আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢেউয়ের গর্জনে

রাগে, অনুরাগে, বিরক্তিতে, উত্তেজনায়, ভাললাগায়, মন্দ লাগায়, আঘাতে, আনন্দে…..প্রতিটি আবেগে এই সমুদ্র মিশে আছে রউফের জীবনে। ঢেউয়ের বিরামহীন গর্জন কখনও খুব আপন আবার কখনও প্রচন্ড বিরক্তির কারন। তবে, অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। কক্সবাজারেই জন্ম তার। শুধু এটুকুই জানে সে।

এর বেশি কিছুই জানা নেই তার। নিজের জন্ম পরিচয়টাও সঠিকভাবে বলতে পারে না সে। না পারারই কথা। এই কক্সবাজারে প্রতিদিন দেশী বিদেশী অজস্র পর্টকেরা আসছে সমুদ্র দেখতে। সেই সব পর্যটকদের মধ্যেই কেউ একজন তারা পিতা।

মায়ের স্মৃতি নেই বললেই চলে। শুধু এটুকু জানে, মায়ের নাম কুলসুম। হোটেল “সান সেট” এ কোন একসময় কাজ করতো সে। মা সম্পর্কে খুব বেশি জানার কৌতুহল নেই তার। অভিযোগও নেই।

ভুল করে জন্ম তার। ভুল এই পৃথীবিতে তার শুরুটাই হয়েছে ভুল দিয়ে। কিন্তু, বেঁচে থাকাটা একেবারে মন্দ নয়। সমুদ্র সৈকতে প্রতিদিনই নতুন আসে অনেকে। সমুদ্র দেখে তাদের যে উন্মাদনা, তা হাসির খোরাক যোগায় রউফের।

সমুদ্র দেখলেই সবাই এরকম পাগল হয়ে যায় কেন!
******

জীবন যুদ্ধের ময়দানের কোটি কোটি যোদ্ধাদের মাঝে রউফও একজন। তবে, যথেষ্ট সম্ভাবনাময় যোদ্ধাই বলতে হবে। এই কঠিন প্রতিযোগীতার মাঝে দিব্যি একটা ব্যবসা জুটিয়ে নিয়েছে সে। ব্যবসাটা একেবারে মন্দ না। সমুদ্র তীরে রৌদ্রস্নান করার জন্য যে সিটগুলো থাকে সেগুলোর একটা আছে তার দ্বায়িত্বে।

ঘন্টা চুক্তিতে ভাড়া দেয় সে। কত মানুষ এসে সেখানে বসে। শুয়ে থাকে। সমুদ্র দেখে মুগ্ধ হয়।
একটু একটু করে বড় হচ্ছে রউফ।

এখন অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে সে। মানুষের হাসি মুখ কিংবা ধমক, কোনকিছুতেই গলে যায় না সে। সিট ভাড়া প্রতি ঘন্টা ৩০ টাকা। এর এক পয়সাও কম না। এই ইনকাম রউফের জন্য যথেষ্ট বললে ভুল হবে।

একেবারেই চলে না। তবে, চালিয়ে নেয়।
*****
কিশোর বয়সটা খুব অদ্ভুত। রবিঠাকুর বলেছিলেন, “তেরো চৌদ্দ বছরের ছেলেদের মত বালাই আর নাই” তবে রউফের কাছে পুরো দুনিয়াটাকেই একটা বালাই মনে হচ্ছে। প্রতিদিন সুমদ্রের জলে নেমে যুবক যুবতীতের এই রঙ ঢং আর সহ্য হয় না।

সমুদ্রের জলে নেমে দাঁত মুখ কেলিয়ে ছবি তুলা দেখলে ওর থাবরাতে মন চায়। কেনই বা চাইবে না? গত বছর যে ছেলেকে এক মেয়ের সাথে দেখা গেলো, পরের বছরই সেই ছেলেকে দেখছে আরেক মেয়ের সাথে। কয়েক দিনের মাঝেই, ঐ একই ছেলে আরেক মেয়ের সাথে। বিরক্তিতে মন প্রান ছেয়ে যায় ওর। তবুও, মুখে একটা হাসি ঝুলিয়ে না রেখে উপায় নেই।

কারন, এটা তার ব্যবসা। খরিদদারকে হাসিমুখে বলতে হবে, “স্যর, আসেন। ম্যাডাম আসেন। বসেন...বসেন” এমনভাবে বলতে হবে যেন, কতদিন পর বাড়িতে কোন মেহমান আসলো!
****
তখন আমি ভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। আমাদের অ্যানুয়েল ট্যুর উপলক্ষে ক্লাসের সবাই মিলে এসেছিলাম কক্সবাজারে।

বিকাল বেলা সমুদ্র সৈকতে আমি আর রতন হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম। একটা ছেলে এসে বললো, “স্যার, বসেন...” আমি তাকালাম ছেলেটার দিকে। চেহারার মাঝে কি যেন একটা আছে। “মায়া”? নাহ, মায়া বললে ভুল হবে। যা আছে, তা বোঝার মত জ্ঞান হয়তো আমার নেই।

ছেলেটাকে দেখে ভাল লাগলো আমার। আমি হেসে বললাম, “না ভাই। বসবো না। আমরা ঘুরে দেখবো। ” ঠিক এরকম সময়, কোথা থেকে একটা মেয়ে এসে বল উঠলো, “চা খাবেন?? কফি খাবেন??” আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম।

চোখে মুখে নিষ্পাপ ভাব যেমন, কন্ঠে পেশাদারিত্বটাও যেন বেশি। তার পেশাটাই এরকম। রউফকে অনেক হাসি খরচ করতে হয় খরিদদারকে পটানোর জন্য। মেয়েটার কোন দরকার নেই এসবের। সমুদ্র তীরে এক কাপ কফির প্রয়জনীয়তা বোঝানোর জন্য খুব বেশি কথা বা হাসি খরচ করার দরকার আসলেই নেই।

আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে অনেক তাড়া ওর। কারনটা অবশ্য বেশ বুঝতে পারলাম আশেপাশে তাকানো মাত্রই। আমাদের ঠিক পাশেই ছিল সদ্য বিবাহিত এক দম্পতি। মেয়েটা পরেছে শাড়ি আর ছেলেটা পাঞ্জাবি।

সমুদ্রতীরে এরা কফি খাবে নাতো কি আমি খাব? আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম আরেকবার। বললাম, “তুমি এক কাজ করো। ঐ, ওদের কাছে আগে যাও। বিক্রি করে আসো। তারপর আমাদের কাছে আসো।

আমরা তোমার কাছেই খাবো। ” মেয়েটা, একটু হেসে আবার মুখ শক্ত করে বললো, “আচ্ছা, যাই। কিন্তু, অন্য কারোর কাছে খাবেন না কিন্তু”... কথাটা মাথায় থাকলো আমার। সমুদ্র দেখতে লাগলাম আমরা। আমি আগেও দেখেছি।

তাই উন্মাদনাটা হয়তো আমার একটু কম। তারপরও সমুদের বিরামহীন গর্জন শুনলে মন অন্যরকম হবেই। সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে আসা মানুষগুলোর সমস্ত আবেগ, অনুভূতি যেন মিলে মিশে হারিয়ে যায় এই গর্জনের কাছে। সমুদ্র যে দেখেনি, সে সত্যিই অনেক বড় কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছে এই জীবনে।
আমি আর রতন কথা বলতে বলতে হাঁটছিলাম।

আমাদের হাঁটা দেখে, ছেলেটা হঠাত আমদের সামনে এসে দাড়ালো। আমি বেশ অবাক হলাম। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম ওর দিকে। ছেলেটা বলে উঠলো, “আপনারা কফি খাবেন না?” বলে মেয়েটার দিকে তাকালো। মেয়েটা আরেক কাস্টমারের কাছে কফি বিক্রি করছে।

আমি হেসে ফেললাম। বললাম, “কথা যখন দিয়েছি, তখনতো খেতেই হয়। ” ছেলেটা মেয়েটাকে ডাকলো। ওদের আঞ্চলিক ভাষায় কিছু বললো। যা বললো, তার মানেটা হয়তো এরকম যে, তোর জন্য কি ইনারা সারা বেলা বসে থাকবে।

কফি নিয়ে কই ঘুরে বেড়াস! বেশ মজা লাগলো আমার ব্যপারটা দেখে। আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমার নাম কি?” ছেলেটা খুব খুশি হয়ে বললো, “রউফ”। “ও আচ্ছা। তা বাবা মা কি এখানেই থাকে?” রউফ বেশ হাসিমুখে জানালো, “না স্যার। বাবা মারা গেছে অনেক ছোট বেলায়।

আর মা এখানে থাকে না। নোয়াখালি থাকে” আমি তাকিয়ে রইলাম ছেলেটার দিকে। ছেলেটার মুখের অভিব্যক্তি অন্যরকম। আমার কাছে বেশ গড়বড় মনে হলো। আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে সাহস করলাম না।

ইতিমধ্যে মেয়েটা কফি নিয়ে আমাদের সামনে এসে হাজির। দুই কাপ গরম কফি হাতে ধরিয়েও দিলো। রউফ ততক্ষনে আমাদের সামনে আর নেই। কফি খেতে খেতে যা বুঝলাম, রউফের সাথে মেয়েটার কোন ব্যবসায়িক সম্পর্ক নাই। তাহলে, রউফ কি এই মেয়ের শুভাকাঙ্খি? বোঝা গেলো না বিষয়টা।

মেয়েটার বয়স রউফের চেয়ে অনেক কম। কি যে মাথায় চাপলো কে জানে, রউফকে আবার ডাক দিলাম কফি শেষ করে। জিজ্ঞাসা করলাম, “এই মেয়ে কে হয় তোমার?” ছেলে কিছুই বলে না প্রথমে। আমি খুব করে ধরলাম। বললাম, বলো আমাকে সমস্যা নাই।

আমি ধরেই নিয়েছিলাম, রউফ মেয়েটাকে পছন্দ করে। রউফকে মেয়েটার কথা জিজ্ঞাসা করতেই কেমন লজ্জা পেলো মনে হলো। একটা রোমান্টিক গল্পের প্লট তৈরি হচ্ছে, এটুকু নিশ্চিত। কিন্তু, আমাকে চমকে দিয়ে রউফ বললো, “আমার মায়ের নাম কুলসুম। এই মেয়ের মা আর আমার মা একই মানুষ।

আমার বাপকে আমি চিনি না। এই মেয়েও চেনে না। তবে, বাপ একই না, এটুকু শিউর। এই মেয়ের বুদ্ধিসুদ্ধি কিছুই নাই মাথায়। কিছুই বোঝে না।

বুঝাইলেও বোঝে না। তাই আর কিছু বুঝাই না। আর হ্যা, আমি লাইক করি তারে। এইসব জানার অনেক আগে থেকেই লাইক করি। এখন সব জানলাম।

হিসেবেতো সে আমার বোন হয়। তাইতে কি আসে যায়? আমাদের আবার সম্পর্ক! আমার মা যে, নোয়াখালী থাকে সেইটা আমি খোজ নিয়া জানছি। তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই। আপনিই কন স্যার, এই মেয়েরে যদি আমি বিয়া করতে চাই, সেইটা কি দোষের?” আমি থমকে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। মেয়েটার দিকেও তাকালাম।

মনে অনেক কল্পনার জন্ম হলো। রউফ আর এই মেয়েটা মিলে জমিয়ে একটা কল্পনা করছিলাম এতক্ষন। ওরা দুই জন বেশ জমিয়ে সংসার করছে, এরকমই দেখছিলাম। কিন্তু, কল্পনায় ছেদ পরলো। ওদের ভবিষ্যতটা যে কেমন হবে, কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।

মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করতে লাগলো।
*******
বেশ কয়েক বছর পর আবার আসলাম কক্সবাজার। রউফের কথা আমার বেশ ভাল মনে আছে। মেয়েটার কথাও মনে আছে। মেয়েটার নাম শোনা হয়নি আগেরবার।

এবার আর এই ভুল করা যাবে না। মজার ব্যপার, সমুদ্র সৈকতে যাওয়া মাত্র সেই মেয়েটা আমাদের সামনে এসে হাজির! খুব সুন্দর করে একটা হাসি দিয়ে বললো, “কফি খাবেন?” মেয়েটার হাসি দেখে আমার মাথাটা কেমন যেন গুলিয়ে গেলো। এই মেয়ে হাসে কেন? সে কি আমাকে চিনতে পেরেছে? মেয়েটার চেহারা আমার কাছে অদ্ভুত মনে হলো। কড়া করে লিপস্টিক দিয়েছে। মাথায় ফিতাও বাঁধা।

এত সাজুগুজু করে কেউ কফি বিক্রি করে? হঠাত দেখতে পেলাম রউফকে। আমি তাকালাম তার দিকে। রউফ আমার কাছে এসে আস্তে করে বললো, “কোন হোটেলে উঠছেন স্যার?” আমি বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, “হোটেল সান সেট। কেন?”
রউফ রহস্যের হাসি হেসে বললো, “কিছু না স্যার। একাইতো আইছেন।

বেশি একা লাগলে কয়েন। আমি ব্যবস্থা করে দিমুনে” বলে সে সেই মেয়েটার দিকে তাকালো। আমিও অবাক হয়ে তাকালাম। হাসলো মেয়েটা। অদ্ভুত সেই হাসি।

সমুদ্র সৈকতে শত হাসির মাঝে একেবারেই অন্যরকম সেই হাসি। এই হাসিতে যৌনাকাঙ্খা আছে। আছে বেঁচে থাকার প্রেরনা। এই হাসি কি বেঁচে থাকার সুখের হাসি? রউফও হাসছে। মৃদু হাসি।

তারপরও, হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে কিছুটা। তবে, সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনে আর সবকিছুর মত হারিয়ে গেলো এই শব্দটুকুও......।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.