ছোট এপার্টমেন্ট আছে সেখানে।

প্রতিটা এপার্টমেন্টেই একটা মেইন দরজা আর প্রতি রুমের সাথে বারান্দা। আমরা এক তলায় থাকি। আমার পাশের রুমে এক Spanish মেয়ে থাকে। নাম মারিয়া। মজার ব্যাপার হল আমরা দুজনেই একই দিনে জার্মানি এসেছি।

তার চেয়েও মজার ব্যাপার হল ও দেখতে অনেকটাই আমার মত। হোস্টেলের caretaker (Hausmeister) সবসময় আমাদের জমজ বলতেন।

যাই হোক তখন ক্রিসমাসের ছুটি ছিল। ক্লাস শুরু হওয়ার আগে মারিয়া গেল বার্লিনে ওর খালার সাথে দেখা করতে। আমি ঘরে একা।

পাশে অবশ্য আরও এপার্টমেন্ট আছে কিন্তু তবুও একা লাগছিল। তার উপর সকাল থেকেই তুষার পড়ছিল। আমি শুয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল কেউ যেন কারো নাম ধরে ডাকছে। আমাদের হোস্টেল পাহাড়ের উপর ছিল আর বাইরে ঝড়ো বাতাস বইছিল তাই প্রথমে কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

কিছুদিন আগে university তে সবাই মিলে একটা জার্মান মুভি দেখেছিলাম, সেই পাহাড়ি ভূতের কথা মনে পড়ে গেল। মোবাইলে দেখি রাত প্রায় ১২ টা। আরও অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কে যেন আমার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। মেরুদণ্ড বেয়ে ঠাণ্ডা একটা ভয়ের স্রোত নেমে গেল। আমার রুমের লাইট নিভানো আর বারান্দা লাগোয়া double glazing door এর কারনে বাইরে থেকে আমাকে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি।

একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে বাইরে। লাইটের উল্টা দিকে দাঁড়ানোর কারনে আমি তার মুখ ঠিকমত দেখতে পাচ্ছিলাম না। মনে হল সে নিচু গলায় কাউকে ডাকছে। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলাম। এবার শুনতে পেলাম।

রাজ নামের কাউকে ডাকছে। একবার চিন্তা করলাম উঠে গিয়ে তাকে বলি যে এখানে রাজ নামের কেউ থাকে না। আবার ভাবলাম যদি মাতাল হয়, কি দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে। আমি চুপচাপ থাকলাম। মেয়েটি কি বলে তা শোনার চেষ্টা করলাম।

ডাকের কোন উত্তর না পেয়ে মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। ওর চুপ করে যাওয়া দেখে আমি আর শোনার চেষ্টা করলাম না। এমনিতেই এত রাত তার উপর কে না কে। তবে ভয় কেটে গেল কারন ভূত হলে তো আমাকে দেখতেই পেত অতএব শুয়ে পড়লাম।

হঠাৎ আবার ঘুম ভেঙ্গে গেল।

মনে হল কেউ কাঁদছে। আস্তে উঠে বসলাম। হ্যাঁ, মেয়েটাই কাঁদছে। চাপা কান্না কিন্তু তারপরও কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। সেটা ঠাণ্ডার কারনে না কান্নার বুঝতে পারলাম না।

মানুষ ভাববে যে একটা মেয়েকে কাঁদতে দেখেও আমি কেন বারান্দায় গেলাম না। আমি আসলে কি করব বুঝতে পারছিলাম না। যাই হোক কিছুক্ষণ কেঁদে সে আবার কথা বলা শুরু করল। কথা শুনে বোঝা গেল হিন্দিতে কথা বলছে। কান্না জরানো গলায় রাজ নামের ছেলেটাকে বলছে তাদের ভালবাসার দিনগুলোর কথা।

কত স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে! ছেলেটার সাথে ওদের বিয়ে নিয়ে দেখা স্বপ্নগুলোর কথা বলতে বলতে মেয়েটা ফোঁপাতে শুরু করল। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ফোঁপাতে ফোঁপাতেই মেয়েটা ওদের বাসর রাত নিয়ে হাজারো স্বপ্নের কথা বলতে লাগল। আমার মনে হল আমি আমার চোখের সামনে ওদের সেই সুখময় দিনগুলো দেখতে পাচ্ছি। কেমন যেন চাপ ব্যথা অনুভব করলাম বুকের ভেতর।

আমার কি হয়েছিল আমি জানি না কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য আমি স্থান, কাল সব ভুলে গিয়েছিলাম। যখন আবার বাস্তবে ফিরে এলাম তখন আর কোন শব্দ শুনতে পেলাম না। বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে দেখি কেউ নেই। খুব অপরাধ বোধ হচ্ছিল। মেয়েটা জানলও না যে এখানে ছেলেটা থাকে না।

আমাকে অনেকগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি রেখে মেয়েটা চলে গেল। তারপরও অনেকদিন জার্মানিতে ছিলাম, কত ইন্ডিয়ান মেয়ে দেখেছি, কতজনকে জিজ্ঞেস করেছি যে তুমি কি রাজ নামের কাউকে চেন কিন্তু কেউই তেমন কোন সম্ভাবনাময় উত্তর দিতে পারে নাই।

একটা মেয়ে একটা ছেলেকে কত ভালবাসলে এত রাতে তুষারপাতের মাঝেও ভালবাসার কাছে ছুটে আসতে পারে তা আমার ঠিক জানা নাই। শুধু প্রার্থনা করি সবাই যেন এমন ভালবাসা পায় কিন্তু এত কষ্ট যেন না পায়। ভাল থেক তুমি নাম না জানা মেয়ে।

তুমি যেমন স্বপ্ন দেখেছিলে তেমনই স্বপ্নময় হোক তোমার জীবন এই কামনা করি।

বিঃদ্রঃ ভিডিওতে দেখানো এই বারান্দাতেই মেয়েটি দাড়িয়ে ছিল এমনি তুষারপাতের মাঝে।

P1010157.MP4

ফাহিমা দিলশাদ

ফাইল: 

You are missing some Flash content that should appear here! Perhaps your browser cannot display it, or maybe it did not initialize correctly.

সোর্স: http://www.sachalayatan.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.