আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হেরে গেলাম আজ !





লাঞ্চ টাইম। আজ আর বাসায় যাওয়া হয়নি। খুব কাছের এক কলিগ বললেন, চলো আজ তোমাকে গোলপাতায় খাওয়াই।
গোলপাতা হোটেলটি এই শহরের নামকরা একটি রেঁস্তোরা। একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে।

খাওয়াশেষে কলিগের অন্যত্র একটা গ্রোগ্রাম থাকায় তিনি বিদায় নিলেন। একটি রিকশা নিয়ে শাওন অফিসের দিকে...
লাঞ্চ টাইম শেষ হওয়ার আগেই পৌঁছা যায় অফিসে। অনেকেই আসেনি। তবে, অফিসে তার নতুন কলিগ নীলাঞ্জনা নীলু ছিল। ও সাধারণত বাইরের খাবার খায় না।

বাসা থেকেই খাবার আনে। শাওনকে দু’একবার বলেছে খেতে। কিন্তু সামান্য দুটো রুটি, ভাজি কিংবা মুরগির মাংস-একজনেরই ভালভাবে হয় না-আবার তাতে ভাগ! এড়িয়ে যায় সে।
দু’মাস হল নীলু নতুন একটি প্রজেক্টে জয়েন করেছে। মাঝেমধ্যে কথা হয়, তবে তা নিতান্ত অফিসিয়ালই।

শাওন লক্ষ্য করে মেয়েটি খুবই শান্ত এবং নির্ঝঞ্ঝাট টাইপের। কোনরকম হৈ হুল্লোড়ে তাকে মাততে দেখেনি কেউই। তা সে অফিসের আড্ডাবাজ রকিবও যদি আসে তবুও।
আজ শাওনের মনটা ফুরফুরে। দুপুরে খাওয়ার পর একখান পানও মুখে দিয়েছে।

নীলুর টেবিলের পাশ দিয়ে যাবার সময় আজ একটু হাই হ্যালোও করে।
কী খাবার এনেছেন আজ? চোখের ঝিলিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়।
রুটি, মুরগির মাংস আর মিষ্টি। খাবেন একটা মিষ্টি?
মিষ্টি! তা খাওয়া যায় একটা
তারপর দুপুরে কোথায় খেয়েছে, তাদের রান্না কেমন ইত্যাদির একটা সুন্দর উপস্থাপনা করে। কথায় কথায় নীলুকে একটা প্রশ্ন করার অনুমতিও নিয়ে নেয়।

আচ্ছা, আপনি সারাক্ষণ এমন মনমরা হয়ে বসে থাকেন কেন?
কোথায় মনমরা হয়ে থাকি? পাল্টা প্রশ্ন নীলুর। এই তো কাজ করছি, দুপুরে খাবার খেলাম আপনার সাথে গল্প করছি...
নাহ্ ... আমার কেন যেন মনে হয়। আসলে, আপনি বলতে না চাইলে থাক...
আড়চোখে দেখে নেয় সে।
মাথা নিচু করে কী যেন ভাবতে থাকে নীলু। আবারও আনমনা হয়ে যায়।

ততক্ষণে অন্য কলিগরা এসে গেছে। শাওন ফিরে যায় তার ডেস্কে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে পরেরদিনের একটা ট্রেনিঙের কাজে। অনেক কাজ তার।
পরদিন খুবসকালে আসতে হয় শাওনের।

জেলার বাইরে একটি উপজেলা শহরে ভোটার উদ্বুদ্ধকরণে সামাজিক নেতৃবৃন্দের সাথে কর্মশালা। অনেক লজিস্টিক লাগে। গতদিন সবকিছু রেডি রেখেছিল। তারপরও চেক করে নিচ্ছে।
ভাই এসেছে? প্রশ্ন শুনে তাকায় শাওন।

চোখে জিজ্ঞাসা। ভেদ ভাঙে নীলু। আপনার সাথে গিয়ে ট্রেনিঙের স্টাইলটা দেখতে বলেছেন ইডি।
ও! শিউর!! আপনি থাকলে ভালই লাগবে আমার। কথাটা বলে আবার তাকায় নীলুর মুখের দিকে।

না মানে, আপনার সহযোগিতা পাওয়া যাবে-তাই বলতে চাইছিলাম।
ড্রাইভার এসে ডাক দিতেই তড়িঘড়ি শুরু হয়। অফিসের কেয়ারটেকার মালামালগুলো গাড়িতে তুলে দেয়।
পাশাপাশি বসে শাওন, নীলু। কী বলবে-ভাবে শাওন
তারপর হঠাৎ করেই বলে, জার্নিটা কিন্তু আমার খারাপ লাগে না।

বাইরের কত মানুষের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। মানুষের কতরকম ধরন দেখা যায়...
ভাইয়া কাল আপনি একটা প্রশ্ন করেছিলেন
জি, কেন মনমরা হয়ে থাকেন?
আপনাকে সময় করে একদিন বলবো সব। আমি কাল রাতে ভেবেছি, কথাটি আপনাকেই বলা যায়।
রাস্তার পাশে একটা টিশপের সামনে দাড়ায় গাড়িটা। সবাই নেমে চা খায়।

তারপর আবার শুরু গন্তব্যে...
নীলুর কথা শুনে আবেগে কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে যায় শাওনের। তার ভাবতে অবাক লাগে, একজন মানুষ এত কষ্ট বুকে নিয়ে কীভাবে পারে?
খুব ছোট থাকতে নীলুর মা চলে আসেন স্বামী সংসার ছেড়ে। দু’ভাইবোনের মধ্যে ভাই বড়। এরপর মামাদের সাথে কত ঝড়-ঝাপ্টা সয়ে মা তাদের মানুষ করেছেন। ভাই একজন প্রকৌশলী।

ভাল একটা জব করেন। আর বাড়িতে সময় কাটে না বলেই তার এনজিওতে ঢোকা। অনেকেই নিষেধ করেছিল। কিন্তু, মা তাকে এই চাকরিটা করতে বলেন। নিজ শহরে, বাসায় থেকে এমন একটা জব-তারও পছন্দ।


বাবা আরেকটা বিয়ে করেন। সেইঘরেও দু ছেলেমেয়ে। মা চলে আসার পর কখনো বাবা খোঁজ নেননি তাদের। তারা কেমন আছে, কীভাবে চলে সংসার, কিছুই না। সেকারণে বাবা নামক শব্দে তার ব্যাপক বিদ্বেষ।

এই শব্দটাকে সে মোটেও সহ্য করতে পারে না। এভাবেই চলছিল তাদের দিন। আস্তে আস্তে এসএসসি পাশ। ভর্তি হয় কলেজে। তার ভাইয়ার বন্ধু আরিফের যাতায়াত ছিল বাসায়।

মা তাকে নিজসন্তান জ্ঞান করতেন। আরিফ তাকে খুবই ভালবাসতো। কত ঘুরেছে একসাথে। কখনো খুলনা, কখনো ঝিনাইদহ। নীলু প্রেমে পড়ে তার।

অনেক স্বপ্ন দেখতো দুজন। স্বপ্ন দেখাতে পারতো তাকে আরিফ। কথা ছিল, বৃটেন থেকে ডিগ্রিটা নেবারপর বিয়ে করবে। মা-ভাইয়া দুজনই রাজি ছিলেন। বলা চলে, তাদের সম্মতিতে সম্পর্ক অনেকখানি গড়ায়।

এক ডিসেম্বরে তার দেশে ফিরে বিয়ে করার কথা। বৃটেনে থাকতে ফোনে কথা হতো নিয়মিত।
কিন্তু বিধিবাম! ডিসেম্বরে দেশে ফিরে বিয়ে করে আরিফ। বিষয়টি গোপন রেখে আবার চলে যায়। এরমধ্যে আর কথা হয়নি প্রায় দু’মাস।

অনেক চেষ্টা করে নীলু, পারেনি। একসময় নীলু জানতে পারে, মায়ের কথা অনুযায়ী বাধ্য হয়েই আরিফকে বিয়েটা করতে হয়েছে। মাকে ব্যথা দিতে পারেনি সে। নীলু যেন তাকে ক্ষমা করে দেয়।
কথাগুলো যখন নীলু বলছিল, দু’চোখ বেয়ে তার কান্নার জল তীব্র বেগে ছুটছিল।

বিষাদে মন ভরে যায় শাওনের।
সেইদিনই সে শপথ করে, মেয়েটাকে হাসি-খুশি প্রাণোচ্ছ্বল করতে যা যা দরকার তা সে করবে। এরপর কারণে-অকারণে নীলুর সাথে যেচে কথা বলা শুরু শাওনের। তাকে অফিসিয়াল কাজে সহযোগিতা করে। ছোটখাট কেনাকাটাতও সঙ্গী হয় তার।


এক ছুটির বিকেলে ভয়ে ভয়ে নীলুকে শহরের একটা নিরিবিলি জায়গায় যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। রাজি হয় নীলু। দুজনে একটা রিকশা নিয়ে চলে যায় শহর থেকে দূরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেভরা ছায়ামাখা নিবিড়বনে। কখন যে সময় বয়ে যায়। দুজনের অনেক কথা বিনিময় হয়।

ফেরারপথে সাহস করেই জিজ্ঞেস করে শাওন, নীলু হাতটা কি ধরবো?
ধরেন
ইতস্তত করতে করতে ধরে ফেলে তার হাতখানি। বেশ সাহসী দেখায় তাকে, বলে- আজ থেকে আমরা বন্ধু হলাম! আমাদের দুজনের সব কষ্টই ভাগাভাগি করে নেব দুজন। নীলুও সম্মতি দেয়
তারপর পেরিয়ে যায় একটি মাস। একটা ট্রেনিঙে ঢাকায় যাবে নীলু। খুবসকালে তাকে বাসে উঠিয়ে দিতে আসে শাওন।

যাবার বেলায় মুখের ঘামবিন্দুখানি সযতনে টিস্যুপেপারে মুড়িয়ে নেয়।
ঢাকা যাবার পথে বহুবার কথা হয় দুজনার। মোবাইলফোনে। কখন কোথায়-সবকিছুই জানায় নীলু।
এভাবে চলতে থাকে।

একদিন কফির আমন্ত্রণে দুজন বসে। কথার ফাঁকে শাওন পকেট থেকে সেই টিস্যুখানি দেখায়। একসময় দুরু দুরু বুকে বলে ফেলে-ভালবাসি। তোমাকে খুব ভালবাসি।
কয়েক পলক নির্বাক চেয়ে থাকেন নীলু।

চোখ থেকে ঝরঝর করে পড়তে থাকে মুক্তোদানার মত অশ্রু। কোন কথা না বলেই বেরিয়ে পড়ে কফিশপ থেকে। কোন কথা হয় না। দাম মিটিয়ে বাইরে এসে তাকে আর পায় না শাওন
কয়েকবার ফোন করে। রিসিভ করে না ও প্রান্তের মানুষ।


তবে কি বড় ভুল করেছি-ভাবে শাওন। রাতে মোবাইলফোনে কল করে; সুইচড অফ...!
পরদিন অফিসে আসে না নীলু। কাউকে কিছু বলেনি; অ্যাডমিন অফিসারকে শুধোন, লা জবাব
টেনশনে দরদর করে ঘামতে থাকে শাওন। কী হলো মেয়েটার?
পরদিন সন্ধ্যায় ফোন আসে, শাওনের বহু কাক্সিক্ষত নাম্বারটি মোবাইলফোন স্ক্রিনে! উত্তেজনায় হ্যালো বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে।
ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়
হ্যালো হ্যালো করতে থাকে শাওন...
ভেজাকণ্ঠে সুদূর সমুদ্র থেকে উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ে যেন, আমি হেরে গেলাম আজ! হেরে গেলাম...
কেন বলছো হারার কথা-শাওন ব্যাকুল
ভেবেছিলাম আমাকে অমন করে ভালবাসতে পারবে না কেউ আর
শাওন চুপ করে শুনতে থাকেন
তুমি আমাকে হারিয়ে দিলে; তোমার ভালবাসার কাছে হেরেছি আমি
তবে কাঁদছো কেন?
সব কান্না বিষাদের নয়, আনন্দের অশ্রু থাকে! তুমি একটা স্বার্থপর! আর সে স্বার্থপরতায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে রাজি আমি।



এই সন্ধ্যাখানি হঠাৎ করে হাজার সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। কোথাও অন্ধকারের লেশমাত্র নেই! পৃথিবীটা এত সুন্দর-এর আগে কখনো দেখতেই পায়নি শাওন!

পাদটীকা: দুজনের কেউ আর কারো পারিবারিক নামে সম্বোধন করেন না। এখন শাওনকে জান আর নীলুকে সোনা বলে ডাকা হয়

৩০.০১.১৪

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।