আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রূপকথার ডাক্তার

পদ্মা পার হয়ে মাধবদিয়ার চর। সেই চরে রোগী দেখতে গেলেন এক ডাক্তার। রোগী হতদরিদ্র। রোগী দেখার পর যখন প্রেসক্রিপশন লিখছিলেন, তখন ডাক্তার দেখলেন রোগীর বাবা গোয়াল থেকে হালের বলদ বের করছেন। আর একজন বলদের দড়ি ধরে টানাটানি করছে কিন্তু বলদ নড়ে না।

বৃদ্ধ কেঁদে কেঁদে বলছেন, “তোরে আমি রাখতে পারলাম নারে। আমারে কোন দোষ দিস না। পরের বাড়িত যাইয়া সুখে থাকিস। ”
ডাক্তার লক্ষ্য করলেন, বৃদ্ধের সাথে সাথে বলদ গরুটির চোখ থেকেও যেন অশ্রু ঝরছে।
ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে?”
: রোগী আমার একমাত্র ছেলে।

এত দূরের পথ আপনাকে এনেছি। আপনার হাতে অন্ততঃ একশো টাকা তো দিতে হবে। তাছাড়া ওষুধপত্র কিনতে হবে। তাই গরু বিক্রি করে দিচ্ছি। ”
: গরু বিক্রি করলে হালচাষ করবেন কি দিয়ে?
: সেকথা ভাবলে তো চোখে আন্ধার দেখি।

আগে ছেলে তো ভালো হউক। কিন্তু গরু তো বোধ হয় টের পেয়ে গেছে। গোয়ালঘর থেকে নড়ানো যাচ্ছে না।
: মিঞাসাহেব, আপনাকে গরু বিক্রি করতে হবে না। রোগী দেখার জন্য আমাকে কোন টাকা দিতে হবে না।


: কিন্তু ওষুধের দাম তো দিতে হবে। ঘরে যে একটি পয়সাও নেই।
: আপনার ছেলের ওষুধও কিনে দিব। কোনো চিন্তা করবেন না।
এই হলো রূপকথার ডাক্তার।

“এই ডাক্তারের খ্যাতি এতো ছড়িয়ে গিয়েছিল যে, কেউ যদি তাঁর মূর্তি বানিয়ে পূজা করতো, তবে দেশের হিন্দু-মুসলমান একত্র হয়ে অঞ্জলি দিতো। ”
একবার বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলেন ডাক্তার। রোগীর আত্মীয়-স্বজন, ডাক্তারের ছেলেরা গ্রাম থেকে গ্রামে তাঁকে খুঁজলো। থানায় খবর দিলো। কয়েকদিন পর পর শ্রান্ত-ক্লান্ত, অনিদ্রায় অবসন্ন হয়ে ডাক্তার বাড়ি ফিরলেন।


ডাক্তার-বৌ হাতপাখার বাতাস দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, “এতদিন কোথায় ছিলে?”
: প্রথমে গেলাম রঘুয়াপাড়া। মাতবর বাড়ি। রোগী যায় যায় অবস্থা। সারারাত সেবা করে রোগী কিছুটা চাঙ্গা করে আনতেই ডাক পড়ল ভাটপাড়া থেকে। সেখানে হলদে পাখির মত ছোট্ট এক মেয়ের নিউমোনিয়া হয়েছে।

তাকে ঔষুধপত্র দিয়ে কিছুটা সেরে তুলতে খবর এলো বউঘাটা থেকে। কার ছেলেকে জানি সাপে কেটেছে। গেলাম সেখানে। এই করতে করতেই দেরি হয়ে গেলো।
: টাকা-পয়াসা কি এনেছো? ঘরে তো চাউল নেই।


: এবার অনেক টাকা পেয়েছিলাম। রঘুয়াপাড়ার মাতবরই তো দিয়েছিলো দু’শো টাকা।
: তবে যে তোমার ব্যাগে মাত্র দশ টাকা দেখলাম?
: ভাটপাড়ায় হলদে পাখির মত মেয়েটির ওষুধের দাম দিতে হলো যে! ওরা এত গরীব যে ওষুধের টাকা না দিলে মেয়েটির চিকিৎসাই হতো না। এরপরও কিছু টাকা ছিল। পথের মধ্যে একটি গরীব ছেলে পরীক্ষার ফিস চাইলো, দিলাম।

সবশেষে সাপে কাটা রোগীর কাছ থেকে টাকা নিইনি। উল্টো আমি আরও কিছু দিয়ে এসেছি।
এসব শুনে ডাক্তার-বৌ আর কিছু বলেন নি।
এরপর থেকে ডাক্তার উধাও হলে খুব একটা খোঁজ খবর করতেন না।
এসময় তিনি লাঠিখেলা ও তলোয়ার চালনায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।

ছেলের মাথায় আলু রেখে অথবা ছেলেকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে গলার উপর লাউ রেখে চোখ বন্ধ করে তলোয়ার দিয়ে সেই আলু, লাউ খন্ড খন্ড করতেন। ডাক্তারের কাছ থেকে ট্রেনিং নেয়ার জন্য বিভিন্ন গ্রাম থেকে লাঠিয়ালরা এসে ২/৩ দিন ডাক্তারের বাড়ি থাকতো। ডাক্তার তাদের সাধ্যাতীত আদর-আপ্যায়ন করতেন। কখনো দেখা যেতো, বৈঠকখানায় রোগী বসে আছে। তিনি হয়তো কাউকে তলোয়ার ভাঁজ করার নতুন কৌশল শিখিয়ে দিচ্ছেন।

গ্রামে রোগী দেখতে গিয়ে লাঠিখেলার কোনও ওস্তাদের সাথে দেখা হয়ে গেলে তখনই কৌশল শেখা শুরু করে দিতেন। তাঁর ধারণা ছিল, দলবদ্ধ লাঠিয়ালদের সাথে নিয়ে একদিন তিনি ইংরেজদের সাথে সংগ্রাম করবেন।
রূপকথার এই ডাক্তারের সাথে পরিচয় হলো এক জনদরদীর। এই জনদরদীর কান্ড আর একদিন বলবো। আজ শুধু ডাক্তারের কথা বলি।

এমন ডাক্তারের সাথে জনদরদীর যোগসূত্র- এ যেন, একে তো নাচুনে বুড়ি, তার উপর ঢোলের বাড়ি। জনদরদীর কাছে খবর এলো পদ্মার চরে এক বৃদ্ধা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন। হাট-বাজার থেকে নানা পদের আচার কিনে পাড়ার বৌঝিদের কাছে বিক্রি করে বেড়াতে গিয়ে এ-বাড়ি ও-বাড়ি খেয়ে বৃদ্ধার দিন চলতো। খবর পেয়ে ছুটলেন দু’জনে। দেখা গেলো, ষাঁড়ের গুতা খেয়ে বৃদ্ধার শরীরে ঘা হয়েছে।

ঘায়ে পঁচন ধরেছে। দূর্গন্ধে ধারে কাছে যাওয়ার উপায় নেই। মাছি ঘিরে ধরেছে। শুরু হলো চিকিৎসা। গরম পানির সাথে ওষুধ মিশিয়ে ঘা সাফ করা হলো।

ইনজেকশন দেয়া হলো। ডাক্তার ইনজেকশন দেয়ার কায়দা-কানুন শিখিয়ে দিলেন সেই জনদরদীকে। বললেন, “কাল থেকে তুমি ইনজেকশন দিবে। ”
মোনা মল্লিক। গ্রামের সাধরণ চাষী।

গুরুতর অসুস্থ। খবর পেয়ে জনদরদী শহর থেকে ডেকে আনলেন ডাক্তারকে। চিকিৎসা শুরু হলো। ওষুধ কিনতে বেশ কিছু টাকা লাগবে। মোনা মল্লিকের সাধ্য নেই তা দেয়ার।

অগত্যা ডাক্তার তাঁর এক বন্ধুর কাছে চিঠি লিখে জনদরদীকে পাঠালেন। টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেল। জনদরদীকে শিখিয়ে দিলেন ডাক্তার, কিভাবে ডুস দিয়ে রোগীকে প্রতিদিন পায়খানা করাতে হবে, গরম পানিতে গা মুছে দিতে হবে, কোন্ ওষুধ গরম পানিতে মিশিয়ে রোগীর দাঁত সাফ করতে হবে।
বোবার নাকি শত্রু নেই। না থাকলে কিংবদন্তীতুল্য এই ডাক্তারের শত্রু পয়দা হবে কেন? খ্যাতির ঈর্ষায় অন্য ডাক্তারেরা তাঁর বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগলেন।

তাঁরা বলতেন, “এই ডাক্তারের বুদ্ধি কম। রোগ নির্ণয় করতে তাঁর অনেক সময় লাগে। তাই তিনি অনেকক্ষণ ধরে রোগীকে দেখেন। মাঝে মাঝে তিনি উধাও হয়ে যান। তখন তাঁকে কল দিয়ে পাওয়া যায় না।


এসব ক্রমাগত প্রচারের ফলে ডাক্তারের কল কমে গেলো, রোজগার যেটুকু ছিল, তাও প্রায় বন্ধ হয়ে গেলো। কোনও ডাক্তার যখন দূরের কোন কলে যেতে চাইতেন না, তখনই কেবল এই ডাক্তারের ডাক পড়তো। এত কিছুর পরও ডাক্তারের দানের হাত ছোট হলো না। বলতেন, “রোগী গরীব হতে পারে কিন্তু তার রোগটা তো গরীব নয়। ” গরীব ধনী বিচার না করে সকলের জন্য তিনি বেশি দামের ওষুধ লিখতেন।

যার ফলে শহরের কয়েকটি ফার্মেসীতে ডাক্তারের কয়েক হাজার টাকা দেনা হলো। নিজের ছেলের প্রাইভেট মাষ্টার টাকার অভাবে ছেড়ে দিতে হলো। বৌ’র পরনের শাড়িতে তালি পড়লো, গয়নাগুলো একে একে বিক্রি হয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু ডাক্তারের সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।
কোনও বাড়িতে গিয়ে হয়তো দেখলেন, রোগী ভিজা স্যাঁতেসঁতে মাটির মেঝেয় মাদুরের উপর পড়ে আছে।

রোগী দেখার আগে খড় চাইলেন। খড়ের পালা থেকে খড় এনে দেয়া হলো। সেই খড় পরিপাটি করে বিছিয়ে উপরে কাঁথা মেলে দিয়ে রোগী শুইয়ে দিলেন। নিউমোনিয়ার রোগী। আকনের পাতায় পুরাতন ঘি মাখিয়ে আগুনের উপর সেঁকে ডাক্তার নিজেই রোগীর বুকে সেঁক দিয়ে পদ্ধতিটি বাড়ির লোকজনদের শিখিয়ে দিলেন।


নিয়তি বড় নিষ্ঠুর। পাওনাদারদের অত্যাচারে, ডাক্তারদের সমালোচনায় ধীরে ধীরে ডাক্তার পাগল হয়ে গেলেন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে কলকাতা নেয়া হলো। একদিন জানা গেল, তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
এর বেশ কিছুদিন পর দেখা গেল, ডাক্তার-বৌ তাঁর ছেলে আর মেয়েটিকে নিয়ে ফরিদপুর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

যাচ্ছেন পায়ে হেঁটে। কারণ তখন একটি ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করারও সামর্থ্য তাঁর ছিল না।
রূপকথার এই ডাক্তারের নাম সুবোধ চন্দ্র সরকার। প্রজাপালক হিসেবে খ্যাতিমান জমিদার ঈশান চন্দ্র সরকার, যার নামে ফরিদপুর সদর উপজেলার ঈশান গোপালপুর ইউনিয়ন, তাঁর ভাতিজা এই ডাক্তার। কেউ সুবোধ ডাক্তার, কেউ পাগলা ডাক্তার বলতেন।

তখন তাঁর নিবাস ছিল ফরিদপুর। কলকাতা থেকে ডাক্তারি পাশ করার পর গোপালপুরের প্রাসাদ ছেড়ে ফরিদপুর শহরে এসে থাকতেন তিনি।
জনদরদী হচ্ছেন, আমাদের পল্লীকবি জসীম উদদীন। রূপকথার এই ডাক্তার সম্পর্কে পল্লীকবি তাঁর জীবন কথা’য় লিখেছেন-

সোর্স: http://www.sachalayatan.com

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।