আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিশু যিশুর গল্প

অনেক বছর আগে বিজ্ঞান যখন ‘হাঁটি হাঁটি পা পা’ করছিলো সেই মধ্যযুগে বা তারও আগে কোন এক সময়ে পেরুর জেলেরা লক্ষ্য করেছিলো কোন কোন বছর তাদের জালে বেশি মাছ ধরা পড়ছে, আবার কোন কোন বছর মাছ একেবারেই কম। তারা আরো খেয়াল করলো- যে বছরগুলোতে জালে মাছ কম আসছে সে সময় প্রশান্ত মহাসাগরের পানিও থাকে খুব উষ্ণ, বৃষ্টিপাত হয় বেশি আর এই ব্যাপারটা শুরু হয় ঠিক যখন তারা ‘ক্রিসমাস’ বা যিশু খ্রিস্টের জন্মোৎসব পালনে মেতে ওঠে তার কাছাকাছি সময়ে। যিশুর আবির্ভাবকে স্মরণ করে পেরুর জেলেরা প্রশান্ত মহাসাগরের এই অদ্ভুত ঘটনার নাম দিয়েছিলো ‘এল নিনো’ বা ‘দ্য চাইল্ড’। স্প্যানিশ ভাষায় ছেলে শিশুদের বলা হয় ‘নিনো’ আর মেয়েদের ‘নিনা’। ‘এল নিনো’র বিপরীত ঘটনার নাম তাই হয়ে গেলো ‘লা নিনা’- যে সময় পেরুর জেলেদের জালে বেশি মাছ ধরা পড়ে আর সাগরের পানি থাকে বেশ ঠাণ্ডা।



চিত্র-কঃ স্বাভাবিক ও এল নিনো পরিস্থিতিতে প্রশান্ত মহাসাগরে তাপমাত্রার তুলনামূলক চিত্র। এখানে দেখা যাচ্ছে ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে এল নিনো পরিস্থিতিতে পেরুর কাছে প্রশান্ত মহাসাগরের কিছু অংশের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে

এল নিনো আর এনসোঃ তাহিতি থেকে ডারউইন
এল নিনো আর লা নিনা (সাধারণতভাবে ‘এল নিনো’ হিসেবে পরিচিত) সম্পর্কে পেরুর জেলেরা বহু বছর আগে থেকে জানলেও বিজ্ঞানীরা নিছক স্থানীয় কোন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য মনে করে অনেকদিন একে মোটেও পাত্তা দেন নি। ১৯২৩ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী স্যার গিলবার্ট ওয়াকার প্রথম এল নিনোর সাথে বায়ুর চাপের সম্পর্ক আবিষ্কার করেন। তিনি লক্ষ্য করেন যখন এল নিনো হয়, তখন প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব প্রান্তে যেখানে তাহিতি দ্বীপ রয়েছে এবং পশ্চিম প্রান্তে অস্ট্রেলিয়ার ডারউইন শহরের নিকটে বায়ুর চাপের ব্যাপক তারতম্য ঘটে।
স্যার ওয়াকার আরো দেখান, প্রশান্ত মহাসাগরে মাঝে মাঝে বায়ুর চাপ গড় চাপের চেয়ে বেশি বেড়ে যায়, এবং তখন ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অর্থাৎ আফ্রিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ন এলাকায় বায়ুর চাপ কমে যায়।

আবার কোন কোন সময় এর বিপরীত ঘটনাও ঘটে। সাধারণত এল নিনোর সময় প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্তে বায়ুচাপ গড় চাপের চেয়ে বেশি ও পূর্ব প্রান্তে গড় চাপের চেয়ে কম থাকে এবং পেরুর কাছে উষ্ণ তাপমাত্রার পানি জমা হতে থাকে। তেমনিভাবে লা নিনার সময় পশ্চিম প্রান্তে বায়ুচাপ কম এবং পূর্ব প্রান্তে বেশি থাকে এবং একই স্থানে শীতল তাপমাত্রার পানি জমা হতে থাকে। ওয়াকার এই প্রবাহের নাম দেন ‘সাউদার্ন ওসিলেশন’ বা দখিনা ঘূর্ণন।

চিত্র-খঃ স্যাটেলাইট থেকে তোলা নাসার এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে এল নিনোর সময় পেরুর কাছাকাছি এলাকায় উষ্ণ তাপমাত্রার পানি জমা হয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেছে এবং লা নিনার সময় শীতল তাপমাত্রার পানি জমা হয়ে উচ্চতা হ্রাস পেয়েছে

সাউদার্ন ওসিলেশনকে একটি সূচকের (index) মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় যার মাধ্যমে এল নিনো ও লা নিনার অবস্থা বোঝা যায়।

ঋণাত্মক সূচক এল নিনো এবং ধনাত্মক সূচক লা নিনা অবস্থা প্রকাশ করে। সূচকটি পরিমাপের জন্য তাহিতি এবং ডারউইন শহরের বায়ুচাপের তারতম্য বিবেচনা করা হয়। এল নিনো/লা নিনা এবং সাউদার্ন ওসিলেশনকে একত্রে ডাকা হয় ‘এল নিনো সাউদার্ন ওসিলেশন’ (El Nino Southern Oscillation) বা সংক্ষেপে ‘এনসো’ (ENSO) নামে।
এল নিনো বা এনসো কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
পেরুর জেলেদের আবিষ্কার করা যে ঘটনাটিকে বিজ্ঞানীরা স্থানীয় বৈশিষ্ট্য ভেবে অনেকদিন দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন, বায়ুর চাপের সাথে এর সম্পর্ক জানার পর বিজ্ঞানীরা অনেকটা নড়েচড়ে বসলেন। এরপর আরো অনেক কিছু বিশেষ করে আবহাওয়াজনিত নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে এল নিনোর যোগসূত্র পাওয়া গেলো।

স্যাটেলাইট আবিষ্কারের ফলে এ সম্পর্কগুলো আরো পরিস্কারভাবে বোঝা গেলো। নিচের ছবিতে এল নিনোর সময় পৃথিবীব্যাপি কী ধরনের আবহাওয়া বিরাজ করতে পারে তার একটা ধারণা দেয়া হয়েছে।

চিত্র-গঃ এল নিনোর সময় পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় যেধরনের আবহাওয়াজনিত অবস্থা বিরাজ করতে পারে তার একটি সম্ভাব্য চিত্র

প্রশান্ত মহাসাগরের একটি স্থানীয় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য যে পৃথিবীব্যাপি এত প্রভাব বিস্তার করতে পারে তা কিছুদিন আগেও সবার ধারণার বাইরে ছিলো। কিন্তু এখন আমরা জানি, এল নিনোর সময় পেরুতে যখন ব্যাপক বৃষ্টিপাত ও বন্যা হয় তখন ভারতে বা আফ্রিকায় অনাবৃষ্টির ফলে খরার আশংকা থাকে, ইন্দোনেশিয়া বা অস্ট্রেলিয়ায় শুষ্কতার কারণে আগুন লেগে দাবানল ছড়িয়ে পড়তে পারে, প্রশান্ত মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ বেড়ে যায়। আবার লা নিনার সময় দেখা যেতে পারে এর বিপরীত চিত্র।

গবেষণায় দেখা গেছে লা নিনা বছরগুলিতে উত্তর আমেরিকায় ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তাই আমরা দেখি- যে সময় লা নিনা বিদ্যমান থাকে, যুক্তরাষ্ট্রে সে সময় ঘূর্ণিঝড় বেশি হবার পূর্বাভাস থাকে। ঝড়, বৃষ্টি, খরা, দাবানল- এগুলো তাই কোন স্রষ্টার অভিশাপ বা আশীর্বাদ নয়; বরং প্রকৃতির স্বাভাবিক ঘটনা যার একটা নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে এবং যার গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা মানুষ করে চলেছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এল নিনো পূর্বাভাস ও প্রস্তুতির গুরুত্ব
এল নিনো ও লা নিনা প্রতি বছর সংঘটিত হয় না। সাধারণত পাঁচ বছর পরপর বা এর কম সময়ের মধ্যেও এটি হতে দেখা যায় এবং যখন হয় তখন কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত তা গড়াতে পারে।

এল নিনোর প্রভাব অনেকটা ‘ডোমিনো এফেক্ট’ এর মতো। প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় এর উৎস হলেও পুরো পৃথিবীর আবহাওয়া এবং জলবায়ুর ওপর তা প্রভাব ফেলে। যার ফলে খাদ্য, কৃষি, চিকিৎসা, বাণিজ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি অনেক সেক্টরে এর সরাসরি প্রভাব রয়েছে। এল নিনোর সঠিক পূর্বাভাসের মাধ্যমে আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে এসব সেক্টরে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। যেমন এল নিনোর সময় যেসব অঞ্চলে অনাবৃষ্টি হয়, সেখানে বৃষ্টিপাতের অভাবে কৃষি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, কৃষকদের তা আগে থেকে জানিয়ে পূর্ব প্রস্তুতি নিলে এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠা যায়।

বাংলাদেশে সাধারণত এল নিনো বছরগুলিতে বৃষ্টিপাত কম হয়। এখন সেচ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে দুর্ভিক্ষের আশংকা অনেক কমে এসেছে, কিন্তু অতীতে ১৭৭০, ১৯৪৩, ১৯৭৪ সালের কুখ্যাত দুর্ভিক্ষগুলো হয়েছিলো এল নিনোর সময়ে। আবার লা নিনার বছরগুলিতে এদেশের ভয়ংকর বন্যাগুলো হয়েছে। এনসোর সাথে এ অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়েরও যোগসূত্র রয়েছে। এল নিনো বা এনসোর সঠিক পূর্বাভাস এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতির মাধ্যমে আবহাওয়াজনিত এসব বিভিন্ন দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়।

বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপীড়িত দেশে যে এনসো পূর্বাভাস ও প্রস্তুতির গুরুত্ব অপরিসীম তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.